Inqilab Logo

বৃহস্পতিবার, ০৯ মে ২০২৪, ২৬ বৈশাখ ১৪৩১, ২৯ শাওয়াল ১৪৪৫ হিজরী

অর্থনৈতিক সঙ্কট যত না বৈশ্বিক তার চেয়ে বেশি অভ্যন্তরীণ -পরিকল্পনা প্রতিমন্ত্রী

সানেমের অর্থনীতিবিদ সম্মেলন কাগজে সই করলেই কি খেলাপি ঋণ কমে যাবে : ওয়াহিদউদ্দিন মাহমুদ

অর্থনৈতিক রিপোর্টার : | প্রকাশের সময় : ৫ ফেব্রুয়ারি, ২০২৩, ১২:০০ এএম

পরিকল্পনা প্রতিমন্ত্রী শামসুল আলম বলেছেন, গত কয়েক মাস ধরে অর্থনীতির যে চাপ, তার নেপথ্যে বৈশ্বিক পরিস্থিতির চেয়ে অভ্যন্তরীণ দায়ই বেশি দেখছেন। অবশ্য সরকারের পক্ষ থেকে বারবার এই পরিস্থিতির জন্য রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে পরিবর্তিত বিশ্ব পরিস্থিতিতে দায়ী করা হচ্ছে। এই প্রথম অন্য একটি ব্যাখ্যা এল। যদিও এই ‘অভ্যন্তরীণ সঙ্কটের’ বিষয়ে বিস্তারিত ব্যাখ্যা দেননি তিনি। প্রতিমন্ত্রী বলেন, অর্থনৈতিক সঙ্কট যতটা না বৈশ্বিক সৃষ্টি, তার চেয়ে বেশি অভ্যন্তরীণ। আইএমএফের ঋণের প্রথম কিস্তি জমা পড়ার দু’দিন পর গতকাল ঢাকায় মহাখালী ব্র্যাক সেন্টারে বেসরকারি গবেষণা সংস্থা সাউথ এশিয়ান ইকোনমিক মডেলিংয়ের (সানেম) ষষ্ঠ বার্ষিক অর্থনীতিবিদ সম্মেলনে প্রধান অতিথির বক্তব্যে তিনি এ কথা বলেন। দুই দিনব্যাপী এ সম্মেলন আজ রোববার শেষ হবে এবং এ সম্মেলনে অর্থনীতি ও বাণিজ্য নিয়ে প্রবন্ধ উপস্থাপন করবেন দেশ-বিদেশের অর্থনীতিবিদেরা। বিশ্বের অন্যান্য অনেক দেশের মতো গত একটি বছর কঠিন যাচ্ছে বাংলাদেশের জন্যও। বিশ্ববাজারে পণ্য ও জ্বালানির মূল্য বৃদ্ধি, ডলারের বিপরীতে টাকার মান পড়ে যাওয়ার কারণে মূল্যতে আরও বেশি প্রভাব, ডলার সঙ্কট, রিজার্ভের ক্রমাগত পতন, প্রবাসী আয়ে ভাটা, ইত্যাদির কারণে গত এক যুগের মধ্যে অর্থনীতি নিয়ে সবচেয়ে বেশি উৎকণ্ঠার কথা বলছেন বিশেষজ্ঞরা।

রাজনীতি ব্যবসায়ীদের হাতে চলে গেছে বলে যে সমালোচনা করা হয়, সেটি নিয়েও বক্তব্য রাখেন পরিকল্পনা প্রতিমন্ত্রী। তিনি বলেন, দেশের রাজনীতি রাজনীতিবিদদের হাতেই আছে, তবে সংসদে অনেক সদস্যই ব্যবসায়ী। তিনি শিক্ষা খাতে সরকারি ব্যয় মোট দেশজ উৎপাদনের (জিডিপি) ২ শতাংশের বেশি উল্লেখ করে বেসরকারি খাতে শিক্ষাব্যবস্থার বিকাশে সন্তোষ প্রকাশ করেন।

অর্থনৈতিক এই সঙ্কট থেকে বের হয়ে আসতে আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল বা আইএমএফ থেকে সরকার যে ঋণ নিচ্ছে, সেটি দেশের জন্য ইতিবাচক হবে বলেও মনে করেন প্রতিমন্ত্রী। তিনি বলেন, আইএমএফ আমাদের আর্থিক খাতে যেসব সংস্কার প্রস্তাব করেছে সেগুলো যৌক্তিক। তাদের (আইএমএফ) পরামর্শে আর্থিক খাতে ধারাবাহিক সংস্কার করা হচ্ছে। এসব প্রস্তাব আমরা ইতিবাচকভাবে নেওয়ায় এখন অন্যান্য দাতা সংস্থাও ইন্টারেস্ট দেখাচ্ছে।

গত ৩১ জানুয়ারি বাংলাদেশের জন্য ৪৭০ কোটি ডলার ঋণ অনুমোদনের বিষয়টি বিজ্ঞপ্তিতে জানায় আইএমএফ। দুই দিন পরেই প্রথম কিস্তির ৪৭ কোটি ৬২ লাখ ডলার জমা পড়ে বাংলাদেশ ব্যাংকের অ্যাকাউন্টে। এই ঋণ নিতে সংস্থাটির ৩০টি শর্ত মানতে হয়েছে বাংলাদেশকে। এর অন্যতম হলো বিদ্যুৎ ও জ্বালানিতে ভর্তুকি কমানো। এক মাসের মধ্যে দুইবার বিদ্যুতের দাম বাড়ানো, আবাসিক ও পরিবহন ছাড়া অন্য খাতের গ্যাসের দাম আড়াই গুণ করে দেয়ার পেছনে এই শর্তই দায়ী বলে মনে করেন অর্থনীতিবিদরা। বিশেষ করে শিল্প আর বিদ্যুতের গ্যাসের দর বাড়লে পণ্যমূল্য আরও বাড়বে বলে আশঙ্কার কথাও বলাবলি হচ্ছে। তবে আইএমএফ মনে করে, ভর্তুকি কমিয়ে দাম বাড়ানোর পদক্ষেপ বাংলাদেশের জন্য সামনের সামগ্রিকভাবে ইতিবাচক হবে। এটি সামাজিক ও উন্নয়ন ব্যয়ের জন্য আরও অর্থায়নের সুযোগ তৈরি করবে।

আইএমএফের অন্য শর্তের মধ্যে আছে ব্যাংক খাতে খেলাপি ঋণ কমানো। সরকারি ব্যাংকে খেলাপি ঋণ সর্বোচ্চ ১০ শতাংশ এবং বেসরকারি ব্যাংকে ৫ শতাংশে নামিয়ে আনার ক্ষেত্রেও সরকার একমত পোষণ করেছে। বৈশ্বিক সঙ্কটে দেশের অর্থনীতিতে যে চ্যালেঞ্জ তৈরি হচ্ছে তা মোকাবেলা ও উত্তরণের উপায় নিয়েই সানেমের এবারের সম্মেলনে আলোচনা করেন বক্তারা।

প্রথম সেশনে সানেমের নির্বাহী পরিচালক অধ্যাপক সেলিম রায়হান বলেন, আইএমএফের ৪৭০ কোটি টাকা ঋণ রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত না, বরং টার্নিং পয়েন্ট। এই ঋণ পাওয়ার ফলে এখন অন্যান্য দাতা সংস্থা বাংলাদেশের ব্যাপারে আস্থা পাবে। তাদের কাছে স্বল্প সুদে ঋণ পাওয়া সহজ হবে। দেশের অর্থনীতি ঠিক করতে চারটি বিষয়ের উপর জোর দিতে বলেন অর্থনীতিবিদ অধ্যাপক রেহমান সোবহান। তিনি বলেন, সামষ্টিক অর্থনীতিতে যেসব আঘাত এসেছে সেগুলোর কোনটিতে প্রাধান্য দেয়া উচিত, তা খোঁজে বের করতে হবে। এ বিষয়ে সরকার ও প্রতিষ্ঠানগুলো কীভাবে কাজ করবে এবং আঞ্চলিক অর্থনৈতিক পরিম-লে এসব আঘাতের প্রভাব কেমন, তার উপর জোর দিতে হবে।

অর্থনীতিবিদ ওয়াহিদউদ্দিন মাহমুদ বলেন, রিজার্ভের পরিমাণ কত, সেটি বড় কথা না, এর প্রবণতাটা খেয়াল করা গুরুত্বপূর্ণ। এক-দুই বছরে এটি কত কমে যাচ্ছে তা দেখতে হবে। কমে গেলে, তা চলতে দেয়া যাবে না, একবার কমে যাওয়া শুরু করলে নিয়মনীতির মধ্যে থেকে তা সামাল দেয়া আমাদের মতো আমদানিনির্ভর দেশের জন্য কঠিন। তিনি বলেন, দেশের রিজার্ভ একসময় ৩০০ কোটি মার্কিন ডলারও ছিল। তাই বলছি, পরিমাণ অনেক সময় বড় সমস্যা নয়, প্রবণতাটাই বড় কথা। প্রতিমন্ত্রী শামসুল আলমের এই কথা প্রসঙ্গে ওয়াহিদউদ্দিন মাহমুদ বলেন, পরিকল্পনা প্রতিমন্ত্রী সজ্জন ব্যক্তি। কিন্তু শিক্ষা নিশ্চিত করতে সরকারি ব্যয়ের বিকল্প নেই, বেসরকারি খাত থাকবে পরিপূরক হিসেবে। ভারত ও নেপালে শিক্ষা খাতে সরকারি ব্যয় ৫ শতাংশের বেশি। শিক্ষা খাতে সরকারি ব্যয়ের দিক থেকে বাংলাদেশ ও শ্রীলঙ্কা এখন সমান।

সম্মেলনে পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের (পিআরআই) নির্বাহী পরিচালক আহসান এইচ মনসুর বলেছেন, ঋণ দিতে এবার আইএমএফ বেশি শর্ত দেয়নি। আহসান মনসুরের এই বক্তব্য উদ্ধৃত করে ওয়াহিদউদ্দিন মাহমুদ খেলাপি ঋণ নিয়ে বলেন, অনেক দশক ধরে দেখেছি, কাগজে সই করলেই কি খেলাপি ঋণ কমে যাবে? এটা সম্পূর্ণভাবে রাজনৈতিক ব্যাপার। ওয়াহিদউদ্দিন মাহমুদ আরও বলেন, খেলাপি ঋণ কমানোর শর্ত দেয়ার মাধ্যমে আইএমএফের আমলাতন্ত্র খুশি, আমরাও খুশি।

দুই দিনের এই সম্মেলনে দক্ষিণ এশিয়াসহ বিভিন্ন অঞ্চলের দেড়শ অর্থনীতিবিদ অংশ নিচ্ছেন। সম্মেলনে ২৩টি অধিবেশনে বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক-শিক্ষার্থীসহ অর্থনীতি-গবেষকরা ৮০টি প্রবন্ধ উপস্থাপন করবেন।



 

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

আরও পড়ুন
এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ
গত​ ৭ দিনের সর্বাধিক পঠিত সংবাদ