Inqilab Logo

বৃহস্পতিবার, ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১, ১৫ শাওয়াল ১৪৪৫ হিজরী

বছরজুড়েই মন্ত্রীদের উপস্থিতি নিয়ে বিতর্ক, নিষ্প্র্রাণ সংসদ

| প্রকাশের সময় : ২৯ ডিসেম্বর, ২০১৬, ১২:০০ এএম

ফিরে দেখা ২০১৬
হাবিুর রহমান : ২০১৬ বছরজুড়েই মন্ত্রীদের উপস্থিতি নিয়ে বিতর্ক এবং কার্যকর ও প্রাণবন্ত হয়ে উঠেনি  সংসদ। সারা বছরে এ সংসদ অধিবেশনগুলো ছিল প্রায় নিষ্প্রাণ। গত ২০ জানুয়ারি শুরু হওয়া বছরের প্রথম (দশম সংসদের নবম) অধিবেশন থেকে শুরু করে সর্বশেষ অধিবেশন  ৮ ডিসেম্বর (দশম সংসদের ত্রয়োদশ) পর্যন্ত মোট ৫টি অধিবেশনে পাস হয় অর্ধশত বিল। এর মধ্যে প্রেসিডেন্ট, প্রধানমন্ত্রী, মন্ত্রী-এমপি এবং বিচারপতিদের বেতন-ভাতা দ্বিগুণ বৃদ্ধির মতো গুরুত্বপূর্ণ বিলও ছিল। লুই আই কানের তৈরী বিশ্বের অনন্য স্থাপত্য নিদর্শন জাতীয় সংসদের মূল নকশা এ বছরে আনা হয়েছে। সেই নকশার আলোকে অবৈধ স্থাপনা ভেঙ্গে ফেলার পদক্ষেপও নেয়া হচ্ছে। এছাড়া যুদ্ধাপরাধী ও বঙ্গবন্ধুর খুনিদের সম্পদ বাজেয়াপ্ত, এরশাদ-জিয়া ও মোশতাকের পেনশন সুবিধা বাতিলের মতো সাহসী সিদ্ধান্তও গৃহীত হয় ২০১৬ সালে। তবে এতো অর্জনের মধ্যেও অধিবেশনে মন্ত্রীদের কম উপস্থিতি, প্রতিটি অধিবেশনে কোরাম সঙ্কট এবং অনির্ধারিত আলোচনার নামে কালক্ষেপণ করে সংসদের অর্থ অপচয়ের মতো নেতিবাচক কর্মকান্ডের মতো ঘটনাও হয়েছে।
অধিবেশন পর্যালোচনা
২০ জানুয়ারি শুরু হওয়া গত বছরের প্রথম অধিবেশনটি ২৭ কার্যদিবস চলে। এ অধিবেশনে রীতি অনুযায়ী প্রেসিডেন্ট আবদুল হামিদ ভাষণ দেন। প্রেসিডেন্টের ভাষণের ওপর আনীত ধন্যবাদ প্রস্তাবের আলোচনায় অংশ নিয়ে প্রধানমন্ত্রী ও বিরোধীদলীয় নেতা বাদে সরকারি দল, বিরোধীদল ও স্বতন্ত্র মিলিয়ে মোট ২০৯ জন ৫৩ মিনিট ৪৬ সেকেন্ড কথা বলেন। এ অধিবেশনে প্রশ্নোত্তর পর্বে প্রধানমন্ত্রী ৮৯টি প্রশ্নের উত্তর দেন। এছাড়া বিভিন্ন মন্ত্রণালয় সংক্রান্ত চার হাজার ৯২২টি প্রশ্নের মধ্যে তিন হাজার ৪৪৪টি প্রশ্নের জবাব দেন দায়িত্বপ্রাপ্ত মন্ত্রীরা। ২৪ এপ্রিল শুরু হওয়া বছরের দ্বিতীয় অধিবেশনটি চলে ৯ কার্য দিবস। অধিবেশনে প্রধানমন্ত্রীর উত্তর দেয়ার জন্য ১২৫টি প্রশ্ন পাওয়া যায়। যার মধ্যে ৪৪টি প্রশ্নের উত্তর দেন তিনি। বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রীদের উত্তর দেয়ার জন্য এক হাজার ৮৫২টি প্রশ্ন পাওয়া যায়। যার মধ্যে মন্ত্রীরা জবাব দেন এক হাজার ২৯২টি। বছরের তৃতীয় অধিবেশনে পাস হয় মেগা বাজেট। অধিবেশনের ৩২ কার্যদিবসের ২৩ দিনই ছিল বাজেট সংক্রান্ত আলোচনা। মোট ৬০ ঘণ্টা ৫০ মিনিট আলোচনা হয় এ অধিবেশনে। এরমধ্যে মূল বাজেটের ওপর আলোচনা ছিল ৪৯ ঘণ্টা ১৩ মিনিট। আর সম্পূরক বাজেটে ১ ঘণ্টা ৪০ মিনিট আলোচনা হয়। এবার সাধারণ বাজেটে মোট ২৩৭ জন এবং সম্পূরক বাজেটে ৯ জনসহ মোট ২৪৬ জন সদস্য আলোচনায় অংশ নেন। এই অধিবেশনে ২৩১টি প্রশ্নের মধ্যে ৯১টি প্রশ্নের উত্তর দেন প্রধানমন্ত্রী। আর বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রীদের জন্য ৪ হাজার ১৮৪টি প্রশ্ন পাওয়া যায়। এরমধ্যে ৩ হাজার ৪৭১টি প্রশ্নের উত্তর দেন মন্ত্রীরা। ২৫ সেপ্টেম্বর শুরু হওয়া বছরের চতুর্থ অধিবেশনে আইনপ্রণয়ন সম্পর্কিত কাজ সম্পাদনের পাশাপাশি কার্যপ্রণালী বিধির ৭১ বিধিতে ৩১৮টি নোটিশ পাওয়া যায়। নোটিশগুলো থেকে ১৮টি গৃহীত নোটিশের মধ্যে ছয়টি আলোচিত হয়। এ অধিবেশনে প্রধানমন্ত্রী ১৫৬টি প্রশ্নের মধ্যে ২৮টি প্রশ্নের উত্তর দেন। মন্ত্রীদের জন্য আনা ২ হাজার ৪০০টি প্রশ্নের মধ্যে ১ হাজার ৬৬৮টি প্রশ্নের জবাব দেন। মাত্র ৫ কার্যদিবস চলা বছরের শেষ অধিবেশনটিতে আইনপ্রণয়ন সম্পর্কিত কাজ সম্পাদনের পাশাপাশি কার্যপ্রণালী বিধির ৭১ বিধিতে ১৩৯টি নোটিশ পাওয়া যায়। নোটিশগুলো থেকে ৬টি গৃহীত হয়। এ ছাড়া ৭১ (ক) বিধিতে দুই মিনিটের আলোচিত নোটিশের সংখ্যা ছিল ৩০টি। এ অধিবেশনে প্রধানমন্ত্রীর উত্তরদানের জন্য সর্বমোট ৯২টি প্রশ্ন পাওয়া যায়। এর মধ্যে তিনি ৬৮টি প্রশ্নের উত্তর দেন। মন্ত্রীদের জন্য আনা এক হাজার ৫২৭টি প্রশ্নের মধ্যে ৬৯২টি প্রশ্নের জবাব দেন।
কার্যকর ও প্রাণবন্ত এ সংসদ হয়নি
সরকার ও বিরোধীদল কার্যকর ও প্রাণবন্ত রাখার ঘোষণা দিলেও গত বছরের অধিবেশনগুলোতে কোরাম সঙ্কট কাটিয়ে উঠতে পারেনি এ সংসদ। দশম সংসদের একদশতম এই অধিবেশনের প্রায় প্রতিটি দিনেই এজন্য নির্ধারিত সময়ের অনেক পরে অধিবেশনের কার্যক্রম শুরু করতে হয়েছে স্পীকারকে। প্রায় প্রতিদিনই নির্ধারিত সময়ের ২০-২৫ মিনিট পর অধিবেশনের কার্যক্রম শুরু হয়েছে। বিশেষ করে মাগরিবের নামাজের বিরতির পর আরও সঙ্কটাপূর্ণ অবস্থায় পড়তে হয়েছে সংসদকে। সাধারণত সিনিয়র এমপি এবং মন্ত্রীদের হাজিরা কমে সংসদে। কিন্তু এবার হলো পুরো ব্যতিক্রম। অধিবেশনে পুরনোদের দেখা মিললেও নতুনদের প্রায়ই খুঁজে পাওয়া যায়নি।
মন্ত্রীদের উপস্থিতি নিয়ে বিতর্ক
মন্ত্রীদের অনুপস্থিতি নিয়ে গেল বছরের প্রায় সবক’টি অধিবেশনে সরকারি দলের এমপিরা নিজেদের মধ্যেই বিতর্কে জড়িয়েছেন। তারা নিজ দল ও জোটের এমপিদের সমালোচনায় অযাচিত ভাষা প্রয়োগ করেছেন, যা তাৎক্ষণিকভাবেই একপাঞ্জ করার দাবি ওঠে। আলোচনায় অংশ নিয়ে সংসদ কক্ষে সরকারি দলের প্রথম সারিতে কোনো মন্ত্রী উপস্থিত না থাকার বিষয়টি তুলে ধরেন এমপিরা।
দুর্লভ স্থাপত্যকর্মের ঐতিহাসিক নকশা
গত বছরই সরকার ও জাতীয় সংসদ সংশ্লিষ্টদের ঐকান্তিক প্রচেষ্টায় প্রস্তাবিত আইয়ুব নগর প্রকল্পসহ সংসদ ভবনের দুর্লভ স্থাপত্যকর্মের ঐতিহাসিক নকশাগুলো দেশে আনতে সক্ষম হয়েছে জাতীয় সংসদ। স্বাধীনতার ৪৫ বছর পেরিয়ে গেলেও এই নকশা বাংলাদেশের হাতে ছিল না। আর লুই আই কানের এই মূল নকশা না পাওয়ার কারণে সংসদ ভবন এলাকার উন্নয়ন কার্যক্রম আটকে যায়। বহু খোঁজাখুঁজির পর যুক্তরাষ্ট্রের পেন্সিলভেনিয়া ইউনিভার্সিটির আর্কাইভে এই নকশার সন্ধান পাওয়া যায়। এরপর তার উত্তরসূরিদের নিকট থেকে ওই নকশা সংগ্রহ করতে গত ২৯ মে জাতীয় সংসদের অতিরিক্ত সচিব (আপিএ) আ ই ম গোলাম কিবরিয়ার নেতৃত্বে পাঁচ সদস্যের প্রতিনিধি দলটি যুক্তরাষ্ট্রে যান। এ প্রতিনিধি দলে ছিলেন- স্থাপত্য অধিদপ্তরের প্রধান স্থপতি কাজী গোলাম নাসির, গৃহায়ন ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয়ের যুগ্ম-সচিব (উন্নয়ন শাখা-৯) অধিশাখা মো. মনিরুজ্জামান, গণপূর্ত অধিদপ্তরের তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী আহসান হাবিব ও স্থাপত্য অধিদপ্তরের সহকারী স্থপতি সাইকা বিনতে আলম। তারা সেখানে নকশাগুলো দেশে আনার বিষয়ে সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে চুক্তি সম্পাদন করেন। সম্পাদিত ওই চুক্তি অনুযায়ী মাত্র ক’দিন আগেই নকশাগুলো বাংলাদেশের হাতে আসে।  
৫ অধিবেশনে ৫০ বিল পাস
গত বছরে চলা ৫টি অধিবেশনে মোট ৫০টি জনগুরুত্বপূর্ণ বিল পাস করে জাতীয় সংসদ। এর মধ্যে প্রেসিডেন্ট, প্রধানমন্ত্রী, স্পীকার, মন্ত্রী ও সংসদ সদস্যদের বেতন-ভাতা দ্বিগুণ করার কয়েকটি বিলও ছিল। সংসদ সচিবালয়ের তথ্যানুযায়ী, বছরের প্রথম এবং চলমান দশম সংসদের নবম অধিবেশনে পাস হয়েছে ৯টি বিল। দশম অধিবেশনে ১৪টি বিল পাস হয়। একাদশতম অধিবেশনে ২৭টি সরকারি বিল পাওয়া যায়, এর মধ্যে পাস হয় ১৬টি বিল।  দ্বাদশতম অধিবেশনে উত্থাপিত ৮টি বিলের মধ্যে ৬টি বিল পাস হয় এবং সর্বশেষ ত্রয়োদশ অধিবেশন মাত্র ৫টি কার্যদিবস চললেও এই ৫ দিনে পাস হয়েছে ৫টি বিল।
এরশাদ-জিয়া ও মোশতাকের পেনশন সুবিধা বাতিল
প্রেসিডেন্টের দায়িত্ব পালনকারী মোশতাক আহমেদ, জিয়াউর রহমান ও হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ কোনো পেনশন সুবিধা পাবেন না এমন বিধান করে ‘প্রেসিডেন্ট অবসর ভাতা, আনুতোষিক ও অন্যান্য সুবিধা আইন-২০১৬’ বিল পাস করা হয় গত বছরের তৃতীয় অধিবেশনে। আইন অনুযায়ী, এই তিনজন বাদে ছয় মাস প্রেসিডেন্টর দায়িত্ব পালন করেছেন এমন সবাই পেনশন সুবিধার অধিকারী হবেন। কৃষিমন্ত্রী মতিয়া চৌধুরী গত ০৪ অক্টোবর যুগান্তকারী এই বিলটি সংসদে উত্থাপন করলে বিরোধী দল জাতীয় পার্টির এমপিদের বাঁধার মুখেই সংখ্যাগরিষ্টতার ভিত্তিতে তা কণ্ঠভোটে পাস হয়।
যুদ্ধাপরাধী ও বঙ্গবন্ধুর খুনিদের সম্পদ বাজেয়াপ্ত
গত বছরই বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের হত্যাকারী এবং দ-প্রাপ্ত যুদ্ধাপরাধীদের সব স্থাবর, অস্থাবর সম্পত্তি বাজেয়াপ্ত করার যুগান্তকারী সিদ্ধান্ত দিয়েছে জাতীয় সংসদ। আওয়ামী লীগের এমপি ফজিলাতুন নেসা বাপ্পী সিদ্ধান্ত প্রস্তাবটি সংসদে উত্থাপন করেন। উত্থাপিত সিদ্ধান্ত প্রস্তাবটি সমর্থন করে বক্তব্য দেন নূরজাহান বেগম, মনিরুল ইসলাম, আবদুল মতিন, বেগম সানজিদা খানম ও ড. মোহাম্মদ শামছুল হক ভূঁইয়া। সবার বক্তব্য শেষে আইনমন্ত্রী আনিসুল হক বলেন, জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের খুনি এবং মহান মুক্তিযুদ্ধে ৩০ লাখ মানুষকে হত্যাকারী যুদ্ধাপরাধী-মানবতাবিরোধীদের কোন সম্পত্তি এই স্বাধীন দেশে থাকতে পারে না, রাখার কোন অধিকার নেই। অতি দ্রুতই বঙ্গবন্ধুর খুনি এবং দ-িত যুদ্ধাপরাধীদের নামে-বেনামে থাকা সকল স্থাবর-অস্থাবর সম্পত্তি বাজেয়াপ্ত করা হবে। এই কাজ ইতোমধ্যে শুরু হয়ে গেছে। পরে প্রস্তাবটি সর্বসম্মতিক্রমে পাস হয়।
সংসদীয় কমিটি পুনর্গঠন
দশম সংসদের যাত্রালগ্নে গঠিত সংসদীয় স্থায়ীগুলোর মধ্যে নতুন করে ৮টি কমিটি পুনর্গঠিত করা হয়েছে গত বছর।



 

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

ঘটনাপ্রবাহ: সংসদ

১৬ জানুয়ারি, ২০২৩
৫ জানুয়ারি, ২০২৩
৫ জানুয়ারি, ২০২৩

আরও
আরও পড়ুন
এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ
গত​ ৭ দিনের সর্বাধিক পঠিত সংবাদ