Inqilab Logo

শুক্রবার, ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১, ১৬ শাওয়াল ১৪৪৫ হিজরী

সিম ক্লোনিংয়ের মাধ্যমে অপরাধ বৃদ্ধি উদ্বেগজনক

| প্রকাশের সময় : ৪ ফেব্রুয়ারি, ২০১৭, ১২:০০ এএম

মোবাইল ফোনের মাধ্যমে সংঘটিত অপরাধমূলক কার্যক্রম প্রতিরোধে গত বছর সব শ্রেণীর গ্রাহকের নতুন করে ফিঙ্গার প্রিন্ট নিয়ে বিটিআরসি মোবাইল নম্বর পুনঃনিবন্ধন কার্যক্রম পরিচালনা করে। সরকারের পক্ষ থেকে তখন বলা হয়েছিল মোবাইল ফোনে জঙ্গী কার্যক্রমসহ অপরাধ ঠেকাতে পুনঃনিবন্ধন বাধ্যতামূলকভাবে করতে হবে। ফিঙ্গারপ্রিন্ট নেয়া নিয়ে পক্ষ-বিপক্ষে ব্যাপক তর্ক-বিতর্ক হলেও শেষ পর্যন্ত সকলকেই তা করতে হয়। যারা যতবার নতুন সিম নেবে তাদেরকে ততবারই ফিঙ্গারপ্রিন্ট দিতে হবে। এখন দেখা যাচ্ছে, এ পদ্ধতি গ্রহণ করেও অপরাধমূলক কর্মকা- ঠেকানো যাচ্ছে না। নতুন নতুন অ্যাপস ব্যবহার করে জঙ্গী ও প্রতারক চক্র তাদের কার্যক্রম পরিচালনা করে আসছে। বিষয়টি এমন হয়ে দাঁড়িয়েছে, গৃহস্থ চোর ঠেকাতে যতই নিরাপত্তা ব্যবস্থা নিক না কেন, চোরও নিরাপত্তা ব্যবস্থা ভাঙতে নতুন নতুন কৌশল অবলম্বন করে চলেছে। সফলও হচ্ছে। অর্থাৎ গৃহস্থের চেয়ে  চোর এক ধাপ এগিয়ে থাকছে। মোবাইল ফোনের সিম নকল বা ক্লোনিংয়ের বিষয়টি নতুন নয়। অপরাধীদের এ কৌশল ধরা পড়লেও তারা নতুন কৌশল উদ্ভাবন করে ফেলেছে। এবার তারা স্পুফিং নামে নতুন এক কৌশল নিয়ে হাজির হয়েছে এবং এর মাধ্যমে প্রতারণা করে সফলও হয়েছে। এ পদ্ধতিতে প্রতারণা করে ইতোমধ্যে তারা সরকারি আদেশ-নির্দেশ দেয়া থেকে শুরু করে অর্থকড়িও আদায় করে নিয়েছে। এমনকি যে বিটিআরসি সিমের নিরাপত্তামূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করেছে, সেই প্রতিষ্ঠানটিও এ প্রতারক চক্রের হাত থেকে রেহাই পায়নি। গত বুধবার স্পুফিং পদ্ধতিতে প্রতারণাকারী চক্রের ৯ সদস্যকে উত্তরা থেকে গ্রেফতার করেছে র‌্যাব। তাদের কাছ থেকেই নতুন এই প্রতারণা পদ্ধতি সম্পর্কে জানা যায়।
স্পুফিং পদ্ধতিটি এমন যে ইয়েস কার্ড নামে একটি অ্যাপসের মাধ্যমে প্রতারকচক্র আরেকজনের মোবাইল নম্বর হুবহু নকল করে ফোন করতে পারে। এর মাধ্যমে প্রতারকচক্রের কম্পিউটার ও মোবাইল ফোনের আইডি গোপন রাখা যায়। কেউ ধরতে পারে না। এ পদ্ধতির মাধ্যমে ইতোমধ্যে প্রশাসনের গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিদের ফোন নম্বর নকল করে আদেশ-নির্দেশ এমনকি অর্থ আদায়ের ঘটনাও ঘটেছে। তারা মৎস্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালক, জেলা প্রশাসক, উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা এবং বিভিন্ন সরকারি দপ্তরের কর্মকর্তাদের মোবাইল ফোন ব্যবহার করে লাখ লাখ টাকা হাতিয়ে নিয়েছে। গত দুই বছরে মন্ত্রী, এমপি, সচিব, আইজিপি এমনকি প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের কর্মকর্তাসহ গুরুত্বপূর্ণ কর্মকর্তাদের মোবাইল ফোনের সিম ক্লোন করে অর্থাৎ হুবহু একই নম্বর থেকে ফোন করে বিভিন্ন জায়গায় চাঁদাবাজি, টেন্ডারবাজি, বদলিসহ বিভিন্ন অপরাধ সংঘটিত হয়েছে। রাষ্ট্রীয় গুরুত্বপূর্ণ বিভিন্ন ব্যক্তির মোবাইল ফোন নম্বর নকল করে তদবিরের ঘটনা ঘটেছে। সিম ক্লোনিংয়ের মাধ্যমে ২০১৫ সালে বাণিজ্যমন্ত্রী তোফায়েল আহমেদের নাম ব্যবহার করে তাঁর গ্রামীণ ফোনে একটি তদবির করা হয়। বিষয়টি অবহিত হয়ে তিনি গ্রামীণ ফোনে অভিযোগ করেন। শ্রম প্রতিমন্ত্রী মুজিবুল হক চুন্নু ও তাঁর এপিএসের মোবাইল ফোন নকল করে বিভিন্ন তদবির করা হয়। প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের এক কর্মকর্তাও এ রকম প্রতারণার শিকার হন। একই বছর আইজিপির ফোন নম্বর নকল করে ডিএমপির এক ওসিকে ফোন করে এক আসামী ছাড়িয়ে নেয়া হয়। প্রতারক চক্র মাসকিং সফটওয়্যারসহ বিভিন্ন নামের সফটওয়্যার ব্যবহার করে সিম ক্লোনিংয়ের মাধ্যমে এ ধরনের প্রতারণা করে। এ পদ্ধতি ধরা পড়ে যাওয়ায় নতুন সংস্করণ হিসেবে স্পুফিং পদ্ধতি ব্যবহার করা শুরু করে। সবচেয়ে বড় কথা যে বিটিআরসি মোবাইল ফোনের সিম নিরাপত্তা বিধানে পদক্ষেপ নিয়েছে, সেই বিটিআরসির মধ্যেও প্রতারক চক্র ঢুকে পড়েছে। বিটিআরসির নিজস্ব ল্যান্ডফোন এবং মোবাইল ফোন নম্বর নকল করে প্রতারকচক্র জেনে নিচ্ছে গ্রাহকের সিম নিবন্ধনের তথ্য, মোবাইল ফোনের মাধ্যমে আর্থিক লেনদেনের পিন নম্বর এবং ব্যক্তিগত তথ্য। যদিও বিটিআরসির মাধ্যমে এভাবে ফোন বা এসএমএসের মাধ্যমে গ্রাহকের ব্যক্তিগত তথ্য বা গোপন পিন নম্বর চাওয়া হয় না। প্রতারক চক্র এই অবৈধ প্রক্রিয়ায় অ্যাপস ব্যবহারের মাধ্যমে অন্যদেরও সাহায়তা করত। প্রতি মিনিট ১ টাকা ৭০ পয়সা রেটে কথা বলার সুযোগ করে দিত। শুধু তাই নয়, চক্রটি তাদের ফেসবুক অ্যাকাউন্টে বিভিন্ন প্রতারণামূলক কর্মকা- শেখানোর জন্য বিজ্ঞাপনও দিত। প্রতারক চক্রের এ ধরনের প্রতারণা বায়োমেট্রিক পদ্ধতিতে সিম রেজিস্ট্রেশনের কুফল কিনা, তা নিয়ে এখন প্রশ্ন উঠেছে। তবে ডাক ও টেলিযোগাযোগ প্রতিমন্ত্রী তারানা হালিম বলেছেন, বায়োমেট্রিক পদ্ধতিতে সিম রেজিস্ট্রেশনের ফলে চাঁদাবাজি, অপহরণসহ মোবাইল ফোনের মাধ্যমে সংঘটিত অপরাধ কমেছে। এ পদ্ধতিতে এখন আর কোনো অপরাধ সংঘটিত হচ্ছে না। তাঁর এ কথা যে পুরোপুরি সঠিক নয়, তা সিম ক্লোনিং বা স্পুফিং পদ্ধতিতে প্রতারণার বিষয়টিই প্রমাণ করছে। কারণ, প্রতারক চক্র যেসব বড় বড় কর্মকর্তার মোবাইল ফোন ক্লোন বা স্পুফিং করে প্রতারণা করছে, তাদের সিমও নিশ্চয়ই বায়োমেট্রিক পদ্ধতিতে রেজিস্ট্রেশন করা। এর মাধ্যমে চক্রটি যে গ্রাহকদের ব্যক্তিগত তথ্যাদি চুরি করতে পারছে তেমনি সরকারি গুরুত্বপূর্ণ কর্মকর্তার ব্যক্তিগত তথ্যাদিও চুরি করতে সক্ষম হচ্ছে। এতে জাতীয় নিরাপত্তা বিঘিœত এবং হুমকিতে পড়লেও অবাক হওয়ার কিছু থাকবে না।
বলার অপেক্ষা রাখে না, প্রযুক্তিগত অপরাধ প্রযুক্তির উন্নয়নের সাথে সাথে বদলায়। প্রশ্ন হচ্ছে, আমাদের প্রশাসন যন্ত্র ধাবমান এ প্রযুক্তির সাথে কতটা তাল মেলাতে পারছে? দেখা যাচ্ছে, অপরাধ সংঘটিত এবং মানুষ ক্ষতিগ্রস্ত হয়ে যাওয়ার পর বিষয়টি ধরা পড়ছে। এতে প্রতারক চক্র শনাক্ত এবং গ্রেফতার হচ্ছে ঠিকই, তবে তাদের ধারাবাহিকতায় নতুন প্রতারক চক্র নতুন কোনো পদ্ধতি নিয়ে হাজির হচ্ছে। প্রতারক চক্র যদি প্রযুক্তির সাথে তাল মেলাতে পারে, তবে আমাদের সংশ্লিষ্ট প্রশাসনকে তো আরও অধিক অগ্রগামী থাকার কথা। বিশ্বে কি ধরনের নতুন প্রযুক্তি এবং অ্যাপসের আধুনিক ভার্সন চলছে, সে সম্পর্কে প্রশাসনের খোঁজ খবর নেয়া ও আপডেট থাকা উচিত। কারণ, প্রশাসনের কাছে রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ পর্যায় থেকে শুরু করে গুরুত্বপূর্ণ এবং সাধারণ মানুষের সকল তথ্যাদিই সংরক্ষিত রয়েছে। এসব তথ্য আমানত হিসেবে যাতে নির্বিঘেœ সংরক্ষণ করা যায়, এ ব্যবস্থা করা প্রশাসনেরই দায়িত্ব এবং সংরক্ষণের জন্য সর্বাধুনিক প্রক্রিয়া অবলম্বন করা অত্যাবশ্যক। যদি তা না করা হয়, তবে দেশী প্রতারক চক্রের চেয়ে অত্যাধুনিক প্রযুক্তি নির্ভর আন্তর্জাতিক প্রতারক চক্র আরও ভয়ংকর হয়ে উঠতে পারে। এতে জাতীয় নিরাপত্তাও বিঘিœত হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। কাজেই সংশ্লিষ্টদের এ ব্যাপারে সবসময় সচেতন থাকতে হবে।



 

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

আরও পড়ুন