Inqilab Logo

শুক্রবার, ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ০৬ বৈশাখ ১৪৩১, ০৯ শাওয়াল ১৪৪৫ হিজরী

সন্ত্রাস ও জঙ্গিবাদের সঙ্গে ইসলামের সম্পর্ক নেই

| প্রকাশের সময় : ৩১ মার্চ, ২০১৭, ১২:০০ এএম

আল ফাতাহ মামুন : বিশ্বব্যাপী ‘সন্ত্রাস ও জঙ্গিবাদ’ একটি আলোচিত ইস্যু। দূর ও নিকট অতীতে বিশ্ব মোড়লরা রাজনৈতিক উদ্দেশ্য চরিতার্থের জন্য মুসলিম দেশগুলোতে জঙ্গিবাদের উদ্ভব ঘটিয়েছে। জঙ্গিবাদ দমনের নাম করে শেষ করে দিয়েছে প্রতিষ্ঠিত অনেক দেশকে। ইরাক, আফগানিস্তান, তাজিকিস্তান, বেলুচিস্তান, সিরিয়া যার জ্বলন্ত প্রমাণ। গেল কয়েক বছর ধরে আমাদের দেশেও জঙ্গিবাদের গন্ধ পাওয়া গেছে বলে মুখে ফেনা তুলেছেন কেউ কেউ। কিন্তু সম্প্রতি যা ঘটছে, বিশেষ করে সিলেটের দক্ষিণ সুরমার শিববাড়ী, মৌলভী বাজার, ঢাকার গুলশান ও বিমানবন্দরসহ আরো অন্যান্য জায়গায়, এখন হলফ করেই বলা যায় আমাদের দেশে জঙ্গিবাদের শেকড় অনেক গভীরে পৌঁছে গেছে। যেহেতু তাদের নিয়ন্ত্রণে আনতে দেশের সর্বোচ্চ শক্তি সেনাবাহিনীকে অনেক কসরত করতে হয়েছে, তাই এ ধারণাকে অসাড় বলা যায় না। কেন এবং কী উদ্দেশ্যে জঙ্গিবাদের উত্থান তা হয়তো বিশ্লেষণ সাপেক্ষ, কিন্তু জঙ্গিবাদের পেছনে ইসলাম ও ধর্মীয় উন্মাদনাকে দায়ী করা একেবারেই অগ্রহণযোগ্য। আসুন জেনে নিই সন্ত্রাস ও জঙ্গিবাদ সম্পর্কে ইসলাম এবং কোরআন কী বলে।
‘ত্রাস’ শব্দ থেকে এসেছে সন্ত্রাস। ত্রাস মানে ভয়। সমাজে ত্রাস সৃষ্টি করাকেই সন্ত্রাস বলে। সমাজ ও দেশে ভয়ভীতি-আতঙ্কিত পরিবেশ সৃষ্টি করে রাজনৈতিক বা ব্যক্তিগত উদ্দেশ্য হাসিল করার নাম সন্ত্রাসবাদ। ‘বিশ্ব মুসলিম সংস্থার’ একটি অঙ্গ সংগঠনের নাম ‘ইসলামী ফিকহ কাউন্সিল’। এ কাউন্সিলের মতেÑ ‘কোনো ব্যক্তি, সংগঠন বা রাষ্ট্র কোনো মানুষের ধর্ম, বিবেক বুদ্ধি, ধন-সম্পদ ও সম্মান-মর্যাদার বিরুদ্ধে অন্যায়ভাবে যে শত্রæতার চর্চা করে তাকে সন্ত্রাস বলে।’ জঙ্গিবাদ শব্দের উৎপত্তি ফারসি ‘জঙ্গ’ শব্দ থেকে। জঙ্গ অর্থ যুদ্ধ-লড়াই, হানাহানি-মারামারি ইত্যাদি। যিনি ‘জঙ্গ’ বা যুদ্ধ করেন তাকে বলে জঙ্গি। আর যুদ্ধসৈনিক ও তাদের সার্বিক কার্যক্রমকে বলে জঙ্গিবাদ। জঙ্গিবাদের আরেকটি সংজ্ঞা হলোÑ ধর্মীয় কারণে রাজনৈতিক পরিবর্তনের লক্ষ্যে চোরাগোপ্তা হামলা, অতর্কিত আক্রমণ, আত্মঘাতী হামলা অথবা হত্যা কিংবা কোনো নির্দিষ্ট মতবাদ প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে নৈরাজ্য সৃষ্টি করে জনগণের মাঝে আতঙ্ক সৃষ্টি করাকে জঙ্গিবাদ বলে।
সন্ত্রাস ও জঙ্গিবাদের সব সংজ্ঞা পর্যালোচনা করলে দেখা যাবে, এ দুটো কাজের জন্য কোথাও ইসলাম বা মুসলমানদের অন্তর্ভুক্ত বা দায়ী করা হয়নি। পাশ্চাত্য জ্ঞানীরাও সন্ত্রাস ও জঙ্গিবাদের সংজ্ঞায় ইসলামের প্রসঙ্গ তুলেননি। তার মানে, তাত্তি¡ক দিক থেকে সবাই একমত সন্ত্রাসবাদ-জঙ্গিবাদের সঙ্গে কোনো ধর্ম বিশেষ করে ইসলামের কোনো সম্পর্ক নেই। কিন্তু যখনই কোথাও কোনো সন্ত্রাসী কার্যক্রম সংঘটিত হয়, আত্মঘাতী ঘটনা ঘটে তখন বিশ্ব মিডিয়া মুসলমানদের দিকেই আঙ্গুল তোলে। পাশ্চাত্য মিডিয়ার দেখাদেখি এদেশের একশ্রেণির সাংবাদিকও সাম্প্রতিক সময়ের সন্ত্রাসী ও জঙ্গি হামলার পেছনে ধর্মীয় তথা ইসলাম ও মুসলিম চেতনাকে দায়ী করেন।
ইসলাম শান্তির ধর্ম। শান্তি বিলানোই মুসলমানের একমাত্র কাজ। অথচ এ ইসলামের নাম করেই বিশ্বব্যাপী চালানো হচ্ছে সন্ত্রাসী ও জঙ্গি কার্যক্রম। প্রথম কথা হলো, একজন প্রকৃত মুসলমান কখনো সন্ত্রাসবাদের সঙ্গে একাত্মতা পোষণ করতে পারে না। দ্বিতীয় কথা হলো, ইসলামের নামে যারা সন্ত্রাসী কার্যক্রম পরিচালনা করে তারা আদৌ ইসলামী বিশ্বাসী তথা মুসলিম কিনা সে ব্যাপারে বড় সন্দেহ রয়েছে। বরং গবেষণায় উঠে এসেছে, সন্ত্রাসী সংগঠনগুলোর সর্বোচ্চ নেতা থেকে শুরু সাধারণ লেবেলের কর্মীরাও অন্য ধর্ম থেকে কনভার্ট হয়ে সন্ত্রাসী কার্যক্রম পরিচালনা করছে। যেমন আইএসের প্রধান বোগদাদী ছিলেন ইহুদি ধর্মের অনুসারী। সে ছদ্মবেশে মুসলমানদের সঙ্গে মিশে যায়। এক পর্যায়ে তার সমমনাদের নিয়ে গড়ে তোলে সন্ত্রাসী সংগঠন আইএস বা ইসলামী স্টেট। মজার ব্যাপার হলো, আইএসসহ বিশ্বের যত সন্ত্রাসী সংগঠন ইসলামের কথা বলে জঙ্গি কার্যক্রম পরিচালনা করছে, তাদের প্রতিটি কার্যক্রমই ইসলাম ও মুসলমানদের জন্য অকল্যাণ ছাড়া ভালো কিছু বয়ে আনছে না। শুধু তাই নয়, তাদের কার্যকলাপে মুসলমানরা নিজেদের দেশ থেকে বিতারিত হচ্ছে কিংবা বিব্রত হচ্ছে নিজ দেশেই। অন্তত মুসলমানদের স্বাভাবিক জীবনযাত্রা তো ব্যাহত হচ্ছেই। প্রশ্ন হলোÑ মুসলমানদের স্বার্থেই যদি জঙ্গি কার্যক্রম পরিচালনা করা হয় তবে মুসলমানরাই টার্গেট কেন?
সন্ত্রাসী সংগঠনগুলোতে সব বিধর্মী বা কনভার্টেড মুসলমান তা আমি বলছি না। কিছু অজ্ঞ ও হতাশাবাদী মুসলমানও এদের কথায় আকৃষ্ট হয়ে ওই পথ বেছে নেয়। তবে এদের সংখ্যা একেবারেই কম। ইসলাম সম্পর্কে স্বচ্ছ ধারণা না থাকার কারণেই শান্তির ধর্মের অনুসারী দাবি করা সত্তে¡ও অশান্তি-অরাজকতার বিস্তারে জঙ্গি তথা সৈনিক হিসেবে তারা কাজ করছে। এ জন্য ইসলাম দায়ী নয়। দায়ী সে নিজে। কেন সে সঠিক ধর্ম জানল না। কোরআন পড়ল না কেন। তারপর দায় কিছুটা তার সমাজ ও দেশের আলেম-ওলামা সর্বোপরি সাধারণ মুসলমানদের ওপর পড়ে। তারা কেন তাকে ইসলাম ও কোরআন জানার সুযোগ করে দেয়নি। এ দায় থেকে মুক্ত হওয়ার জন্য আলেম-ওলামা নির্বিশেষে সব মানুষকে দায়িত্বশীল ভ‚মিকা পালন করতে হবে। শান্তি-সম্প্রীতি ও সৌহার্দ্যরে ধর্ম ইসলাম। এ কথা সর্বত্র সবার মাঝে ছড়িয়ে দিতে হবে। এর পক্ষে কোরআন এবং হাদিসের বাণীগুলো মুখে মুখে প্রচার করতে হবে।
হত্যা-নৈরাজ্য-বিশৃঙ্খলা সৃষ্টির ব্যাপারে কোরআন যে কত কঠোর হুঁশিয়ারি উচ্চারণ করেছে তা না জানার কারণেই এক শ্রেণির অজ্ঞ মুসলমান ওই পথে যাচ্ছে। আবার অমুসলিমরাও কোরআনে বর্ণিত শান্তি-সৌহার্দ্যরে নির্দেশগুলো না জানার কারণেই অশান্ত কোনো পরিবেশের কারণে ইসলামকে দায়ী করছে। মোদ্দা কথা, ইসলামের নামে যে কেউই সন্ত্রাসী কার্যক্রম করবে মনে করতে হবে তার উদ্দেশ্য ভিন্ন কিছু। কারণ, ইসলামের সঙ্গে সন্ত্রাস ও জঙ্গিবাদের দূরতম সম্পর্কও নেই।
এ সম্পর্কে পবিত্র কোরআনের কয়েকটি আয়াত তুলে ধরছি। কোরআন বলছে, ‘নরহত্যা কিংবা পৃথিবীতে বিপর্যয় সৃষ্টি করা ছাড়া অন্য কোনো কারণে যে ব্যক্তি কাউকে হত্যা করল, সে যেন পৃথিবীর সমস্ত মানুষকে হত্যা করল’ (সূরা মায়েদাহ : ৩২)। ‘আর যে ব্যক্তি জেনেবুঝে কোনো মুমিনকে হত্যা করে, তার শাস্তি হচ্ছে জাহান্নাম। সেখানে সে চিরকাল থাকবে। তার ওপর আল্লাহর ক্রোধ ও অভিসম্পাত বর্ষিত হতে থাকবে। আল্লাহ তার জন্য কঠিন শাস্তির ব্যবস্থা করে রেখেছেন।’ (সূরা নিসা : ৯৩)। একজন মানুষকে হত্যা করা বিশ্বের সব মানুষ হত্যা করার মতোই গুরুতর অপরাধ। কারণ, পৃথিবীর সব মানুষের প্রাণের বিনিময়ও ওই একজন মানুষের প্রাণ ফিরিয়ে আনা যাবে না। তাই যে ব্যক্তি এ ঘোরতর অন্যায় কাজ করবে তার শাস্তি জাহান্নাম ছাড়া আর কীইবা হতে পারে? জঙ্গিরা বলে, জান্নাতের আশায় তারা সন্ত্রাসী কার্যক্রম করে থাকে। তাদের আশায় গুঁড়েবালি দিয়েছে কোরআনের এ আয়াতগুলো।
জঙ্গিদের আরেকটি দাবি হলো, বিশ্বের মানুষ পাপাচারে লিপ্ত। তাই আমরা পাপীদের শায়েস্তা করতে আত্মঘাতীসহ ছোট-বড় হামলা করে থাকি। দেখি এ ব্যাপারে কোরআন কী বলে। ‘তোমাদের প্রত্যেকের জন্য একটি শরিয়ত এবং একটি কর্মপদ্ধতি নির্ধারণ করে রেখেছি। আল্লাহ চাইলে তোমাদের সবাইকে একই উম্মতের অন্তর্ভুক্ত করতে পারতেন। কিন্তু তিনি তোমাদের যা দিয়েছেন তা তোমাদের পরীক্ষা করার জন্য দিয়েছেন। কাজেই সৎকাজে একে অপরের অগ্রগামী হতে চেষ্টা কর। শেষ পর্যন্ত তোমাদের সবাইকে আল্লাহর দিকে ফিরে যেতে হবে’ (সূরা মায়েদাহ : ৪৮)। এখানে কোরআন বলছে, কারো মন্দ কাজে মনোযোগ না দিয়ে সৎকাজের প্রতিযোগিতা কর। পরকালের বিচারে প্রমাণিত হবে কে সঠিক ছিল। অন্য ভুল করছে তার দায়ভার তো আমার নয়। এর জন্য আত্মঘাতী হওয়ারও প্রয়োজন নেই। আল্লাহ বলেন, ‘হে মুহাম্মাদ! ওরা যদি ইমান না আনে তবে কি সে দুঃখে আপনি আত্মঘাতী হয়ে যাবেন?’ (সূরা কাহাফ : ৬।) ‘এ লোকেরা ইমান আনছে না বলে আপনি যেন নিজের প্রাণ বিনষ্ট করে দিতে বসেছে। আসলে এত মর্মবেদনায় মুর্ষে যাওয়ার প্রয়োজন নেই। আমি চাইলে আকাশ থেকে এমন নিদর্শন অবতীর্ণ করতাম, যার ফলে তাদের ঘাড় আমার সামনে নত হয়ে যেত। কিন্তু তাহলে তো আর তাদের পরীক্ষা করা হলো না’ (সূরা আশ শু’আরা : ২।) আল্লাহ বলেন, ‘ধর্মের ব্যাপারে জোরজবরদস্তি নেই। ভ্রান্ত মত ও পথকে সঠিক মত ও পথ থেকে ছাঁটাই করে আলাদা করে দেয়া হয়েছে’ (সূরা বাকার : ২৫৬।) সুতরাং ‘তোমাদের ধর্ম তোমাদের জন্য, আমাদের ধর্ম আমাদের জন্য’ (সূরা কাফিরুন : ৫।)
উগ্রপন্থিরা মনে করে বোমা মেরে মানুষ হত্যা করলে বিশ্বব্যাপী ইসলামী হুকুমত কায়েম হয়ে যাবে। কিন্তু ইতিহাস সাক্ষী, মানুষ হত্যা করে জোরপূর্বক ইসলাম প্রতিষ্ঠা করা ইসলামের আদর্শ নয়। প্রেম-প্রীতি, ভালোবাসা, ক্ষমা ও মহানুভবতার মাধ্যমে মানুষের হৃদয় জয় করাই ইসলাম ও মুহাম্মাদ (সা.)-এর আদর্শ। তাই জোর-জুলুম ও অশান্ত পরিবেশ সৃষ্টির সঙ্গে ইসলামের কোনো সম্পর্ক আগেও ছিল না, পৃথিবী ধ্বংস পর্যন্তও থাকবে না।
লেখক : শিক্ষার্থী, ডিপ্লোমা ইন অ্যারাবিক ল্যাঙ্গুয়েজ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
[email protected]



 

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

আরও পড়ুন
এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ
গত​ ৭ দিনের সর্বাধিক পঠিত সংবাদ