Inqilab Logo

শুক্রবার, ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ০৬ বৈশাখ ১৪৩১, ০৯ শাওয়াল ১৪৪৫ হিজরী

ইসলামী ইবাদতের চতুর্থ রোকন : হজ

সত্যালোকের সন্ধানে

| প্রকাশের সময় : ২ মার্চ, ২০১৭, ১২:০০ এএম

এ. কে. এম. ফজলুর রহমান মুন্শী
(পূর্ব প্রকাশিতের পর)
হজের আরকান :
হজের হাকীকত যে সকল আরকানের সাথে সংশ্লিষ্ট এবং সেগুলোর সংস্কার, সংযোজন ও বিস্তৃতির মাধ্যমে হজের পরিপূর্ণতার রূপরেখা বাস্তবায়িত হয়, তা কেন শরীয়তে বিধিবদ্ধ করা হয়েছে এর মূলে বহুবিধ উপকারিতা ও মুসলিহাত নিহিত আছে। নিম্ন তার বিশদ বিবরণ তুলে ধরা হল।
ইহরাম :
যাবতীয় কর্মকান্ড যদিও নিয়তের উপর নির্ভরশীল কিন্তু তবু নিয়তের বিকাশ ও বহিঃপ্রকাশ আমল বা কাজ ছাড়া সাধিত হয় না। নামাযে তাকবীরে-তাহরীমা সেই নিয়তেরই ঘোষণা। অনুরূপভাবে ইহরামও হচ্ছে হজের তাকবীরস্বরূপ। ইহরাম বাঁধার সাথে সাথে মানুষ সাধারণ জীবনযাত্রা হতে বের হয়ে একটি নির্দিষ্ট অবস্থায় উপনীত হয়। এজন্য তার উপর ঐ সকল বস্তু হারাম হয়ে যায় যা জাগতিক আয়েশ-আরাম, সুখ-সৌন্দর্য এবং চিত্তবিনোদনের উপকরণ ছিল। সে শিকার করতে পারে না। শুধু কাজ এবং বাসনার পরিতৃপ্তির জন্য কোনও প্রার্থী হত্যা করতে পারে না। স্ত্রীসম্ভোগ ও আত্মতৃপ্তিকর কর্মকান্ডে অংশগ্রহণ করতে পারে না। বস্তুত এ হচ্ছে খাহেশাতে নফসানী ও আরামপ্রিয়তাকে পরিহার করার মোক্ষম সময়। সেলাইযুক্ত কাপড় যা বিত্তবৈভবের প্রকাশক তা পরিধান করতে পারে না। এ কারণেই অন্ধকার যুগে আরবরা উলঙ্গ অবস্থায় কা’বা শরীফ তাওয়াক করত। কিন্তু আল্লাহ পাকের সন্নিধানে এটাও ছিল একটি চরম বেয়াবদী। এ জন্য ইসলামে তা নিষিদ্ধ ঘোষিত হয়েছে। তাই ইসলাম এ কথা নির্ধারিত করে দিয়েছে যে, ইহরামের নিয়তের সাথে সাথে ধনী, বাদশাহ, গরিব সকলেই নিজ নিজ পরিধেয় সেলাইযুক্ত কাপড় পরিহার করবে এবং মানুষের প্রাথমিক গাত্রাবরণের স্মৃতিস্বরূপ সেলাইবিহীন কাপড় পরিধান করবে। একটি কাপড় দ্বারা নাভি হতে দেহের নিম্নাংশ আবৃত করবে এবং অপর এক প্রস্থ কাপড় দ্বারা ডান কাঁধকে উন্মুক্ত রেখে বাঁ-কাঁধ ও পিঠ এবং বক্ষদেশ আবৃত করবে। এ ক্ষেত্রেও মাথাকে উন্মুক্ত রাখতে হবে।
এটাই হচ্ছে হযরত ইব্রাহীম (আঃ)-এর সময়কালীন গাত্রাবরণের নমুনা। হজের সময় এভাবে গাত্রাবরণ গ্রহণ করাকে এজন্যই বিধিবদ্ধ করা হয়েছে যেন সেই বরকতময় যুগের অবস্থা আমাদের বাহ্যিক আকার-আকৃতির মাঝে প্রকাশ পায়, যেন বিশ্ব অধিপতির দরবারে হাজিরী দেয়ার সময় একান্ত নিরহঙ্কার, নিরভিমান ও সাদামাটা অবকাঠামো নিয়ে উপস্থিত হওয়া যায়। কারণ অতি সাধারণ বেশভূষার মাঝে দেহমনের বিনয়াবনত ভাব সহজেই প্রকাশ পায়।
তাওয়াফ :
খানায়ে কা’বার চতুর্দিকে প্রদক্ষিণ করা এবং এরই মাঝে দোয়া ও মুনাজাত সহকারে এই কাজ সমাধা করাকে তাওয়াফ বলে। এভাবেই হজরত ইব্রাহীম (আ:)-এর আমলে নজর এবং কুরবানীর পশুকে কুর’বানগাহের চতুর্দিকে ফেরানো হত। সেহেতু হজ আদায়কারী নিজেকে কুরবানগাহে উপস্থিত করেন এবং এরই নিদর্শণস্বরূপ সে নিজে খানায়ে কা’বার চতুর্দিকে প্রদক্ষিণ করে এবং প্রদক্ষিণের প্রাক্কালে সে নিজের মাগফিরাতের দোয়া ও মুনাজাত করে আল্লাহর কাছে আত্মসমর্পণ করে। এই প্রার্থনার শেষ কথাটি- “হে আল্লাহ! আপনি আমাদের দুনিয়ার জীবনের মঙ্গল দান করুন এবং আমাদেরকে দোযখের আযাব হতে মুক্তি দান করুন।”
তাওয়াফ মূলত, এক প্রকার ইব্রাহিমী সালাতের প্রতিবিম্ব যা অতীত স্মৃতির স্মরণিকা হয়ে আছে। এ জন্যই রাসূলুল্লাহ (সা:) বলেছেন : “খানায়ে কা’বার তাওয়াফ হচ্ছে এক প্রকার নামাজ। তবে পার্থক্য হচ্ছে এই যে, তাওয়াফের হালতে তোমরা কথা বলতে পার। তবে তোমরা তাওয়াফের হালতে নেক কথা ছাড়া অন্য কথা বলো না।” (তিরমিজী’ নাসাঈ, দারমী ও মুস্তাদরেকে হাকেম) তাই আল কুরআনে ঘোষণা করা হয়েছে : “(তাদের উচিত) বাইতে আতীকের তাওয়াফ করা।” (সূরা হজ : রুকু-৪)
হাজারে আসওয়াদ চুমো দেয়া :
‘হাজারে আসওয়াদ’ শব্দের অর্থ হচ্ছে কালো পাথর। এই পাথরটি খানায়ে কা’বার দেয়ালের গাত্রে কয়েক ফুট উঁচুতে লাগনো রয়েছে। খানায়ে কা’বার দেয়াল কয়েকবার ভেঙ্গে গেছে। কখনো বৃষ্টির জমানো পানিতে দেয়াল ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। আবার কখনো এতে আগুন লেগেছে। হযরত ইব্রাহীম (আঃ) যে সকল পাথর দ্বারা গৃহটি নির্মাণ করেছিলেন, তার একটিও অবশিষ্ট নেই। কিন্তু ইব্রাহীম (আ:)-এর জমানার মাত্র এই একটি পাথরই অবশিষ্ট রয়েছে। যা অন্ধকার যুগেও আরববাসীরা হেফাজত করেছে এবং শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে এই স্থানে সন্নিবিষ্ট আছে। (হিজরী ৩১৭ সালে বাতেনী সম্প্রদায়ের লোকেরা এই পাথরটি নিয়ে গিয়েছিল; কিন্তু কিছু দিন পর উহা উদ্ধার করে যথাস্থানে স্থাপন করা হয়) এই পাথরটি খানায়ে কা’বার ঐ কোণে স্থাপন করা আছে, যার দিকে মুখ করে দাঁড়ালে ‘বাইতুল মুকাদ্দাস’ সামনে থাকে। এজন্যই হাজারে আসওয়াদের বরাবর অপর কোণকে ‘রুকনে শামী’ বলা হয়। হাজরে আসওয়াদ রক্ষিত কোনটি মূলত ‘বাইতুল মুকাদ্দাসের’ দিকটিই পরোক্ষভাবে সুস্পষ্ট করে তোলে। আর এই কোণে পাথরটি সংস্থাপনের অর্থ হচ্ছে, খানায়ে কা’বার তাওয়াফ শুরু করার এবং শেষ করার চিহ্ন শনাক্ত করা।
প্রত্যেক তাওয়াফ শেষে এই পাথরটি চুমো দেয়া যায়, সীনার সাথে লাগানো যায়। হাত দ্বারা, কাঠ দ্বারা উহা স্পর্শ করে চুমো দেয়া যায়। তা সম্ভব না হলে এর দিকে ইশারা করেও চুমোর কাজ সমাধান করা যায়। বলতে গেলে, এটি একটি সাধারণ পাথর। যার মাঝে কোন আসমানী কেরামত নেই। এটি কেবলমাত্র স্মৃতিচিহ্ন। কিন্তু যিয়ারত প্রত্যাশীদের কাছে এই পাথরটিই পৃথিবীকে বদলে দিয়েছে। মক্কা নগরীর প্রতিটি বালুকণা পর্যন্ত পরিবর্তিত হয়ে গেছে। কা’বা গৃহের এক একটি পাথর বদলে গেছে। কিন্তু এটিই সেই পাথর, যাকে চুমো খেয়েছেন হযরত ইব্রাহীম খলীলুল্লাহ (আ:) এবং যাকে চুমো খেয়েছেন এবং যার মাঝে হাত রেখেছেন নূরনবী মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহ (সা:), খোলাফায়ে রাশেদীন, সকল সাহাবায়ে কেরাম, সুবিজ্ঞ ইমামগণ। ইসলামের জন্য নিবেদিতপ্রাণ ব্যক্তিগণ যাকে চুমো খেয়েছেন এবং আজও আমাদের মত গোনাহগার লোকগণ একই পাথরকে চুমো খাচ্ছে। এ পর্যায়ে আমাদের অন্তর, চোখ ও সর্বাঙ্গে এক আকর্ষণীয় ভাব ব্যঞ্জনার লহর বয়ে যায়। সর্বোপরি আমরা মুসলমানরা মনে করি, এই পাথরটির কোন শক্তি নেই। এ কারণেই হযরত ওমর বিন খাত্তাব (রা:) এই পাথর চুমো খেয়ে বলেছিলেন : হে কালো পাথর! আমি জানি, তুমি একটি সাধারণ পাথর। তুমি না কোন উপকার সাধন করতে পার, না ক্ষতি সাধন করতে পার। কিন্তু আমি তোমাকে এই কারণেই চুমো দেই যে, মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহ (সা:)-কে তোমায় চুমো খেতে আমি দেখেছি। (সহীহ মুসলিম, তিরমিজী, মুস্তাদরেকে হাকেম) হাজারে আসওয়াদকে চুমো দেয়া এর তা’জিম বা সম্মান প্রদর্শনের জন্য নয় বরং ভালোবাসার আকর্ষণে। যা হযরত ইব্রাহীম (আ:)-এর প্রতি রূহানী ভালোবাসার স্মৃতিকে জাগরুক করে তোলে। কিন্তু পক্ষান্তরে কেউ যদি এই পাথরটি স্পর্শ না করে, এর দিকে ইশারা না করে অথবা চুমো না খায়, এতে হজ আদায়ের ক্ষেত্রে কোনই ক্ষতিকর প্রভাব পতিত হবে না।
সাফা এবং মারওয়ার মধ্যবর্তী স্থানে দৌড়ান :
সাফা এবং মারওয়া কা’বার সন্নিকটস্থ দুটি পাহাড়। যা বর্তমানে নামমাত্র বাকি আছে। তবুও সামান্য নিদর্শন এখনো রয়েছে। সাফা ঐ পাহাড়টি মনে হয়, যেখানে হযরত ইব্রাহীম (আ:) নিজের আরোহণ গাধাটি ও চাকরদেরকে রেখে একাকী হযরত ইসমাঈল (আ:)-কে সঙ্গে নিয়ে এগিয়ে গিয়েছিলেন এবং সেখানে তিনি হযরত ইসমাঈল (আ:)-কে কুরবানী করতে চেয়েছিলেন। পরিশেষে গায়েবী আওয়াজ; শ্রবণ করে থেমে গিয়েছিলেন এবং হযরত ইসমাঈল (আ:)-এর পরিবর্তে দুম্বা কুরবানী করেছিলেন। হযরত হাজেরা (রা:) হযরত ইসমাঈল (আ:)-কে নিয়ে এখানেই এসেছিলেন। তখন তিনি পিপাসায় কাতর ছিলেন। তাই তিনি পানির তালাশে সাফা এবং মাওয়ার মধ্যবর্তী স্থানে দৌড়েছিলেন। সর্বশেষে ‘জমজম’ ক‚প নজরে পড়ে। সাফা এবং মাওয়ার মাঝে দৌড়ানো এই স্মৃতির কথাই স্মরণ করিয়ে দেয়।
মোটকথা, হজের সময় প্রথমে সাফা পাহাড়ে ও পরে মারওয়া পাহাড়ে আরোহণ করে কা’বার দিকে মুখ করে আল্লাহর প্রশংসা করা হয় ও দোয়া করা হয়। এ দু’টি স্থান হচ্ছে ঐ স্মৃতিবহ যেখানে হযরত ইব্রাহীম (আ:) ও হযরত হাজেরা (আ:) আল্লাহর কুদরতের বিকাশ অবলোকন করেছিলেন। তাই তো আল কুরআনে ঘোষণা করা হয়েছে: “অবশ্যই সাফা এবং মারওয়া আল্লাহর নিদর্শনের অন্তর্ভুক্ত; তাই যে হজ করবে বা ওমরাহ করবে, এ দু’টি পাহাড় তাওয়াফ করাতে তার কোন গোনাহ হবে না। (সূরা বাকারাহ : রুকু-১৯)
আরাফাতে অবস্থান :
আরাফাত ময়দানে জিলহজের ৯ তারিখ সকল হাজীকে অবস্থান করতে হয় এবং দ্বিপ্রহরের পর হতে সূর্যাস্ত পর্যন্ত দোয়া, মুনাজাত এবং আল্লাহর হামদ ও সানায় নিমগ্ন থাকতে হয়। মূলত হজের নাম এটাই। এখানে কয়েক ক্রোশ পর্যন্ত যতদূর নজর যায়, বিভিন্ন দেশের লোক একই লেবাসে দাঁড়িয়ে কান্না-বিজরিত কন্ঠে অতীত পাপের মাগফেরাত কামানা করে এবং আল্লাহর কাছে নতুন করে শপথ গ্রহণ করে। এখানেই জাবালে রহমতের পাশে দাঁড়িয়ে ইসলামের আমীর সারা দুনিয়ার আগত মুসলমানদের উদ্দেশ্যে খুতবা প্রদান করেন এবং তাদের কর্ম ও আদর্শ সম্পর্কে অবহিত করেন। আরাফাতের এই অবস্থান একদিকে ইসলামের শান ও শওকতের বিরাট প্রদর্শনীর ব্যবস্থা এবং অপরদিকে এর চেয়েও বৃহত্তর জনসমাবেশ রোজ হাশরের কথা স্মরণ করিয়ে দেয়। এ কারণেই সূরা হজের আরম্ভ হয়েছে হাশরের বর্ণনার মাধ্যমে। গণসমাবেশের এই অদ্বিতীয় ভাবধারা এবং অভূতপূর্ব প্রাণস্পর্শী দৃশ্য মানুষের অন্তরে জাগিয়ে তোলে মাগফেরাত ও রহমতে ইলাহী লাভের তীব্র আকর্ষণীয় প্রভঞ্জন। সেখানে প্রতিটি মানুষের আগে, পিছে, ডানে, বামে, একই পরিবেশ ও একই চিত্র নজরে

পড়ে। তা প্রত্যক্ষ করে স্বভাবতই প্রতিটি মানুষ অভিভূত হয়ে পড়ে। এমনকি এ প্রভাবে গোটা জীবনের সর্বত্রই অবশিষ্ট থেকে যায় এবং স্মৃতিপটে অ¤øান হয়ে ফুটতে থাকে।
মুজদালিফাতে অবস্থান :
হজের সময় মানুষের ভিড় এবং দৌড়ঝাঁপের মাধ্যমেই অতিবাহিত হয়। এ সময়ে কোনক্রমেই নিশ্চেষ্ট বসে থাকা যায় না।
অতীতে আরবরা মাগরিবের সময়ের পর আরাফাত হতে রওয়ানা হত। এমতাবস্থায় তারা সরাসরি যদি মীনায় গমন করত, তাহলে প্রথম ভাগে ঘরমাক্ত হয়ে যেত। এ কারণে তারা পথিমধ্যে সামান্য বিশ্রাম লাভের মানসে মুজদালিফাতে এসে অবস্থান করাকে সুনির্দিষ্ট করে নিয়েছিল। কিন্তু ইসলাম মুজদালিফাতে অবস্থান করাকে এজন্য প্রচলিত রেখেছে যে, এখানে এমন একটি মসজিদ আছে, যাকে ‘মাশয়ারে হারাম’ বলা হয়। এ স্থানটি ইবাদতের নির্দিষ্ট মাকাম ছিল বিধায় সূর্যাস্তের সাথে সাথে আরাফাত হতে মুজদালিফায় এসে অবস্থান করা এবং পুরো রাতটি ইবাদত-বন্দেগীতে অতিবাহিত করাকে হজের আবশ্যকীয় কাজ হিসেবে গণ্য করা হয়েছে। এ প্রসঙ্গে আল কোরআনে ঘোষণা করা হয়েছে : “সুতরাং তোমরা যখন আরাফাত হতে প্রত্যাগমন করবে, তখন ‘মাশয়ারে হারামে’র সন্নিকটে আল্লাহকে স্মরণ কর, এবং আল্লাহকে এভাবেই স্মরণ কর, যেভাবে তিনি তোমাদেরকে নির্দেশ দিয়েছেন; যদিও তোমরা এর পূর্বে সত্যকে বিস্মৃত হয়ে পড়েছিল।”
(সূরা বাকারাহ : রুকু-২৫)
একথা পূর্বেই জানা হয় গেছে যে, কুরবানীর আসল স্থান হচ্ছে ‘মারওয়া’ পাহাড়। সেখানে হযরত ইব্রাহীম (আ:) স্বীয় কুরবানী পেশ করেছিলেন। এ কারণেই রাসূলুল্লাহ (সা:) ইরশাদ করেছেন : “কোরবানগাহ হচ্ছে মারওয়াহ, তারপর মক্কার প্রতিটি গলিই হচ্ছে কুরবানগাহ।” (মুয়াত্তা ইমাম মালেক: হজের কুরবানী অধ্যায়)
তারপর ক্রমশ যখন মুসলমানদের আধিক্য হজের পরিমÐলকে বিস্তৃত করে তোলে, একই সাথে অসংখ্য কুরবানীর প্রয়োজনীয়তা দেখা দেয়। অপরদিকে মারওয়াহ এবং মক্কার সকল ময়দান শহর ও জনবসতিতে রূপান্তরিত হয়ে যায়, তখন মক্কা হতে কয়েক মাইল দূরবর্তী এক ময়দানকে কুরবানীর জন্য চয়ন করা হয়, যার নাম ‘মীনা’। এখানে হাজীগণ দু’তিন দিন অবস্থান করে পরস্পর মিলিত হন এবং একে অন্যের সাথে পরিচয়ের সেতুবন্ধনে আবদ্ধ হন। এখানেই কুরবানী করা হয়। একে অন্যকে দাওয়াতে আপ্যায়ন করা হয়। এখানে বাজার বসে ও লোকজন প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র বেচাকেনা করে।
অন্ধকার যুগে আরবের লোকেরা মীনাতে একত্রিত হত এবং নিজেদের বাপ-দাদাদের বুজুর্গী নিয়ে অহঙ্কার প্রকাশ করত যা অধিকাংশ সময় যুদ্ধ-বিগ্রহের দ্বার উন্মুক্ত করে দিত। এই অসার রেওয়াজের পরিবর্তে উত্তম পন্থা অবলম্বন করার তাগিদে এখানে আল্লাহপাকের হামদ ও ইবাদতের হুকুম দেয়া হয়েছে এবং এখানে খান্দান ও কাওমের বুজুর্গী বয়ানের পরিবর্তে মুসলমানদের পরস্পর পরিচয় গ্রহণ, মহব্বত ও বিশ্ব ভ্রাতৃত্ব প্রতিষ্ঠার স্থান হিসেবে গ্রহণ করা হয়েছে। এরই প্রতি ইঙ্গিত প্রদান করে আল কোরআনে ঘোষণা করা হয়েছে: “তোমরা আল্লাহকে কতিপয় সুনির্দিষ্ট দিনে স্মরণ কর।” (সূরা বাকারাহ : রুকু-২৪)
কুরবানী :
কুরবানী হচ্ছে হযরত ইসমাঈল (আ:)-এর স্মৃতিচিহ্ন এবং নিজেদের রূহানী কুরবানীর প্রতিবিম্ব এবং এর প্রত্যক্ষ উপকারিতা হচ্ছে এই যে, এখানে তিন দিন অবস্থানের প্রাক্কালে সামগ্রিক সম্প্রদায়ভিত্তিক ঈদের অবতারণা ঘটে। যেখানে মানুষ একে অন্যকে, দোস্ত ও প্রিয়জনদেরকে, ফকির ও মিসকীনদেরকে আহার্য দান করতে পারে। আল কোরআনে ঘোষণা করা হয়েছে : “তোমরা নির্দিষ্ট দিনগুলোতে আল্লাহর দান জানোয়ারগুলো কুরবানীকালে, তাঁর নাম স্মরণ কর, এর মধ্যে হতে নিজেরা কিছু খাও এবং ফকীর ও দুস্থদেরকে খাওয়াও।” (সূরা হজ: রুকু-৪) তবে যদি কোনও কারণবশত নির্দিষ্ট দিনে কোরবানী আদায় করতে না পার তাহলে দশটি রোজা রাখবে, এটাও স্বকীয় আত্মোৎসর্গেরই শামিল। এ প্রসঙ্গে আল কোরআনে ঘোষণা করা হয়েছে : “সুতরাং যে ব্যক্তি ওমরাহ এবং হজ উভয়টির ফায়েদা লাভ করতে চাও, তাহলে কুরবানী করা সম্ভব হলে করে নেবে, তবে কেউ যদি এতে অক্ষম হয়ে পড়ে, তাহলে হজের সময় তিন দিন রোজা রাখবে এবং হজ হতে প্রত্যাবর্তন করে সাত দিন রোজা পালন করবে। (সূরা বাকারাহ : রুকু-২৪)
মাথা মুড়ানো :
মীনাতে হাজী সাহেবান কুরবানী আদায় করার পর মাথা মুড়ান অথবা চুল কর্তন করেন। এটাও পুরনো রেওয়াজের প্রতিফলন। অতীতে কোন মানতকারী মানত পুরা করার পর মাথা মুড়াত। (তৌরাত : বিচার পুস্তক-১০-৫ এবং গণনা পুস্তক-৬-৫)
এক্ষেত্রে একটি অতীত স্মৃতির প্রতিও প্রচ্ছন্ন ইশারা দেখতে পাওয়া যায়। সভ্যতার প্রাথমিক যুগে এই রেওয়াজ ছিল যে, যে দাসকে মুক্তি দান করা হত, তখন তার মাথার চুল মুড়ানো হত, এটা ছিল গোলামীর চিহ্ন। (ইবনে সায়াদ : ২য় খন্ড, ১ম পর্ব, ৪৭ এবং সীরাতে ইবনে হিশাম : বিরে মাউনা প্রসঙ্গ) যেহেতু হজ আল্লাহ পাকের সার্বক্ষণিক গোলামী এবং বন্দেগীর স্বরূপ, সেহেতু মানবতার এই পুরানো রেওয়াজকে প্রচলিত রাখা হয়েছে। এ প্রসঙ্গে আল কোরআনে ঘোষণা করা হয়েছে : “নিজেদের মাথা মুড়িয়ে অথবা মাথার চুল ছেটে ফেল।” (সূরা ফাতহ : রুকু-৪) অপর এক আয়াতে ঘোষণা করা হয়েছে :
“যতক্ষণ পর্যন্ত কুরবানী যথাস্থানে না পৌঁছে, ততক্ষণ পর্যন্ত তোমরা মাথা মুড়িয়ো না। ” (সূরা বাকারাহ : রুকু-২৪)
কঙ্কর নিক্ষেপ :
মীনার ময়দানে তিনটি পাথর নির্মিত স্তম্ভ রয়েছে। বলা হয়ে থাকে যে, হযরত ইব্রাহীম (আ:) স্বীয় পুত্র ইসমাঈল (আ:)- কে যখন কুরবানী করতে চললেন, তখন শতায়ন এ সকল স্থানে তাঁর অন্তরে ওয়াসওয়াসাৎ দিয়েছিল। তিনি এখানে রজম করেন। ‘রজম’ শব্দের অর্থ হচ্ছে কঙ্কর নিক্ষেপ করা। যা প্রাচীনকালে অভিসম্পাৎ প্রকাশের তরীকা ছিল। এজন্যই শয়তানকে ‘রাজীম’ বা কঙ্কর মারা হয়েছে বলে অভিহিত করা হয়।
নেজামুল কোরআনের লেখক বলেছেন যে, যখন আবরাহার সৈন্যরা মক্কার উপর চড়াও হয়েছিল, তখন কতিপয় গাদ্দার মুনাফিক ‘ছাকাফী আরব’ তাদের পথ দেখিয়েছিল। অন্যান্য আরবরা তার অতর্কিত আক্রমণের মোকাবেলা করেছিল পাথর নিক্ষেপের মাধ্যমে।
যার উল্লেখ সূরা ফীলের “তাদের উপর চিহ্নিত প্রস্তর নিক্ষেপ করা হয়” আয়াতে রয়েছে। নিক্ষিপ্ত এই প্রস্তরের দ্বারা আল্লাহ পাক আবরাহার সৈন্য বাহিনী ধ্বংস করে ছিলেন এবং একই সাথে গাদ্দার সাকাফীরাও ধ্বংস হয়েছিল।
মীনাতে কঙ্কর নিক্ষেপ করা এই “তারমিহিম” নির্দেশের স্মৃতিচিহ্ন। আল্লাহর তাসবীহ ও হামদ পাঠ করে সেই স্তম্ভগুলোর প্রতি কঙ্কর নিক্ষেপ করা হয় এবং শয়তানের প্ররোচনা হতে বেঁচে থাকার জন্য প্রার্থনা করা হয়। যেহেতু কঙ্কর নিক্ষেপ করা বাহ্যত: একটি বেকার কাজ মনে হয়। এজন্য রাসূলুল্লাহ (সা:) এর গোপন রহস্য উন্মোচন করেছেন এবং বলেছেন, কঙ্কর নিক্ষেপের বাহানার মাধ্যমে আল্লাহর স্মরণকে বুলন্দ করাই একমাত্র উদ্দেশ্য” (মিশকাত: কঙ্কর নিক্ষেপ অধ্যায় এবং দারেমী ও তিরমিজী; ইমাম তিরমিজী বলেছেন : এই হাদীসটি হাস্সান সহীহ) আল কোরআনও এই হাকীকতের প্রতি এভাবে ইঙ্গিত প্রদান করেছে, “যখন তোমরা হজের আরকান পরিসমাপ্ত করবে, তখন তোমাদের বাপ-দাদাকে যেভাবে স্মরণ করতে তদনুরূপ বরং তার চেয়ে বেশী পরিমাণে আল্লাহকে স্মরণ করবে।” (সূরা বাকারাহ : রুকু-২৫)
এ সকল রেওয়াজ পালনের উদ্দেশ্য :
উপরের আলোচনা হতে সুস্পষ্ট বুঝা যায় যে, এ সকল রেওয়াজ পালন হচ্ছে অতীত যুগের স্মৃতিবহ। এ সকল রুসুম ও রেওয়াজ বাকি রাখা এজন্য জরুরি, যেন ইনসানিয়াতের রূহানী উন্নতির প্রাথমিক যুগ আমাদের দৃষ্টির সামনে পরিস্ফুট থাকে এবং আমাদের আকাক্সক্ষা ও অনুপ্রেরণাকে ঐতিহাসিক স্মরণীয় দিকনির্দেশনার ঘটনাবলী সর্বদাই উজ্জীবিত করতে থাকে এবং আল্লাহর স্মরণ, নিজের গোনাহের মাগফেরাত এবং পরবর্তী সময়ে নেক জিন্দেগী অতিবাহিত করার শপথ আমাদের হজের পূর্ববর্তী ও পরবর্তী জীবনে সেতুবন্ধন রচনা করতে পারে এবং একই সাথে পরিবর্তন ও সংস্কারের এক নতুন অধ্যায়ের সূচনা করে। এজন্য রাসূলুল্লাহ (সা:) অত্যন্ত বিস্তৃতভাবে বলেছেন : কঙ্কর নিক্ষেপ করা, সাফা-মারওয়া পাহাড়ে দৌড়ানো এবং খানায়ে কা’বার তাওয়াফের উদ্দেশ্য হচ্ছে আল্লাহর স্মরণকে বুলন্দ করা।”
(তিরমিজী, সুনানে দারেমী, সুনানে নাসাঈ, মুস্তাদরেকে হাকেম : কিতাবুল হজ)
কোরআনুল কারীমেও এই উদ্দেশ্যের প্রতি ইঙ্গিত প্রদান করে ঘোষণা করা হয়েছে : “তোমরা নির্দিষ্ট দিনসমূহে আল্লাহকে স্মরণ কর।” (সূরা হজ : রুকু-৪) হজের মাকামাত বা স্থানসমূহ সাধারণত: পয়গাম্বরসুলভ শান এবং রাব্বানী নিদর্শনাবলীর বিকাশস্থল। যেখানে উপস্থিত হয়ে এবং যেগুলো দর্শন করে আল্লাহ পাকের সে সকল রহমত ও বরকতময় ঘনটাবলীর কথা মনে পড়ে। এ জন্যই আল কোরআনের ব্যবহারিক ভাষায় এগুলোকে ‘শায়াইরিল্লাহ’ বলা হয়েছে এবং এই বস্তুসমূহের প্রতি সম্মান প্রদর্শন ও এগুলোর জিয়ারতের নামই হচ্ছে আরকানে হজ। সূরা হজে হজের বিস্তৃত আরকান উল্লেখ করার পর ঘোষণা করা হয়েছে “এবং যে ব্যক্তি আল্লাহর সম্মানীত বস্তুসমূহকে ইজ্জত করবে, তা হলে এটা তার প্রতিপালকের দৃষ্টিতে খুবই উত্তম।” (সূরা হজ : রুকু-৪) সাফা এবং মারওয়া সম্পর্কে বলা হয়েছে : “অবশ্যই সাফা এবং মারওয়া আল্লাহর নিদর্শনাবলীর অন্তর্ভুক্ত।” (সূরা বাকারাহ : রুকু-১৯)। আর সূরা হজে ঘোষণা করা হয়েছে “এটাই (হচ্ছে সিদ্ধান্ত) যে ব্যক্তি আল্লাহর নিদর্শনাবাণীকে সম্মান করবে, তাহলে এটাই হচ্ছে অন্তরের পরহেজগারীর বিকাশ।” (সূরা হজ : রুকু-৪)
এই আয়াতসমূহের দ্বারা সুস্পষ্ট বুঝা যায় যে, হজের একটা বড় উদ্দেশ্য হলো এ সকল সম্মানীত স্থানগুলো আদব রক্ষা করা ও সম্মান করা। কেননা এ সকল পবিত্র স্থানগুলোর সাথে যে সকল পবিত্র বর্ণনা ও ঘটনাবলী সম্পৃক্ত রয়েছে সেগুলো যেন স্মরণে জাগরুক থাকে এবং অন্তরসমূহে এগুলোর প্রতিক্রিয়া পয়দা করতে থাকে।



 

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

আরও পড়ুন
এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ
গত​ ৭ দিনের সর্বাধিক পঠিত সংবাদ