Inqilab Logo

শুক্রবার, ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০, ১৮ রমজান ১৪৪৫ হিজরী

পটুয়াখালী ইটবাড়িয়া ইউসিকে মাধ্যমিক বিদ্যালয় প্রধান শিক্ষকের তালিকা অনুযায়ী গাইড বই কিনতে বাধ্য করা হচ্ছে শিক্ষার্থীদের

| প্রকাশের সময় : ১৩ ফেব্রুয়ারি, ২০১৭, ১২:০০ এএম

মো. হাসান, পটুয়াখালী থেকে : লাইব্রেরির মালিক ও প্রকাশকের জেলা মার্কেটিং অফিসারের সাথে চুক্তি করে বাজারের নিম্নমানের গাইড কিনে পড়তে বাধ্য করা হচ্ছে শিক্ষার্থীদের। শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের নির্দেশনা উপেক্ষা করে এ কাজটি করছে পটুয়াখালী সদর উপজেলার ইটবাড়িয়া ইউসিকে মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষকসহ অন্যান্য শিক্ষকেরা। এভাবে শিক্ষার্থী-অভিভাবকদের পকেট থেকে লাখ লাখ টাকা হাতিয়ে নিচ্ছেন বলে অভিযোগ উঠেছে। ব্যাহত হচ্ছে সরকারের শিক্ষানীতিমালা। ঝরে পড়ছে দরিদ্র শিক্ষার্থীরা।
জানা যায়, চলতি বছরের প্রথম দিনেও সরকার দেশের লাখ লাখ শিক্ষার্থীর হাতে বিনামূল্যে নতুন বই তুলে দেয়। এর মধ্যে ষষ্ঠ থেকে দশম শ্রেণি পর্যন্ত সব শ্রেণির সকল পাঠ্যবইসহ বাংলা ব্যাকরণ এবং ইংরেজি ব্যাংকরণ বইও দেয়া হয়েছে। কিন্তু পটুয়াখালী সদর উপজেলার ইটবাড়িয়া ইউসিকে মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক লেকচার পাবলিকেশন প্রকাশনীর পটুয়াখালীর জেলা প্রতিনিধি ও লাইব্রেরির মালিকের সাথে চুক্তি করে তাদের প্রকাশনীর গাইড বই কেনার জন্য শিক্ষার্থীদের হাতে গাইড বইয়ের তালিকা তুলে দিয়ে ওই গাইডগুলো ক্রয় করতে বাধ্য করা হচ্ছে। এভাবে এ বছর ইটবাড়িয়া ইউসিকে মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের অন্তত এক হাজার শিক্ষার্থীর হাতে তুলে দেয়ায় পাঁয়তারা চলছে প্রায় পাঁচ হাজার অননুমোদিত বই, যা থেকে প্রধান শিক্ষকসহ অন্যান্য শিক্ষকরা আয় করবেন কমপক্ষে দুই লাখ টাকা।
লাইব্রেরিতে গিয়ে দেখা যায়, ষষ্ঠ শ্রেণির সৃজনশীল গাইড কমিশন বাদে ৬৭৯ টাকা, গণিত মডেল গাইড কমিশন বাদে ২০০ টাকা, সপ্তম শ্রেণির সিরিজের সকল বিষয়ের সৃজনশীল গাইড কমিশন বাদে ৭০০ টাকা, গণিত মডেল গাইড কমিশন বাদে ২৫০ টাকা, জেএসসি স্কুল সার্টিফিকেট পরীক্ষা ২০১৭ সৃজনশীল গাইড কমিশন বাদে ৯৬০ টাকা, গণিত মডেল গাইড কমিশন বাদে ৩৫০ টাকা, নবম শ্রেণির গণিত ও উচ্চতর গণিত গাইড কমিশন বাদে ৩৮০ টাকা, নবম শ্রেণির লেকচার সিরিজের সকল বিষয়ের সৃজনশীল গাইড কমিশন বাদে দুই হাজার টাকা। এছাড়া ইংরেজি ব্যাংকরণ বইটি ও বাংলা ব্যাকরণ বইটির গায়ের মূল্যে কিনতে হয়। এছাড়া লেকচার পাবলিকেশন প্রকাশনীর গাইড বই প্রধান শিক্ষকের নির্দেশে নির্দিষ্ট লাইব্রেরি থেকে ক্রয়ের জন্য বাধ্যতামূলকভাবে শিক্ষার্থীদের চাপিয়ে দেয়া হয়েছে।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক শিক্ষার্থীর অভিভাবক বলেন, গাইড বইয়ের তালিকা নিয়ে লাইব্রেরিতে গাইড কিনতে গিয়ে অষ্টম ও নবম শ্রেণির গাইডের দাম ক্রয় ক্ষমতার বেশি হওয়ায় লাইব্রেরি থেকে চলে এসেছি। ছেলেকে বলে দিয়েছেন এত টাকা দিয়ে বই কিনে পড়ানো যাবে না। ওই ব্যক্তি নাম প্রকাশ করলে তার সন্তানকে স্কুলে থেকে বের করে দেয়া হবে।
এ শুধু ইটবাড়িয়া ইউসিকে মাধ্যমিক বিদ্যালয়েই নয়। জেলার অপর আটটি উপজেলার বিদ্যালয়ের হাজার হাজার শিক্ষার্থীর হাতে শিক্ষকদের পছন্দের আর সরকারের অননুমোদিত ব্যাকরণ, বিভিন্ন বাহারি নাম ও মোড়কে মোড়ানো নোট ও গাইড বই তুলে দেয়া হচ্ছে বাধ্যতামূলকভাবে।
পটুয়াখালীর পুস্তক বিক্রেতাদের সাথে কথা বলে জানা গেছে, শিক্ষকের খেয়াল-খুশিমতো গাইড বই পাঠ্য করে তা বিক্রি করতে বাধ্য করছে। এক সময় বিক্রেতারা এসব বই প্রকাশকদের কাছ থেকে ৬০-৭০ শতাংশ হ্রাসকৃত মূল্যে ক্রয় করে তা শিক্ষার্থীদের কাছে আবার ৩০-৫০ শতাংশ হ্রাসকৃত দামে বিক্রি করত। কিন্তু কয়েক বছর ধরে পটুয়াখালীর লাইব্রেরি মালিকরা তাদের স্বার্থে মাত্র ১০-১৫ শতাংশ টাকা ছাড় দিয়ে বিক্রি করছে। আর হাতিয়ে নিচ্ছে লক্ষ লক্ষ টাকা এবং ধ্বংস করছে জাতির বিবেককে।
সরেজমিন অনুসন্ধানে বেরিয়ে এসেছে, চলতি শিক্ষাবর্ষে ইটবাড়িয়া ইউসিকে মাধ্যমিক বিদ্যালয় থেকে হ্যান্ডবিল ছাপিয়ে ষষ্ঠ থেকে নবম শ্রেণি পর্যন্ত সব শিক্ষার্থীর হাতে হ্যান্ডবিলে থাকা পুস্তকের তালিকা অনুযায়ী লেকচার পাবলিকেশনের গাইডগুলো ক্রয় করার জন্য নির্দেশ দেন। বর্তমান সরকার প্রতিটি শ্রেণির শিক্ষার্থীর জন্য বাংলা ব্যাকরণ ও ইংরেজি গ্রামার বই বিনামূল্যে বিতরণ করার পরও শিক্ষকেরা তাদের খেয়াল-খুশিমতো চারটি শ্রেণিতেই তিনটি করে ব্যাকরণ বই পাঠ্য করান।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক শিক্ষার্থীদের অভিভাবকেরা জানান, প্রতি বছরই আমাদের হাতে এ রকম তালিকা তুলে দিয়ে স্যারেরা বই কিনতে বলেন। এ বই কিনে না দিলে স্কুল থেকে নাম কেটে দিবেন এই ভয় দেখায়। আর এই কারণে আমরা তা কিনে দিয়ে পড়াতে বাধ্য হই। কোনো লাইব্রেরি মালিকের সাথে পরামর্শ করেই তাদের মন মতো গাইডবই পাঠ্য করে আমাদেরকে ক্রয় করার নির্দেশ দেন। আমরা তাদের কথা মতো এই গাইডবইগুলো ক্রয় করি।
ইটবাড়িয়া ইউসিকে সহকারী শিক্ষক মো. আ: কাদের বলেন, ছাত্র-ছাত্রীরা জানেন না কোন গাইড বইটি ভালো? তাই প্রধান শিক্ষক লেকচার প্রকাশনীর গাইড বইটি লিস্ট করে দিয়েছেন। আমরা সহকারী শিক্ষক এ বিষয় ভালো বলতে পারব না ।
ইটবাড়িয়া ইউসিকে প্রধান শিক্ষক আতাহার লেকাচার পাবলিকিশনের গাইড তালিকা করার কথা স্বীকার করে তিনি বলেন, গ্রামের ছেলে-মেয়েরা সরকারি জুবিলী স্কুল ও সরকারি বালিকা বিদ্যালয়ের ছেলে-মেয়েদের মতো অত মেধাবী না, তাই তাদের গাইড বই ক্রয়ের জন্য বলা হয়। মূলতঃ কোম্পানির কাছ থেকে ও লাইব্রেরি মালিকের সাথে মোটা অঙ্কের টাকার চুক্তিতে প্রধান শিক্ষক আতাহার এ বছরের মতো প্রতিবছর এ কাজটি করেন। উল্লেখ্য, তিনি ২০১৬ সালের ১ জানুয়ারি শিক্ষার্থীদের কাছে বিনামূল্যের সরকারি নতুন বই বিতারণ করে প্রতিজন শিক্ষার্থীর কাছ থেকে ২০০ (দুইশত) টাকা চাঁদা আদায় করে লাখ লাখ টাকা হাতিয়ে নেন।
এ বিষয়ে পটুয়াখালী জেলা শিক্ষা কর্মকর্তা বলেন, বাজারের সকল গাইড নিষিদ্ধ বই। শিক্ষার্থীদের ওপর এভাবে গাইড বই লিস্ট করে চাপিয়ে দিলে তার দায়ভার সংশ্লিষ্টদের নিতে হবে। আর এ ব্যবস্থা চলতে থাকলে সরকারের শিক্ষানীতি ব্যাহত হবে। সহায়ক বই হিসেবে বাংলা ও ইংরেজি ব্যাকরণ বই সরকার বিনামূল্যে বিতরণ করছে।
এ ব্যাপরে জেলা প্রশাসক এ কে এম শামীমুল হক সিদ্দিকি সাংবাদিকদের জানান, তদন্ত করে এর সত্যতা পেলে আইনানুগ ব্যবস্থা নেয়া হবে।



 

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

ঘটনাপ্রবাহ: পটুয়াখালী


আরও
আরও পড়ুন
এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ
গত​ ৭ দিনের সর্বাধিক পঠিত সংবাদ