Inqilab Logo

বুধবার, ১৭ এপ্রিল ২০২৪, ০৪ বৈশাখ ১৪৩১, ০৭ শাওয়াল ১৪৪৫ হিজরী

জিজ্ঞাসার জবাব

| প্রকাশের সময় : ২৬ জানুয়ারি, ২০১৭, ১২:০০ এএম

১। মোহাম্মাদ ফাত্হুল বারী ফাইয়্যাজ, রাজামেহার মুন্শী
মঞ্জিল, কুমিল্লা।
জিজ্ঞাসা : জাকাতের ফজিলত ও মাসায়িল বর্ণনা করুন?
জবাব : নিসাব পরিমাণ মালের মালিকের ওপর জাকাত ফরজ। জাকাত ইসলামের অন্যতম একটি স্তম্ভ। নামাজ-রোজার মতোই ফরজ। জাকাত কারো প্রতি করুণা প্রদর্শন নয়; বরং গরিব-দুখির ন্যায়সঙ্গত অধিকার। শরীয়ত নির্ধারতি নিয়মে যথাযথভাবে জাকাত আদায় করা প্রত্যেক সামর্থ্যবান ব্যক্তির ওপর ফরজ দায়িত্ব। আভিধানিক অর্থে জাকাতের অর্থ হলো, বৃদ্ধি করা, পবিত্রতা, বিশুদ্ধতা ইত্যাদি। জাকাত প্রদানের মাধমে সম্পদ পবিত্র ও পরিশুদ্ধ হয় এবং মালের মধ্যে বরকত বৃদ্ধি পায়। শরয়ী পরিভাষায়, জীবন যাত্রার অপরিহার্য প্রয়োজন মিটানোর পর নির্দিষ্ট পরিমাণ সম্পদ পূর্ণ এক বছর কাল সঞ্চিত থাকলে, শরীয়তের নির্ধারিত সম্পদের একাংশ শরীয়ত নির্ধারিত খাতে কোনো প্রকার বিনিময় ছাড়া মালিকানা হস্তান্তর করাকে জাকাত বলে। ইসলামে জাকাতের গুরুত্ব অপরিসীম। কোরআন ও হাদিসে জাকাত প্রদানের জন্য তাগিদ দেওয়া হয়েছে। পবিত্র কোরআনুল কারীমে আল্লাহতায়ালা এরশাদ করেন, ‘তোমরা নামাজ কায়েম কর, জাকাত প্রদান কর এবং নামাজে অবনত হও তাদের সাথে যারা অবনত হয়’। (সূরা বাকারা : ৪৩) আল্লাহপাক ইরশাদ করেন, ‘তাদের ধনমালে রয়েছে সুনির্দিষ্ট অধিকার। প্রার্থী ও বঞ্চিত মানুষের জন্য’। (সূরা মাআরিজ : ২৪) আল্লাহতায়ালা আরো ইরশাদ করেন, ‘তোমরা নামাজ কায়েম কর, জাকাত প্রদান কর এবং রাসূলের আনুগত্য কর, যাতে তোমরা অনুগ্রহ প্রাপ্ত হও’। (সূরা নূর : ৫৬) আল্লাহ রাব্বুল আলামিন আরো ইরশাদ করেছেন, ‘আর যারা সোনা ও রুপা সঞ্চিত করে রাখে এবং তা আল্লাহর পথে ব্যয় করে না, তাদেরকে যন্ত্রণাদায়ক শাস্তির সুসংবাদ প্রদান করুন। সেদিন ঐসব (সোনা-রুপা) দোযখের আগুনে উত্তপ্ত করা হবে এবং তদ্বারা তাদের ললাটে, পার্শ্বদেশ এবং তাদের পৃষ্ঠদেশে দাগ দেওয়া হবে। এটা তোমরা নিজেদের জন্য যা সঞ্চয় করেছিলে তার প্রতিফল। সুতরাং যা তোমরা সঞ্চিত করেছিলে তার স্বাদ গ্রহণ কর’। (-সূরা তাওবাহ : ৩৪-৩৫) অনুরূপভাবে আল্লাহপাক আরো ইরশাদ করেন, ‘তোমাদেরকে কিসে জাহান্নামে নিয়ে এসেছে? তারা বলবে আমরা নামাজ পড়তাম না এবং অভাবগ্রস্তকে আহার্য (জাকাত) দিতাম না’। (-সূরা মুদাসসির : ৪২-৪৪)
হযরত আবু হুরায়রা (রা.) হতে বর্ণিত, তিনি বলেন রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, ‘যেসব স্বর্ণ ও রৌপ্যের মালিক তা হতে তার হক (জাকাত) আদায় করে না, যখন কিয়ামতের দিন আসলে নিশ্চয়ই তার জন্য অনেকগুলো আগুনের পাত তৈরি করা হবে এবং সেগুলোকে জাহান্নামের আগুনে গরম করা হবে। আর তা দ্বারা তার পাঁজরে, ললাটে এবং পিঠে দাগ দেয়া হবে। যখনই পৃথক করা হবে তখনই পুনরায় তা শুরু করা হবে। তার এ শাস্তি অব্যাহত থাকবে সেদিন পর্যন্ত যার পরিমাণ হবে পঞ্চাশ হাজার বছরের সমান। যতক্ষণ না বান্দাদের সকলের বিচার ফয়সালা শেষ করা হবে এবং প্রত্যেকে নিজ নিজ পথ ধরবে, হয় বেহেশতের দিকে না হয় দোজখের দিকে’। (মুসলিম শরীফ, হাদিস নং-১৬৮১)
হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে আব্বাস (রা.) হতে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূল (সা.) হযরত মুআজ (রা.)-কে গভর্নর হিসেবে ইয়েমেনে প্রেরণ করলেন। এ সময় রাসূল (সা.) তাকে বললেন, তুমি এমন এক সম্প্রদায়ের নিকট যাচ্ছ যারা আহলে কিতাব। প্রথমত তুমি তাদেরকে এ কথার সাক্ষ্য দিতে আহ্বান করবে যে, আল্লাহ ব্যতীত কোন ইলাহ তথা উপাস্য নেই এবং মুহাম্মদ (সা.) আল্লাহর রাসূল। অতঃপর তারা যদি এ কথার আনুগত্য করে তবে তাদেরকে জানিয়ে দেবে, আল্লাহতায়ালা দিবারাতে তাদের ওপর পাঁচওয়াক্ত নামাজ ফরজ করে দিয়েছেন। তারা যদি এ কথার আনুগত্য করে তবে তাদেরকে জানিয়ে দেবে, আল্লাহতায়ালা তাদের ওপর জাকাত ফরজ করে দিয়েছেন, যা তাদের ধনীদের নিকট থেকে গ্রহণ করা হবে এবং দরিদ্রদের মাঝে বণ্টন করা হবে’। (-বুখারি ও মুসলিম : ১৬৮০)
হজরত আবু হুরায়রা (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসূল (সা.) ইরশাদ করেন, যাকে আল্লাহতায়ালা মালসম্পদ দান করেছেন, আর সে তার জাকাত আদায় করেনি কিয়ামতের দিন তার মালকে তার জন্যে একটি টাকপড়া সাপস্বরূপ করা হবে, যার চক্ষুর ওপর দুটি কালো দাগ থাকবে। ওই সাপকে কিয়ামতের দিন তার গলার বেড়িস্বরূপ করা হবে। সাপটি আপন মুখের দুই দিক দ্বারা তাকে দংশন করতে থাকবে এবং বলবে আমি তোমার মাল, আমি তোমার সংরক্ষিত অর্থ’। (মিশকাত)
হজরত আব্দুল্লাহ ইবনে মাসউদ (রা.) থেকে বর্ণিত রাসূলুল্লাহ (সা.) এরশাদ করেন, ‘যে ব্যক্তি তার সম্পদের জাকাত আদায় করবে না, আল্লাহতায়ালা কিয়ামতের দিন তার গলায় একটি বিশাল সাপ ঝুলিয়ে দিবেন’। (তিরমিজি)
ইসলামের জাকাত বিধান ধনী-গরিবের মাঝে বৈষম্য দূরীকরণে ন্যায় ও ইনসাফপূর্ণ বণ্টন ব্যবস্থা। জাকাত আদায়ে ধনী-গরিবের মাঝে ভালোবাসা তৈরি হয়। অর্থনৈতিক ভারসাম্য সৃষ্টি হয়। সমাজ থেকে দারিদ্র্য দূর হয়। (চলবে)
কোরআনুল কারীমে আল্লাহ বলেন, ‘যারা জাকাত দেয় না তারা হলো সেসব লোক, যারা আখিরাতের প্রতিও অবিশ্বাসী’ (সূরা হামীম আসসাজদা : ৭) সূরা বাকারার ১১০ নাম্বার আয়াতে আল্লাহপাক আরও এরশাদ করেন-‘তোমরা নামাজ কায়েম করো এবং জাকাত দাও’। মিশকাত শরিফে উল্লেখ রয়েছে, হজরত রাসূলুল্লাহ (সা.) এরশাদ করেন- ‘ইসলামের মূল ভিত্তি পাঁচটি। এই সাক্ষ্য দেয়া যে, আল্লাহ ব্যতীত কোনো ইলাহ নেই এবং মুহাম্মদ (সা.) আল্লাহর বান্দা ও রাসূল, নামাজ কায়েম করা, জাকাত আদায় করা, হজ সম্পন্ন করা এবং রমজানের রোজা রাখা’। ঈমান আনা ও নামাজ আদায়ের পর জাকাত প্রদান করা ঈমানের দাবি। ইসলামী শরীয়তে সাড়ে সাত তোলা স্বর্ণ বা সাড়ে বায়ান্ন তোলা রৌপ্য বা যে কোন একটির সমমূল্যের সম্পদ এক বছর কারো নিকট আবর্তিত হলে শতকরা ২.৫০% সম্পদ আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য কোরআনে বর্ণিত আট প্রকার খাতে ব্যয় করাকেই জাকাত বলা হয়। জাকাত ফরজ হওয়ার জন্য শর্ত ছয়টি : ১. মুসলমান হওয়া। ২. জাকাত প্রদানকারী ব্যক্তি সুস্থ মস্তিস্ক সম্পন্ন হওয়া। ৩. ঋণমুক্ত হওয়া। ৪. নেসাব পরিমাণ (সাড়ে সাত তোলা স্বর্ণ বা সাড়ে বায়ান্ন তোলা রূপা বা সমপরিমাণ) সম্পদের মালিক হওয়া। ৫. নেসাব পরিমাণ সম্পদ পূর্ণ একবছর অতিক্রান্ত হওয়া। ৬. জাকাত প্রদানকারী ব্যক্তি প্রাপ্ত বয়স্ক হওয়া।
জাকাতের ক্ষেত্র ও নিসাব : জাকাতের ক্ষেত্র খুবই ব্যাপক। প্রায় সকল প্রকার ধন সম্পদের ওপরই জাকাত ধার্য করা হয়েছে। নগদ অর্থ, সোনা-রুপা, কৃষিজ উৎপাদন, ব্যবসায়ের পণ্য, গৃহপালিত পশুসহ প্রায় সব কিছুই জাকাতের আওতায় আসে। জাকাতের হার শরীয়তের বিধান দ্বারা নির্দিষ্ট। একে মানুষের ইচ্ছাধীন করে দেয়া হয়নি। জাকাতক্ষেত্র অনুযায়ী জাকাত প্রদানের পদ্ধতিও ভিন্ন ভিন্ন। (জাকাত কোন ক্ষেত্রে ২.৫ ভাগ। কোনো ক্ষেত্রে ৫ ভাগ, কোন ক্ষেত্রে ১০ ভাগ)। ফকিহগণের সর্বসম্মতিক্রমে স্বর্ণে জাকাতের নিসাব ২০ মিসকাল বা সাড়ে সাত ভরি, তথা ৮৭.৪৫ গ্রাম। এর কম হলে জাকাত দিতে হবে না। কারো নিকট ২০ মিসকাল পরিমাণ স্বর্ণ যদি একবছর অতিক্রম করে তবে তাতে অর্ধ মিসকাল স্বর্ণ জাকাত ওয়াজিব হবে। (নূরুল আনওয়ার, শরহে বিকায়া) ৫২ তোলা রুপা অথবা ৭.৫০ তোলা সোনা অথবা সমপরিমাণ অর্থ। শর্ত হলো নেসাব পরিমাণ সম্পদ একবছর অতিক্রান্ত হওয়া। উপরিউক্ত নেসাব পরিমাণ সম্পদ যার আছে তার ওপর জাকাত ফরজ। তবে গরু, ছাগল, ভেড়া ও দুম্বার ক্ষেত্রে জাকাত আদায়পদ্ধতি ভিন্ন। নগদ অর্থ, সোনা-রুপা, ব্যবসায়িক পণ্যসামগ্রী ছাড়াও মহিলাদের অলঙ্কারের জাকাত আদায় করা ওয়াজিব। নাবালেগের সম্পদের জাকাত অভিভাবক আদায় করবেন। ব্যবসায়িক পণ্যে জাকাত আদায়ের ক্ষেত্রে দোকান বা গুদামে মজুতকৃত সব পণ্যের মূল্যমান হিসাব করে জাকাত আদায় করতে হবে। শিল্প-কারখানায় প্রস্তুতকৃত পণ্যসামগ্রীর ওপরও জাকাত আদায় ওয়াজিব। অবশ্য কারখানার ভূমি, বিল্ডিং, মেশিনারি, গাড়ি ইত্যাদির ওপর জাকাত ওয়াজিব নয়। আনুমানিক থোক বরাদ্দের মতো আন্দাজে একটি পরিমাণ নির্ধারণ করে দান করলে জাকাত আদায় হবে না। সম্পদেও হিসাব করে পরিমাণমতো জাকাত আদায় করতে হবে।
জাকাতের হকদার : কাছের আত্মীয়স্বজন যারা আর্থিকভাবে দুর্বল, তারা জাকাতের বেশি হকদার। যারা জাকাত পাওয়ার উপযুক্ত কোরআনের আলোকে তারা হচ্ছে নিঃস্ব, অভাবী, জাকাত সংগ্রহে নিযুক্ত কর্মী, নও মুসলিম, ঋণী, মুক্তিপ্রত্যাশী দাস-দাসী, মুজাহিদ ও মুসাফির। আল্লাহতায়ালা কোরআনে সুস্পষ্ট ভাষায় জাকাতের হকদ্বার সর্ম্পকে বলে দিয়েছেন।তিনি বলেন, ‘নিশ্চই সদকাহ হচ্ছে, ফকীর ও মিসকীনদের জন্য এবং এতে নিয়োজিত কর্মচারীদের জন্য, আর যাদের অন্তর আকৃষ্ট করতে হয় তাদের জন্য, দাস আযাদ করার ক্ষেত্রে, ঋণগ্রস্তদের মধ্যে, আল্লাহর রাস্তায় এবং মুসাফিরদের মধ্যে। এটি আল্লাহর পক্ষ থেকে নির্ধারিত, আর আল্লাহ মহাজ্ঞানী, প্রজ্ঞাময়’। (সূরা তাওবা : ৬০)
জাকাতের খাত : জাকাতের খাত আটটি : ১. ফকির। ২. মিসকিন। ৩. যাকাতের কাজে নিযুক্ত ব্যক্তি ৪. মুআল্লাফাতুল কুলুব। ৫. দাসমুক্তি ৬. ফি সাবিলিল্লাহ। ৭. ঋণগ্রস্ত। ৮. মুসাফির।
জাকাতের টাকা একজনকে অথবা খুচরা করে অনেকজনকে দেয়া যাবে। তবে ১০০ জনকে খুচরা টাকা, শাড়ি-লুঙ্গি না দিয়ে স্বাবলম্বী হওয়ার মতো করে ব্যবস্থা করে দিতে পারলে (যেমন একটি দুধের গাভী কিনে দিলেন, দোকান করে দিলেন, অন্য কোনো ব্যবসার পুঁজি করে দিলেন) তা দারিদ্র্য বিমোচনে প্রত্যক্ষ ভূমিকা রাখতে পারে। পিতা-মাতা-দাদা-নানা-স্ত্রী-সন্তানদের জাকাত দেয়া যায় না। মসজিদ ও মাদ্রাসা ভবন নির্মাণের জন্য জাকাত দেয়া যায় না। তবে গরিব মাদ্রাসার ছাত্রদের জাকাত দেয়া যাবে। জাকাত রমজান মাসেই দিতে হবে এমন কোনো কথা নেই। সুবিধামতো অর্থবছর নির্ধারণ করে নিয়ে প্রতি বছর সেই হিসাব মোতাবেক জাকাত আদায় করা যায়। তবে রমজানে দানের সওয়াব যেহেতু বেশি, তাই বেশিরভাগ মুসলমান রমজানে জাকাত আদায় করে থাকেন। জাকাত প্রদানের আগে প্রত্যেকের নিয়তকে বিশুদ্ধ করে নেয়া জরুরি। নিয়ত শুদ্ধ না থাকলে জাকাত আদায় কবুল হবে না। মহান আল্লাহতায়ালা আমাদেরকে জাকাতের গুরুত্ব অনুধাবন করে যথযথভাবে জাকাত আদায়ের তাওফিক দান করুন। আমিন।
উত্তর দিচ্ছেন : এহসান বিনমুজাহির



 

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

আরও পড়ুন
এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ
গত​ ৭ দিনের সর্বাধিক পঠিত সংবাদ