Inqilab Logo

মঙ্গলবার, ১৬ এপ্রিল ২০২৪, ০৩ বৈশাখ ১৪৩১, ০৬ শাওয়াল ১৪৪৫ হিজরী

জঙ্গী রাজীব গান্ধীর জবানবন্দিতে এক যুগ পর উদ্ঘাটিত সাংবাদিক দীপঙ্কর হত্যা রহস্য

বগুড়ায় জামায়াত পল্লীর ভাই বোন মেসে তৈরী হয় হত্যা মিশন

| প্রকাশের সময় : ৮ মার্চ, ২০১৭, ১২:০০ এএম

মহসিন রাজু, বগুড়া থেকে : দীর্ঘ এক যুগ পর উদ্ঘাটিত হল বগুড়ার বহুল আলোচিত চাঞ্চল্যকর বাংলাদেশ ফেডারেল সাংবাদিক ইউনিয়ন (বিএফইউজে) সাবেক সহসভাপতি ও স্থানীয় দৈনিক দুর্জয় বাংলার নির্বাহী সম্পাদক দীপঙ্কর চক্রবর্তী হত্যা রহস্য। উদঘাটিত তথ্য অনুযায়ী জেএমবি’র তৎকালীন সামরিক শাখার কমান্ডার সিদ্দিকুল ইসলাম ওরফে বাংলা ভাই এবং জেএমবি’র তৎকালীন আমীর শায়খ আব্দুর রহমানের জামাই আব্দুল আউয়ালের নির্দেশেই এই হত্যাকান্ড সংঘটিত হয়। এছাড়া বগুড়ার জামায়াত পল্লীখ্যাত জহুরুল নগরের ভাই বোন ছাত্রাবাস থেকে এই হত্যা মিশন সম্পন্ন করা হয়। বগুড়া পুলিশের হাতে রিমান্ডে থাকা হলি আর্টিজান রেস্তোরাঁয় হামলায় জড়িতদের মধ্যে অন্যতম আসামী শীর্ষ জেএমবি নেতা জাহাঙ্গীর আলম ওরফে রাজীব গান্ধী বগুড়ার শেরপুর জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট আদালতে দীপঙ্কর হত্যাকান্ড সম্পর্কে স্বীকারোক্তি মূলক জবানবন্দি দেওয়ায় এই হত্যাকান্ডকে ঘিরে সৃষ্ট বিতর্কের অবসান হল। মঙ্গলবার দুপুরে বগুড়া পুলিশ সুপারের কনফারেন্স রুমে এক প্রেস ব্রিফিংয়ে বগুড়ার পুলিশ সুপার আসাদুজ্জামান বগুড়ার শেরপুর উপজেলার আমলী আদালতের জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট আহসান হাবিবকে দেয়া রাজীব গান্ধীর স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দির প্রেক্ষিতে ঘটনার রহস্য উদ্ঘাটনের দাবী জানান।
রাজীব গান্ধীর জবানবন্দি সূত্রে জানা যায়, জেএমবি’র তৎকালীন শীর্ষ নেতা সিদ্দিকুল ইসলাম ওরফে বাংলা ভাই ও আব্দুল আউয়ালের (শায়খ আব্দুর রহমানের জামাতা) নির্দেশে সাংবাদিক দীপঙ্কর চক্রবর্তীকে হত্যা করা হয়। জেএমবি ও বাংলা ভাইকে নিয়ে নেতিবাচক লেখালেখির কারণেই তাকে হত্যা মিশন বাস্তবায়নের সিদ্ধান্ত হয়। মিশন বাস্তবায়নে রাজীব গান্ধীসহ আরো ৩ জন অংশ গ্রহণ করে। তারা হলো সম্প্রতি র‌্যাবের অপারেশনে সাভারে নিহত সারোয়ার জাহান ওরফে মানিক, সানাউল্লাহ এবং নুরুল্লাহ। বগুড়ার জামায়াত পল্লীখ্যাত জহুরুল নগরে ভাই বোন নামের একটি ছাত্র মেসে বসে ওই হত্যার পরিকল্পনা করা হয়। হত্যার আগের রাত ১০টায় মানিক মটর সাইকেল যোগে সানাউল্লাহ ও নুরুল্লাহকে নিয়ে শেরপুরে যায়। এর আগেই বাসযোগে সেখানে পৌঁছে রাজীব গান্ধী। রাজীব গান্ধীর দায়িত্বে ছিল দীপঙ্কর চক্রবর্তীর গতিবিধি লক্ষ্য করা, আর হত্যার দায়িত্ব ছিল সানাউল্লাহ ও নুরুল্লাহ। রাত ১২ টায় বগুড়া থেকে কাজ শেষে সাংবাদিক দীপঙ্কর চক্রবর্তী শেরপুরে নেমে জলযোগ নামের একটি হোটেলে চা পান করে বাসায় যাওয়ার পথেই তাকে কুপিয়ে হত্যা করা হয়।
জবানবন্দির সূত্রে পুলিশ সুপার সাংবাদিকদের জানান, সাংবাদিক নেতা দীপঙ্কর চক্রবর্তী গত ২০০৪ সালের ২ অক্টোবর রাতে শেরপুর উপজেলার সান্যালপাড়ায় নিজ বাড়ির সামনে খুন হন। হত্যাকারীরা ধারালো অস্ত্রের আঘাতে তার দেহ থেকে মাথাকে প্রায় বিচ্ছিন্ন করে ফেলেছিল। ঘটনাটি ওই সময়ে বগুড়াসহ সারাদেশে ব্যাপক আলোড়ন সৃষ্টি করে। ঘটনার পরপরই ভিকটিম দীপঙ্কর চক্রবর্তীর ছেলে পার্থ সারথী চক্রবর্তী বাদী হয়ে অজ্ঞাতনামাদের আসামী করে একটি হত্যা মামলা দায়ের করে। উক্ত মামলাটি প্রথমে শেরপুর থানা পুলিশ তদন্ত করে। পরবর্তীতে ডিবি পুলিশ ও সিআইডি তদন্ত করে পরপর তিন দফা চূড়ান্ত প্রতিবেদন দাখিল করা হয়। প্রতিবারই বাদী ওইসব রিপোর্টের বিরুদ্ধে নারাজির আবেদন জানান। একারণে মামলাটি পুনরায় তদন্তের আদেশ হয় এবং সর্বশেষ ২০১৪ সালের ১২ ডিসেম্বর জেলা গোয়েন্দা পুলিশ (ডিবি) বগুড়ার উপর দায়িত্ব প্রদান করে।
পুলিশ সুপার আরো বলেন, ২০১৬ সালের ১ জুলাই হলি আর্টিজান হামলার অন্যতম প্রধান পরিকল্পনাকারী জাহাঙ্গীর আলম ওরফে নাছির ওরফে রাজীব গান্ধী ওরফে সুভাস ওরফে জাহিদ ওরফে জাকির ওরফে আদিল ওরফে টাইগার ওরফে আবু ওমর আল বাঙ্গাল (৩৩) কে পুলিশ গ্রেপ্তার করে। তাকে বগুড়ার শেরপুর উপজেলার জোয়ানপুরে জেএমবি আস্তানায় বোমা বিস্ফোরণের মামলায় গ্রেফতার দেখিয়ে রিমান্ডে নেয়া হয়। রিমান্ডে ব্যাপক জিজ্ঞাসাবাদে রাজীব গান্ধী উক্ত ঘটনার সাথে জড়িত থাকাসহ দীপঙ্কর চক্রবর্তী হত্যায় জড়িত থাকার কথা স্বীকার করে। পুলিশি জিজ্ঞাসাবাদে রাজীব গান্ধী জানায়, সে ২০০১ সালে জেএমবিতে যোগদান করে এবং ২০০৪ সালের মাঝামাঝি সময়ে সারোয়ার জাহান ওরফে মানিক তাকে হিজরত করতে বলে। তার আহŸানে সাড়া দিয়ে সে গাইবান্ধা জেলার সাঘাটা থেকে সিরাজগঞ্জ জেলায় ডা. নজরুলের নিকটে যায়। ডা. নজরুল তাকে একটি মেসে নিয়ে যায়। সেখানে শাহাদত, মানিকসহ ৫/৬ জনকে দেখতে পায়। সে প্রায় ২ মাস উক্ত মেসে অবস্থান করেছিল। একদিন মানিক জাহাঙ্গীর আলম ওরফে রাজীব গান্ধীকে বলে বগুড়ায় একটা কাজ করতে হবে। রাজীব গান্ধী তাতে রাজি হওয়ায় ২০০৪ সালের সেপ্টেম্বর মাসের শেষের দিকে মানিক তাকে সিরাজগঞ্জ হতে বগুড়া জহুরুল নগর এলাকায় ভাই বোন ছাত্রাবাসে নিয়ে আসে। ঐ মেসে সে নুরুল্লাহ, সানাউল্লাহ, রাহাত, শিহাব, ওসমানসহ মোট ১০/১২ জনকে দেখতে পায়। উক্ত মেসে ৩টি রুম ছিল তার মধ্যে একটি রুম ফাঁকা ছিল। তারা ২ জন রাতে ঐ মেসে অবস্থান করে। পরের দিন সকাল ১০ টায় আব্দুল আওয়াল ঐ মেসে একজন ব্যক্তিসহ আসে এবং সেখানে একটি মিটিং হয়, সেখানে রাজীব গান্ধীসহ উক্ত ব্যক্তিবর্গ উপস্থিত ছিল। উক্ত মিটিংয়ে আব্দুল আওয়াল আলোচনা করে যে, জেএমবি সম্পর্কে পত্র-পত্রিকায় লেখালেখি এবং বিভিন্ন মিটিংয়ে জেএমবি কার্যক্রম সম্পর্কে বিরূপ মন্তব্য করায় সিদ্দিকুল ইসলাম ওরফে বাংলা ভাই দুর্জয় বাংলার সাংবাদিক দীপঙ্কর চক্রবর্তীকে হত্যার নির্দেশ দিয়েছে এবং সেখানে শায়খ আব্দুল আওয়াল ওই সাংবাদিককে হত্যা মিশনের বিস্তারিত পরিকল্পনা করে। পরিকল্পনা অনুযায়ী জাহাঙ্গীর আলম ওরফে রাজীব গান্ধী, নুরুল্লাহ, সানাউল্লাহ এবং মানিক মিলে হত্যার পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করবে। এরপর নুরুল্লাহ, মানিক চাপাতি দিয়ে সাংবাদিক দীপঙ্কর চক্রবর্তীর ঘাড়ে আঘাত করে হত্যা নিশ্চিত করে মটরসাইকেল যোগে পালিয়ে যায়। প্রেস বিফ্রিংকালে বিভিন্ন প্রশ্নের জবাবে পুলিশ সুপার বলেন, দীপঙ্কর হত্যাকান্ড সম্পর্কে স্বীকারোক্তি প্রদানের পর রাজীব গান্ধীকে এই মামলায় গ্রেফতার দেখিয়ে তাকে আরো ৭ দিনের রিমান্ডে নিয়েছে। রাজীব গান্ধীর কাছ থেকে আরো গুরুত্বপূর্ণ তথ্য পাওয়া যাবে বলে ধারণা পুলিশ সুপারের।
ব্রিফিংকালে পুলিশ সুপারের সাথে উপস্থিত ছিলেন অতিরিক্ত পুলিশ সুপার আরিফুর রহমান মন্ডল বিপিএম, আব্দুল জলিল বিপিএম, সনাতন চক্রবর্তী, সহকারী পুলিশ সুপার আনোয়ার হোসেন, আলোচ্য মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা ডিবি পুলিশের এসআই মজিবর রহমান।



 

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

ঘটনাপ্রবাহ: জঙ্গী


আরও
আরও পড়ুন
এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ
গত​ ৭ দিনের সর্বাধিক পঠিত সংবাদ