Inqilab Logo

বৃহস্পতিবার, ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১, ১৫ শাওয়াল ১৪৪৫ হিজরী

সন্তান বিক্রি করে ও ঘাস খেয়ে বেঁচে থাকার দুর্ভিক্ষ মধ্যপ্রাচ্যে হাজার কোটি ডলারের যুদ্ধব্যয়

| প্রকাশের সময় : ১৯ এপ্রিল, ২০১৭, ১২:০০ এএম

জামালউদ্দিন বারী : ব্যাপক বিধ্বংসী অস্ত্রের মজুদ থাকার মিথ্যা অভিযোগ এবং নাইন-ইলেভেন বিমান হামলার দায় চাপিয়ে আলকায়েদা নেটওয়ার্ক ও তালেবানদের ঘাঁটি গুঁড়িয়ে দেয়ার কথা বলে, ‘সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে যুদ্ধ’ নাম দিয়ে একযুগ আগে ইরাক ও আফগানিস্তানে মার্কিন প্রেসিডেন্ট জর্জ বুশ যে যুদ্ধ শুরু করেছিল, প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প সে যুদ্ধকে এখন ভয়াবহ ধ্বংসের ক্লাইমেক্সে নিয়ে যেতে শুরু করেছেন। যুদ্ধের এই দীর্ঘ পথচলায় মার্কিন সমরাস্ত্র শিল্প এবং মিলিটারি ইন্ডাস্ট্রিয়াল কমপ্লেক্স তাদের সম্ভাব্য সব ধরনের সমরাস্ত্রের পরীক্ষা-নিরীক্ষা চালানোর সুযোগ লাভ করেছে। এই যুদ্ধ আফগানিস্তানের সাথে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নয়। বরং বিশ্বের সবচেয়ে শক্তিশালী সামরিক-অর্থনৈতিক পরাশক্তি ও তাদের জোটের সাথে আফগানিস্তানের দরিদ্র কৃষক ও বেকার যুবকদের। গত ১২ বছরে এসব দরিদ্র মানুষের ওপর হাজার হাজার টন ক্লাস্টার বোমা, নাপাম বোমা, টমাহক ক্ষেপণাস্ত্রসহ প্রচলিত-অপ্রচলিত সব ধরনের মারণাস্ত্র ব্যবহার করে লাখ লাখ মানুষকে হত্যা করা হয়েছে। লাখ লাখ মানুষকে পঙ্গু করা হয়েছে, কোটি মানুষকে উদ্বাস্তু করে ইরাক ও আফগানিস্তানে মানবিক বিপর্যয় সৃষ্টি করেও মার্কিনি ও পশ্চিমা সাম্রাজ্যবাদীরা রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক বা মনস্তাত্তি¡ক বিজয় অর্জন করতে পারেনি। তবে তাদের তথাকথিত সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে যুদ্ধ শুরুর পর আল কায়েদার নতুন নতুন শাখা গঠিত হয়েছে, আইএসের মতো জঙ্গিবাদী গ্রুপ প্রবল শক্তি নিয়ে মাঠে নেমেছে, সিরিয়ায় বাশার আল আসাদকে ক্ষমতাচ্যুত করতে সশস্ত্র বিদ্রোহী গ্রুপগুলো সিরিয়ায় ব্যাপকভিত্তিক গৃহযুদ্ধ শুরু করেছে এবং এসবই ঘটেছে পশ্চিমা গোয়েন্দা সংস্থাগুলোর আনুকূল্য ও পৃষ্ঠপোষকতায়। ইরাক, আফগানিস্তান বা সিরিয়ায় রাজনৈতিক লক্ষ্য অর্জনে চরমভাবে ব্যর্থ হলেও আইএসের মতো জুজুর ভয় দেখিয়ে মধ্যপ্রাচ্যে হাজার হাজার কোটি ডলারের অস্ত্র বিক্রি করা সম্ভব হয়েছে। তেলের মূল্য ধসের মধ্যেও সউদি আরবের মতো দেশকে হাজার কোটি ডলারের অস্ত্র কিনতে হচ্ছে, অন্যদিকে তেল আমদানি খাতে বছরে হাজার হাজার কোটি ডলার সাশ্রয় হওয়ায় বিগত দশকের অর্থনৈতিক মহামন্দার রেশ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র অনেকটা কাটিয়ে উঠতে সক্ষম হলেও সউদি আরবের মত দেশ বিপুল পরিমাণ ঘাটতি বাজেটের দেশে পরিণত হয়েছে। কয়েক বছর ধরে সউদি অর্থনীতিতে ২০ শতাংশ হারে বাজেট ঘাটতি হচ্ছে বলে রিপোর্টে প্রকাশিত হচ্ছে। ২০ শতাংশ হারে বাজেট ঘাটতি অব্যাহত থাকলে মধ্যপ্রাচ্যের সবচেয়ে সমৃদ্ধ অর্থনীতির দেশটিও পাঁচ বছরের মধ্যে দেউলিয়া হয়ে যেতে পারে। ২০১৫ সালে প্রকাশিত আইএমএফের এক রিপোর্টে সউদি বাজেট ঘাটতি প্রায় ২১ শতাংশ হার উল্লেখ করে বলা হয়েছে, ২০২০ সাল নাগাদ দেশটি দেউলিয়া হয়ে যেতে পারে। পশ্চিমাদের ‘সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে যুদ্ধ’ শুরুর আগে সউদি আরবের এমন পরিণতির কথা কেউ কল্পনাও করতে পারেনি।
মধ্যপ্রাচ্যে জর্জ বুশের যুদ্ধ শুরুর দিকেই পশ্চিমা নিওকন সমরবিদরা একে ‘অন্তহীন যুদ্ধ’ আখ্যায়িত করেছিল। হাজার বছর আগে মুসলমানদের দিগি¦জয় ঠেকাতে ইউরোপীয় খ্রিস্টানরা ঐক্যবদ্ধ হয়ে যে ক্রুসেড শুরু করেছিল তা শেষ পর্যন্ত দুইশ বছর স্থায়ী হয়েছিল। সে যুদ্ধে প্রথমে জেরুজালেম নগরী মুসলমানদের হাতছাড়া হয়ে গেলেও তা পুনরুদ্ধারে মুসলমানদের খুব বেশি সময় লাগেনি। মধ্যযুগের পর  ইউরোপীয় রেনেসাঁস, শিল্পবিপ্লবের মধ্য দিয়ে হাজার বছর পেরিয়ে আমাদের বিশ্ব একবিংশ শতাব্দীতে প্রবেশ করলেও ইউরোপে মুসলমানদের অগ্রযাত্রা কখনো রুদ্ধ হয়ে যায়নি। ইতোমধ্যেই ইউরোপের প্রায় সব বড় শহরে মুসলমানরা দ্বিতীয় বৃহত্তম ও প্রভাবশালী জনগোষ্ঠী হিসেবে আবিভর্‚ত হয়েছে। আগামী কয়েক দশকের মধ্যেই ইউরোপের অনেক শহরে মুসলমানরা সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগোষ্ঠী হিসেবে আবির্ভূত হবে বলে ইউরোপের রাজনীতি ও ডেমোগ্রাফিক বিশ্লেষকরা মনে করছেন। পশ্চিমা দুনিয়ায় ইসলামের এই অগ্রযাত্রা রুখতেই সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে যুদ্ধের নাম করে ইউরোপ-আমেরিকায় আরেকটি ক্রুসেডের প্রয়োজনীয়তা বোধ করেছিল পশ্চিমা পাওয়ার এলিটরা। নাইন-ইলেভেন বিমান হামলার পর প্রথম ভাষণেই সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে যুদ্ধকে নতুন ‘ত্রুসেড’ বলে উল্লেখ করেছিলেন মার্কিন প্রেসিডেন্ট জর্জ বুশ। আফগানিস্তানে সোভিয়েত দখলদারিত্বের বিরুদ্ধে আফগান তালেবানরা দেশকে শত্রুমুক্ত করতে জানবাজ লড়াই করেছিল। সে লড়াইয়ে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও তার গোয়েন্দা সংস্থা আফগান মুজাহিদদের পাশে দাঁড়িয়েছিল। তাদেরই সরাসরি তত্ত্বাবধানে আল কায়েদার মতো চৌকস গেরিলা টিম গড়ে উঠেছিল। সউদি বিন লাদেন গ্রুপ ও ওসামা বিন লাদেনের পরিবারের সাথে সাবেক মার্কিন প্রেসিডেন্ট জর্জ বুশদের পারিবারিক সম্পর্কের কথাও কারো অজানা নয়। সেই ওসামা বিন লাদেনের ওপর নাইন-ইলেভেন বিমান হামলার দায় চাপিয়ে তাকে ধরা ও আলকায়েদার নেটওয়ার্ক ভেঙে দেয়ার অজুহাত তুলেই আফগানিস্তানে শত শত যুদ্ধবিমান নিয়ে হামলা চালিয়ে সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে যুদ্ধের সূচনা হয়েছিল। মাত্র কয়েকশ আল কায়েদা যোদ্ধার নেটওয়ার্ক বা পতিত তালেবানদের সক্ষমতা গুঁড়িয়ে দিতে ১২ বছর ধরে অবিরাম বোমাবর্ষণ করেও তারা সফল হয়নি। উপরন্তু নতুন নতুন সন্ত্রাসী গ্রæপের আত্মপ্রকাশ ঘটেছে। এক যুগেরও বেশি সময় ধরে যুদ্ধ করে শত শত বিলিয়ন ডলারের সমরাস্ত্র ও যুদ্ধব্যয় খরচ করার পর তালেবানরা আফগানিস্তানে ২০০২ সালের চেয়ে বেশি এলাকা নিয়ন্ত্রণ করছে। এখন আমেরিকান ও ন্যাটো বাহিনীর প্রতি প্রকাশ্য চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দিচ্ছে তালেবানরা। আন্তর্জাতিক ফোরাম এবং নিগোসিয়েশন ডায়ালগেও তালেবানরা আগের চেয়ে অনেক বেশি সক্রিয় সক্ষমতা দেখাচ্ছে।  
সিরিয়ায় নানা ৬ বছরের গৃহযুদ্ধে বাশার আল আসাদ সরকারের পতন নিশ্চিত করতে ব্যর্থ হয়ে অবশেষে ডোনাল্ড ট্রাম্প  অর্ধশতাধিক টমাহক ক্ষেপণাস্ত্র ব্যবহার করেছে। গত ৭ এপ্রিল পারস্য উপসাগরে অবস্থানরত মার্কিন রণতরী থেকে সিরিয়ার হোমসের আল শায়রাত বিমান ঘাঁটিতে ৫৯টি টমাহক ক্ষেপণাস্ত্র নিক্ষেপের তথ্য জানা যায়। তবে ৫৯টি টমাহক ক্ষেপণাস্ত্রের মধ্যে মাত্র ২৩টি ক্ষেপণাস্ত্র লক্ষ্যবস্তুর কাছাকাছি আঘাত হানতে পেরেছে বলে স্যাটেলাইট থেকে প্রাপ্ত তথ্যে জানা যায়। মার্কিনিদের এই আকস্মিক আক্রমণে শতাধিক মানুষ হতাহত হয়েছেন। প্রতিটি টমাহক ক্ষেপণাস্ত্রের পেছনে দেড় মিলিয়ন ডলার খরচ হয়। অর্থাৎ ১৫ মিনিটের ক্ষেপণাস্ত্র বর্ষণে শুধুমাত্র ৫৯টি টমাহক ক্ষেপণাস্ত্রের মূল্য বাবদ খরচ হয়েছে বাংলাদেশি মুদ্রায় অন্তত সাড়ে ৭০০ কোটি টাকা। কথিত রাসায়নিক অস্ত্রের ডিপোতে এই ক্ষেপণাস্ত্র হামলার কথা বলা হলেও আন্তর্জাতিক মিডিয়ার অব্যাহত দাবির পরও ট্রাম্প প্রশাসন শায়রাত বিমান ঘাঁটিতে রাসায়নিক অস্ত্র মজুদের কোনো প্রমাণ দিতে ব্যর্থ হয়েছে। অন্যদিকে জাতিসংঘসহ আন্তর্জাতিক কনভেনশন বা জনমত উপেক্ষা করে সিরিয়ায় মার্কিন বাহিনীর ক্ষেপণাস্ত্র হামলার জবাবে রাশিয়া তাৎক্ষণিকভাবে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সাথে ২০১৫ সালে সম্পাদিত আকাশ নিরাপত্তা চুক্তি বাতিল করে দিয়ে পাল্টা সামরিক ব্যবস্থা গ্রহণের হুঁশিয়ারি জানিয়েছে। এ কথা সত্য যে, সিরিয়ায় মানবিক বিপর্যয় সৃষ্টির প্রেক্ষাপট নির্মানে শাসক বাশার আল আসাদেরও দায় রয়েছে। তবে ছয় বছরের যুদ্ধবিধ্বস্ত ও মানবিক বিপর্যয়ের সম্মুখীন একটি দেশ বিশ্বের একনম্বর সামরিক পরাশক্তি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের এমন অযাচিত ক্ষেপণাস্ত্র হামলার শিকার হয়ে শতাধিক মানুষ প্রাণ হারানোর ঘটনা খুবই দু:খজনক নিহতদের সকলে বা কেউ আইএস জঙ্গি কিনা এটাও কিন্তু নিশ্চিত করতে পারেনি মার্কিন সেনাদপ্তর। মার্কিন সমরাস্ত্র ভান্ডারে টমাহক ক্ষেপণাস্ত্র বহুল ব্যবহৃত অস্ত্র। নব্বইয়ের দশকে প্রথম গাল্ফ ওয়ার থেকে শুরু করে বিভিন্ন যুদ্ধক্ষেত্রে এ পর্যন্ত দুই হাজারের বেশি টমাহক ক্ষেপণাস্ত্র নিক্ষেপ করা হয়েছে বলে জানা যায়। বলাবাহুল্য, এসব সমরাস্ত্রের ৯০ শতাংশের বেশি ব্যবহৃত হয়েছে মুসলমানদের বিরুদ্ধে। সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে যুদ্ধ, সাদ্দাম হোসেন বা বাশার আল আসাদের রিজিম চেঞ্জ, আল-কায়েদা, আইএস ইত্যাদি ইস্যুকে সামনে রেখে এসব রণদামামা বাজানো হলেও কোনো ক্ষেত্রেই মার্কিনিরা তাদের শান্তি ও নিরাপত্তার রাজনৈতিক প্রতিশ্রুতির বাস্তবায়ন করতে পারেনি। কোনো সন্ত্রাসী বা জঙ্গিবাদী গ্রুপকে ধ্বংস বা দুর্বল করতে পারেনি। শুধুমাত্র মধ্যপ্রাচ্যের সমৃদ্ধ মুসলিম দেশ ও জনপদ, হাজার হাজার বছরের প্রত্মতাত্তিক নির্দশনগুলোকে ধ্বংসস্তূপে পরিণত করা হয়েছে।
এই মুহূর্তে সিরিয়া, ইরাক, লিবিয়া, ইয়েমেন, দক্ষিণ সুদান, সোমালিয়া, নাইজেরিয়ার কয়েক কোটি মানুষ মানবিক বিপর্যয়ের সম্মুখীন। শুধুমাত্র উত্তর আফ্রিকার তিনটি দেশের প্রায় ৩ কোটি মানুষ চরম খাদ্যাভাবে দুর্ভিক্ষের মুখোমুখি পড়েছে বলে গত মাসে প্রকাশিত জাতিসংঘের এক রিপোর্টে জানা যায়। এর মধ্যে প্রায় দেড় কোটি শিশুর অবস্থা আশঙ্কাজনক, জরুরি ভিত্তিতে এদের প্রয়োজনীয় চিকিৎসাসেবা ও পুষ্টিসহায়তা দিতে না পারলে তাদের প্রাণহানি ঘটার আশঙ্কা রয়েছে। ইয়েমেন সরকারের পক্ষ থেকে প্রায় দুই কোটি মানুষের জন্য জরুরি মানবিক সহায়তার আবেদন জানানো হয়েছে। গৃহযুদ্ধ কবলিত দক্ষিণ সুদানের সরকার এবং জাতিসংঘের তিনটি সংস্থা দেশটির দুটি কাউন্টিতে দুর্ভিক্ষাবস্থা ঘোষণা করেছে। বিদ্রোহী ও সেনাবাহিনীর লুটতরাজের মধ্যে সেখানকার ৪০ লাখ মানুষ ক্ষুধার যন্ত্রণায় কাতরাচ্ছে। লতাপাতা, ঘাস ও শাপলা খেয়ে বেঁচে থাকার শেষ চেষ্টা করছে তারা। বিশ্ব সম্প্রদায় একদিকে যুদ্ধ বন্ধে কার্যকর উদ্যোগ গ্রহণে ব্যর্থ হচ্ছে, অন্যদিকে দুর্ভিক্ষের মহামারী থেকে রক্ষায়ও মানবিক উদ্যোগ নিতে দেখা যাচ্ছে না। অবস্থাদৃষ্টে মনে হচ্ছে, যুদ্ধোন্মাদ সাম্রাজ্যবাদীরা গৃহযুদ্ধের ইন্ধন দিয়ে, বিমান হামলা করে, স্থলসেনা পাঠিয়ে, ক্ষেপণাস্ত্র ফেলে লাখ লাখ মুসলমানকে হত্যা করেই ক্ষান্ত নয়, তারা দুর্ভিক্ষাবন্থা সৃষ্টি করে পরোক্ষভাবে আরো কোটি কোটি মানুষকে মৃত্যুর দিকে ঠেলে দেয়ার চেষ্টা করছে। এক দশকেরও বেশি সময় ধরে ফিলিস্তিনের গাজা স্ট্রিপের ২০ লাখ মানুষ ইসরাইলের সর্বাত্মক অবরোধের শিকার হয়ে মানবিক বিপর্যয়ের মধ্যে বেঁচে আছে। এদের জন্য সাম্রাজ্যবাদীদের বা বিশ্বসম্প্রদায়ের যেন কোনো দায় নেই। অন্যদিকে মধ্যপ্রাচ্যের জায়নবাদী রাষ্ট্র  ইসরাইল অস্ত্র রফতানি ও মার্কিন সহায়তা নিয়ে তার নাগরিকদের মাথাপিছু আয় ও ইউরোপীয় লিভিং স্টান্ডার্ড নিশ্চিত করার পাশাপাশি পুরো বিশ্বে গোয়েন্দাগিরি করে নানা রকম প্যাঁচ লাগিয়ে রাখছে। অস্ত্রের মুখে ফিলিস্তিনিদের জমি দখল করে ইসরাইল রাষ্ট্র সৃষ্টির পর থেকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র বিরামহীনভাবে প্রতিবছর গড়ে সাড়ে তিন বিলিয়ন ডলারের অর্থসহায়তা পাচ্ছে। সমরাস্ত্র, সামরিক প্রযুক্তি, নিরাপত্তা সহায়তার বিচারে ইসরাইলের প্রতি মার্কিন সহায়তার পরিমাণ আরো অনেক বেশি। তবে কয়েক বছর আগে মার্কিন কংগ্রেসে দেয়া এক ভাষণে সাবেক মার্কিন কংগ্রেসম্যান জেমস ট্র্যাফিকেন্ট দাবি করেন, মার্কিন জনগণের রাজস্ব থেকে প্রতি বছর ইসরাইলকে ১৫ বিলিয়ন ডলার দেয়া হচ্ছে। অর্থাৎ ইসরাইলের প্রায় ৫০ লাখ ইহুদির প্রত্যেকে বছরে গড়ে ৩ হাজার ডলারের মার্কিন অর্থ সহায়তা পাচ্ছে। দখলদার, যুদ্ধবাজ ইসরাইলকে অর্থ সহায়তা দেয়া তেলামাথায় তেল দেয়ার শামিল। এর অর্ধেক সহায়তা দিয়ে মধ্যপ্রাচ্য, উত্তর আফ্রিকা ও এশিয়ার অতি দরিদ্র ও যুদ্ধের কারণে দুর্ভিক্ষ কবলিত চার কোটি মানুষকে খাদ্য ও চিকিৎসা দিয়ে ভালোভাবে বেঁচে থাকার পথ করে দেয়া যায়। আর প্রতি বছর এ পরিমাণ সহায়তা চ্যারিটিতে ব্যয় করে ক্ষুধা-দারিদ্র্যমুক্ত বিশ্ব গড়ে তোলা সম্ভব। সরাসরি সহায়তা না দিলেও ইসরাইলকে সহায়তা বন্ধ করে দেয়ার পাশাপাশি দেশগুলোতে রাজনৈতিক ও সামরিক হস্তক্ষেপ থেকে পশ্চিমারা বিরত থাকলেই ক্ষুধা, দারিদ্র্য, শরণার্থী সমস্যা ও দুর্ভিক্ষের ঝুঁকি অন্তত ৮০ ভাগ কমিয়ে আনা সম্ভব। বর্তমানে বিশ্বের যেসব অঞ্চলে দুর্ভিক্ষ ও মানবিক বিপর্যয় দেখা দিয়েছে তার প্রায় সবগুলোই ঘটছে পশ্চিমা সাম্রাজ্যবাদী হস্তক্ষেপ এবং তথাকথিত সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে যুদ্ধের কারণে।
যুদ্ধ শেষ করে শান্তি প্রতিষ্ঠা করা তাদের লক্ষ্য নয়। তাদের লক্ষ্য হচ্ছে অন্তহীন যুদ্ধ চালিয়ে যাওয়া। বিশেষত মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোতে বিদ্রাহ, আলকায়েদা, আইএস জুজু দেখিয়ে সন্ত্রাসবিরোধী যুদ্ধে জড়িয়ে অস্ত্র বিক্রির মাধ্যমে নিজেদের অর্থনীতিকে সচল রাখা। পেট্রোলিয়ামের মতো ফসিল জ্বালানির সুলভ বিকল্প না থাকা এবং ইসরাইলের নিরাপত্তা হুমকি পুরোপুরি দূরীভ‚ত না হওয়া পর্যন্ত তারা সম্ভবত এই যুদ্ধ চালিয়ে যেতে চায়। তা না হলে বিশ্বের অন্যতম দরিদ্র ও অনগ্রসর দেশ আফগানিস্তানে একযুগের বেশি সময় ধরে আগ্রাসন ও দখলদারিত্ব বজায় রাখার পর সেখানে মার্কিন অস্ত্র ভান্ডারের বৃহত্তম বোমা ‘মাদার অব অল বোম্বস’ ফেলার কোনো যৌক্তিক কারণ বা প্রয়োজনীয়তা ছিল না। সিরিয়ার আল শায়রাত বিমান ঘাঁটিতে টমাহক ক্ষেপণাস্ত্র ফেলার পাঁচ দিনের মাথায় গত ১৩ এপ্রিল পাকিস্তান সীমান্তবর্তী আফগানিস্তানের নানগাহর প্রদেশের একটি গ্রামের ওপর এমওএবি (মাদার অব অল বম্বস) নামে খ্যাত প্রায় ১০ টন ওজনের ভয়াবহ ধ্বংসাত্মক বোমাবর্ষণ করে মার্কিন বাহিনী। অপারমাণবিক সমরাস্ত্রের মধ্যে এটি এ যাবৎকালের সর্ববৃহৎ ক্ষেপণাস্ত্র, যা  আইএস ঘাঁটি ধ্বংসের নাম করে এই প্রথম কোনো যুদ্ধে ব্যবহার করা হলো। আফগানিস্তানে এই অস্ত্র ফেলার পর দেশটির সাবেক প্রেসিডেন্ট হামিদ কারজাই এক টুইটার বার্তায় বলেছেন, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র তার দেশকে ব্যাপক ধ্বংসক্ষমতাসম্পন্ন নতুন নতুন সমরাস্ত্র পরীক্ষা কেন্দ্র হিসেবে ব্যবহার করছে। এ ধরনের একটি বোমার উৎপাদন খরচ ১৬ মিলিয়ন ডলার বা প্রায় দেড়শ কোটি টাকা। গত তিন দশকে আফগানিস্তানের ওপর রাশিয়া ও আমেরিকার চাপিয়ে দেয়া যুদ্ধে লাখ লাখ আফগান পরিবার বাস্তুহীন হয়েছে। দরিদ্র আফগান কৃষকরা আরো দরিদ্র, সর্বহারা শেকড় বিচ্ছিন্ন হয়েছে। এরা যদি কোনো বিদেশি গোয়েন্দা সংস্থার নগদ ডলারের প্রলোভনে পড়ে কোনো জঙ্গি গ্রুপে যোগ দিয়ে ফলস ফ্লাগ অপারেশনের শিকার হয় তার জন্য প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ দুভাবেই পশ্চিমা সাম্রাজ্যবাদীরাই দায়ী। গত বছর ‘সেভ দ্য চিলড্রেন’ আফগানিস্তানের এক রিপোর্টে আফগান জনগণের দারিদ্র্যের ভয়াবহ অবস্থা তুলে ধরতে গিয়ে এক নারীর কেস স্টাডি তুলে ধরা হয়, যিনি খাদ্য ও জ্বালানি কাঠ সংগ্রহের খরচ জোগাতে ৪৩৫ ডলারের বিনিময়ে নিজের শিশু সন্তানকে বিক্রি করে দিয়েছেন। সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে যুদ্ধের মধ্য দিয়ে যখন মধ্যপ্রাচ্যে ব্যাবেল প্রতি ১২০ ডলারের তেল ৪০ ডলারে বিক্রি হচ্ছে, তখন মধ্যপ্রাচ্যের শরণার্থী মা-বোনেরা সন্তানদের বাঁচিয়ে রাখতে দেহ বিক্রি করতে বাধ্য হচ্ছেন, অথবা খাদ্য ও জ্বালানি কাঠ কেনার জন্য নিজের সন্তান বিক্রি করতে হচ্ছে। আফগানিস্তান, ইরাক, সিরিয়া, লিবিয়া, ইয়েমেন, দক্ষিণ সুদান, নাইজেরিয়া ও সোমালিয়ায় এমন পরিস্থিতি সৃষ্টির জন্য পশ্চিমা সাম্রাজ্যবাদীদেরকে গত দেড় দশকে লাখ লাখ মানুষকে হত্যা করতে হয়েছে, হাজার হাজার টন বোমা ফেলে কোটি কোটি মানুষকে বাস্তুচ্যুত করা হয়েছে, স্কুল, হাসপাতাল, শস্যখামার ও উর্বরা ভ‚মিকে পুড়িয়ে ধূসর করে দিতে তাদেরকে হাজার হাজার কোটি ডলারের সামরিক বাজেট খরচ করতে হয়েছে। বিনিময়ে বিশ্বব্যাপী মানবিক বিপর্যয়, দুর্ভিক্ষ, দারিদ্র্য, অপুষ্টি ও নানা ধরনের স্বাস্থ্যসমস্যা দেখা দিলেও পশ্চিমা সাম্রাজ্যবাদের বিজয় দূরের কথা অর্থনৈতিক-রাজনৈতিক পরাশক্তি হিসেবে তাদের অবস্থান তলিয়ে যেতে চলেছে।
[email protected]



 

Show all comments
  • -কামাল উদ্দিন ২০ এপ্রিল, ২০১৭, ১১:১৯ পিএম says : 0
    আমেরিকাই সন্ত্রাসিদের গড়ফাদার আজ তার কারনে সারা বিশ্ব অস্থির, কারনে অকারনে মুসলমানদেরকে সন্ত্রাসী বানিয়ে মুসলমানদের সম্পদ লুন্টন করে চলছে।মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং তার দোসররা মিলে লক্ষ লক্ষ টন বোমা হামলা চালিয়ে ব্যাপক অরাজকতা করে লক্ষ লক্ষ নিরীহ মুসলমানদের হত্যা করে ইরাক, আফগানিস্তান, সিরিয়া, লিবিয়া এসব দেশগুলোকে শেষ করে দিয়ে এখন বলছে ভূল ছিল l মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং তার দোসররা মিলিয়া তথাকথিত ইসলামিক স্টেট (আইএস) গোষ্ঠী গঠন করে মুসলমানদের হত্যা করে চলেছে।জাতিসংঘ এখন মরা লাশে পরিণত হয়েছে যার ফলে অত্যাচারী দেশগুলো আরো অত্যাচার করে চলেছে এবং নির্যাতিত দেশগুলো আরো নির্যাতিত হচ্ছে। পাশ্চাত্যেও অনেকের মধ্যে এ রকম চিন্তাহীন বিশ্বাস আছে। তারা মনে করে, মুসলমানমাত্রই সম্ভাব্য সন্ত্রাসী। মনে করে, মধ্যপ্রাচ্যের শরণার্থীদের সঙ্গে সঙ্গে সন্ত্রাসবাদও চালান হচ্ছে ইউরোপে। এসব চিন্তার পেছনে যুক্তি নেই, তথ্য-প্রমাণও নেই। এফবিআইয়ের হিসাবে, ১৯৮০ থেকে ২০০৫ পর্যন্ত যুক্তরাষ্ট্রের মাটিতে ঘটনা সব সন্ত্রাসী ঘটনার মাত্র ৬ শতাংশ ছিল ইসলামি চরমপন্থীদের কাজ। বাকি ৭ শতাংশ ইহুদি চরমপন্থী এবং ৬৭ শতাংশ বাম ও লাতিনোদের কাজ। ইউরোপোল রিপোর্ট জানাচ্ছে, ২০১৫ সালে ইউরোপে ২১১টি সন্ত্রাসী ঘটনার মাত্র ১৭টিতে জিহাদিরা জড়িত,বাকিগুলো বিচ্ছিন্নতাবাদী ও অন্যদের কাজ। একটা ঘটনার জন্য একটি সম্প্রদায় বা গোষ্ঠীর সবাইকে দোষী ভাবা চিন্তার হঠকারিতা।
    Total Reply(0) Reply

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

আরও পড়ুন
গত​ ৭ দিনের সর্বাধিক পঠিত সংবাদ