Inqilab Logo

শুক্রবার, ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ০৬ বৈশাখ ১৪৩১, ০৯ শাওয়াল ১৪৪৫ হিজরী

পানির আকাল : উৎপাদন ব্যাহত হওয়ার আশংকা

| প্রকাশের সময় : ৮ জানুয়ারি, ২০১৭, ১২:০০ এএম

বোরো মওসুমে সেচের পানির সংকট ব্যাপক ও মারাত্মক আকার ধারণ করতে পারে, আলামতাদি থেকে সেটাই প্রতীয়মান হচ্ছে। উজান থেকে ভারতের একতরফা পানি প্রত্যাহারের কারণে ইতোমধ্যে তিস্তা, পদ্মা, যমুনা, ব্রহ্মপুত্রসহ সব নদীতেই পানি কমে গেছে। প্রতিদিনই কমছে। সব নদীতেই ছোট বড় চর পড়তে শুরু করেছে। সেচ প্রকল্পগুলো এখনই ভয়াবহ পানি সংকটের কবলে পতিত হয়েছে। ফেব্রুয়ারি থেকে এপ্রিল পর্যন্ত সময়ে পরিস্থিতি কি দাঁড়াবে, এ থেকে সহজেই তার একটি ধারণা লাভ করা যায়। কৃষকদের কপালে এখনই ভাঁজ দেখা দিয়েছে। তারা উদ্বিগ্ন, বিচলিত ও শংকিত। তারা তাদের আবাদী জমিতে সেচ দিয়ে কাক্সিক্ষত ফসল ফলাতে এখন ভরসা খুঁজে পাচ্ছে না। তিস্তার পানি প্রবাহ ক’দিন আগে এক হাজার কিউসেকে নেমে এসেছে। এক সপ্তাহ আগেও ছিল তিন হাজার কিউসেক। আশংকা করা হচ্ছে, শেষাবধি পানি তিনশ’ কিউসেক কিংবা তারও নিচে নেমে আসতে পারে। গত বছর এ যাবৎকালের রেকর্ড তিনশ’ কিউসেকে নেমে এসেছিল। তিস্তা সেচ প্রকল্পের অধীন জমিতে বোরোর আবাদ নিয়ে কৃষকদের দুর্ভাবনা-দুশ্চিন্তা এখন কোন পর্যায়ে আছে তা অনুধাবন করতে কষ্ট হয় না। তিস্তা প্রকল্প এলাকায় সেচযোগ্য জমির পরিমাণ ৬৬ হাজার হেক্টর। স্থানীয় পানি উন্নয়ন বোর্ড পানি সংকটের কারণে মাত্র ১০ হাজার হেক্টরে পানি দিতে পারবে বলে লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করেছে। বাকি ৫৬ হাজার হেক্টরে কৃষকরা ধানের বদলে ভুট্টা চাষের চিন্তা-ভাবনা করছে। এর সরলার্থ এই যে, ধানের উৎপাদন কমবে, যার প্রভাব অনিবার্যভাবে খাদ্য নিরাপত্তার ওপর পড়বে। বলা বাহুল্য, শুধু তিস্তা প্রকল্প এলাকারই এটা একক চিত্র নয়, গঙ্গা-কপোতাক্ষসহ অন্যান্য সেচ প্রকল্প এলাকাতেও একই বাস্তবতা লক্ষণীয়। প্রকল্পগুলোর আওতাধীন সামান্য পরিমাণ জমিতে সেচ সুবিধা দেয়া সম্ভব হবে। বাকি জমিতে হয়তো ভুট্টা বা অন্যান্য ফসলের আবাদ হবে। অথবা জমি পতিত থেকে যাবে।
এটা প্রতিবছরেরই সাধারণ চিত্র। ভারত পানি ছাড়বে এবং সেচ প্রকল্পগুলো কার্যকর হবে, তাদের আওতাধীন সব জমিতে ধানের আবাদ-উৎপাদন হবে এমনটা এখন শুধু কল্পনার বিষয়। দুঃখ এখানে যে, পানির মামলায় আমাদের সরকার যেন হারার আগেই হেরে বসে আছে। চুক্তি অনুযায়ী গঙ্গার পানি বাংলাদেশ পাচ্ছে না; এ ব্যাপারে সরকারের টুঁ শব্দ নেই। ভারত নানা অজুহাতে তিস্তার পানি চুক্তি আটকে রেখেছে; তা নিয়েও সরকারের তেমন কোনো বিকার আছে বলে মনে হয় না। সরকারের কর্তাব্যক্তিরা যখন তিস্তার পানি চুক্তির ব্যাপারে ভারতের বক্তব্যই যুক্তি হিসেবে তুলে ধরেন, তখন বুঝতে অসুবিধা হয় না, এ চুক্তি আর কখনো হবে না। সরকার ব্যস্ত ভারত তোষণে। কীভাবে ভারতকে খুশী রাখা যায়, কীভাবে তার সব চাহিদা চাইবা মাত্র পূরণ করা যায়, সেটাই যেন সরকারের মিশনে পরিণত হয়েছে। কোনো সরকার জাতীয় স্বার্থকে এভাবে উপেক্ষা করতে পারে, এমন নজির বিশ্বে দ্বিতীয়টি আছে বলে মনে হয় না। সরকারের লোকেরা গর্বভরে বলেন, তারা দেশকে খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণ করে ফেলেছেন। এটা অর্ধসত্য, পুরো সত্য নয়। সাম্প্রতিক বছরগুলোতে খাদ্যশস্যের উৎপাদন বেড়েছে, অস্বীকার করা যাবে না। এ জন্য সরকারের কৃতিত্ব অতি সামান্য। কৃতিত্বের দাবিদার মূলত, দেশের কৃষকরা। তাদেরই শ্রমে-ঘামে-বিনিয়োগ এই সাফল্য এসেছে। উৎপাদনের এই ধারাবাহিকতা আগামীতে রক্ষা করা যাবে, এটা মনে করার কারণ নেই। কৃষকরা যদি সেচ সুবিধা না পায়, না পায় অন্যান্য সুবিধা ও ধানচালের ন্যায্য দাম, তবে উৎপাদন নেমে আসতে বাধ্য। উৎপাদন বাড়াতে হলে সেচ প্রকল্পগুলো বাঁচাতে হবে, কার্যকর রাখতে হবে। এ জন্য পানি চাই। অভিন্ন নদীর পানির ন্যায্য হিস্যা ছেড়ে দিলে সে পানি পাওয়া যাবে না। সরকার এদিকে মোটেই নজর দিচ্ছে না।
আগের দিন এখন আর নেই। এখন কৃষিতে সেচ অপরিহার্য। এ জন্য পানির নিশ্চিত যোগান থাকার বিকল্প নেই। নদীনির্ভর সেচ প্রকল্প বা সেচ ব্যবস্থা টিকিয়ে রাখা কঠিন হয়ে পড়েছে। এ জন্য উজান থেকে ভারতের একতরফা পানি ছিনতাই প্রধানত দায়ী। কিন্তু বিকল্প ব্যবস্থাও নেয়া হয়নি। যা নেয়া হয়েছে তাও ষোলআনা কার্যকর অবস্থায় নেই। গভীর-অগভীর নলকূপের মাধ্যমে ভূগর্ভের পানি টেনে সেচের যে ব্যবস্থাটি রয়েছে, সেই ব্যবস্থাও নানা সংকটে পতিত হয়েছে। প্রথমত, নলকূপগুলো সব সচল অবস্থায় নেই। বিএডিসি’র ২০১৪-১৫ সালের হিসাব অনুযায়ী, দেশে সরকারী-বেসরকারী গভীর নলকূপের সংখ্যা ৩৩ হাজার ৭১৪টি। এর মধ্যে সরকারী গভীর নলকূপের সংখ্যা ২৪ হাজার ১৫২টি। এছাড়া সরকারী-বেসরকারী অগভীর নলকূপ বা শ্যালো পাম্প রয়েছে ২৭ লাখ ছয় হাজার ৩৪৭টি। এদের বেশিরভাগই বেসরকারী। জানা গেছে, সরকারী গভীর নলকূপের কয়েকশ’ অকেজো হয়ে পড়ে আছে। দ্বিতীয়ত, গভীর-অগভীর নলকূপের মাধ্যমে ভূগর্ভ থেকে ব্যাপকভাবে পানি উত্তোলনের কারণে পানির স্তর দ্রুত নিচে নেমে যাচ্ছে, যা অত্যন্ত, উদ্বেগজনক। অন্যদিকে অনেক এলাকায় গভীর নলকূপে পর্যাপ্ত পানি পাওয়া যায় না। যা পাওয়া যায় তাতে আর্সেনিকসহ নানা দূষিত উপাদান উঠে আসে। জনস্বাস্থ্য ও ফসলের জন্য এটা হুমকিস্বরূপ। তৃতীয়ত, গভীর-অগভীর নলকূপের একাংশ চলে বিদ্যুতে, অপরাংশ তেলে। বিদ্যুৎ সব সময় মেলে না। এতে সেচকাজ ব্যাহত হয়। তেলের দাম এখন কিছুটা কম হলেও বিদ্যুতের চেয়ে তেলে উৎপাদন খরচ বেশি পড়ে। সব মিলিয়ে বলা যায়, পানির অভাব ও সেচের ক্ষেত্রে নানাবিধ সংকট থাকায় ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে আবাদ ও উৎপাদন। এমতাবস্থায়, বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, আগামীতে খাদ্য নিরাপত্তা মারাত্মক ঝুঁকির মধ্যে পড়ে যেতে পারে। আশংকার এদিকটি বিবেচনায় নিয়ে প্রয়োজনীয় কার্যব্যবস্থা গ্রহণ করা এখন সময়ের প্রধান দাবিতে পরিণত হয়েছে।



 

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

আরও পড়ুন