Inqilab Logo

শুক্রবার, ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১, ১৬ শাওয়াল ১৪৪৫ হিজরী

দুদকের উদ্দেশ্য কি?

| প্রকাশের সময় : ১ মার্চ, ২০১৭, ১২:০০ এএম

চার লাখ ২০ হাজার কোটি টাকার বাজেট আসছে। চলতি বাজেট এর চেয়ে অনেক কম হলেও শতভাগ বাস্তবায়নের কোনো সম্ভাবনা নেই। এই অভিজ্ঞতা মজুদ থাকার পরও আগামী বাজেটের আকার আরো বড় করা হচ্ছে। পর্যবেক্ষকদের অভিমত, বাজেটকে নির্বাচনবান্ধব করার অভিপ্রায় সরকারের থাকতে পারে। উন্নয়ন কার্যক্রম জোরদার করাও এতবড় বাজেটের বিশেষ লক্ষ্য বলে ধারণা করা যেতে পারে। ২০২১ সালের মধ্যে দেশকে মধ্যম আয়ের দেশে উন্নীত করতে হলে বড় বাজেটের প্রয়োজন অস্বীকার করা যায় না। কিন্তু বাজেটের আকার বড় করার মধ্য দিয়েই লক্ষ্য অর্জিত হতে পারে না, যদি না তা পুরোপুরি বাস্তবায়ন করা যায়। এ-ও কারো অজানা থাকার কথা নয়, উন্নয়ন লক্ষ্য অর্জন করতে হলে বিনিয়োগ, রফতানি আয় ও রাজস্ব আয় বাড়ানো অপরিহার্য হিসেবে বিবেচিত। স্বতঃস্ফূর্ত ও ধারাবাহিক বিনিয়োগ বলতে যা বোঝায় তা মোটেই কাক্সিক্ষত পর্যায়ে নেই। দীর্ঘদিন ধরে দেশি-বিদেশি বিনিয়োগে মন্দাভাব বিরাজ করছে। ইইউর মতে, স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা, সহজীকরণ, সহযোগিতা, বাস্তবায়ন ও বৈষম্য সবচেয়ে বড় বাধা বিনিয়োগে। তার আরো অভিমত হলো, মধ্যম আয়ের দেশে পরিণত হওয়ার পথে সবচেয়ে বড় প্রতিবন্ধকতা বাণিজ্য সহায়ক পরিবেশের অনুপস্থিতি। বলাই বাহুল্য, শুধু রফতানি আয় দিয়ে উন্নয়ন লক্ষ্য অর্জন করা সম্ভব নয়। নিরেট বাস্তবতা তো এই, রফতানি আয় বাড়ছে না। রেমিট্যান্স প্রাপ্তির হারেও নেতিবাচক প্রবণতা লক্ষণীয়। গার্মেন্ট খাত রফতানি আয়ের প্রধান অবলম্বন হলেও এই খাতটি দেশি- বিদেশি ষড়যন্ত্রের কবলে পড়ে ধুঁকছে। নানা সমস্যায় জর্জরিত এ খাত টিকিয়ে রাখাই কঠিন হয়ে পড়েছে। বহু কারখানা বন্ধ হয়ে গেছে। বহু শ্রমিক পড়েছে বেকার হয়ে। রফতানি প্রবৃদ্ধি তাই নেতিবাচক ধারায় চলে গেছে। রেমিট্যান্স আয়ের বড় উৎস বটে, তবে এখন তা ধারাবাহিকভাবে কমছে। একই সঙ্গে রাজস্ব আয়ও লক্ষ্যমাত্রা অর্জনে ব্যর্থ হচ্ছে। এমতাবস্থায়, নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে দেশকে মধ্যম আয়ের দেশে উন্নীত করা নিঃসন্দেহে একটা বড় চ্যালেঞ্জ। লক্ষ্য অর্জনে সফল হতে হলে বিনিয়োগ, রফতানি, রেমিট্যান্স ও রাজস্ব আয় বাড়ানোর বিকল্প নেই। এ জন্য সব ক্ষেত্রে প্রয়োজন অনুকূল ও সহায়ক পরিবেশ।
অত্যন্ত দুঃখজনক হলেও বলতে হচ্ছে, বিনিয়োগ বাড়ানো যখন অপরিহার্য ও জরুরি তখন দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) তার পথে প্রধান বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে। দেশে রাজনৈতিক অস্থিরতা বা অস্থিতিশীলতা নেই। তবে এক ধরনের গুমোট ও অনিশ্চিত পরিবেশ রয়েছে। এটা বিনিয়োগ কিছুটা নিরুৎসাহিত করলেও তা বড় বাধা নয়। বিনিয়োগের যে সম্ভাবনা তা মূলত নষ্ট হচ্ছে দুদকের অবিবেচক, অপরিণামদর্শী আচরণ ও কার্যকলাপে। সবারই জানা, ব্যাংকিং খাত থেকে বিপুল অংকের অর্থ লুণ্ঠিত হয়েছে, পুঁজিবাজার পথে বসেছে, বিদেশে অর্থ পাচার ভয়ঙ্কর রূপ নিয়েছে। এসব দিকে দুদকের কোনো নজর নেই। বড় লুটেরাদের ধরার ব্যাপারে শুরু থেকেই দুদক অনীহ ও নিরুৎসাহিত। তার নজর নিবদ্ধ ছোটখাটো দুর্নীতি ও দুর্নীতিবাজ খোঁজার কাজে। ব্যাংকের অর্থ লোপাটের মূল হোতাদের ছাড় দিয়ে দুদক ব্যাংকের নিচের সারির কর্মকর্তাদের আটক করে ব্যাংকিং খাতে একটা ভীতিকর পরিবেশ সৃষ্টি করেছে। এই ভীতি ও আতঙ্কের কারণে ঋণ বিতরণ স্থবির হয়ে পড়েছে। বিনিয়োগ কার্যক্রম প্রায় বন্ধ হয়ে গেছে। ব্যাংকঋণ পাওয়ার সব রকমের যোগ্যতা থাকার পরও অনেক উদ্যোক্তা ও ব্যবসায়ী ঋণ পাচ্ছে না। এ কারণে নতুন শিল্প স্থাপন, শিল্প সম্প্রসারণ কিংবা বাণিজ্য বৃদ্ধি তাদের পক্ষে সম্ভব হচ্ছে না। ঋণের কোনো প্রস্তাব ব্যাংকের কাছে দেয়া হলে ব্যাংক কর্মকর্তারা নানা অজুহাতে প্রস্তাব ফিরিয়ে দিচ্ছেন। ‘দুর্নীতিবাজ’ হিসেবে তারা কেউই ব্যক্তি ও পারিবারিক মর্যাদা ক্ষুণœ করতে চাইছেন না, চাইছেন না দুর্নীতিবাজ হিসেবে দুদকের হয়রানি, জুলুম কিংবা গ্রেফতারের শিকার হতে। দেখা গেছে, একজন কর্মকর্তার ভুল বা দুর্নীতির কারণে আরো অনেক কর্মকর্তাকে হয়রানি বা গ্রেফতারের সম্মুখীন হতে হয়েছে। একজন ব্যাংক ম্যানেজার ২০ থেকে ৫০ লাখ টাকার ঋণ অনুমোদন করতে পারেন। এখন তার কোনো ত্রুটি হলে অন্যদেরও তার জন্য দায়ী করা হচ্ছে। এমতাবস্থায় কোনো ব্যাংক ম্যানেজারই ঝুঁকি নিয়ে ঋণ দিচ্ছেন না। ফলে বিনিয়োগ এক প্রকার হচ্ছেই না। বিনিয়োগকারীদের অনেকেই এ বন্ধত্ব ও অচলাবস্থার কারণে বিদেশ থেকে ঋণ গ্রহণে আগ্রহী হয়ে উঠেছে। অথচ ব্যাংকিং খাতে বিনিয়োগযোগ্য বিপুল অংকের অর্থ পড়ে আছে। দুদকের আচরণ ও তৎপরতার কারণে তা কাজে আসছে না।
আসলে দুদক বিনিয়োগবিরোধী, ব্যবসাবিরোধী ও হয়রানি করার একটি প্রতিষ্ঠানে পরিণত হয়েছে। ব্যাংকিং খাতে তারই কারণে অনাকাক্সিক্ষত পরিবেশ-পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়েছে। এতে ব্যাংকগুলোর ব্যবসাই ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে না, বিনিয়োগও অচল হয়ে পড়ছে ঋণ প্রস্তাব ফিরিয়ে দেয়ার কারণে। আবাসন দেশের একটি বড় খাত। এ খাতে দু’লাখ কোটি টাকারও বেশি বিনিয়োগ আছে। কর্মসংস্থান আছে লাখ লাখ মানুষের। এই খাতের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট লিংকেজ শিল্পগুলোতে ব্যাপক বিনিয়োগ ও কর্মসংস্থান রয়েছে। জাতীয় অর্থনীতিতে এ খাতের অবদান প্রায় ৯ শতাংশ। এত বড় একটি খাতও অস্তিত্বের সঙ্কটে পড়েছে। হাজার হাজার ফ্ল্যাট ও প্লট অবিক্রীত অবস্থায় পড়ে আছে। কোনো ফ্ল্যাট বা প্লট কেউ কিনতে গেলেই দুদক হাজির হয়ে তার অর্থের উৎস সন্ধান করছে। দুদকের এই হয়রানি ও বিড়ম্বনার কারণে মানুষ ফ্ল্যাট-প্লট কিনতে আগ্রহী হচ্ছে না। আরো দুঃখের বিষয়, দুদক ফাঁদ পেতে দুর্নীতিবাজ ধরছে। ১০ হাজার, ২০ হাজার টাকার উৎকোচ ধরার এই ফাঁদে অনেকেই পড়েছে। প্রশ্ন হলো, বড় বড় দুর্নীতিবাজ না ধরে ছোটখাটো দুর্নীতিবাজ ধরে কি দুর্নীতিবিরোধী অভিযানে সাফল্য অর্জন করা সম্ভব? সেনা সমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে দুদক বহু রাজনীতিক ও ব্যবসায়ীর বিরুদ্ধে মামলা দিয়ে গ্রেফতার করেছিল। সেটা ছিল একটা বিশেষ পরিস্থিতি এবং এর পেছনেও একটা ‘রাজনীতি’ ছিল, সেই রাজনীতির প্রভাব থেকে দুদক এখনো মুক্ত হতে পারেনি। রাজনৈতিক বিরোধীদের তরফে অভিযোগ রয়েছে, দুদক সরকারের আজ্ঞাবহ হিসেবে কাজ করছে। এই অভিযোগের পাশাপাশি দুুদকের কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগও রয়েছে। কিছু কর্মকর্তা দুর্নীতির অভিযোগে আটকও হয়েছে। বিভিন্ন ক্ষেত্রে দুদকের এই প্রশ্নবিদ্ধ আচরণ, ভূমিকা ও তৎপরতায় সঙ্গত কারণেই জিজ্ঞেস করতে হয়, দুদকের উদ্দেশ্য কি? দুর্নীতি দমন, নাকি বিনিয়োগ, ব্যবসা-বাণিজ্য ও উন্নয়ন লাঠে তোলা? এ অবস্থা চলতে থাকলে দেশের অর্থনীতির  নিয়ন্ত্রণ দেশের হাতে থাকবে না, অন্যের হাতে চলে যাবে। এই বাস্তবতায় সরকারকে গভীরভাবে চিন্তা-ভাবনা করতে হবে। দুদককে সামলাতে হবে। সংশ্লিষ্ট ও ভুক্তভোগীর সঙ্গে আলোচনা করে সিদ্ধান্ত নিতে হবে। বিনিয়োগ, ব্যবসা-বাণিজ্য এবং মানুষের সামাজিক মর্যাদাকে সমুন্নত করতে হবে।



 

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

আরও পড়ুন