Inqilab Logo

শুক্রবার, ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ০৬ বৈশাখ ১৪৩১, ০৯ শাওয়াল ১৪৪৫ হিজরী

কোন পথে আমাদের কিশোররা

প্রকাশের সময় : ৮ ফেব্রুয়ারি, ২০১৭, ১২:০০ এএম | আপডেট : ১২:১৪ এএম, ৮ ফেব্রুয়ারি, ২০১৭

জি কে সাদিক : শিশু-কিশোর শব্দগুলো শুনলেই মনের ভিতরে ভেসে উঠে ফুটফুটে সুন্দর নিষ্পাপ আদর স্নেহ-মায়া, ভালোবাসামাখা এক একটা মুখ। তবে কেন যেন আর সেই ছবি মনে আসছে না। বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘পথের পাঁচালী’তে ভালোবাসা আর প্রকৃতির চঞ্চলতাময় শিশুর রূপ যেন সমাজ থেকে বিদায় নিচ্ছে। সকলের ভালোবাসা আর স্মৃতিমাখা জীবনের একটা অধ্যায় হচ্ছে  কৈশর। সময়ের বিবর্তনে কালের চক্রে আমরা এমন এক সমাজ, কিশোর পাচ্ছি যারা আর কিশোর নয়। তারা কিশোরকে সন্ত্রাসী বিশেষণে বিশেষিত করেছে। সকলের ভালোবাসা, আদার, স্নেহ পাওয়া কিশোররা আজ ঘৃণার রূপ নিচ্ছে। গত ৬ জানুয়ারি রাজধানী ঢাকার উত্তরায় এক কিশোর হত্যা এবং ২৮ জানুয়ারি বরিশালে একজনকে হত্যা ও অন্যজন আহত হওয়ার পর সংবাদ মাধ্যমে যে তথ্য উঠে এসেছে তা আমাদের সমাজকে এক অন্ধকার গন্তব্যের পথে ঠেলে দিয়েছে। ক্ষণ বিলম্ব না করে যদি যথাযথ পদক্ষেপ ও কাজ না করা হয় তাহলে নৈতিকতার যে অবক্ষয় শুরু হয়েছে তা সমাজকে মুখ থুবড়ে পড়তে বাধ্য করবে। বর্তমানে আমরা যাদের দ্বারা পরিচালিত হচ্ছি- মানে আজ যারা দেশকে বিভিন্ন স্থান থেকে বিভিন্নভাবে নেতৃত্ব দিচ্ছে তারা এক সময় থাকবে না। কালের আর্বতে  হারিয়ে যাবে তারা। আজ যারা কিশোর তারাই আসবে আগামীর পথপ্রদর্শক হিসেবে। তাহলে যে কিশোর বা তরুণ সন্ত্রাস, ধর্ষণ, মাদকাসক্ত, হত্যা, নারী নির্যাতন করে  বেড়াচ্ছে তারাই কী হবে আগামীর পথপ্রদর্শক? কিন্তু একজন সন্ত্রাসী, ধর্ষক কখনো কোনো সমাজের জন্য উন্নয়নের কা-ারী হতে পারে না।
গেলো বছর ২০১৬ সালেও নববর্ষের শুরুতেই কিশোরদের বিপথগামিতার প্রতিফলন দেখা যায় রাজধানী ঢাকাসহ সারা দেশে। এই নিয়ে সংবাদ মাধ্যমে যে তথ্য উঠে এসেছে তা আমাদের ভাগ্যাকাশে কালোমেঘের অশনিসংকেত। গত ৬ জানুয়ারি রাজধানীর উত্তরায় আধিপত্য বিস্তারকে কেন্দ্র করে আদনান কবির নামে নবম শ্রেণির একছাত্র খুন হয় প্রতিপক্ষের হাতে। গত ১৮ জানুয়ারি তেজগাঁওয়ে কে বড় আর কে ছোট এনিয়ে খুন হয় আবদুল আজিজ নামে এক কিশোর। গত ১৫ জানুয়ারি রূপনগরে এক স্কুল ছাত্রকে পিটিয়ে আহত করে একদল কিশোর। এমন ঘটনা কোনো সিনেমার নয়, প্রতিনিয়ত ঘটছে আমাদের দেশের বিভিন্ন জাগায়। গত বছর ১৪ মে ভাষানটেকে প্রাথমিক বিদ্যালয়ের এক শিশু ধর্ষণের শিকার হয় ১৪ বছরের এক কিশোরের হাতে। গত জানুয়ারি মাসের ২৮ তারিখে বখাটেপনায় বাধা দেয়ার জন্য বরিশালে সাইদুর রহমান হৃদয় নামে এক কিশোরেকে ধারালো অস্ত্র দিয়ে কুপিয়ে হত্যা করা হয়। গুরুতর আহত হয় তার এক সহপাঠী। দেশব্যাপী এমন ঘটনা যেন নিত্যদিনের চিত্র হয়ে উঠেছে।
গাজীপুরের টঙ্গী ও যশোরের পুলের হাট কিশোর (বালক) উন্নয়ন কেন্দ্রের তথ্য মতে, তাদের আশ্রয়ে থাকা ২০ শতাংশ কিশোর খুনের মামলা ও ২৪ শতাংশ কিশোর নারী ও শিশু নির্যাতনের মামলার আসামি। অন্যান্য অপরাধের চাইতে সম্প্রতি সময়ে খুন ও ধর্ষণ আশঙ্কাজনকভাবে বেড়ে চলছে। সমান তালে পাল্লা দিয়ে বাড়ছে অন্যান্য অপরাধমূলক কাজও। বিগত দিনগুলোর চাইতে কিশোরদের মধ্যে নানা ধরনের অপরাধমূলক কাজ ক্রমান্বয়ে বেড়েই চলছে। দেশের দুটি কিশোর উন্নয়ন কেন্দ্র থেকে সমাজ সেবা অধিদপ্তরে গত ৩১ ডিসেম্বরে হালনাগাদের কিছু তথ্য পাঠানো হয়। সে তথ্য মতে দুটি কেন্দ্রে ৫৯৭ জন কিশোর রয়েছে যারা বিভিন্ন ধরনের অপরাধের দায়ে আশ্রয় কেন্দ্র দুটিতে আছে। এদের মধ্যে ১৪২ জন কিশোর নারী ও শিশু নির্যাতন মামলার আসামি। ১২০ জন হত্যা মামলার আসামি। এছাড়াও আরো আছে চুরির মামলায় ৮৯ জন, মাদক মামলায় ৬৬ জন, অস্ত্র মামলায় ২০ জন, তথ্য-প্রযুক্তি ও পর্নোগ্রাফি আইনে করা মামলায় ৯ জন, ডাকাতির মামলায় ১৬ জন এবং অন্যান্য মামলায় আরো অনেক কিশোর আটক আছে।
সম্প্রতি এক গবেষণায় দেখা গেছে ১৯৯০ থেকে ২০০০ সাল পর্যন্ত ১০ বছরে রাজধানী ঢাকাসহ মোট কিশোর অপরাধের মামলা ছিল ৩ হাজার ৫০১টি। এর মধ্যে নারী ও শিশু নির্যাতনের মামলা ছিল ৮৭টি এবং ৮২টি ছিল হত্যা মামলা। পরবর্তী ১০ বছরে অর্থাৎ ২০০১ সাল থেকে ২০১০ সাল পর্যন্ত এই মামলা দিগুণ বেড়ে যায়। যথাক্রমে ২২৪ ও ১৩৮টি মামলা। এই ১০ বছরে মোট মামলা হয় ৪ হাজার ৮৮২টি। ২০১২ সালে কিশোর অপরাধের মামলা কমলেও হত্যা ও ধর্ষণের মামলা আরো বেড়ে যায়। কিশোর উন্নয়ন কেন্দ্র ও বিভিন্ন গবেষণায় উঠে এসেছে যে, অপরাধী এই কিশোরদের বয়স ১৪ থেকে ১৬ বছর। আর এদেরে মধ্যে অপরাধ প্রবণতা ক্রমশ বাড়ছে বলেও প্রতিবেদনে বলা হয়। উপরের তথ্য মতে দেখা যাচ্ছে যে, কিশোররা হত্যা-ধর্ষণ, মাদক, অস্ত্র, তথ্য-প্রযুক্তি ও পর্নোগ্রাফি, ডাকতি, চুরিসহ নানা ধরনের অপরাধ কর্ম করছে এবং তা ক্রমান্বয়ে লাগাম হীনভাবে বেড়ে চলছে।
এখন প্রশ্ন হলো, কেনো কোমলমতি কিশোরদের মধ্যে এমন হিংস্র ভাব? কেন তারা এমন অপরাধে জড়িয়ে পড়ছে? এর উত্তর পেতে হলে যেসব অপরাধ ঘটছে তার দিকে দৃষ্টি দিতে হবে। উত্তরায় আদনান কবির হত্যার পর তার বাবা-মাকে যখন তার ছেলে কীভাবে এমন পথভ্রষ্ট হলো সে সম্পর্কে প্রশ্ন করা হয় তারা উত্তরে বলেছিলেন যে, ‘কবে তাদের ছেলে এমন হয়ে উঠেছে তারা জানেন না।’ পুলিশ ও সংবাদ মাধ্যমের বিভিন্ন অনুসন্ধানী তথ্যে বিভিন্ন স্থানে গ্যাংদের মাদকের সাথে জড়ানোর সংবাদও উঠে এসছে। কিশোর গ্যাংদের বিভিন্ন ফেসবুক পেইজের কথাও উঠে এসছে যার মাধ্যমে তারা পরস্পরের সাথে যোগাযোগ করতো এবং প্রতিপক্ষকে হুমকি দিতো। বিভিন্ন সময় ধর্ষণ করে ফেইজবুকে তার ভিডিও আপলোড ও অশ্লীল ফটো আপলোডের চিত্রও উঠে এসেছে। কিশোরদের এই কর্মগুলোর প্রতি দৃষ্টি দিলেই তারা কেন অপরাধে জড়িয়ে পড়ছে তার উত্তর পেয়ে যাবো। আর এই কিশোরদের মধ্যে যেমন উচ্চ ও মধ্যবৃত্ত পরিবারের কিশোররা রয়েছে তেমনি দরিদ্র ও বস্তি এলাকার কিশোরদের উপস্থিতিও আছে। ওপরের তথ্য থেকে কিশোরদের অপরাধের কারণগুলোর মধ্যে আমরা পাই ১. পরিবারের দায়িত্ব অবহেলা, ২. মাদক, ৩. আকাশ সাংস্কৃতির প্রভাব এবং ৪. তথ্য-প্রযুক্তির অপব্যবহার। অপরাধ ও সমাজ বিশ্লেষকরা বলছেন যে, আর্থ-সামাজিক অবস্থার পরিবর্তন, আকাশ সংস্কৃতির ও ইন্টারনেটের সহজলভ্যতা, মাদকদ্রব্যের বিপুল প্রসার ও সহজলভ্যতার কারণে কিশোররা সহজে অপরাধে জড়িয়ে পড়ছে। তাহলে এই কয়েকটি কারণেই মূলত কিশোর অপরাধ বৃদ্ধি পাচ্ছে। কোমলমতি, আদরের সন্তান হয়ে উঠছে হিংস্র ও ভয়াবহ সন্ত্রাসী।
বাবা-মা সন্তান জন্মদানের পরে সন্তানকে আদর-যতœ করে বড় করে, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ভর্তি করে তাদের পিছনে টাকা খরচ করেই মনে করেন দায়িত্ব শেষ। আসলে তারা এটা বুঝতে চায় না যে, সন্তান বড় হওয়ার সাথে সাথে তাদের বাড়তি যতেœর প্রয়োজন হয়। সন্তান কী করছে? কী পড়ছে? কে তার বন্ধু বা খেলার সাথী? কোথায় সে বাড়তি সময় ব্যয় করছে ইত্যাদি ক্ষেত্রে তার একে বাড়ে গা-ভাসানো কাজ করছে। সন্তানদের এসব ক্ষেত্রে তাদের উদাসীনতা চরম পর্যায়ে। এটা ভুলে গেলে চলবে না যে, আমার যে বস্তুগত সুখের পেছনে দৌড়াচ্ছি তা মূল্যহীন যদি তা নৈতিকতার সুখে আচ্ছন্ন না হয়। সন্তানের বিপথগামিতা ঠেকাতে হলে এখানে পরিবারকে মুখ্য ভূমিকা পালন করতে হবে। সন্তানের ব্যাপারে দায়িত্বশীল হতে হবে। মনে রাখতে হবে, সন্তান বড় হোক আর ছোট হোক সে সন্তান। তাকে শাসন ও পরিচালনার জন্য কোন বয়স নেই। যে কোন সময় সে পথভ্রষ্ট হতে পারে। আর কিশোর বয়সটা হলো বিপথগামিতার জন্য উপযোগী সময়। বর্তমানে কিশোর বা উঠতি বয়সের তরুণদের দিকে তাকালে শালীনতা কথাটা কেমন যেন উপেক্ষিত হিসেবে পাওয়া যায়। তাদের মাথার চুল থেকে পায়ের নখ পর্যন্ত তথা সর্বাঙ্গে সাংস্কৃতির অগ্রাসন লক্ষ্য করা যায়। কিন্তু আমরা যদি ১০ থেকে ১৫ বছর পূর্বে ফিরে তাকাই তাহলে আমরা বর্তমান ও সে সময়ের মাঝে একটা বিস্তর পার্থক্য দেখতে পাই। কিশোরদের মাঝে এমন সন্ত্রাসী গ্রুপ, আধিপত্যের দাপট, মাদকতা এসবই আকাশ পথে সংস্কৃতির সাথে ভেসে আসা। এই অপসংস্কৃতি আমাদের সমাজের রন্ধ্রে রন্ধ্রে চেপে বসেছে। শালীনতার ও শ্রদ্ধাবোধের সীমাকে যেন গুঁড়িয়ে দিয়েছে। যে হত্যা ও ধর্ষণগুলো হচ্ছে তা মূলত বিভিন্ন অশ্লীল সিনেমা থেকে উদ্ভূত। বিভিন্ন ভিনদেশী সিনেমাতে কিশোররা যা দেখছে তারা তা বাস্তবে নিজেদের মধ্যে চরিত্রায়ণ ঘটাচ্ছে। অন্যদিকে মাদকতার অবাধ প্রসার ও সহজলভ্যতা আছেই। ভুলে গেলে চলবে না যে মাদকতা ও সন্ত্রাস হাত ধরাধরি করে চলে। হত্যা-ধর্ষণ, ডাকতি, ছিনতাই, চুরির মতো নানাবিধি কাজের সাথে মাদকতার সম্পর্ক খুব গভীর। এসবের পেছনে মাদকের ভূমিকা রয়েছে। সরকার এ বিষয়ে যথেষ্ট আন্তরিকতার সাথে কাজ করলেও তা প্রয়োজনের তুলনায় খুবই কম।
কিশোরদের মাঝে সন্ত্রাসী কর্মকা-ের এমন প্রসার আগামী দিনের জন্য অশনিসংকেত। দেশের উন্নয়নের অগ্রযাত্রার সময় কিশোরদের এমন সন্ত্রাসী হয়ে উঠা উন্নয়নের জন্য বড় ধরনের অন্তরায় হয়ে দাঁড়িয়েছে। দেশের উন্নয়নকে স্থায়ী করতে হলে প্রয়োজন স্থায়ী নেতৃত্ব। তাহলে যারা আজ সন্ত্রাসী তারা কী পারবে আমদের ভবিষ্যৎ উন্নয়নের হাতিয়ার হতে? তাই আগামী পথ চলা যেন থেমে না যায়, আমাদের উন্নয়নের ধারা যেন থাকে অটুট সে জন্য তৈরি করতে হবে যোগ্য ভবিষ্যৎ নেতৃত্ব। কিন্তু কিশোরদের মাঝে এমন চিত্র ফুঠে উঠায় আমাদের ভবিষ্যৎ যেন অন্ধকার হয়ে যাচ্ছে। যদি কিশোরদের এই অবস্থা থেকে বের করা না হয় তাহলে আমাদের দেশের উন্নয়নের যাত্র মাঝ পথে থেমে যেতে বাধ্য। পাগলা ঘোড়া হাত ছাড়া হওয়ার আগেই তার লাগাম টানতে হবে।
য় লেখক : শিক্ষার্থী, ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়, কুষ্টিয়া



 

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

আরও পড়ুন