Inqilab Logo

বৃহস্পতিবার, ১৮ এপ্রিল ২০২৪, ০৫ বৈশাখ ১৪৩১, ০৮ শাওয়াল ১৪৪৫ হিজরী

শিক্ষার্থীরাই বেশি ইয়াবা সেবন করে

| প্রকাশের সময় : ২৫ ডিসেম্বর, ২০১৬, ১২:০০ এএম

মোহাম্মদ আবু নোমান : চরম উদ্বেগ, উৎকণ্ঠা, পরিতাপ ও লজ্জার খবর, যা ফাঁস করেছেন মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদফতরের অতিরিক্ত পরিচালক (গোয়েন্দা) নজরুল ইসলাম শিকদার। তিনি বলেছেন, ‘শিক্ষার্থীরাই বেশি ইয়াবা সেবন করে’। গত ১৯ ডিসেম্বর রাজধানীর তেজগাঁওয়ে মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদফতরে আয়োজিত এক সংবাদ সম্মেলনে তিনি এ তথ্য জানান। কোন পথে ইয়াবা আসে সাংবাদিকদের এমন প্রশ্নের জবাবে বলেন, ‘ইয়াবা আসে মিয়ানমার হয়ে। এছাড়াও ইয়াবা আসার নতুন বড় রুট হচ্ছে ভারত’। এ সময় মাদক নিয়ন্ত্রণ অধিদফতরের ডিআইজি সৈয়দ তৌফিক উদ্দিন আহম্মেদ বলেন, ‘দেশে ভিন্ন নামে ফেনসিডিল প্রবেশ করছে। আমরা ল্যাবে পরীক্ষা করে দেখেছি আইকোনিক, কোডেক্স, কোডোকোক ও পাববোকোক এসব নাম ব্যবহার করে ফেনসিডিল দেশে আসছে’।
ইতোপূর্বের ঘটনা, ড্যান্ডি নেশায় আক্রান্ত মানিকগঞ্জের প্রাইমারি স্কুলের কোমলমতি শিশুরা। বাসস্ট্যান্ড এলাকার একটি দোকানে স্থানীয় শিশু কল্যাণ প্রাথমিক বিদ্যালয়ের দুই শিক্ষার্থীর কাছে ড্যান্ডি বিক্রির সময় পৌরসভার কান্দা পৌলী গ্রামের বাসিন্দা ব্যবসায়ী আমিনুল ইসলাম বিল্টুকে ১৬৫ পিস ড্যান্ডিসহ আটক করে মানিকগঞ্জ ডিবির স্পেশাল স্কোয়াডের সদস্যরা। এ ঘটনায় মানিকঞ্জের পুলিশ সুপার মাহফুজুর রহমান সংবাদ সম্মেলনে বলেন, আটককৃত বিল্টু শহরের বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীদের কাছে এই ড্যান্ডি বিক্রি করে থাকেন। ওই বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী সাব্বির ও সুমিকে সাংবাদিকদের সামনে হাজির করা হলে জানায়, বিল্টুর দোকান থেকে তারা ড্যান্ডি কিনে নেশা করে থাকে। দুই শিশুর মতে, মানিকগঞ্জে অনেক শিশু শিক্ষার্থী এই ড্যান্ডি নেশায় আক্রান্ত।
সার্বিক পরিস্থিতি হলোÑ ইয়াবা, ফেনসিডিল, হেরোইন, ড্যান্ডি, গাঁজা, ভায়াগ্রা ও নেশামিশ্রিত এনার্জি ড্রিংক্সে ভাসছে গোটা দেশ। ইয়াবার নেশায় বুঁদ অভিজাত স্কুল ও বিশ্ববিদ্যালয়ের বহু শিক্ষার্থী। মাদকসেবীদের প্রথম পছন্দে রয়েছে ইয়াবা। আইন প্রয়োগকারী সংস্থার তথ্য মতে, শুধু রাজধানীতেই ইয়াবা ব্যবসায়ীর সংখ্যা প্রায় ২০ হাজার। বেশ কয়েকটি গোয়েন্দা সংস্থার তথ্য অনুযায়ী, নগরীর প্রতিটি ওয়ার্ডে রয়েছে দুই শতাধিক ইয়াবা ব্যবসায়ী। এ ছাড়াও বহু আগে থেকেই রাজধানীর অভিজাত এলাকায় ধনাঢ্য ব্যক্তিদের বখে যাওয়া সন্তানেরা ‘ইয়াবা ক্লাব’ গঠন করেছে। ওইসব ক্লাবে দিনে-রাতে তরুণ-তরুণীরা চুর হয়ে থাকে ইয়াবা নেশার আড্ডায়।
কিশোর-কিশোরী ও যুবক-যুবতীদের সহশিক্ষার সুবাধে-অবাধ মেলামেশা, আবেগ, কৌতূহল, প্রেম, ভালোবাসায় জড়ানো এরপর ভুল বোঝাবুঝি, বিচ্ছেদ, বিরহ, ভয়, প্রতিশোধের স্পৃহা, অভিমান, অবসাদ ও হতাশায় পড়ে মাদক ধরে পরবর্তী সময়ে আর ফিরে আসতে পারছে না। আবার কেউ কেউ এর থেকে উত্তোরণের উপায়ে মন স্বাভাবিক, ফুরফুরে, আত্মবিশ্বাসী, দুশ্চিন্তামুক্ত ও কাজে মানোযোগী হওয়ার আকাক্সক্ষার ভ্রান্ত ধারণা থেকেই মাদকের হাতে খড়ি হয়।
আমাদের কিশোর ও যুব ছেলেমেয়েদের শিক্ষার নামে মর্ডানাইজেশন বা আধুনিকায়ন ও কোয়ালিটি ডেভলপমেন্টের চিন্তায় অস্থির কিছু অভিভাবক। লাগামহীন আনন্দ-বিনোদন ও দৈনন্দিন অ্যাকাডেমিক শিক্ষায় ব্যাপক উৎসাহ থাকলেও পারিবারিক বন্ধন, ব্যক্তিজীবনে শৃঙ্খলা, শিষ্টাচার, দেশপ্রেম, ধর্মীয় অনুশীলন ও নীতি নৈতিকতার কোনো বালাই নেই। বেশ কয়েক দফায় আইন প্রয়োগকারী সংস্থার হাতে ইয়াবা ব্যবসার সঙ্গে জড়িত থাকায় বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র গ্রেফতার হয়েছে। রাজধানীর অভিজাত ইংলিশ মিডিয়াম স্কুল ও বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা ইয়াবা ব্যবসায়ীদের টার্গেটে পরিণত হচ্ছে। নিজের অজান্তেই অনেকে ইয়াবার নেশায় বুঁদ হয়ে আছে। অনেকে জড়িয়েও পড়ছে জীবনবিধ্বংসী মাদকের ব্যবসায়। পড়ালেখা ছেড়ে আবার অনেকে কাজ করে ইয়াবার ক্যারিয়ার হিসেবে।
ইতোপূর্বে পুলিশের বিশেষ শাখার (এসবি) পরিদর্শক মাহফুজুর রহমান ও তার স্ত্রী স্বপ্না তাদেরই মেয়ে ঐশীর হাতে নৃশংসভাবে খুন হন। ঐশী ধানমন্ডির অক্সফোর্ড ইন্টারন্যাশনাল স্কুলের ওলেভেলের ছাত্রী ছিল। এ স্কুলটির ছাত্রছাত্রীদের বড় একটি অংশ ইয়াবাসহ নানা ধরনের মাদকে আসক্ত বলে অভিযোগ ছিল দীর্ঘদিন থেকেই। ঐশীর শিক্ষাজীবন শুরু হয়েছিল মতিঝিল আইডিয়াল স্কুলে। সেখানকার নিয়ন্ত্রিত জীবনযাপন তার ভালো লাগেনি। বায়না ধরে ইংলিশ মিডিয়াম স্কুলে ভর্তির। বাবা-মায়ের আদরের মেয়ে তাই সাধ্য, সামর্থ্য, নৈতিকতা শিক্ষার কোন চিন্তা না করে ঐশীকে ধানমন্ডির অক্সফোর্ড স্কুলে ভর্তি করে দেন বাবা-মা। শুধু প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষাই সব নয়। নৈতিক, ধর্মীয় ও সামাজিক শিক্ষাটাও দরকার। আর এই সামাজিক শিক্ষাটা সন্তানরা পায় পরিবার তথা বাবা-মায়ের কাছেই। এর প্রথম গাঁথুনিটা পরিবার থেকেই পায় সন্তানরা। আর যদি কেউ এই শিক্ষা দিতে ব্যর্থ হন, তাহলে তার সন্তান অকালেই ঝরে যেতে পারে। তেমনি তার হাতে নিজেও ঝরে যেতে পারেন। ঐশীর ব্যবহৃত মোবাইল ফোন কেড়ে নেয়া, বন্ধু মহলের সঙ্গে যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন করাসহ কোন পরিবারে হঠাৎ করে ছেলেমেয়ের উপর এমন খবরদারি বা শাসন নেমে এলে দুর্ঘটনা কিছু ঘটবেই। আর সেই ছেলেমেয়ে যদি হয় মাদকাসক্ত কিংবা বখে যাওয়া, তাহলে তো কথাই নেই। তাদের কাছে, কীসের আবার বাবা-মা? অভিভাবক হয়ে যায় তখন শত্রু।
অক্সফোর্ডে ভর্তি হয়েই পাল্টে যায় কিশোরী ঐশী। বেপরোয়া জীবনযাপন, অনিয়ন্ত্রিত প্রেম ও ইয়াবার মত জঘন্য মাদক সেবনে ডুবে যায় সে। এতে বাধা দেয় বাবা-মা। মাসে দেড় লাখ টাকার অধিক ছিল ঐশীর হাত খরচ। তাহলে পরিবারটি চলতো কত খরচে? চামেলীবাগের বিলাসবহুল ফ্ল্যাটে ভাড়াই জুটতো কিভাবে? একজন সাধারণ এসআই পুলিশের যদি এতো বিশাল পরিমাণ মাসিক অবৈধ অর্থের পার্মানেন্ট সোর্স থাকে, তাহলে তার উপরের যারা হর্তাকর্তা আছেন, তাদেরকেও তো নিশ্চয় ভাগ দিয়েই চলতে হয়। নাকি কেউ কিছু টেরই পায় না? একথা ঠিক যে সবাই দুর্নীতিবাজ না। ঐশীর বাপের মত এসআই এখনও থাকতে পারে। আর এদের কর্মকা- তাদের উপরের অফিসারদের প্রশ্রয় ছাড়া সম্ভব নয়।
অবৈধ উপায়ে অর্থ উপার্জন, বেহিসেবী জীবনযাপন কখনোই ভালো কিছু বয়ে আনতে পারে না, এই পরিবারটিই তার সবচেয়ে বড় উদাহরণ। অধিক ছাড়াছাড়ি আবার অধিক নিয়ন্ত্রণ ও ধরাধরি! এরমাঝেই বড় দেরি করে ফেলে বাবা-মা। আর তাতেই ক্ষেপে যায় ঐশী। ভাবতে শুরু করে নিজের পিতা-মাতাকে হত্যার কথা। কিন্তু এই হত্যার দায় কী ঐশীর একার? ঐশীর শাস্তি দিয়ে এ বিষয়গুলোর সুরাহা সম্ভব নয় বরং অনেক নিষ্ঠুর সত্যকেই ধামাচাপা দেয়া হবে। ঐশী তৈরির নায়কদের কী হবে? তার বাবা-মা ও এই সমাজব্যবস্থার কী কোনো দায় নেই?
বিশেষজ্ঞদের মতে, পরিবার থেকে বেশুমার হাত খরচের টাকা পাওয়া ছেলেমেয়েরাই ইয়াবা নেশায় বেশি আসক্ত হচ্ছে। ইংলিশ মিডিয়াম স্কুল ও বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা ইয়াবা ব্যবসায়ীদের টার্গেটে পরিণত হওয়ার নেপথ্য কারণ হিসেবে জানা গেছে, সাধারণত ধনাঢ্যদের সন্তানরা ইংলিশ মিডিয়াম ও বেসরকারি প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ছে। প্রাচ্যাত্যের ঢংয়ে মর্ডানাইজেশনের নামে এসব কোমলমতি ছেলেমেয়েরা বখাটে বন্ধুদের পাল্লায় পড়ে ইয়াবাসহ বিভিন্ন মাদকে আসক্ত হয়। সিগারেটের অভ্যাসের মতো করে, প্রথমে সহজলভ্য ও স্বল্পমূল্য, একপর্যায়ে চরম নেশাগ্রস্ত হয়ে যে কোনো উপায়ে ইয়াবা সেবনের জন্য টাকার জোগাড় করে আসক্তরা। যেসব শিক্ষার্থী ইতোপূর্বে সিগারেট পর্যন্ত ছুঁয়ে দেখেননি, তাদের হাতেও এখন গাঁজা। মাদকাসক্ত অনেকের আক্ষেপ, ‘আমার জীবনের বড় ভুল এটা। চেষ্টা করেও এখন বিরত থাকতে পারছি না’।
মাদক ও অপরাধ বিশেষজ্ঞদের মতে, মস্তিষ্ককে চরমভাবে উদ্দীপ্ত করে ইয়াবা। এটি সেবন করলে তাৎক্ষণিকভাবে হৃৎস্পন্দন, রক্তচাপ ও শরীরের তাপমাত্রা বেড়ে যায়। তাৎক্ষণিক মৃত্যু ঘটে মস্তিষ্কের কিছু কোষের। ইয়াবা সেবনে হৃদযন্ত্রের ক্রিয়া বন্ধ হয়ে যেতে পারে হার্ট দুর্বল ব্যক্তিদের। বিশেষজ্ঞরা আরো বলেন, ইয়াবা সেবনে উচ্চ রক্তচাপ ও হৃদরোগ বৃদ্ধি, হজমশক্তি নষ্ট হওয়া ও শরীর দুর্বল হয়ে পড়া, পিঠে ব্যথা, ফুসফুস ও কিডনি নষ্ট, স্বাস্থ্যহানি হওয়ার আশঙ্কা থাকে। উদ্ভব হতে পারে হতাশা, বিষাদ, ভয়, অনিশ্চয়তার। এছাড়া এটি সহিংস করে তুলতে পারে আচরণগতভাবে। মাদক খেলে কিডনি, লিভার নষ্টসহ শারীরিক প্রতিবন্ধী হয়ে যেতে পারে।
সমাজবিজ্ঞানীরা স্কুল-কলেজের শিক্ষার্থীদের নেশায় আসক্ত হয়ে পড়ার জন্য অনেকটা দায়ী করেন পরিবার ও সামাজিক পরিস্থিতিকে। তারা বলেন, আধুনিকতার নামে একটা টিনেজ ছেলেমেয়েকে অধিক স্বাধীনতা সন্তানের কি চরম সর্বনাশ নয়? এ থেকে আমাদের বাবা-মাও কি কোন শিক্ষা নেয়? সন্তানরা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে যাচ্ছে কিনা এ বিষয়ে খোঁজখবর বাড়াতে হবে বাবা-মাকে। মাদকাসক্তের সংখ্যা বৃদ্ধির অন্যতম কারণ হিসেবে প্রশাসনের নজরদারির অভাব বলে মনে করা হয়। এজন্য দায়ী করা হয় মাদকের সহজলভ্যতাকেও। আগে শিক্ষকরা ক্লাসের বাইরে গিয়েও অনেক দায়িত্ব পালন করতেন। এখন আর তা লক্ষ্য করা যায় না। এ সমস্যা থেকে উত্তরণে দরকার ধর্মীয় অনুশীলন ও পারিবারিক বন্ধন আরও জোরদার করা। সন্তানরা যদি বাবা-মায়ের কাছে কোনো কিছু শেয়ার করতে না পারে তাহলে তারা ঝুঁকে পড়ে বাইরের দিকে।
[email protected]



 

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

আরও পড়ুন