Inqilab Logo

শুক্রবার, ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ০৬ বৈশাখ ১৪৩১, ০৯ শাওয়াল ১৪৪৫ হিজরী

গ্রেফতার আতঙ্কে অবৈধ বাংলাদেশীরা

মালয়েশিয়ায় সাগরপথে যাওয়া কর্মীরা বৈধতার সুযোগ পাচ্ছে না

প্রকাশের সময় : ২৮ ফেব্রুয়ারি, ২০১৬, ১২:০০ এএম

শামসুল ইসলাম : মালয়েশিয়ায় অবৈধ অভিবাসীদের গ্রেফতার অভিযান চলছে পুরোদমে। দেশটিতে অবৈধ বাংলাদেশী কর্মীরা গ্রেফতার আতঙ্কে ভুগছেন। মালয়েশিয়া সরকার অবৈধ অভিবাসীদের বৈধতা দেয়ার কর্মসূচি ঘোষণা করেছে। মালয়েশিয়ায় অবৈধ কর্মীদের বৈধকরণের কর্মসূচি’র আওতায় অবৈধ কর্মীদের নিবন্ধনের কার্যক্রমও শুরু হয়েছে। তবে এ সুযোগের আওতাধীনদের বিশেষ কিছু শর্ত বেঁধে দেয়া হবে। সে ক্ষেত্রে যারা অযোগ্য বিবেচিত হবেন, তাদেরকে দেশে ফেরত পাঠানো হবে। যেসব বাংলাদেশী কর্মী জীবনের ঝুঁকি নিয়ে সাগরপথে দালালদের মাধ্যমে অবৈধভাবে মালয়েশিয়ায় গিয়ে কাজ করছে। তারা বৈধতা লাভের নিবন্ধন কার্যক্রমে অংশ নিতে পারবে না। এসব অবৈধ বাংলাদেশীদের দেশে ফিরে আসতে হবে। সাগরপথে যাওয়া অবৈধ বাংলাদেশী কর্মীদের বৈধতা লাভের লক্ষ্যে সরকারের পক্ষ থেকে কূটনৈতিক উদ্যোগ নেয়া জরুরী হয়ে পড়েছে। মালয়েশিয়ার কারাগারের আটককৃত বাংলাদেশী কর্মীদের দেশটিতে বৈধতা লাভের সুযোগ পেতেও সরকারের পক্ষ থেকে উদ্যোগ নিতে অনুরোধ জানিয়েছেন ভুক্তভোগিদের আত্মীয়-স্বজনরা। মালয়েশিয়া থেকে একাধিক সূত্র এতথ্য জানিয়েছে। গত ১৯ ফেব্রুয়ারী পূর্ব মালয়েশিয়ায় সেনাবাহিনীর সাথে বৈঠক শেষে মালয়েশিয়ার উপ-প্রধানমন্ত্রী ও স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী দাতো শ্রী ড. আহমদ জাহিদ হামিদি বাংলাদেশসহ অন্যান্য সোর্স কান্ট্রি থেকে অভিবাসী কর্মী নেয়ার সিদ্ধান্ত স্থগিত করেছেন। মালয়েশিয়া সরকারের ঘোষণা এমন সময়ে দেয়া হয়েছে যখন বাংলাদেশ থেকে অনলাইনের মাধ্যমে নতুন করে কর্মী নেয়ার ব্যাপারে জিটুজি প্লাস সমঝোতা স্মারক সই হয়েছে। মালয়েশিয়া সরকার অভিবাসী কর্মী নিয়োগের সিদ্ধান্ত স্থগিত ঘোষণা করায় বাংলাদেশী কর্মী ও রিক্রুটিং এজেন্সি’র মালিকদের মাঝে চরম হতাশার সৃষ্টি হয়েছে। দেশটিতে অবৈধ অভিবাসী কর্মীদের নিজ নিজ দেশে ফেরত পাঠানোর ঘোষণাও দেয়া হয়েছে।
বাংলাদেশ থেকে ১৫ লাখ কর্মী নেয়ার বিষয়ে জিটুজি প্লাস সমঝোতা স্মারক স্বাক্ষরের মাত্র এক দিনের মাথায় এ সিদ্ধান্তের কথা ঘোষণা দিয়েছেন দেশটি’র উপ-প্রধানমন্ত্রী ও স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী দাতো শ্রী ড. আহমদ জাহিদ হামিদি। মালয়েশিয়ার বার্তাসংস্থা ‘বার্নামা’ এ সংক্রান্ত একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করেছিল। প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, সারওর্য়াক-এর কোতাকিনাবারুতে দেশটির সেনাবাহিনীর সঙ্গে বৈঠক শেষে মালয়েশিয়ার উপ-প্রধানমন্ত্রী ও স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বলেন, শিল্প মালিকদের স্থানীয় কর্মীদের নিয়োগ দিতে অনুরোধ করা হয়েছে। আর অবৈধ বিদেশী কর্মীদের আটক করা হবে এবং নিজ নিজ দেশে ফেরত পাঠানো হবে। মালয়েশিয়ার উপ-প্রধানমন্ত্রী আহমদ জাহিদ হামিদি আশা করেন, মালয়েশিয়া বিশেষত, দেশটির তরুণরা সরকারের সিদ্ধান্তে সাড়া দেবেন এবং বিদেশীদের কাছে থাকা কাজগুলোতে নিজেরা অংশ নিয়ে দেশের অর্থনীতির বৃদ্ধিতে অবদান রাখবেন। এদিকে গত ১৮ ফেব্রুয়ারী ঢাকায় প্রবাসী কল্যাণমন্ত্রী নুরুল ইসলাম বিএসসি ও মালয়েশিয়ার মানবসম্পদ মন্ত্রী দাতো শ্রী রিচার্ড রায়ত জায়েম পাঁচ বছরের জন্য বাংলাদেশ থেকে কর্মী নেয়ার লক্ষ্যে জিটুজি প্লাস সমঝোতা স্মারকে সই করেন। যদিও মালয়েশিয়ার মানব সম্পদ মন্ত্রী দাতো শ্রী রিচার্ড রায়ত জায়েম এক বিবৃতিতে বলেছেন, গত ১৯ ফেব্রুয়ারী জনশক্তি আমদানির উপর জারিকৃত নিষেধাজ্ঞা জনশক্তি আমদানির লক্ষ্যে সদ্য স্বাক্ষরিত জিটুজি প্লাস চুক্তিতে কোনো প্রভাব পড়বে না।
উল্লেখ্য, ২০০৯ সালের মার্চ মাস থেকে মালয়েশিয়ায় জনশক্তি রফতানি বন্ধ রয়েছে। বহু কূটনৈতিক তৎপরতার পর ২০১২ সালে মালয়েশিয়ার সাথে বাংলাদেশের জিটুজি প্রক্রিয়ায় শুধু প্লানটেশন খাতে সরকারী উদ্যোগে কর্মী যাওয়ার চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়েছিল। জিটুজি প্রক্রিয়ায় মালয়েশিয়া কর্মী প্রেরণের জন্য ডাক-ঢোল পিটিয়ে দু’দফায় সারা দেশ থেকে প্রায় ২২ লাখ কর্মীর নিবন্ধন করা হয়েছিল। কিন্তু জিটুজি প্রক্রিয়ায় মালয়েশিয়ায় জনশক্তি রফতানি চরমভাবে ব্যর্থ হয়েছে। ২০১৩ সালের ২৪ এপ্রিল থেকে স্বল্প অভিবাসন ব্যয়ে গত ২১ জানুয়ারী পর্যন্ত ৯ হাজার ৮শ’ ৯২ জন কর্মী জিটুজি প্রক্রিয়ায় মালয়েশিয়া গেছে।
সম্প্রতি মালয়েশিয়ার প্রধানমন্ত্রী দেশটিতে সকল অবৈধ অভিবাসী কর্মীদের বৈধকরণের ঘোষণা দিয়েছেন। মালয়েশিয়ায় অবস্থানরত অবৈধ কর্মীদের নিবন্ধন কার্যক্রম শুরু হচ্ছে। সকল কাগজপত্র সঠিকভাবে নথিবদ্ধ করেই এবারের নিবন্ধনের কাজ শুরু হবে। অবৈধ কর্মীদের বৈধতা পাওয়ার সুযোগ ও মালয়েশিয়ার কর্মী চাহিদা মেটানোর কথা মাথায় রেখেই এ ব্যবস্থা নিয়েছে মালয়েশিয়া সরকার। তবে এ সুযোগের আওতাধীনদের বিশেষ কিছু শর্ত বেঁধে দেয়া হয়েছে। সে ক্ষেত্রে যারা অযোগ্য বিবেচিত হবেন, তাদেরকে দেশে ফেরত পাঠানো হবে। মালয়েশিয়া সরকারের অবৈধ অভিবাসী কর্মীদের বৈধকরণের সিদ্ধান্তে দেশটিতে অবৈধ বাংলাদেশী কর্মীরাও বৈধ হবার সুযোগ পাচ্ছে। মালয়েশিয়ার কুয়ালালামপুরস্থ ভেস্ট মার্কেটিং এসডিএন-বিএইচডি’ (৭৬৯২২৪-এ)-এর ম্যানেজিং ডিরেক্টর রুহুল আমিন গতকাল টেলিফোনে ইনকিলাবকে বলেন, মালয়েশিয়ায় ব্যাপক ধরপাকড় শুরু হয়েছে। এতে মালয়েশিয়ায় অবৈধ বাংলাদেশী কর্মীদের মাঝে আতংক বিরাজ করছে। তিনি অবৈধ কর্মীদের বৈধকরণের সুযোগ দেয়ায় মালয়েশিয়া সরকারকে আন্তরিক অভিনন্দন জানিয়ে বলেন, মালয়েশিয়ার বিভিন্ন ডিস্ট্রিকের কারাগার ও ডিটেনশন ক্যাম্পগুলোতে প্রচুর অবৈধ বাংলাদেমী কর্মী মানবেতর জীবনযাপন করছে। প্রবাসী বিশিষ্ট ব্যবসায়ী রুহুল আমিন মালয়েশিয়ার কারাগার ও ডিটেনশন ক্যাম্পে আটককৃত কর্মী এবং সাগরপথে আসা হাজার হাজার অবৈধ বাংলাদেশী কর্মীদের বৈধতা লাভের সুযোগ সৃষ্টির জন্য বাংলাদেশ সরকারের প্রতি উদাত্ত আহ্বান জানিয়েছেন। এদিকে, শুক্রবার রাতে চার বাংলাদেশীসহ ৬৫ জন অবৈধ অভিবাসীকে আটক করেছে মালয়েশিয়া পুলিশ। মালয়েশিয়ার ওপস সাপুতে চালানো এক অভিযানে তাদের আটক করা হয়। বাতু পাহাত এবং কেলুয়াং ইমিগ্রেশন অফিসকে সঙ্গে নিয়ে এই অভিযান পরিচালনা করে জোহর ইমিগ্রেশন বিভাগ। গভীর রাতে কাহাংয়ের বুকিক চানতিং অয়েল পাম প্লান্টেশনে কর্মীদের হোস্টেলে অভিযান চালিয়ে তাদের আটক করা হয়। আটককৃতদের মধ্যে চারজন বাংলাদেশী, একজন নেপালি এবং ৫৪ জন ইন্দোনেশিয়ান পুরুষ এবং ছয়জন নারী রয়েছেন বলে সাংবাদিকদের জানান অভিযানের নেতৃত্বে থাকা জোহর পুলিশের উপ-সহকারী পরিচালক রাশদিন রহমাত। তিনি বলেন, অবৈধ অভিবাসীদের বিরুদ্ধে ইমিগ্রেশন এ্যাক্ট-১৯৬৩ অনুযায়ী তদন্ত করা হবে। এসব অভিবাসীদের বয়স ৪৯ থেকে ৬২ বছরের মধ্যে। অভিবাসীরা সবাই সারাদিন কঠোর পরিশ্রম শেষে ঘুমাচ্ছিলেন। অভিযানের সময় অনেকেই পালানোর চেষ্টা করে ব্যর্থ হয়। আটক সবাইকে সেতিয়া ট্রোপিকা ইমিগ্রেশন অফিসে রাখা হয়েছে বলেও জানান তিনি। গত ৬ ফেব্রুয়ারী কুয়ালালামপুরের মসজিদ ইন্ডিয়ার পাশ্বের করিমের ক্লাব থেকে পুলিশ অভিযান চালিয়ে ১০ জনকে আটক করে। আটককৃতদের মধ্যে পটুয়াখালির মোতালেব হাওলাদারের ছেলে এমডি মিলনও রয়েছে। আটককৃত এমডি মিলনের পিতা ক্যান্সারে আক্রান্ত মোতালেব হাওলাদার বর্তমানের মৃত্যু শয্যায় শায়ীত। আটককৃত এমডি মিলন মালয়েশিয়ার কোন কারাগারে আছে এখনো তা’ জানা যায়নি। তার মাতা আটকৃত ছেলে এমডি মিলনকে মালয়েশিয়ায় বৈধতা লাভের সুযোগ দেয়ার জন্য সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের আশুহস্তক্ষেপ কামনা করেছেন।
এদিকে, মালয়েশিয়ায় অবস্থানরত অবৈধ কর্মীদের নিবন্ধন শুরু হচ্ছে। সরকারি এক বিজ্ঞপ্তিতে সম্প্রতি এ কথা জানানো হয়, সকল কাগজপত্র সঠিকভাবে নথিবদ্ধ করেই এবারের নিবন্ধনের কাজ শুরু হবে। অবৈধ কর্মীদের বৈধতা পাওয়ার সুযোগ ও মালয়েশিয়ার কর্মী চাহিদা মেটানোর কথা মাথায় রেখেই এ ব্যবস্থা নিয়েছে মালয়েশিয়া সরকার। এছাড়া এ নিবন্ধনের মাধ্যমে দেশে অবস্থানরত সকল অবৈধ কর্মীদের আদমশুমারি করা হবে, যা পরবর্তীতে দেশের আইন-শৃঙ্খলা নিয়ন্ত্রণে সাহায্য করবে। প্রশাসন থেকে জানানো হয়, সকল প্রকার হয়রানি ও জালিয়াতি ঠেকাতে সজাগ দৃষ্টি রাখা হবে। প্রাথমিক পর্যায়ে তিন মাস এ কর্মসূচি চলবে এবং এর ফলাফলের উপর ভিত্তি করে সময় বাড়ানোর সিদ্ধান্ত নেয়া হবে। নিবন্ধনের ক্ষেত্রে কর্মীদের নিয়োগকর্তা থাকতে হবে। আগে কোনো অপরাধমূলক কাজে জড়িত থাকলে নিবন্ধিত হওয়ার সুযোগ পাবেন না। পরবর্তীতে অনিবন্ধিত নিয়োগকর্তাদের খুঁজে পাওয়া গেলে তাদের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেয়া হতে পারে। কোনো ধরনের তাড়াহুড়ো না করে সঠিক প্রক্রিয়ায় নিবন্ধিত হওয়ার জন্য আবেদন জানানো হয়েছে সবাইকে। নিবন্ধনের বিস্তারিত তথ্য পাওয়া যাবে এই ওয়েবসাইটে। গতকাল পূর্ব মালয়েশিয়া থেকে প্রবাসী ব্যবসায়ী জাইদী জানান, মালয়েশিয়ার বিভিন্ন অঞ্চলে ইমিগ্রেশন পুলিশ ধরপাকড় শুরু করেছে। পূর্ব মালয়েশিয়ার সারওয়ার্ক থেকে যে সব অবৈধ বাংলাদেশী কর্মী রয়েছে তাদেরকে দেশে ফেরত আসতে হবে। পূর্ব মালয়েশিয়ার বিভিন্ন কারাগারে কয়েকশ’ বাংলাদেশী রয়েছে বলেও তিনি উল্লেখ করেন। কুয়ালালামপুরস্থ বাংলাদেশ হাইকমিশনের ফাস্ট সেক্রেটারী জেবিন গতকাল টেলিফোনে ইনকিলাবকে বলেন, মালয়েশিয়ায় অবৈধ অভিবাসীদের বৈধতা দেয়ার লক্ষ্যে নিবন্ধন কার্যক্রম শুরু হয়েছে।

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 



 

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

ঘটনাপ্রবাহ: গ্রেফতার আতঙ্কে অবৈধ বাংলাদেশীরা
আরও পড়ুন
এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ
গত​ ৭ দিনের সর্বাধিক পঠিত সংবাদ