Inqilab Logo

শুক্রবার, ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ০৬ বৈশাখ ১৪৩১, ০৯ শাওয়াল ১৪৪৫ হিজরী

প্রতিটি ভবনেই অগ্নিনির্বাপণ ব্যবস্থা মজুদ রাখতে হবে

| প্রকাশের সময় : ১৩ জানুয়ারি, ২০১৭, ১২:০০ এএম

আল ফাতাহ মামুন : আমাদের প্রিয় মাতৃভূমি বাংলাদেশ যেন ক্রমেই অগ্নি দুর্ঘটনার স্বর্গরাজ্যে পরিণত হচ্ছে। প্রায়ই রাজধানীসহ দেশের কোথাও না কোথাও অগ্নিকা-ে ভস্মীভূত হচ্ছে কল-কারখানা, বস্তি, ব্যবসায় প্রতিষ্ঠান ও বসতবাড়ি। হতাহত হচ্ছে মানুষ। হচ্ছে বিপুল পরিমাণ আর্থিক ক্ষতিও। অনেকেই অগ্নিদগ্ধ হয়ে বিভীষিকাময় জীবন অতিবাহিত করছেন। সাম্প্রতিক সময়ে ঘটে যাওয়ারন দুর্ঘটনার জন্য কেউ কেউ আধুনিক প্রযুক্তিকে দোষছেন। মূলত অগ্নি দুর্ঘটনার পেছনে প্রযুক্তি নয় দায়ী মানুষের অসাবধানতা ও সচেতনতার অভাব। ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্সের হিসাব মতে বছরে অন্তত ১৬ হাজার অগ্নিকা-ের ঘটনা ঘটছে। গত ৮ বছরে সারা দেশে ১ লাখ ৩০ হাজার ২১৫টি অগ্নিকা-ের ঘটনা ঘটেছে। এতে নিহত হয়েছে ১ হাজার ৯২৮ জন। আহত হয়েছেন ১২ হাজার ৮২৫ জন। ওই সময়ে আনুমানিক ক্ষতির পরিমাণ সোয়া ৪ হাজার কোটি টাকার বেশি বলে এক পরিসংখ্যানে উল্লেখ করা হয়েছে। অনেক ঘটনা পরিসংখ্যানের বাইরে রয়ে যাওয়ায় প্রকৃত সংখ্যা আরো বেশি বলে ধারণা করছেন গবেষকরা।
ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্স এবং পুলিশ সূত্রে পাওয়া তথ্যানুযায়ী, ২০১০-২০১৬ সালে দেশে সংঘটিত ৯১ হাজার ২৩০টি অগ্নিকা-ের ঘটনায় মারা গেছেন ১০২০ জন। আহত হয়েছেন ৫ হাজার ১২০ জন। ২০১৫ সালে সর্বাধিক অগ্নিকা- সংঘটিত হয় বৈদ্যুতিক গোলযোগের কারণে। এ সংখ্যা ৫ হাজার ৯২৩টি। দ্বিতীয় কারণ ছিল রান্নার চুলা থেকে সৃষ্ট আগুন। ৩ হাজার ৩৬৬টি অগ্নিকা- হয়েছে রান্নার চুলা থেকে। সিগারেট থেকে ২ হাজার ৫৩২টি, শিশুদের আগুন নিয়ে খেলার কারণে ৫২৬টি, যন্ত্রাংশের সংঘর্ষজনিত কারণে ২৪৪টি, অগ্নিসংযোগে ২৩৮টি, মানবসৃষ্ট হাঙ্গামায় ৯৬৩টি, মিস ফায়ারে ৫৯২টি এবং বাকিগুলো অন্যান্য কারণে সংঘটিত হয়। এসব ঘটনার প্রায় ৮০ ভাগই অসাবধানতা ও অসতর্কতার কারণে ঘটেছে।
বড় অগ্নিকা-গুলো ব্যাপক প্রাণহানি ও ক্ষয়ক্ষতির কারণে সবার দৃষ্টি কাড়লেও প্রকৃতপক্ষে প্রতিনিয়তই দেশের কোথাও না কোথাও আগ্নি দুর্ঘটনা ঘটছে। পরিসংখ্যান মতে, ছোট-বড় মিলিয়ে প্রতিদিন অন্তত অর্ধশতাধিক অগ্নিকা-ের ঘটনা ঘটছে। ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্সের মহাপরিচালক আলী আহমেদ খান বলেন, এসব অগ্নিকা-ের ৬৫ ভাগ ঘটছে বৈদ্যুতিক কারণে। বৈদ্যুতিক কারণ ছাড়াও সিগারেটের আগুন, গ্যাসের চুলা, গ্যাস সিলিন্ডার, রাসায়নিক দ্রব্য, বিস্ফোরণ, আগুন নিয়ে খেলা, অসতর্কতাসহ নানা কারণে ঘটছে অগ্নিকা-। মুহূর্তেই সব কিছু পুড়িয়ে ছাড়খাড় করে দিচ্ছে আগুন। বছরের শুরুতে ২ জানুয়ারি শেষ রাতে গুলশান-১ এর ডিএনসিসি মার্কেটে ভয়াবহ অগ্নিকা-ের ঘটনা ঘটে। প্রলয় সৃষ্টিকারী আগুন ও ভবন ধসে নিশ্চিহ্ন হয়ে গেছে ওই মার্কেটের ২৯৫টি দোকান। একই সঙ্গে পাশের পাকা মার্কেটের আরো ২৩৪টি দোকানও ব্যাপকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়। ওই অগ্নিকা-ে কেউ নিহত না হলেও কয়েকশ’ কোটি টাকার সম্পদ শেষ হয়ে গেছে ঘটনার রাতেই। এর দু’দিন পর অর্থাৎ ৪ জানুয়ারি মিরপুরের ছফুরা টাওয়ারে এবং এক সপ্তাহের মাথায় ৯ জানুয়ারি বনানীর হরায়জন বিল্ডিংয়ে ভয়াবহ অগ্নি দুর্ঘটনা ঘটে। গত বছরের নভেম্বরে সাভারের আশুলিয়ায় একটি গ্যাস লাইটার তৈরি কারখানায় ভয়াবহ অগ্নিকা-ের ঘটনা ঘটে। কালার ম্যাচ বিডি লিমিটেড নামের কারখানায় আগুনে ৩০ জন শ্রমিক দগ্ধ হন। এতে বেশ কয়েকজন মারা যান। ক্ষতি হয় কয়েক কোটি টাকা। শুধু তাই নয়, রাজধানীর উত্তর বাড্ডার প্রিমিয়াম প্লাজা, কাওরান বাজারের হাসিনা মার্কেট, বসুন্ধরা সিটিতে আগুনের ঘটনা ছিলো গত বছরের অন্যতম প্রধান শিরোনাম।
আগুন দুর্ঘটনার কারণ ব্যখ্যা করে, ফায়ার সার্ভিসের কর্মকর্তারা বলেন, দেশে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে রয়েছে অসংখ্য অফিস, কল-কারখানা, ব্যবসা প্রতিষ্ঠান ও আবাসিক ঘরবাড়ি। সেগুলোয় ব্যবহৃত হয় লাখ-লাখ কম্পিউটার। কাজ শেষে ব্যবহারকারীরা কম্পিউটার বন্ধ করলেও অধিকাংশ ক্ষেত্রেই সচল থাকে আইপিএসের লাইন। কোনোরকম বৈদ্যুতিক গোলোযোগ হলেই সেসব আইপিএসের মাধ্যমে ঘটে যেতে পারে বড় ধরনের দুর্ঘটনা। বেশ কয়েকটি অগ্নিকা-ের তদন্তে এ ধরনের তথ্য পাওয়া গেছে। আর গ্যাসজনিত দুর্ঘটনার কয়েকটি কারণের মধ্যে অন্যতম হলো অবৈধ গ্যাস সংযোগে নিম্নমানের মালামাল ব্যবহার। এ ছাড়া পাইপের লিকেজ বা চুলার চাবি নষ্ট হয়ে গেলে, এমনকি গ্যাসের চুলা চালু করে অন্য কাজ বা এর ওপর কাপড় শুকাতে দিলেও অগ্নিকা- ঘটতে পারে। তাই বাসা-বাড়িতে গ্যাসের চুলা ব্যবহার এবং অফিস আদালতে ইলেক্ট্রিক যন্ত্রের ব্যবহারে বিশেষ সতর্কতার পরামর্শ দিয়েছেন বিশেষজ্ঞরা।
আমাদের দেশে অগ্নিদুর্ঘটনা রোধ এবং অগ্নি নির্বাপনের চিত্র অগ্নিকা-ের মতই ভয়াবহ। রাজধানী ঢাকায় বহুতল ভবন নির্মাণের ক্ষেত্রে বিল্ডিং কোড মেনে আগুন নেভানোর জন্য পর্যাপ্ত ব্যবস্থা নেওয়ার বিষয়ে উল্লেখ থাকলেও অধিকাংশ ভবন মালিক তা মানছেন না। এমনকি বড় শপিং মল ও রেস্টুরেন্টগুলোর ভবন তৈরির সময়ও মানা হচ্ছে না বিল্ডিং কোড। নিয়ম মেনে বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠান তৈরি না করায় প্রায়ই নগরীর শপিং মলগুলোতে বড় অগ্নিকা-ের ঘটনা ঘটতে দেখা যাচ্ছে। এ জন্য বেসরকারিভাবেও অগ্নিনির্বাপণ ব্যবস্থা জোরদার করার বিষয়টি এখন গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে। সংশ্লিষ্টরা জানান, শপিং মলের প্রতিটি দোকানে ফায়ার ফাইটিং বা অগ্নিনির্বাপণের ব্যবস্থা আছে কিনা তা যাচাই করেই দায়িত্বপ্রাপ্ত প্রতিষ্ঠানের ট্রেড লাইন্সেস দেওয়া উচিত। এখন মার্কেটের দোকানগুলো স্বঃতস্ফূর্তভাবে গড়ে উঠেছে। যে যার খেয়ালখুশি মতো বৈদ্যুতিক তার লাগিয়েছে। রাসায়নিক দ্রব্য মজুদ করছে। অথচ আগুন নেভানোর জন্য এসব শপিং সেন্টারে স্বয়ংসম্পূর্ণ ‘ফায়ার ফাইটিং’ বা অগ্নিনির্বাপণ ব্যবস্থা নেই। ফলে সহজেই অগ্নিদুর্ঘটনার শিকার হচ্ছে মানুষ।
আগুন লাগলে বরাবরের মতো নগরবাসী শুধু দমকল বাহিনীর ওপর নির্ভর করে বসে থাকে। ফলে আগুনে জানমালের ক্ষতির পরিমাণও কমানো যাচ্ছে না। ফায়ার সার্ভিসের একটি ফিলোসফি হচ্ছে আগুন লাগার প্রথম পাঁচ মিনিট হচ্ছে গুরুত্বপূর্ণ সময়। ছোট একটি আগুনের ঘটনা যদি প্রথম পাঁচ মিনিটে নেভানো সম্ভব হয় তবে সেটি তেমন কোনো দুর্ঘটনা বলেই বিবেচিত হয় না। আর এই পাঁচ মিনিটে স্থানীয়দেরই আগুন নেভানোর কাজটি করতে হবে। এ জন্য ফায়ার বিগ্রেডের ওপর নির্ভর করে থাকলে হবে না। স্থানীয়দেরই আগুন নেভানো বা কমাতে তৎপর হতে হবে। এ জন্য প্রয়োজন প্রশিক্ষণের। কিন্তু এগুলো আমাদের দেশে নেই বললেই চলে। এসব ব্যবস্থা যদি আমরা নিশ্চিত করতে না পারি তবে আমাদের দেশে দুর্ঘটনা ঘটতেই থাকবে। বিশেষজ্ঞরা বলেন, আগুনের দুর্ঘটনা প্রতিরোধে দমকল বাহিনীর পাশাপাশি সাধারণ মানুষেরও নিয়মিত প্রশিক্ষণ প্রয়োজন। একইভাবে আগুন নিয়ন্ত্রণকারী সংস্থা ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্স কর্তৃপক্ষকে আধুনিক যন্ত্রপাতির মজুদ ও প্রশিক্ষিত জনবলে স্বাবলম্বী হতে হবে। আর সরকারি বিভিন্ন উদ্যোগের সঙ্গে বেসরকারি পর্যায় থেকেও অগ্নি নির্বাপণ ব্যবস্থা শক্তিশালীকরণে জোর দিতে হবে।
গেল বছর অগ্নিকা-ের ক্ষয়ক্ষতি কমিয়ে আনা ও অগ্নি দুর্ঘটনা রোধে ফায়ার সার্ভিসের একটি তদন্ত কমিটি ২৭টি সুপারিশ সম্বলিত এক প্রতিবেদন জমা দেয়। সুপারিশে বলা হয়, দুর্ঘটনা এড়াতে ন্যাশনাল বিল্ডিং কোড অনুযায়ী; বহুতল ও বাণিজ্যিক ভবন তৈরি, ভবন তৈরি শেষে ফায়ার সার্ভিসের অকুপেন্সি সার্টিফিকেট গ্রহণ বাধ্যতামূলক, স্থায়ী অগ্নিনির্বাপণ ব্যবস্থা নিয়মিত পরীক্ষা, প্রতিটি ভবনের নিজস্ব অগ্নিনির্বাপণ ও উদ্ধার কার্যক্রম পরিচালনার কনটিনজেন্সি প্ল্যান রাখা, ১৫তলা বা তার চেয়ে উঁচু ভবনের ছাদে হেলিপ্যাড স্থাপন, জনসচেতনায় নিয়মিত ইলেক্ট্রনিক মিডিয়ায় অনুষ্ঠান প্রচার, বড় দুর্ঘটনা মোকাবেলায় সরকারি উদ্যোগে স্থায়ীভাবে কেন্দ্রীয় কমান্ড সেন্টার স্থাপন করা দরকার। এ ছাড়াও ফায়ার সার্ভিসকে আধুনিক ও যুগোপযোগী করতে টিটিএল ও স্নোরকেল গাড়িসহ অন্যান্য গাড়ির পরিমাণ বাড়ানো, বিশেষ টিম সংরক্ষণ, লোকবল বৃদ্ধি ও রাজধানীর মিরপুরের ট্রেনিং কমপ্লেক্সকে ঢাকার বাইরে স্থানান্তর করে একাডেমিতে রূপান্তর করার সুপারিশ ছিল।
অগ্নিকা-ের ঘটনাগুলো সাধারণত শুষ্ক মৌসুমে বেশি ঘটে। এ সময় পানিরও সংকট থাকে। রাজধানীতে মূল সমস্যা পানির সংকট। প্রকৃত পানির উৎসগুলো এখানে নেই বললেই চলে। বড় কোনো পুকুর নেই, ঝিল নেই। এমনকি যেসব বাড়িতে অগ্নিকা-ের ঘটনা ঘটে সেসব বাড়িতেও পানির রিজার্ভের কোনো চেম্বার পাওয়া যায় না। আমরা এতোটাই অসচেতন যে সবকিছু ধ্বংস করে ফেলছি। জলাধারগুলো ভরাট করে ফেলা হয়েছে। নিয়ম না মেনে নির্মাণ করা হচ্ছে বহুতল ভবন ও মার্কেট। এসব বন্ধ করতে হবে। সড়কগুলো প্রশস্ত না করলে ফায়ার সার্ভিসের গাড়ি ঘটনাস্থলে পৌঁছাতে পারবে না। এসব বিষয়েও নজর দিতে হবে সরকারকে।  সর্বোপরি আমাদের সচেতনতাই পারে অগ্নিদুর্ঘটনা রোধ করতে। তাই আসুন, আমরা সবাই সতর্ক হই, সজাগ থাকি; দুর্ঘটনামুক্ত বাংলাদেশ গড়ি।
লেখক : শিক্ষার্থী, ডিপ্লোমা ইন অ্যারাবিক ল্যাঙ্গুয়েজ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
[email protected]



 

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

ঘটনাপ্রবাহ: মজুদ

১৮ অক্টোবর, ২০২০

আরও
আরও পড়ুন
গত​ ৭ দিনের সর্বাধিক পঠিত সংবাদ