Inqilab Logo

শুক্রবার, ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ০৬ বৈশাখ ১৪৩১, ০৯ শাওয়াল ১৪৪৫ হিজরী

মিথ্যা ঘোষণায় রাজস্ব ফাঁকি

| প্রকাশের সময় : ২৮ ডিসেম্বর, ২০১৬, ১২:০০ এএম

চট্টগ্রাম বন্দরে সিআই শিটের বদলে চীনামাটি : আড়াই কোটি টাকার কসমেটিক্স আটক
শফিউল আলম : আমদানি বাণিজ্যে জালিয়াতি ও মিথ্যা ঘোষণায় পণ্যসামগ্রী আমদানির প্রবণতা কমছেই না। মিথ্যা ঘোষণায় পণ্য আমদানিতে ব্যাপক হারে রাজস্ব ফাঁকি দিচ্ছে অসৎ সিন্ডিকেট। সেই সাথে চট্টগ্রাম বন্দর দিয়ে মিথ্যা ঘোষণায় আনীত পণ্যের চালান আটক হচ্ছে একের পর এক। কাস্টম হাউস এবং শুল্ক গোয়েন্দা ও তদন্ত অধিদপ্তরের নজরদারি বৃদ্ধির ফলে ধরা পড়ছে অসদুপায়ে আনীত চালান। সর্বশেষ গত সোমবার চট্টগ্রাম বন্দরে সিআই শিট আমদানির ঘোষণা দিয়ে এর বদলে কন্টেইনার ভর্তি আনীত চীনামাটির চালান ধরা পড়েছে। এছাড়া আটক হয়েছে অসদুপায়ে আনীত আড়াই কোটি টাকার কসমেটিক্স।
আমদানি বাণিজ্যে বিভিন্ন ধরনের অপকৌশলে ব্যাপক গোঁজামিলের আশ্রয় নিয়ে বিদেশ থেকে এসব চালান আনা হয়ে থাকে। আমদানির ডকুমেন্টে এক পণ্যের ঘোষণা দিয়ে প্রকৃতপক্ষে আনা হচ্ছে ভিন্ন আরেক পণ্য। এতে করে শুল্ক-করের হারের ক্ষেত্রে বড় ধরনের তারতম্য ঘটছে। অসৎ ব্যবসায়ী-আমদানিকারক, সিএন্ডএফ এজেন্টদের চাতুর্য ও ধূর্ততার ফলে অনেক চালানই ধরা পড়ে না। হরেক অপকৌশলে ‘ঘাট’ পার হয়ে যায় বহু চালান। এর সাথে বন্দর-কাস্টমসের অসাধু চক্রের যোগসাজশের অভিযোগও দীর্ঘদিনের। আমদানির গোঁজামিলের কারণে রাজস্ব গচ্চা যাচ্ছে কোটি কোটি টাকা।    
আমদানি বাণিজ্যে ডকুমেন্ট জালিয়াতি ও মিথ্যা ঘোষণার মাধ্যমে পণ্যসামগ্রী আমদানি করে শুল্ক-কর নয়-ছয় করার প্রবণতা রোধ করা যাচ্ছে না। তবে আমদানি ছাড়াও অনেক সময়ই রফতানি চালানের ক্ষেত্রেও ডকুমেন্ট জালিয়াতি ও মিথ্যা ঘোষণার অপকৌশল গ্রহণ করা হয়ে থাকে। জাল, ভুয়া অথবা মিথ্যা ডকুমেন্টের মাধ্যমে শিল্পের যন্ত্রপাতি, শিল্পের কাঁচামাল, ভোগ্যপণ্য ইত্যাদি আমদানির নামে ঘোষণা বহির্ভূত অন্য কোন ধরনের মালামাল আমদানি করা হচ্ছে। এর মধ্যদিয়েই ফাঁকি দেয়া হচ্ছে বিপুল অংকের রাজস্ব।
সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন সূত্রে জানা গেছে, উচ্চহারের শুল্কায়ন যোগ্য পণ্যসামগ্রীকে কম শুল্ক হারের, নিম্নতম স্তরের এমনকি নামমাত্র বা শূন্য শুল্কহারের পণ্য হিসেবে আমদানির আনুষঙ্গিক ডকুমেন্টে ঘোষণা দেয়া হয়ে থাকে। তাছাড়া ডকুমেন্টে এক পণ্যের নামে আরেক ধরনের পণ্যের ঘোষণা দেয়া হয়। এভাবে শুল্ককর বা রাজস্বের হারে ব্যাপক তারতম্য করে বিপুল অংকের রাজস্ব ফাঁকি দেয়া হচ্ছে। গত ৭ মাসে চট্টগ্রাম বন্দরে মিথ্যা ঘোষণায় আমদানিকৃত ১২টি অবৈধ চালানের বিপরীতে কয়েক কোটি টাকার রাজস্ব ফাঁকির অপচেষ্টার ঘটনা ধরা পড়েছে। শুল্ক গোয়েন্দা ও কাস্টমস কর্তৃপক্ষ এসব ক্ষেত্রে জরিমানাসহ বাড়তি শুল্ককর আদায়ের পদক্ষেপ নিয়েছে। তবে এর বাইরেও অনেক চালান শুল্ক-কর ফাঁকি দিয়ে পার পেয়ে যায় বলে অভিযোগ রয়েছে। আমদানি বাণিজ্যে মিথ্যা ঘোষণাসহ বিভিন্ন গোঁজামিল উদ্ঘাটন করার জন্য সংশ্লিষ্ট বিভাগের পর্যাপ্ত জনবল, দক্ষতা-অভিজ্ঞতা, যান্ত্রিক ও প্রযুক্তিগত ক্ষেত্রে যথেষ্ট অভাব রয়েছে।    
বিপি শিট ঘোষণায় চীনামাটি      
এবার বিপি শিট আমদানির মিথ্যা ঘোষণা দিয়ে চট্টগ্রাম বন্দরে আনা হয়েছে ২২টি কন্টেইনার বোঝাই চীনামাটি। ক্যাপ ট্রেডিং নামে ঢাকার একটি আমদানিকারক প্রতিষ্ঠানের নামে আসা দু’টি চালানে এসব পণ্য পাওয়া গেছে। গত সোমবার বন্দরের এনসিটি ইয়ার্ডে খালাসের প্রাক্কালে বিষয়টি ধরা পড়ে বন্দর নিরাপত্তা কর্মীদের হাতে। পরে কাস্টমস কর্তৃপক্ষের কর্মকর্তারা এসে কন্টেইনারগুলো খুলে ঘোষণা বহির্ভূত পণ্য আমদানির বিষয়টি নিশ্চিত করেন।
চট্টগ্রাম কাস্টমসের অডিট ইনভেস্টিগেশন এন্ড রিসার্চ (এআইআর) শাখা সূত্র জানায়, দু’টি চালানে চীন থেকে ২২টি কন্টেইনারে ৪ লাখ ৭৩ হাজার ৪৫ কেজি বিপি শিট (সেকেন্ডারি কোয়ালিটি পেইন্টেড বার্মিজ ভার্নিস্ট অব কোটেড উইথ প্লাস্টিকলেস) আমদানির ঘোষণা দেয় ঢাকার ২২/১, ইমামগঞ্জ বাজার লেনের ক্যাপ ট্রেডিং ইন্টারন্যাশনাল। উভয় চালান চট্টগ্রাম বন্দরে এসে পৌঁছায় গত ১ ডিসেম্বর। ২১ ডিসেম্বর আমদানিকারকের পক্ষে বিল অব এন্ট্রি (বিই) দাখিল করে সংশ্লিষ্ট সিএন্ডএফ প্রতিষ্ঠান গ্লোবাল উইক সার্ভিসেস লিঃ। গত সোমবার এনসিটি ইয়ার্ডে রাখা এসব কন্টেইনার পরীক্ষা-নিরীক্ষা করতে গিয়ে প্রতিটি কন্টেইনারের মুখে বিপি শিটের মোড়ানো কয়েল পাওয়া গেলেও ভেতরের কয়েলগুলো বড় সাইজের দেখতে পাওয়া যায়। এতেই সন্দেহ হয় বন্দরের নিরাপত্তা কর্মীদের। বিষয়টি তারা শুল্ক কর্মকর্তাদের নজরে আনেন। পরে প্রতিটি কন্টেইনার খুলে শুল্ক কর্মকর্তারা দেখতে পান কন্টেইনারের মুখে রয়েছে ঘোষণা মোতাবেক বিপি শিট। কিন্তু এর ভেতরে থরে থরে রাখা কয়েলের মতো মোড়ানো শক্ত মাটির গোলাকার চাক। শুল্ক কর্মকর্তারা সেগুলো অনেকটা চীনা মাটির মতো মনে হয় বলে জানান। কর্তৃপক্ষের চোখ ফাঁকি দেয়ার জন্য কন্টেইনারের মুখে বিপি শিট রেখে ভেতরে এসব গোলাকার মাটির চাক রাখা হয়। প্রতি কন্টেইনারে ৭টি কয়েল ভর্তি ২২টি কন্টেইনার আটক করে কাস্টমস কর্তৃপক্ষ। মাটিগুলো বিপিশিটের কয়েলের মতো করে রাখা হয়।
দু’টি চালানের একটিতে ১৩টি কন্টেইনার এবং অপরটিতে ৯টি কন্টেইনার রয়েছে। ১৩ কন্টেইনারে ছিল ৯১টি কয়েল এবং ৯ কন্টেইনারে ছিল ৬০টি কয়েল। আমদানিকারক এই ২২টি কন্টেইনারে আনা পণ্যের মূল্য ঘোষণা দেয় ১ কোটি ৮৮ লাখ ৯৭ হাজার ২৮০ টাকা। মিথ্যা ঘোষণায় পণ্য আমদানি করে বৈদেশিক মুদ্রা পাচার করা হয়েছে বলে ধারণা করছেন কাস্টমস কর্মকর্তারা। আমদানিকারক মিথ্যা ঘোষণায় পণ্য আমদানি করে ১ কোটি ১৪ লাখ ৪৫ হাজার ৩৩৫ টাকা রাজস্ব ফাঁকির অপচেষ্টা করে বলে কাস্টমস সূত্র ধারণা করছে।   
এদিকে মিথ্যা ঘোষণা দিয়ে সিঙ্গাপুর থেকে আমদানিকৃত দুই কন্টেইনার কসমেটিক্স সামগ্রী আটক করে কাস্টমস গোয়েন্দা ও তদন্ত অধিদপ্তর। সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের ধারণা, আনীত চালানে আড়াই কোটি টাকার রাজস্ব ফাঁকির অপচেষ্টা করা হয়। ঢাকার মৌলভিবাজার এলাকার এ এম ট্রেডিং পার্টি স্প্রে আমদানির ঘোষণা দেয়। বিগত ২০ অক্টোবর চট্টগ্রাম বন্দর থেকে পণ্যের চালানটি খালাস নিতে আমদানিকারকের পক্ষে বিল অব এন্ট্রি দাখিল করে সংশ্লিষ্ট সিএন্ডএফ এজেন্ট টিএস কর্পোরেশন। গোপন সংবাদের ভিত্তিতে পণ্য ডেলিভারি পর্যায়ে আটক ও শতভাগ কায়িক পরীক্ষা করা হয়। এতে জালিয়াতির বিষয়টি ধরা পড়ে। পার্টি স্প্রে ঘোষণা দিয়ে উচ্চ শুল্কায়ন যোগ্য পণ্য নিয়ে আসে আমদানিকারক প্রতিষ্ঠান। আমদানিকৃত পণ্যের কান্ট্রি অব অরিজিন থাইল্যান্ড ও যুক্তরাজ্য। চালানে যেসব পণ্য পাওয়া গেছে এতে রয়েছেÑ ডাভ বিউটি ক্রিম, ইম্পেরিয়াল লেদার সোপ, সানসিল্ক শ্যাম্পু, ডাভ প্যাম্পারিং লোশন, জিলেট শেভিং জেল, পামঅলিভ শাওয়ার জেল, ফেয়ার এন্ড লাভলী ফেসওয়াশ ও ক্রিম, ডাভ বডি ওয়াশ, এক্স ডিও বডি স্প্রে। এ ঘটনায় আমদানিকারক ও সিএন্ডএফ এজেন্টের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা গ্রহণ এবং উপযুক্ত শুল্ক-কর আদায়ের লক্ষ্যে চট্টগ্রাম কাস্টমস মামলা দায়েরের প্রস্তুতি নিচ্ছে বলে কর্তৃপক্ষ সূত্র জানায়।



 

Show all comments
  • mohammad ali ২৯ জুন, ২০১৭, ৭:০৮ পিএম says : 0
    D R EDITOR, VERY NICE STORY IN UR PAPER.4 THIS U R DISLIKE BY AL. NOW WE IMAGINE. AGAINST THOSE CULPRITS WHAT R THE PUNISHMENT?? MAY B NO. THANKS.
    Total Reply(0) Reply

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

ঘটনাপ্রবাহ: রাজস্ব ফাঁকি


আরও
আরও পড়ুন
এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ
গত​ ৭ দিনের সর্বাধিক পঠিত সংবাদ