Inqilab Logo

শুক্রবার, ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১, ১৬ শাওয়াল ১৪৪৫ হিজরী

বন্দিদের দুর্বিষহ জীবন

| প্রকাশের সময় : ২১ মার্চ, ২০১৭, ১২:০০ এএম

হাসান-উজ-জামান : হাজার টাকায় সিট মিললেও থাকতে হয়েছে গাদাগাদি করে। বাসি রুটি, মোটা ভাতের সাথে শুধুই ডাল। মুখে নিতেই আসে বমি। এক কথায় দুর্বিষহ জীবন। এ উক্তি সম্প্রতি ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগার থেকে মুক্তি পাওয়া বন্দীদের। ঠাঁই নেই দেশের কারাগারগুলোতে। ধারণ ক্ষমতার চেয়ে অন্ততঃ আড়াই গুণ বন্দি রয়েছে প্রতিটি জেলখানায়। জেলা কারাগারগুলোর চিত্র আরো করুণ। কোথাও কোথাও পাঁচগুণ বন্দিও রয়েছে। দিনে দিনে বন্দির সংখ্যা বাড়ছে। শুধু বাড়ছে না সুযোগ-সুবিধা। এ অবস্থায় মানবেতর জীবন কাটাচ্ছেন সাধারণ বন্দিরা।
কারা কর্মকর্তা-কর্মচারীদের সুযোগ-সুবিধা বৃদ্ধি পেলেও স্বাধীনতার এত বছর পরেও বন্দিদের সেই একই অবস্থা। উল্টো জেল কোড অনুযায়ী তাদের প্রাপ্য খাদ্য, চিকিৎসা ও বাসস্থানের সুবিধাটুকু নিয়েও রীতিমত বাণিজ্য করছেন এক শ্রেণীর অসাধু কারা কর্মচারী। বর্তমানে যুগ্ম-সচিবও পরিচালক (আইন) রাজউক, সাবেক ঢাকার মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট রোকন উদ-দৌলা বলেন, ২০০৫-০৬ সালে ঢাকার মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট থাকাবস্থায় আমার প্রতিমাসে একবার ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগার পরিদর্শনের সুযোগ হয়েছে। এছাড়া ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারের মাসিক সভায় অংশগ্রহণ করতাম। অন্যদিকে ম্যাজিস্ট্রেট কোর্টে বিভিন্ন আসামির বক্তব্যে অনেক কিছু জানা গেছে। সে সব বিষয় রাষ্ট্রীয় এবং জনস্বার্থে সব প্রকাশ করা সম্ভব নয়। তবে ওই সময়ে কর্মকালীন বাস্তব অভিজ্ঞতা হতে যতটুকু উপলব্ধি করতে পেরেছি তাতে আমার কাছে স্পষ্ট মনে হয়েছে মহিলা এবং পুরুষ কারাগার সম্পূর্ণ আলাদা হওয়া উচিৎ। নারীদের জন্য কারাগার সম্পূর্ণ মহিলা দ্বারা পরিচালিত হওয়া আবশ্যক।   
দেশের ১৩টি কেন্দ্রীয় ও ৫৫টি জেলা কারাগারসহ মোট ৬৮টি কারাগারে বন্দির ধারণ ক্ষমতা রয়েছে ৩৪ হাজার। কিন্তু এই ধারণ ক্ষমতার বিপরীতে গতকাল পর্যন্ত বন্দি ছিলো ৭৮ হাজার। এর মধ্যে নারী বন্দির সংখ্যা ছিলো ২ হাজার ৮শ’ ৭৬ জন। যাদের সঙ্গে ৬ বছরের নিচে শিশু সন্তানও রয়েছে। ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারের ধারণক্ষমতা ২ হাজার ৬শ’ ৫০ জন। তার বিপরীতে গত রাতেও বন্দি ছিলেন সাড়ে ৭ হাজার। মানবাধিকার কর্মীরা এটিকে মানবিক বিপর্যয় বলে উল্লেখ করেছেন। তবে কারা কর্তৃপক্ষ বলছে, কারাগারে কোথাও কোন সঙ্কট নেই।  
সহকারী কারা মহা-পরিদর্শক (প্রশাসন) মোঃ আবদুল্লাহ আল মামুন বলেন, দেশের সীমান্ত এলাকা বিশেষ করে কক্সবাজার, সিলেট, সিরাজগঞ্জ, বগুড়া, চাঁপাইনবাবগঞ্জের জেলা কারাগারগুলোতে বন্দির সংখ্যা কয়েকগুণ বেশি হয়। এসব এলাকায় অপরাধ বেশি হয়। এ সময়ে মিয়ানমার থেকে আসা শরণার্থীদের অনেকে বিভিন্ন অপরাধে কক্সবাজারের জেলে বন্দি। অতিরিক্ত চাপে অনেক সময় কম্বল সঙ্কট দেখা দিলেও জেল কোড অনুযায়ী সকল বন্দি প্রাপ্য সুযোগ-সুবিধা পেয়ে থাকেন।
কারা জীবনের তিক্ত অভিজ্ঞতার বর্ণনা দিয়ে কেরানীগঞ্জে ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগার থেকে সদ্য মুক্তিপ্রাপ্ত সবুজ জানান, এখানের খাবার মুখে দেয়া যায় না। সকালে রুটির সাথে সামান্য গুড়। বাসি পচা রুটি মুখে দিতেই বমি আসে। পল্লবী থানার একটি মামলায় বেশ কিছুদিন কারাগারে অবস্থান করা সবুজ ভাতের বর্ণনা দিতে গিয়ে প্রায় কেঁদে ফেলেন। বলেন, দুপুরে ভাতের সাথে শুধুই ডাল। আর রাতে ভাতের সাথে জালী কুমড়ার সবজি। সপ্তাহে ১ বেলা নামমাত্র মাছ ও ১ বেলা গোশত দেয়া হয়। সাধারণ বন্দিদের আল্লাহ তায়ালা বাঁচিয়ে রেখেছেন। প্রতিটি কারাগারে হাসপাতাল থাকলেও চিকিৎসকের দেখা মেলে না। নার্সরা রোগী দেখেন। প্রায় সকল রোগের একই ওষুধ। খোঁজ নিয়ে জানা যায়, বন্দির অতিরিক্ত চাপে বেশিরভাগ কারাগারে খাদ্য, চিকিৎসা, পানি, পয়ঃনিষ্কাশনে সঙ্কট চলছে।
কারা বিধিমতে, থাকার জন্য প্রত্যেক বন্দি ৩৬ স্কয়ার ফিট অর্থাৎ ৬ ফিট বাই ৬ ফিট জায়গা পাবেন। পাবেন তিনটি কম্বল, ১টি থালা ও ১টি গøাস। এছাড়া একজন হাজতি খাবার জন্য নির্ধারিত পরিমাণ আটা, আখের গুড়, চাউল, মশুর ডাল, লবণ, ভোজ্য তেল, পেঁয়াজ, শুকনা মরিচ, হলুদ, ধনিয়া, সবজী, মাছ/গোশত এবং জ্বালানি কাঠ পাবেন।
অথচ জেল ফেরত হেলাল মিয়া জানান, ১ হাজার টাকায় সিট নেয়ার পরেও থাকতে হয়েছে গাদাগাদি করে। তিনটি কম্বলের পরিবর্তে ২টি কম্বল পেয়েছিলেন। ১শ’ টাকা দিয়ে নিজের প্রাপ্য বাকি কম্বল কিনতে হয়েছে। মুক্তি পাওয়া বন্দি মজিবর বলেন, প্রথমবারের মতো জেলে আসা বন্দিদের রাখা হয় টয়লেটের পাশে। তাদের ওপর চলে বিভিন্ন অত্যাচার।
তবে জেলখানায় উল্টো চিত্র প্রভাবশালী ও ধনি বন্দিদের বেলায়। অসাধু কারা কর্মচারীদের ম্যানেজ করে তারা মোবাইলে ব্যবহার, মাদক সেবন সবই করে। তাদের সময় কাটে তাস খেলে, গল্প করে। কারা হাসপাতালে অসুস্থরা ফ্লোরে থাকেন। আর সিট নিয়ে চলে বাণিজ্য। এক শ্রেণীর বন্দি আরাম আয়েশেই থাকেন হাসপাতাল ও প্রাইভেট ক্লিনিকের কেবিনে। যারা সপ্তাহে দশ হাজার করে টাকা দিতে পারেন তারাই এ সুযোগ পাচ্ছেন। শুধুমাত্র কারাগারের নরকযন্ত্রণা ভোগ করেন দরিদ্র বন্দিরা। দেশের সবগুলো জেলখানার চিত্র মোটামুটি একই।
মোহাম্মদপুর থানার মামলার আসামি টিপু সুলতান তার স্বজনদের জানিয়েছেন, তিনি বুকে ব্যথা নিয়ে ভর্তি হয়েছেন। রয়েছে শ্বাসকষ্টসহ শারীরিক দুর্বলতা। ডায়াবেটিসসহ উচ্চ রক্তচাপের রোগী তিনি। হাসপাতালের চিকিৎসকদের একাধিকবার জানানো হলেও কোন ধরনের পরীক্ষা-নিরীক্ষা ছাড়া শুধুমাত্র ব্যথার ট্যাবলেট সরবরাহ করেন।
স্বদেশ মানব কল্যাণ সোসাইটির সভাপতি এডভোকেট এস কে সিকদার বলেন, জেলখানার বন্দিদের অপরাধী হিসেবে চিহিৃত না করে মানুষ হিসেবে গণ্য করা উচিৎ। এ ক্ষেত্রে উন্নত বিশ্বকে অনুসরণ করা এবং তাদের আদলে কারাগার পরিচালনা হওয়া দরকার।  
পুরান ঢাকার ঘিঞ্জি পরিবেশ থেকে কেরানীগঞ্জের খোলামেলা জায়গায় স্থানান্তরিত হয় ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগার। বন্দিরা জানিয়েছেন, বাহ্যিক পরিবেশ পরিবর্তন হওয়ায় কিছুটা স্বস্তি মিলেছে তাদের। তবে মানহীন খাবার, সিট বাণিজ্য, মোবাইল ফোনের ব্যবহার-সবই আগের মতো।



 

Show all comments
  • মোস্তাফিজুর রহমান ২১ মার্চ, ২০১৭, ৯:৩৫ এএম says : 0
    কারাগারকে সংশধনের স্থানে রুপান্তর করুন। আমাদের দেশের কারাগার গুলো হোক ব্যাতিক্রমধরমী পাঠ্যশালা। এ ক্ষেত্রে সরকারের উপরোস্ত কর্মর্তাদের হস্তক্ষেপ কামনা করছি।
    Total Reply(0) Reply

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

ঘটনাপ্রবাহ: বন্দি


আরও
আরও পড়ুন
এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ
গত​ ৭ দিনের সর্বাধিক পঠিত সংবাদ