Inqilab Logo

বৃহস্পতিবার, ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১, ১৫ শাওয়াল ১৪৪৫ হিজরী

নতুন বছরে দুই দলের রাজনৈতিক মহড়া

৫ জানুয়ারি মুখোমুখি হচ্ছে তৃণমূল

| প্রকাশের সময় : ৪ জানুয়ারি, ২০১৭, ১২:০০ এএম

আফজাল বারী : রাজনৈতিক লড়াই-সংগ্রামের সূতিকাগার মানেই রাজধানী ঢাকা। আন্দোলনের পরিকল্পনা, ঘোষণা এবং সূচনা হতো ঢাকা থেকে। কিন্তু সাল বদলের সাথে ঘটছে উল্টোটা। নতুন বছরে রাজনীতির মাঠে হাইকমান্ডের বল চলে গেছে তৃণমূলে। ৫ জানুয়ারিকে সামনে রেখে নানা কর্মসূচি নিয়ে মাঠে থাকার ঘোষণা দিয়েছে দেশের বড় দুই রাজনৈতিক দল। এই দিনে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ ‘গণতন্ত্রের বিজয় দিবস’ ও মাঠের বিরোধী দল বিএনপি ‘গণতন্ত্র হত্যা দিবস’ পালন করতে সর্বাত্মক প্রস্তুতি নিয়েছে। তবে দুই দলের এই মুখোমুখি অবস্থানে রাজধানী ঢাকা নেই। বেছে নেয়া হয়েছে তৃণমূলকে। হুঁশিয়ারি-পাল্টা হুঁশিয়ারি আসছে উভয় মেরু থেকে। বিশ্লেষকদের দৃষ্টিতে, দীর্ঘদিন হিমঘরে থাকা রাজপথের আন্দোলন-সংগ্রাম নতুন বছরে আলোতে আসতে পারে। ৫ জানুয়ারির (২০১৪) নির্বাচনে যে প্রশ্নবিদ্ধ রেখা, তা মুছে ফেলার জন্যই কেন্দ্রীয় আন্দোলনকে পাঠানো হয়েছে মফস্বলে।      
এদিন শান্তিপূর্ণ কর্মসূচির মাধ্যমে মূলত নির্বাচন কমিশন পুনর্গঠনকে টার্গেট করেই মাঠে নামতে চায় বিএনপি।  সারা দেশে কালো পতাকা মিছিল ও ৭ জানুয়ারি ঢাকায় সমাবেশের কর্মসূচি ঘোষণা করেছে দলটি। অন্য দিকে, ৫ জানুয়ারি রাজধানীতে দু’টি সমাবেশ ডেকেছে ক্ষমতাসীন দল আওয়ামী লীগ। ঢাকা পাশাপাশি সারাদেশেও নানা কর্মসূচি পালন করবে দলটি। বিএনপিকে কোনো কর্মসূচি পালন করতে দেয়া হবে না। আর বিএনপি বলছে, তাদের কর্মসূচি হবেই।
২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারির জাতীয় সংসদ  নির্বাচন বর্জন করে বিএনপিসহ বেশ কয়েকটি রাজনৈতিক সংগঠন।  একতরফা নির্বাচনে বিজয়ী হয়ে আওয়ামী লীগ টানা দ্বিতীয়বার সরকার গঠন করে। এর পর থেকে প্রতি বছর দিবসটিকে বিএনপি পালন করছে ‘গণতন্ত্র হত্যা দিবস’ হিসেবে। আর ‘গণতন্ত্রের বিজয় দিবস’ হিসেবে পালন করে আসছে আওয়ামী লীগ।
২০১৫ সালের ৫ জানুয়ারিকে কেন্দ্র করে বড় দুই রাজনৈতিক শক্তির পরস্পরবিরোধী অবস্থানের কারণে দেশ  অচল অবস্থায় পড়েছিল। বিএনপিকে মাঠে নামতে না দেয়ায় টানা হরতাল-অবরোধ কর্মসূচি পালন করে বিএনপি। কর্মসূচিতে ব্যাপক সহিংসতা ও সংঘাত ছড়িয়ে পড়ে। সারাদেশে শতাধিক নিরীহ লোক মারা যান। প্রায় তিনমাস পর পরিস্থিতি স্বাভাবিক হয়। তবে গত বছর দিনটি ঘিরে টানটান উত্তেজনা থাকলেও শেষ পর্যন্ত শান্তিপূর্ণভাবে কর্মসূচি পালন করে।
এবারো শান্তিপূর্ণ কর্মসূচি পালন করতে চায় বিএনপি। দলটির নেতারা মনে করেন, ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারি নির্বাচন একটি বিতর্কিত নির্বাচন। সরকারি দল যতই এ দিনটিতে বিজয় উৎসব করুক, বিশ্ব সেই নির্বাচন মেনে নেয়নি। একতরফা নির্বাচনের কথা জানাতেই বিএনপি এই দিনটিতে কর্মসূচি ঘোষণা করেছে।
সূত্র জানায়, নির্বাচন কমিশন পুনর্গঠন নিয়ে প্রেসিডেন্টের সাথে সংলাপের পর রাজনীতিতে একটা ইতিবাচক ধারার সৃষ্টি হয়েছে। এই ধারাকে তারা অব্যাহত রাখতে চান। তাই সংঘাত এড়াতেই ৫ জানুয়ারি ঢাকায় কোনো কর্মসূচি রাখেনি। ওইদিন ঢাকার বাইরে সকল জেলা-উপজেলায় কালো পতাকা মিছিল ঘোষণা করেছে। আর ৭ জানুয়ারি রাজধানীর সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে সমাবেশের ঘোষণা দিয়েছে দলটি। ইতোমধ্যে দলের পক্ষ থেকে সমাবেশের জন্য কর্তৃপক্ষের কাছে অনুমতি চাওয়া হয়েছে। শান্তিপূর্ণ কর্মসূচির মাধ্যমে মূলত নির্বাচন কমিশন পুনর্গঠনকে টার্গেট করেই মাঠে নামতে চায় বিএনপি
বিএনপি দলীয় সূত্রমতে, ঢাকা মহানগরীর সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের সমাবেশে বড় ধরনের জমায়েত করার পরিকল্পনা করছে হাইকমান্ড। ঢাকার বাইরেও ঘোষিত কর্মসূচি সফল করতে প্রয়োজনীয় প্রস্তুতি নেয়ার নির্দেশনাও দেয়া হয়েছে। তবে অবশ্যই সংঘাত এড়িয়ে কর্মসূচি পালন করতে হবে এই নির্দেশনা দেয়া হয়েছে কড়াভাবে।
আগামী ৫ জানুয়ারি জিয়া অরফানেজ ট্রাস্ট দুর্নীতি মামলায় বেগম খালেদা জিয়াকে আত্মপক্ষ সমর্থনের জন্য তারিখ ধার্য করেছেন আদালত। খালেদা জিয়াসহ মামলার অপর আসামিরা সেদিন সশরীরে আদালতে হাজির না হলে তাদের জামিন বাতিল করা হবে বলেও জানিয়েছেন বিচারক।
বিএনপি নেতারা মনে করেন, চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়ার আদালতে হাজিরার সঙ্গে কোনো রাজনৈতিক যোগসূত্র থাকতে পারে। বিএনপি যাতে ওইদিন ঢাকায় কোনো কর্মসূচি পালন করতে না পারে, হয়তো সেজন্যই এমনটা করা হয়েছে। খালেদা জিয়ার আইনজীবী ব্যারিস্টার মাহবুব উদ্দিন খোকন বলেন, সাবেক প্রধানমন্ত্রী বেগম খালেদা জিয়া ৫ জানুয়ারি সকালে আদালতে হাজিরা দিতে যাবেন। আদালতে হাজিরাকে কেন্দ্র করে ওইদিন রাজধানীতে বড় ধরনের শোডাউন করতে পারে বিএনপি। মহানগর ও অঙ্গসংগঠনের নেতাকর্মীদের সেরকম নির্দেশনা দেয়া হয়েছে।
এ প্রসঙ্গে বিএনপির সিনিয়র যুগ্ম-মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী ইনকিলাবকে বলেন, দলের তরফ থেকে ৫ জানুয়ারি সারা দেশে মহানগর, জেলা ও উপজেলায় কালো পতাকা মিছিল ও কালো ব্যাজ ধারণের কর্মসূচি  ঘোষণা করা হয়েছে। যে কোনো মূল্যে তা হবেই। জেলা নেতাদের কর্মসূচি পালনের নির্দেশনা দেয়া হয়েছে। তারা প্রস্তুতিও নিচ্ছেন। ইতোমধ্যে আমরা সমাবেশের অনুমতি চেয়ে যথাযথ কর্তৃপক্ষের কাছে আবেদন করেছি। আশা করি তারা আমাদের অনুমতি দেবেন। কর্মসূচি তৃণমূল থেকে শুরু করা প্রসঙ্গে তিনি বলেন, জনতার সুপ্ত ক্ষোভের বিস্ফোরণ ঘটতে পারে টেকনাফ থেকে তেঁতুলিয়া, রূপসা থেকে পাথুরিয়ার যে কোনো স্থান এবং কোনো দিনে।   
রিজভী বলেন, সরকার জনগণকে ভয় পায় বলেই হয়ত বিএনপিকে মাঠে নামতে দেয়া হবে না বলে হুঁশিয়ারি দিচ্ছে। তারা গণতন্ত্রে বিশ্বাস করলে বিরোধীদের মাঠে নামতে দিবে। খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, চট্টগ্রাম, রাজশাহী, সিলেট, খুলনা, রংপুর, বরিশাল মহানগরসহ জেলা পর্যায়ের নেতারা কর্মসূচি সফল করে কেন্দ্রকে নতুন বছরের বার্তা দিতে চায়।
গত দুই বছরের মতো এবারও ৫ জানুয়ারি ‘গণতন্ত্রের বিজয় দিবস’ উপলক্ষে রাজধানীসহ সারাদেশে বিভিন্ন কর্মসূচি নিয়েছে শাসক দল আওয়ামী লীগ। সাথে রয়েছে মিত্র দলগুলোও। ওইদিন দুপুরে রাজধানী ঢাকার রাসেল স্কয়ার প্রাঙ্গণে আওয়ামী লীগ ঢাকা মহানগর উত্তর এবং ঐতিহাসিক ২৩ বঙ্গবন্ধু এভিনিউ প্রাঙ্গণে ঢাকা মহানগর দক্ষিণ সমাবেশ ও বিজয় র‌্যালি করবে। একইভাবে জেলা-উপজেলাতে কর্মসূচি পালনের নির্দেশ দেয়া হয়েছে। ঢাকার সমাবেশ ও বিজয় র‌্যালিতে আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় নেতারা অংশগ্রহণ করবেন। এ ছাড়া জেলা, মহানগর ও উপজেলায় কেন্দ্র ঘোষিত কর্মসূচিতে নিজ নিজ নির্বাচনী এলাকার স্থানীয় নেতাদের অংশগ্রহণ করতে বলা হয়েছে। ওইদিন রাজপথে থাকতে তৃণমূল নেতাকর্মীদের কঠোর বার্তা পাঠানো হয়েছে। সভা-সমাবেশ ও র‌্যালিতে কেন্দ্রীয় নেতাদের সরব উপস্থিতি মিলবে বলে দলীয় সূত্র জানিয়েছে।  
এ প্রসঙ্গে আওয়ামী লীগের যুগ্ম-সাধারণ সম্পাদক মাহবুব-উল আলম হানিফ গণমাধ্যমকে বলেন, নির্দিষ্ট সময়ে দশম জাতীয় নির্বাচন না হলে দেশে সাংবিধানিক শূন্যতার সৃষ্টি হতো। ওই নির্বাচন থেকে পিছিয়ে আসার কোনো সুযোগ ছিল না। নির্বাচনে অংশ না নিয়ে বিএনপি ভুল করেছে। তারা নির্বাচনকে প্রতিহত করার জন্য ধ্বংসাত্মক কর্মকা- চালিয়েছে। এসবের মাধ্যমে কার্যত তারা জনগণের ভোটাধিকার হরণের চেষ্টা করেছিল।
তৎকালীন সরকার যথাসময়ে নির্বাচন করে গণতন্ত্রের অগ্রযাত্রাকে অব্যাহত রেখেছে। তাই এ দিনটি গণতন্ত্রের বিজয় দিবস। ঢাকায় দু’টি সমাবেশ এবং জেলা, মহানগর ও উপজেলাতেও নানা কর্মসূচির মাধ্যমে এ দিনটি পালন করা হবে।
 
বিএনপির গণতন্ত্র হত্যা দিবস পালনের সমালোচনা করে হানিফ বলেন, গণতন্ত্র ধ্বংসের প্রচেষ্টা যদি কেউ করে থাকে, সেটা বিএনপি-জামায়াত করেছে। ৫ জানুয়ারির হত্যা, জ্বালাও-পোড়াওয়ের জন্য দেশের জনগণ তাদের এদিন কোনো কর্মসূচি পালন করতে দেবে না।
আওয়ামী লীগ দলীয় সূত্রে জানা গেছে, রাজধানীর দু’টি সমাবেশ সফল করতে ব্যাপক প্রস্তুতি নিচ্ছে দলটির মহানগরের নেতারা। প্রতিটি থানা, ওয়ার্ড ও ইউনিটে সর্বাত্মক প্রস্তুতি নিয়েছে। তাদের মিত্র ও ভাতৃপ্রতীম রাজনৈতিক সংগঠনগুলোও আওয়ামী লীগ ঘোষিত কর্মসূচিতে অংশ নেবে।
দুই দলের এমন প্রস্তুতি ও হুঁশিয়ারি বিষয়ে রাষ্ট্রবিজ্ঞানী নূরুল আমিন বেপারী ইনকিলাবকে বলেন, বিএনপি ১০ বছর ধরে ক্ষমতার বাইরে। সাংগঠনিক দুর্বলতা থাকাটাই স্বাভাবিক। তবে সমন্বয়হীতাটা প্রকট। কেন্দ্র যে ব্যর্থ তা সেই ৫ জানুয়ারিতেই প্রমাণিত। তৃণমূল যেভাবে ভূমিকা পালন করেছে কেন্দ্র তার অংশবিশেষ করলে আজ রাজনৈতিক চিত্র ভিন্ন দেখা যেতো। সফল তৃণমূল থেকে আন্দোলনের সাড়ার মাত্রা জানতেই হয়তো বিএনপির নীতি-নির্ধারকরা এমনতর সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। রাষ্ট্রক্ষতায় থাকার কারণে আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক দুর্বলতাটা তেমন প্রকাশ পাচ্ছে না। তবে হুমকি-পাল্টা হুমকি যা-ই হোক, কর্মসূচি শান্তিপূর্ণই হবে। কর্মসূচির মাধ্যমে দুই দলের অর্জন হবে সাংগঠনিক জাগরণ। কিছুটা হলেও হিমঘরে থাকা আন্দোলন আলোতে আসবে। 



 

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

ঘটনাপ্রবাহ: রাজনৈতিক


আরও
আরও পড়ুন
এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ
গত​ ৭ দিনের সর্বাধিক পঠিত সংবাদ