Inqilab Logo

শুক্রবার, ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ০৬ বৈশাখ ১৪৩১, ০৯ শাওয়াল ১৪৪৫ হিজরী

হাওয়াই মিঠাই

| প্রকাশের সময় : ১৭ মার্চ, ২০১৭, ১২:০০ এএম

সৈয়দ ইবনুজ্জামান
রাতে ভালো ঘুম হয়নি। খুব ভোরে ঘুম থেকে উঠতেই দেখি বুবুর চারটা মিসড কল। কেন টের পাইনি বুঝতে পারছি।
গতকাল রাতে কেবল এপিঠ ওপিঠ করেছি, ঘুম আসেনি। এসেছে কেবল বাজানকে নিয়ে ঘেরা স্মৃতি। স্মৃতিগুলো আমার বুকে তীব্র ব্যথা তৈরি করে। গতকাল রাতে স্মৃতির পাতায় ভেসে উঠেছিল গ্রামের মেলায় বাজানকে হারিয়ে ফেলার ব্যাপারটা। বয়স তখন কতই বা হবে। পাঁচ কিংবা ছয়। বাজান মাইক দিয়ে আমাকে ডাকছেন। আমি বুঝতে পারছিলাম কিন্তু কীভাবে বাজানের কাছে যাব বুঝতে পারছিলাম না। শেষে এক হাওয়াই মিঠাই বিক্রেতাকে বললাম। তিনিই আমাকে বাজানের কাছে পৌঁছে দিলেন।
পৌঁছে বাজানকে বললাম, তোমারে খুঁইজা খুঁইজা আমি ক্লান্ত, বাজান। এক গেলাস পানি খাওয়াইবা!
বাজানের রক্তচক্ষু মুহূর্তেই অশ্রুসিক্ত হলো। আমাকে কোলে তুলে চুমু খেলেন। ছয় বছর বয়সেও বাজান আমার ঘোড়া হতেন। পঙ্খীরাজ ঘোড়ার গল্প শোনাতেন। বাজানের কাছে আবদার করেছিলাম একটা পঙ্খীরাজ ঘোড়া কিনে দেয়ার জন্য।
বুকটা কেমন যেন মোচড় দিল। বুবুকে ফোন দিতে হবে।
বুবু, এত্তো রাইতে ফোন দিসিলি কেন?
বুবু কাঁদতে কাঁদতে বলল, মা তোর সাথে কথা বলতে চায়।
বুবুর কান্নার আওয়াজ কেমন যেন আতঙ্কিত করল আমাকে। মা আমার সাথে কথা বলে না বছরদুয়েক হলো। বাজান বাড়ি থেকে চলে গিয়ে এক সময় নিখোঁজ হয়ে গ্রামে গেলে মা বলত, বাবা! সোনাচাঁন! বাজান রে! তোর বাজানের কোন খবর পাইছস?
যখন অপারগতা আমার চোখেমুখে সূর্যের আলোর মত ভেসে উঠতো মা তখন ধিক্কার দিয়ে বলত, কেমন পুত তুই! বাপে রে খুঁইজা বাইর করবার পারস না!
মাকে জিজ্ঞেস করতাম, মা, বাজান কেন এমনটা করল?
 মা তখন চুপ থাকত। খানিকবাদেই দেখতাম লুকিয়ে কাঁদছে।
বাজানের খোঁজ আজ আমি জানি তবুও মাঝ রাত্রিতে ঘুম ভাঙলে কেঁদে উঠি। বাজানকে কত্ত জায়গায় খুঁজেছিলাম! কিন্তু বাজানের খোঁজ মাকে আমি দিইনি। মা জানতো না তার খোঁজ আমার কাছে আছে। আমার এই অপারগতার জন্যই রাগ করে মা আমার সাথে কথা বলে না।
আজ যন্ত্রণাটা হয়ত প্রশমিত হতে চলেছে। বাড়ি গিয়ে দেখি মা বিছানায় ভীষণ অসুস্থ হয়ে আছে। তার পাশে খালা কোরআন তেলাওয়াত করছে। বুবু আমায় দেখে জড়িয়ে ধরে কাঁদতে লাগল। বুঝলাম মার সময় খুব কম। মার পাশে গিয়ে দাঁড়াতেই মুখটা সরিয়ে নিল। আমি বাইরে গিয়ে কাঁদতে লাগলাম।
সবাই আমাকে সান্ত¡না দিয়ে বলছে, ইস! তোর বাপটা যদি আইজ থাকতো!
বাবার কথা শুনে কষ্টটা আরো তীব্র হল। সবাই জানে বাজান নিখোঁজ। কেবল আমিই জানি বাজান কোথায় আছে।
রাতে মার পাশে গিয়ে বসলাম। মা আলতো করে আমার হাতটা ধরে কেঁদে দিল। চোখ বেয়ে যেন তার যুগ যুগের ঝর্ণা বইছে। আমাকে ইশারা করতেই আমি কানটা তার মুখের সামনে নিলাম। ফিস ফিস করে বলল, তোর বাজানেরে খুঁইজা পাইছস!
মাকে জড়িয়ে তখন চোখের পানি ঝরাতে থাকি। আর মা আমার মাথায় হাত বোলাতে থাকে।
খানিকবাদে বুঝলাম মা আর নেই। মার চোখের পানি এখনো আমার হাতে লেগে আছে। যে হাতে আমি আমার রক্তাক্ত বাজানকে ছুঁয়েছিলাম। আজ হয়ত আমার একটা ভাল চাকরি আছে কিন্তু যেদিন উচ্চ শিক্ষার জন্য শহরে এসেছিলাম সেদিন অনেক রাত পচা পাউরুটি খেয়ে রাত কাটিয়েছিলাম। রিকশায় চড়তাম না দশ টাকা বাঁচিয়ে রাতে একটা ভালো পাউরুটি খাব বলে। বাজান সামান্য কৃষক ছিল। আর আমি উচ্চাকাক্সক্ষার রঙিন স্বপ্ন নিয়ে ভর্তি হই প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ে এ যেন গরিবের ঘোড়ারোগ। বাজান কোন সেমিস্টারের ফি দিতে পারতেন আবার কখনো বা পারতেন না। টিউশনি করে যা পেতাম তা থাকতে একটু খেতেই খরচ হয়ে যেত। মেসের টাকা বাকি ছিল। কয়েক সেমিস্টারের টাকা বকেয়া পড়েছিল। চারিদিক থেকে চাপ আর চাপ। অন্যদিকে বাবা নিখোঁজ। দুশ্চিন্তায় আমি পথে পথে ঘুরতাম।
সেদিন অনেক রাত করে মেসে ফিরছিলাম। মেসের একটু আগেই বিশ্বরোড পড়ে। সেখান দিয়ে বড় বড় ট্রাক যায়। ফুটপাতে দাঁড়িয়ে সিগারেট ফুঁকছিলাম। চোখ পড়ল ফাঁকা রাস্তায় এক আহত পথচারীর দিকে। তাকে সাহায্যের জন্য তার কাছে এগিয়েও যাই। রাতের অন্ধকার আর রক্তে ভেজা পুরো মুখ। তখন পাশে পড়ে থাকা সাতটা একহাজার টাকার নোট আমার চোখ কাড়ল। গভীর রাত তখন। দু একটা গাড়ি চলছে। টাকাগুলো নিয়ে তাকে রক্তাক্ত অবস্থায় রাস্তায় ফেলে আমি দ্রুতবেগে ছুটতে থাকি। শুনিনি তার বাঁচার শেষ আকুতির শব্দ। যখন দিনের আলোতে সেখানে উৎসুক জনতার ভিড় ঘটে তখন পাশ কাটতে চাইলাম। পুলিশ যখন লাশটা ভ্যান গাড়িতে তুলল একটু দূর থেকে প্রশ্ন জাগল একে কি আমি চিনি? কাঁপা কাঁপা বুক নিয়ে সামনে যেতেই দিনের আলোতে চিনতে পারি এ আমার বাজানের রক্তমাখা মুখ।
ছোটবেলায় বাজান প্রশ্ন করত, আমি মইরা গেলে তুই কাঁদবি তো? চোখের সাগরে ভিজাইয়া দিবি আমায়?
বাজানের এ প্রশ্ন শুনে তখন কাঁদতাম, কেঁদে চলছি আজও।
বাজান বলত, জীবনটা একটা হাওয়াই মিঠাই। আর আমাকে এ যন্ত্রণা ততদিন ভোগ করতে হবে যত দিন জীবনের হাওয়াই মিঠাইটা চুপসে না যায়।



 

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

আরও পড়ুন