Inqilab Logo

বৃহস্পতিবার, ১৮ এপ্রিল ২০২৪, ০৫ বৈশাখ ১৪৩১, ০৮ শাওয়াল ১৪৪৫ হিজরী

সঙ্কটে পড়বেন ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীরা

মোবাইল ব্যাংকিং লেনদেন সংকোচন

| প্রকাশের সময় : ১৮ জানুয়ারি, ২০১৭, ১২:০০ এএম

অর্থনৈতিক রিপোর্টার : আর্থিক লেনদেনের ক্ষেত্রে বর্তমানে অত্যন্ত জনপ্রিয় মোবাইল ব্যাংকিং। চালু হওয়ার পর মাত্র কয়েক বছরেই সবার কাছে ব্যাপক জনপ্রিয়তা পেয়েছে অর্থ লেনদেনের এই মাধ্যমটি। বাংলাদেশ ব্যাংকের সর্বশেষ হিসাব মতে, দেশে নিবন্ধিত মোবাইল ব্যাংকিং গ্রাহকসংখ্যা তিন কোটি ৯৬ লাখ। যদিও কিছু অসাধু ব্যক্তি এই মোবাইল ব্যাংকিং সেবার অপব্যবহার করছে। মোবাইল সেবাদানকারী প্রতিষ্ঠানগুলোর এজেন্ট হয়ে অবৈধভাবে বিভিন্ন অ্যাপস খুলে ব্যবসা করছে। এদিকে এসব অসাধু ব্যবসায়ীকে রুখতে সম্প্রতি কেন্দ্রীয় ব্যাংক মোবাইল ব্যাংকিং লেনদেনের ক্ষেত্রে সর্বোচ্চ সীমা কমিয়ে দেয়াসহ বেশ কিছু পরিবর্তন এনেছে। আর বাংলাদেশ ব্যাংকের নতুন এই নির্দেশনা কার্যকর হলে এই খাতনির্ভর যেসব ক্ষুদ্র ব্যবসা গড়ে উঠেছে তা ক্ষতিগ্রস্ত হবে বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা। তাদের মতে, এটা হলে গ্রাহকদের বিভিন্ন মোবাইল ফিন্যান্সিয়াল সার্ভিস ব্যবহারের সুযোগ সংকুচিত হবে, এজেন্টদের আয় কমে যাবে এবং সর্বোপরি সরকারের আর্থিক অন্তর্ভুক্তির এজেন্ডা বাস্তবায়ন বাধাগ্রস্ত হবে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের নতুন নির্দেশনা অনুযায়ী, একজন গ্রাহক তার মোবাইল অ্যাকাউন্টে দিনে দুইবারে সর্বোচ্চ ১৫ হাজার টাকা ক্যাশ-ইন করতে পারবেন এবং দিনে তিন বারে সর্বোচ্চ ১০ হাজার টাকা ক্যাশ-আউট করতে পারবেন। পূর্বে একজন গ্রাহক দিনে ৫ বার ক্যাশ-ইন এবং তিনবার ক্যাশ-আউট করতে পারতেন এবং উভয় ক্ষেত্রে সর্বোচ্চ সীমা ছিল ২৫ হাজার টাকা। নতুন নির্দেশনা অনুযায়ী একজন গ্রাহক তার মোবাইল অ্যাকাউন্টে মাসে সর্বোচ্চ এক লাখ টাকা পর্যন্ত ক্যাশ-ইন করতে পারবেন যা পূর্বে ছিল দেড় লাখ টাকা। একইভাবে একজন গ্রাহক মাসে সর্বোচ্চ ১০ বারে ৫০ হাজার টাকা ক্যাশ- আউট করতে পারবেন, পূর্বে যার পরিমাণ ছিল দেড় লাখ টাকা। নতুন নির্দেশনা অনুসারে একজন গ্রাহক ক্যাশ-ইন করার ক্ষেত্রে ২৪ ঘণ্টার মধ্যে ৫ হাজার টাকার বেশি উত্তোলন করতে পারবেন না এবং ৫ হাজার টাকা বা তদূর্ধ্ব ক্যাশ-আউট করার ক্ষেত্রে অবশ্যই এজেন্টকে জাতীয় পরিচয়পত্রের মূল বা ফটোকপি প্রদর্শন করতে হবে।
টাঙ্গাইলের কালিহাতি থানা সদরে কাপড়ের দোকান রয়েছে ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী জুলহাস আলমের। প্রতি মাসেই তিনি ঢাকার ইসলামপুরে আসেন পাইকারি দরে কাপড় কিনতে। আগে নগদ টাকা নিয়ে আসতেন। কিন্তু একবার অজ্ঞান পার্টির খপ্পরে পড়ে পুরো টাকাটাই হারান। এরপর থেকে তিনি তার দুইটি মোবাইল ব্যাংকিং অ্যাকাউন্টে টাকা ক্যাশ-ইন করে আনেন এবং ঢাকায় এসে ক্যাশ-আউট করে কাপড় কিনে নেন।
জুলহাস আলম বলেন, ‘প্রতি মাসে আমি প্রায় ৪০-৫০ হাজার টাকার কাপড় কিনি এবং পুরো টাকাটাই আমার দুইটি  মোবাইল ব্যাংকিং অ্যাকাউন্টে নিয়ে আসি। নতুন নিয়ম কার্যকর হলে আমার পক্ষে ৩০ হাজার টাকার বেশি ক্যাশ-ইন করা সম্ভব হবে না। আবার ক্যাশ-ইন করলেও ২৪ ঘণ্টার মধ্যে ৫ হাজার টাকার বেশি ক্যাশ-আউট করা সম্ভব হবে না। ফলে আমার পক্ষে এই সেবা ব্যবহার করা সম্ভব হবে না।’
একটি জাতীয় পর্যায়ের এনজিওতে কাজ করেন হাসান শাহরিয়ার। কাজের অংশ হিসেবে তাকে মাসের প্রায় ১৫ দিনই দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চল ঘুরে বেড়াতে হয়। ভ্রমণ খরচ মেটাতে তিনি সাধারণত ২০ থেকে ২৫ হাজার টাকা তার মোবাইল অ্যাকাউন্টে ক্যাশ-ইন করে নিতেন। তিনি বলেন, লেনদেন সীমা কমে যাওয়ায় তাকে এখন মোবাইল অ্যাকাউন্টে টাকা বহন করার পাশাপাশি একটি বড় পরিমাণ নগদ টাকা বহন করতে হবে, যা ঝুঁকিপূর্ণ।  
ফারজানা আশরাফি অনলাইনে মেয়েদের প্রসাধনী সামগ্রীর ব্যবসা করেন। ফেসবুকে তার একটি ব্যবসা পেজ রয়েছে। বেশিরভাগ কাস্টমার তাকে পেমেন্ট করেন মোবাইল ব্যাংকিংয়ের মাধ্যমে।
তিনি মনে করেন, বাংলাদেশ ব্যাংকের নতুন নির্দেশনা তার ব্যবসায় প্রভাব ফেলবে। ‘আগে আমি মাসে দেড় লাখ টাকা জমা ও তুলতে পারতাম। কিন্তু নতুন নিয়মের কারণে আমি এক লাখ টাকার বেশি জমা রাখতে পারব না এবং ৫০ হাজারের বেশি তুলতে পারব না। এতে আমার ব্যবসা কমে যাবে’, তিনি বলেন।  
খাত সংশ্লিষ্টরা মনে করেন, মোবাইল ফিন্যান্সিয়াল সার্ভিস চালু হওয়ার ফলে ই-কমার্সসহ নানা ধরনের ব্যবসা বেড়েছে। অনেক ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র ব্যবসা প্রতিষ্ঠান যেমন মোবাইল ব্যাংকিংয়ের মাধ্যমে তাদের ব্যবসায়িক লেনদেন সম্পন্ন করছে তেমনি অনেক বড় বড় প্রতিষ্ঠান তাদের সরবরাহকারীদের পাওনা পরিশোধ থেকে শুরু করে কর্মীদের বেতনও দিচ্ছে মোবাইল ফিন্যান্সিয়াল সার্ভিস ব্যবহার করে। যানবাহনের টিকিট ক্রয়, হাসপাতালের বিল পরিশোধ, মোবাইলের এয়ারটাইম কেনাসহ অনেক কিছুই করা যাচ্ছে মোবাইল ব্যাংকিংকে কেন্দ্র করে। ফলে মোবাইল ফিন্যান্সিয়াল সার্ভিসকে কেন্দ্র করে এক ধরনের ডিজিটাল অর্থনৈতিক ইকো-সিস্টেম গড়ে উঠেছে। তাই এই খাতের বিকাশে কোনো ধরনের বাধা সষ্টি হলে তা এই ইকো-সিস্টেমকে ক্ষতিগ্রস্ত করবে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের এই নুতন নীতিমালা কার্যকর হলে এজেন্টদের আয়ও কমে যাবে বলে মনে করেন মোবাইল ব্যাংকিং এজেন্টরা। রাজধানীর মগবাজারে বিকাশ এজেন্ট সুলাইমান বলেন, তার মাসিক আয় ৬ থেকে ৭ হাজার টাকার মতো। কিন্তু যদি নতুন লেনদেন সীমা কার্যকর হয় তাহলে তার আয় প্রায় ৪০ ভাগের মতো কমে যাবে।
‘আমাদের কমিশন নির্ভর করে গ্রাহকদের ক্যাশ-ইন ও ক্যাশ- আউটের পরিমাণের ওপর। কিন্তু নুতন নীতিমালায় দৈনিক এবং মাসিক ভিত্তিতে ক্যাশ-ইন এবং ক্যাশ-আউটের সর্বোচ্চ সীমা কমিয়ে  দেয়ার ফলে আমার আয় অনেক কমে যাবে। এই ব্যবসা আমার জন্য আর লাভজনক হবে না।’    
এই খাতে কর্মরত ব্যক্তিরা বলেন, মোবাইল ব্যাংকিং সেবার অপব্যবহার রুখতে ৫ হাজার টাকার বেশি টাকা উত্তোলনের ক্ষেত্রে গ্রাহকের জাতীয় পরিচয়পত্র বা তার ফটোকপি প্রদর্শনের যে বিধান করা হয়েছে তা কোনো কার্যকর সমাধান নয়। এটা বিষয়টিকে আরো জটিল করবে এবং গ্রাহকদের হয়রানি বাড়াবে। এছাড়া এজেন্টদের পক্ষে কোনোভাবেই কেউ ভুয়া আইডি ব্যবহার করে টাকা তুলে নিয়ে যাচ্ছে কি না তা শনাক্ত করা সম্ভব হবে না।   
মোবাইল ব্যাংকিং কার্যক্রম পরিচালনাকরাী প্রতিষ্ঠান বিকাশের মুখপাত্র জাহেদুল ইসলাম বলেন,  লেনদেনের সীমা পুনঃনির্ধারণ করে বাংলাদেশ ব্যাংকের এমএফএস প্রতিষ্ঠানগুলোকে দেয়া নতুন নির্দেশনা গ্রাহকদের ওপর কী ধরনের প্রভাব ফেলতে পারে তা নিয়ে আমরা বিশ্লেষণ করছি এবং গ্রাহক সার্থ অক্ষুণœ রেখে কিভাবে নির্দেশনাটি প্রতিপালন করা যায় তা নিয়ে বাংলাদেশ ব্যাংকের সাথে আলোচনা চলছে।



 

Show all comments
  • MD mostafig ৪ ফেব্রুয়ারি, ২০১৭, ৯:৫৯ এএম says : 0
    এসব নিয়মের কারনে গ্রাহক মোবাইল ব্যাংকিং থেকে ফিরে যেতে শুরু করেছে। আমি একজন ক্ষুদ্রব্যাসায়ী ইতি মধ্যে আমি অনেক ঝামেলায় পড়েগেছি। মণে হচ্ছে এই ব্যাবসা আর করা যাবেনা আগের নিয়মটা মোটামুটি চলার মত ছিল
    Total Reply(0) Reply

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

আরও পড়ুন
এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ
গত​ ৭ দিনের সর্বাধিক পঠিত সংবাদ