Inqilab Logo

মঙ্গলবার, ১৬ এপ্রিল ২০২৪, ০৩ বৈশাখ ১৪৩১, ০৬ শাওয়াল ১৪৪৫ হিজরী

যুদ্ধের কারণে বিশ্বের ২৩ কোটি শিশুর জীবন বিপন্ন-কৈলাশ সত্যার্থী

আইপিইউ সম্মেলনের ২য় দিনে

| প্রকাশের সময় : ৩ এপ্রিল, ২০১৭, ১২:০০ এএম

স্টাফ রিপোর্টার : বিশ্বে ধনী ও দরিদ্রের ব্যবধান ক্রমেই বেড়ে চলেছে। যুদ্ধের কারণে বর্তমান বিশ্বের প্রায় ২৩ কোটি শিশুর জীবন বিপন্ন। প্রতিদিন গড়ে ৯ হাজার শিশু ক্ষুধা ও দারিদ্রের কারণে মারা যাচ্ছে বলে জানিয়েছেন শান্তিতে নোবেল জয়ী মানবাধিকার কর্মী কৈলাশ সত্যার্থী। অপরদিকে সুন্দর পৃথিবী গড়ে তুলতে সংসদ সদস্যদের প্রতি আহŸান জানিয়েছে বিভিন্ন দেশের স্পিকাররা।
গতকাল রোববার আইপিইউ সম্মেলনের সাধারণ অধিবেশন সকাল ৯টায় বঙ্গবন্ধু আন্তর্জাতিক সম্মেলন কেন্দ্রে শুরু হয়। বেলা ১১টায় মূলপ্রতিপাদ্যের উপর সাধারণ আলোচনা শুরু হয়। স্পিকার ড. শিরীন শারমিন চৌধুরীর সভাপতিত্বে শুরু হওয়া এই আলোচনায় চলাকালে আইপিইউ প্রেসিডেন্ট সাবের হোসেন চৌধুরী ও সেক্রেটারি জেনারেল মটিন চুংগং উপস্থিত ছিলেন। ইন্টার পার্লামেন্টারি ইউনিয়ন (আইপিইউ)-এর ১৩৬তম সম্মেলনের প্রথম দিনে আলোচনায় মূলপ্রবন্ধ উত্থাপনকালে শান্তিতে নোবেল জয়ী মানবাধিকার কর্মী কৈলাশ সত্যার্থী একথা বলেন।
তিনি সম্মেলনের প্রতিপাদ্য ‘সমাজের বৈষম্য নিরসনের মাধ্যমে সবার মর্যাদা ও মঙ্গল সাধন’-এর উপর মূলপ্রবন্ধ উত্থাপন করেন। পরে বিষয়টির উপর বিভিন্ন দেশের প্রতিনিধিরা সাধারণ আলোচনায় অংশ নেন। ওই আলোচনায় বৈষম্যের কারণগুলো চিহ্নিত করে তা নিরসনে সমন্বিত পদক্ষেপ গ্রহণের উপর গুরুত্বারোপ করা হয়।
বিশ্বব্যাপী আয় বৈষম্যকে অর্থনৈতিক সহিংসতার বড় কারণ উল্লেখ করে কৈলাশ সত্যার্থী বলেছেন, অর্থনৈতিক বৈষ্ণম্যের কারণে সৃষ্ট এই সহিংসতা মানব জাতির নিরাপত্তা ও শান্তির জন্য বড় ধরনের হুমকি। বিশ্বে ধনী-দরিদ্রের ব্যাবধান ক্রমেই বেড়ে চলেছে। বিশ্বের একশো কোটি মানুষ এখনো দিনে দুই ডলার আয় করতে পারে না। দরিদ্র জনগোষ্ঠির অবস্থা দিনে দিনে আরো খারাপ হচ্ছে।
ভারতের শিশু অধিকার কর্মী কৈলাশ বলেন, আমরা যখন এই সম্মেলন করছি তখন ২৭০ মিলিয়ন শিশু স্কুলে যেতে পারছে না। ২১ মিলিয়ন মানুষ বিক্রি হয়ে শ্রমদাসে পরিণত হয়েছে। এটা মেনে নেয়া যায় না, সহ্য করা যায় না। তিনি বলেন, একদিকে একশো মিলিয়ন শিশু দাসত্ব, পাচার ও শিক্ষাবঞ্চনাসহ বিভিন্ন সহিসংতার শিকার হচ্ছে, অন্যদিকে একশো মিলিয়ন তরুণ রয়েছে, যারা চাচ্ছে পৃথিবীকে বদলে দিতে। তাদের পৃথিবী বদলে দেওয়ার শক্তি, ক্ষমতা ও আদর্শ আছে। এই তরুণদের পাশে দাঁড়াতে হবে আমাদের। তিনি আরো বলেন, পৃথিবীকে সুন্দর করতে তরুণদের শক্তি আছে, আদর্শ আছে, সম্ভাবনা আছে। আমরা যদি এই শক্তিকে কাজে লাগাতে না পারি, তবে তারা হতাশাগ্রস্ত, অসহিষ্ণু এবং সহিংস হয়ে পড়বে। তরুণদের যদি ক্ষমতা কাজে লাগানো গেলে এই পৃথিবী আরো আনন্দময় ও শক্তিশালী হবে বলে তিনি আশা প্রকাশ করেন।
বিশ্বব্যাপী সন্ত্রাস ও জঙ্গিবাদের দিকে ইঙ্গিত করে শান্তিতে নোবেল জয়ী কৈলাশ সত্যার্থী বলেন, দক্ষিণ এশিয়াসহ পৃথিবীর কিছু অংশে তরুণরা ভুল পথে পরিচালিত হচ্ছে। উগ্রবাদের পথ বেছে নিচ্ছে। বিশ্বের ২৩০ মিলিয়ন শিশু সংঘাতপূর্ণ এলাকায় বসবাস করছে। তাদের জীবন ও শিক্ষা বিপদগ্রস্ত। তিনি বলেন, প্রতিদিন গড়ে ৯ হাজার শিশু ক্ষুধা ও দারিদ্রের কারণে মারা যাচ্ছে। প্রকৃত অর্থে তারা মারা যাচ্ছেনা, তাদের হত্যা করা হচ্ছে। আড়াই লাখ শিশু পাচারের শিকার হচ্ছে। যৌথভাবে এর সমাধান আমাদের দায়িত্ব। বিপদগ্রস্ত শিশুদের বাঁচানোর জন্য বিশ্বের সকল দেশের সংসদ সদস্যদের প্রতি আহŸান জানান তিনি।
সংসদ সদস্যদের উদ্দেশ্যে তিনি বলেন, সারা বিশ্বে শিশুরাই বাল্য বিবাহ ও শিশু শ্রমের বিরুদ্ধে দাড়িয়েছে। আপনাদেরও (এমপি) দাঁড়ানো উচিত। বিশ্বের সকল শিশুর প্রাথমিক শিক্ষার জন্য মাত্র ২২ বিলিয়ন ডলার প্রয়োজন। যা বিশ্বের সাড়ে তিনদিনের প্রতিরক্ষা বাজেটের সমান। তিনি প্রশ্ন উত্থাপন করে বলেন, আমাদের এই বিশ্ব কি এতই গরীব যে এই পরিমান অর্থ প্রাথমিক শিক্ষার জন্য ব্যয় করতে পারবো না? তিনি আরো বলেন, বাজেটে এই অর্থ বরাদ্দ করার দায়িত্ব আপনাদের (এমপিদের)। আমি আপনাদের সবার প্রতি আহŸান জানাই, টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রায় শিশুর জন্য যা বলা হয়েছে তা অর্জনের জন্য যার যার দেশে ফিরে কাজ করবেন। প্রয়োজনে আইন পাস করবেন। বাজেটে বরাদ্দের উদ্যোগ নিবেন।
এসময় একটি উদ্যোগের কথা তুলে ধরে কৈলাশ সত্যার্থী বলেন, বিশ্ব নাগরিকদের জন্য একটি নতুন সভ্যতা গড়তে হবে। তাই আমি আপনাদের সবাইকে আহŸান জানাবো, আমরা সকল নোবেলজয়ীরা একটা ক্যাম্পেইন শুরু করেছি। ২০ সেপ্টেম্বর এমপিরা নিজ নিজ স্কুলে যান। আপনাদের স্কুলে শিশুদের সঙ্গে সময় কাটান। আমরাও এই কাজটি করবো। তিনি বলেন, আজই সময়, এই ঢাকাই স্থান, এখান থেকেই আমাদের শিশুদের জন্য কিছু করার জন্য ঐক্যবদ্ধ হতে হবে। সহানুভূতি নিয়ে সারা বিশ্বের শিশুর পাশে দাড়াতে হবে।
প্রবন্ধে নারীর ক্ষমতায়নের উপর গুরুত্বারোপ করেন এই নোবেল বিজয়ী। তিনি বলেন, যদি নারীকে আমরা সমভাবে ক্ষমতায়িত করতে পারতাম, তাহলে গত ৫ হাজার বছরের সভ্যতার ইতিহাসে অনেক সমস্যা আমাদের মোকাবেলা করতে হতো না। যা এখন আমোদের এখনো করতে হচ্ছে। তিনি আরো বলেন, কর্পোরেট নেতৃত্বের ক্ষমতা রয়েছে, কিন্তু জনপ্রতিনিধিদের সাথে এই ক্ষমতা মেলালে চলবে না। আপনারা কেবল জনগণ, ভোটার ও এলাকার জনপ্রতিনিধি নন, আপনারা লাখো প্রত্যাশা ও স্বপ্নের প্রতিনিধিত্ব করেন। আপনরা তাদের বিবেক এবং বিশ্বাসের রক্ষক। এটা বিবেচনায় নিয়ে বিশ্ব শান্তির জন্য আপনাদের ভ‚মিকা রাখতে হবে।
ড. শিরীন শারমিন চৌধুরী বলেন, সমাজে বৈষম্য নতুন বিষয় নয়। পৃথিবীর সৃষ্টি থেকে এই বৈষম্য চলে আসছে। এই বৈষম্য নিরসনে সমন্বিত পদক্ষেপ জরুরি। তার আগে বৈষম্যের কারণগুলো চিহ্নিত করা দরকার। তিনি বলেন, সমাজে যেমন অর্থনৈতিক বৈষম্য রয়েছে, তেমনি নারী পুরুষের বৈষম্য। এই বৈষম্যের কারণে বিপুলসংখ্যক জনগোষ্ঠী পিছিয়ে পড়ছে যা, আমাদের উন্নয়ন ও অগ্রগতিকে বাধাগ্রস্ত করছে।
স্পিকার আরো বলেন, আমাদের বাংলাদেশের সংবিধানের ২৮ অনুচ্ছেদে পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠীর জন্য বিশেষ পদক্ষেপের কথা বলা হয়েছে। আমাদের সরকার এবিষয়ে পদক্ষেপ নিচ্ছে। বিশ্বের অন্যান্য দেশগুলোও সেই পদক্ষেপ নিতে পারে। তবে কি পদক্ষেপ নেয়া হবে, সেটা সকলের আলোচনার মাধ্যমে ঠিক করতে হবে। আইপিইউ সম্মেলন আমাদের আলোচনার পথ তৈরি করে দিয়েছে। বৈষম্য নিরসনে আইপিইউ সম্মেলনের সুপারিশ বাস্তবায়নে কার্যকর উদ্যোগ গ্রহণের আহŸান জানান তিনি।
এই আলোচনায় নামিবিয়ার স্পিকার মার্গারেট মেনসা উইলিয়াম বলেন, বিশ্বে নারী-পুরুষের মধ্যে বৈষম্য রয়েছে। আমাদের সংসদ এসব বৈষম্য নিরসনে কাজ করছে। এছাড়া বর্তমান বিশ্বের ১৭টি দেশের রাষ্ট্রপ্রধান ও স্পিকার রয়েছে। পাশাপাশি ১৮ দশমিক ৩ ভাগ মন্ত্রী-এমপি নারী। অথচ বিশ্বায়নের এই যুগে নারীদের প্রতিনিধিত্ব যে জায়গায় থাকার কথা ছিল, তার থেকে এখনো অনেক পিছিয়ে রয়েছি। তিনি আরো বলেন, যেসব দেশে সংসদের স্পিকার নারী তাদেও, এই ক্ষেত্রে কাজ করার অবারিত সুযোগ রয়েছে। তারা সংসদে জনপ্রতিনিধিদের মাধ্যমে পিছিয়ে পড়া শিশু ও নারীদের উৎসাহিত করতে পারেন।
নাবিয়িার স্পিকার বলেন, নারীরা অথনৈতিকভাবে ক্ষমতাবান হয়ে উঠলেও এখনো আর্থিকভাবে তত বেশি শক্তশালি হয়ে উঠেনি। কারণ এখনো সাধারণ নারীরা পুরুষের তুলনায় অনেক কম আয় করে থাকেন। তবে, গৃহস্থালির কাজে অনেক বেশি এগিয়ে রয়েছেন নারীরা। এতো কিছুর পরও নারীদের সামনের দিকে এগিয়ে নিয়ে আসতে হলে অবশ্যই শক্তভাবে পদক্ষেপ নিতে হবে। এসকল পদক্ষেপ জেন্ডার বৈষম্য কমাতে সহায়ক হবে বলে তিনি আশা প্রকাশ করেন।
অষ্ট্রেলিয়ার তরুণ পার্লামেন্টারিয়ান আর ব মিথি বলেন, সমাজের সকল ধরণের অসমতা কমাতে হলে শিক্ষার মাধ্যমে আমরা এই কাজে যুব-সমাজকে অন্তর্ভুক্ত করতে পারি। যেখানে তারা বিশ্বের মানবাধিকার উন্নয়নে কাজ করতে পারে। পাশাপাশি নারী-পুরুষের মধ্যে বৈষম্য কমাতে চাকরির ক্ষেত্রে সমান সুযোগ রাখতে হবে। এবিষয়ে উদ্যোগী হওয়ার জন্য সম্মেলনে অংশ নেয়া প্রতিনিধিদের প্রতি আহবান জানান।



 

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

আরও পড়ুন
এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ
গত​ ৭ দিনের সর্বাধিক পঠিত সংবাদ