Inqilab Logo

বৃহস্পতিবার, ১৮ এপ্রিল ২০২৪, ০৫ বৈশাখ ১৪৩১, ০৮ শাওয়াল ১৪৪৫ হিজরী

সাফল্যগাথার অন্তরালে কদর্য কাহিনী

| প্রকাশের সময় : ১ মার্চ, ২০১৭, ১২:০০ এএম

জাহাংগীর আলম : সাফল্য ও ব্যর্থতা নিয়েই জীবন, চাই ব্যক্তিগত অথবা সমিষ্টিক। শাসকের ইতিহাস এর ব্যতিক্রম নয়। পার্থক্য যা, ব্যক্তি তার ব্যর্থতা প্রায়ই স্বীকার করে। কিন্তু শাসকবর্গ তা করতে চায় না মোটেই। বর্তমানে বাংলাদেশে প্রতিষ্ঠিত আওয়ামী সরকার নিজেদের সাফল্যকে দুচোখ ভরে এতটাই দেখছেন যে, অতীতের অন্য সরকারগুলোর অবদান বিন্দু মাত্রও দেখছেন না। তাই প্রধানমন্ত্রী থেকে পাতি নেতা পর্যন্ত বলে বেড়াচ্ছেন, অতীতে কোনো উন্নয়ন হয়নি দেশের। বাস্তব সত্য হচ্ছে ’৭৪ সালে তলা বিহীন ঝুড়ি উপাধি পাওয়া বাংলাদেশ (মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী কিসিঞ্জার কর্তৃক) একলাফে বর্তমান অবস্থায় দাঁড়ায়নি। এরশাদ সরকারের গৃহীত পরিকল্পনায় বিএনপি সরকারে বসানো পিলারেই নির্মিত যমুনা সেতু উদ্বোধন করেছিলেন ভাগ্যবান শেখ হাসিনা। বর্তমানে রিজার্ভ বৃদ্ধির গর্ব সরকারের, কিন্তু কৃতিত্ব প্রবাসীদের, শিল্পায়নে উদ্যোক্তাদের কৃতিত্ব। কারণ বিনিয়োগবান্ধব পরিবেশের র‌্যাকিংয়ে বাংলাদেশের অবস্থান ভারত-পাকিস্তানের অনেক নিচে। অন্যদিকে ব্যাংকের দেনার দায়ে, চাঁদাবাজের উৎপাতে যেসব মিল বন্ধ হচ্ছে সেগুলোর দায় বর্তমান সরকারের।
তথাপি আওয়ামী সরকারের সাফল্যকে কেউ অস্বীকার করতে পারে না। কিন্তু আপত্তি তখনই যখন সরকারি দল একলা সব কৃতিত্ব দাবি করে। কৃতিত্বের দাবি আরো প্রশ্নবিদ্ধ হয় যখন ব্যর্থতার মাঝেও সাফল্যের সুগন্ধি আবিষ্কৃত হয়। সম্প্রতি বহুল আলোচিত নারায়ণগঞ্জের সাত খুনের মামলার রায় ঘোষণার পর সরকার বিচার বিভাগীয় কৃতিত্বে নিজের ভগ্নাংশ খুঁজে পেয়েছে। অথচ আলোচনার গভীরে প্রবেশ করলে এখানেও আওয়ামী সাফল্যগাথা যথেষ্ট কদর্য। সাত খুনের ঘটনায় যখন দেশে তোলপাড় তখন খুনি নূর হোসেন পালিয়ে কীভাবে ভারত যায়? সেই সাথে শামীম ওসমানের সাথে ফোন আলাপ থেকে দলীয় প্রশ্রয়ের গন্ধ আসে। ভাগ্যিস ভারতীয় পুলিশ নূর হোসেনকে ধরতে সক্ষম হয়েছিল, না হলে খুনি বেঁচে যাওয়ার সম্ভবনাই ছিল শত ভাগ। আর দেশে যারা ধরা পড়েছিল তাদের কপাল পুড়তো কিনা সন্দেহ, যদি না মিডিয়া সোচ্চার হতো। একথা রায় ঘোষণার পর খোদ স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী কৃতজ্ঞতার সাথে স্মরণ করেছেন, তাছাড়া সাত খুনের প্রধান ভিকটিম নজরুল ইসলাম যদি আওয়ামী নেতা না হয়ে জামায়াত-বিএনপির নেতা হতেন, তাহলে বুঝা যেত পানি কোথায় গড়াতো।
যাহোক, খুনিদের বিচার থেকে র‌্যাবের একটি কলঙ্ক উন্মোচিত হয়েছে র‌্যাব ডিজি যতই ব্যক্তিগত ঘটনা বলে ব্যাখ্যা করুক। কারণ খুনি র‌্যাব কর্মকর্তারা যে আরো খুন-গুমে হাত রঞ্জিত করেছে তার অনেক প্রমাণ রয়েছে। মেজর আরিফ সাত খুন এবং গুমের যে বর্ণনা দিয়েছে তাতে বুঝা যায় তারা খুন-গুমে কতটা দক্ষ। লোমহর্ষক বর্ণনা পড়লে তাদের কোনো ইতঃস্ততা পরিলক্ষিত হয় না। অতীতে দুই-একটা খুন-গুমে হাত পাকানোর ফলেই সাত খুন নিয়ে তাদের দুশ্চিন্তা পরিলক্ষিত হয়নি। বরং সোনারগাঁওর হতভাগ্য ইসমাইল যে তারেক সাঈদদের হাতে খুন হয়েছিল তা বিশ্বাস করার যথেষ্ট কারণ রয়েছে। নোয়াখালী অঞ্চলে তাদের বন্দুক যুদ্ধ নিয়ে অতীতের প্রশ্নগুলো জেগে উঠে সাত খুন প্রমাণের পর।
বিচার বিভাগের সাফল্যগাথাই যদি বলতে হয় তাহলে যুবলীগ নেতা শাওন, চাটখিল যুবলীগ নেতা মুসলেম উদ্দিন, সোনারগাঁওর ক্লিনিক ব্যবসায়ী তাজুল ইসলাম, লক্ষীপুরের জামায়াত নেতা ডা. ফয়েজ আহমদ প্রমুখদের হত্যা-গুমের রহস্য উদ্ঘাটিত হোক র‌্যাব ১১-এর কুখ্যাত খুনি অফিসারদের কাছ থেকে। কেন ওইসব হতভাগ্য ভিকটিমদের পরিবার থেকে করা অভিযোগ আমলে নেওয়া হয়নি? র‌্যাব কর্তৃপক্ষ দায় এড়াতে পারে না এজন্য যে র‌্যাব গোয়েন্দা শাখার তদন্তে ধরা পড়েছিল তারেক সাইদদের জঘন্য অপকর্ম। তথাপি তাদের দীর্ঘদিন র‌্যাবে রাখা হয়েছিল যা মোটেই গ্রহণযোগ্য নয়। কর্তৃপক্ষ যদি তাদের সরিয়ে দিতেন তাহলে র‌্যাব, সরকার, তথা জাতি এহেন কলঙ্ক থেকে বেঁচে যেত। খুলনার এরশাদ শিকদারকে ফাঁসি দিয়ে বিচার বিভাগ দায়মুক্ত হয়েছিল। কিন্তু প্রশ্রয় দিয়ে যারা এরশাদ শিকদার বানায় তাদের বিচারের আনা যায় না। তাই মাঝেমধ্যে ফাঁসি হলেও অপরাধ কমে না। প্রশ্রয় সরকারি দলকে কতটা বেপরোয়া করেছে এখানে মাত্র দুটি ঘটনা উল্লেখ করা গেল। আওয়ামী নেতাদের হাতে লাঞ্ছিত হওয়া শিক্ষক ও অফিসারদের (ইউএনওসহ) কথা না-ইবা বললাম।
নাটোর নলডাংগা বৃদ্ধ আঞ্জোমানারা বেগম (৭৫) যখন মারা যান গত জানুয়ারিতে। যথারীতি কবরস্থ করার জন্য গোরস্থান কর্তৃপক্ষকে ৫শ টাকা দিয়ে কবর খোড়া হয়। রাতে কবরস্থ করতে গেলে বাধা দেয় ওয়ার্ড আওয়ামী লীগের নেতা। বাধার কারণে রাতেই অন্য গোরস্থানে নিয়ে কবর দিতে বাধ্য হন হতভাগ্য পুত্র। দ্বিতীয় ঘটনাটি নভেম্বর মাসের। দিনাজপুরের ট্রাকের হেলপার মঞ্জুরুল ইসলামকে শরীর কেটে লবণ মেখে প্লাস দিয়ে হাত-পায়ের নখ তুলে নির্যাতন করে যুবলীগ ও স্বেচ্ছাসেবক লীগের কর্মীরা। র‌্যাব খবর পেয়ে তাকে উদ্ধার করে হাসপাতালে ভর্তি করে। কিন্তু হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ তাকে রাখতে পারেনি। আট দিন পর বিনা চিকিৎসায় মারা যায় হতভাগ্য মঞ্জুর। সংবাদ ২টি দৈনিক ইনকিলাবের ভেতরের পাতায় ছাপা হলেও নিষ্ঠুরতার দিক থেকে ঘটনা ২টি কম জঘন্য নয়।
হতভাগ্য মঞ্জুরের ওপর নির্যাতনের লোমহর্ষক বর্ণনা এসেছে সংবাদপত্রে। এসেছে তার দৃষ্টিনন্দন ছবি। কিন্তু কি অপরাধে এমন বর্বর নির্যাতন করে মৃত্যু তা আসেনি। অপরাধ যাই হোক হাসপাতালে চিকিৎসা পাওয়ার অধিকার ছিল। কিন্তু সে অধিকার থেকে বঞ্চিত করে তাকে মৃত্যুর নিশ্চিত পথে ঠেলে দেওয়া হয় যা খুনেরই নামান্তর। সরকারি দলের কর্মীরা এতই শক্তিধর যে ঘটনা স্থল থেকে র‌্যাব তাদের ধরেও ছেড়ে দিতে বাধ্য হন। মঞ্জুরের পরিবার মামলা করার সাহস পায়নি। তবে তার মৃত্যুর পর মামলা হয়েছে এবং দু’জন আসামি গ্রেফতার হয়েছে।
দেশে উন্নতির নাকি জোয়ার বইছে কিন্তু হাজারো মঞ্জুরের জীবন যাচ্ছে অপশক্তির হাতে। একটি সমীক্ষায় জানা যায়, বিগত তিন বছরে বারো হাজারের অধিক খুন হয়েছে এবং গুম হয়েছে দিগুণ ২৪ হাজার। যেগুলোর কমপক্ষে অর্ধেক খুন হয়েছে। আতঙ্কিত খবর এই যে, এসব খুন-গুমের ভেতর একটা অংশ সরকারি দলের নেতাকর্মীরা। কাজেই কম গণতন্ত্রের মাশুল শুধু জামায়াত-বিএনপিই দিচ্ছে না, সংঘাতের বিস্তৃতি ঘঠছে আওয়ামী লীগেও। তাই বলা যায়, পূর্ণ গণতন্ত্র ছাড়া টেকসই উন্নয়ন নিশ্চিত করা যায় না। আর যায় না বলেই স্বৈরশাসকদের ভৌত অবকাঠামোগত উন্নয়নে তাদের শেষ রক্ষা হয় না।
জনসাধারণের অধিকার প্রতিষ্ঠিত না হলে উড়াল সেতুর মতো উন্নয়নের ঝিলিকে জাতি শান্তি পাবে না। তাই দেশের উন্নয়ন ধারাকে বেগবান করতে হলে সরকারের একলা চলার নীতি পরিহার করতে হবে। অকারণে প্রতিপক্ষ দমনের হীন পন্থা পরিত্যাগ করে বিরোধী দলের মাঠে নামার নিরাপদ পরিবেশ সৃষ্টি করতে হবে। কারণ যুদ্ধাপরাধী নামের ক্ষেপণাস্ত্রটি এখন সরকারি দলের ওপরও বর্ষিত হচ্ছে। নববর্ষে ময়মনসিংহের সরকারি দলের এমপির বিরুদ্ধে যুদ্ধাপরাধ মামলা ঠুকেছেন খোদ ধর্মমন্ত্রী। ইতোমধ্যে খোদ প্রধানমন্ত্রী ৫ জানুয়ারির নির্বাচনকে প্রশ্নবিদ্ধ বলে স্বীকার করেছেন। এ পর্যন্ত সরকারের কথায় সত্যের অনেক অপলাপ ধরা পড়েছে। সর্বশেষ ব্যক্তি বা মহল বিশেষের উদ্যোগে সু-প্রতিষ্ঠিত প্রতিষ্ঠানের মাথা ভেঙে মগজ খাওয়ার চক্রান্তে লিপ্ত হয়েছে সরকার। ইসলামী ব্যাংকের কর্তৃত্ব হাতে নেওয়া তার প্রমাণ। আরাস্ত খানকে ব্যাংকটির চেয়ারম্যান করে অর্থমন্ত্রী বলেছিলেন, বিদেশি শেয়ার হোল্ডারদের অনুরোধে সরকার হাত বাড়িয়েছে। কিন্তু ২ সপ্তাহ যেতেই প্রথম আলো খবর দিল আইডিবি প্রেসিডেন্টের আপত্তি জানানো চিঠির কথা। ইসলামী উন্নয়ন ব্যাংকের প্রেসিডেন্ট আমাদের অর্থমন্ত্রীকে চিঠিতে লিখেছেন যে তাদের না জানিয়ে সিদ্ধান্ত নেয়া হচ্ছে এখন। অতএব, ‘রাবিশ’ জনগণ আস্থা রাখবে কোথায়?
লেখক : প্রাবন্ধিক



 

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

আরও পড়ুন