Inqilab Logo

শুক্রবার, ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ০৬ বৈশাখ ১৪৩১, ০৯ শাওয়াল ১৪৪৫ হিজরী

সত্যালোকের সন্ধানে : আখেরাতের প্রথম মঞ্জিল প্রসঙ্গে

| প্রকাশের সময় : ২০ এপ্রিল, ২০১৭, ১২:০০ এএম

এ. কে. এম. ফজলুর রহমান মুন্্শী
(পূর্ব প্রকাশিতের পর)
গোনাহসমূহের সাদৃশ্যাত্মক শাস্তি :
পূর্ববর্তী আলোচনা হতে সুস্পষ্ট হয়ে গেছে যে, অশরীরী কর্মকান্ড এবং উদ্দেশ্যসমূহ নিজের যে সকল সাদৃশ্যাত্মক আকারে পরিদৃষ্ট হয়, সেগুলো মূলত সেই কর্মকান্ড ও উদ্দেশ্যাবলীর সাথে সাদৃশ্যাত্মকভাবে সংশ্লিষ্ট থাকে। যেমন- একটি সহিহ হাদিসে আছে, বিখ্যাত সাহাবি হযরত ওসমান বিন মাজউল (রা.)-এর মৃত্যুর পর জনৈক সাহাবি স্বপ্নে দেখলেন যে, তার জন্য একটি নদী বয়ে চলেছে। তারপর যখন এ কথা রাসূলুল্লাহ (সা.)-এর খেদমতে পেশ করলেন, তখন তিনি এর তাবীর এভাবে ব্যক্ত করলেন যে, ‘এই নদী হচ্ছে তার নেক আমলসমূহ’।
এই মুখবন্ধের পর রাসূলুল্লাহ (সা.)-এর সেই সকল সত্য স্বপ্নগুলোর প্রতি চিন্তা করুন, যা বাহ্যত; কেয়ামত সংক্রান্ত নয় এবং যা এখনো আগমন করার নয়, বরং সেগুলো বরযখের চিত্রই তুলে ধরে, যা এখনো কায়েম রয়েছে।
একদিন প্রত্যুষে রাসূলুল্লাহ (সা.) বললেন : রাতে আমি স্বপ্নে দেখেছি যে, দুজন আগমনকারী আগমন করছে এবং তারা আমায় জাগ্রত করেছিল। আমি তাদের সাথে উঠে পড়লাম। আমি দেখলাম, একজন লোক শুয়ে আছে এবং অপর একজন লোক তার মাথার ওপর একটি পাথর নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। এবং সে এই পাথরটি সেই লোকটির ওপর এত জোরে মারছে যে, তার মাথা চ‚র্ণবিচ‚র্ণ হয়ে যায় এবং পাথরটি অন্যত্র ছিটকে পড়ে। লোকটি ছুটে গিয়ে পাথরটিকে কুড়িয়ে আনে। এই ব্যবধানের মাঝেই তার মাথা পুনরায় ভালো হয়ে যায়। লোকটি দ্বিতীয়বার তার পাথরটি খুব জোরে ছুঁড়ে মারে। তারপর সেই একই চিত্রের পুনরাপত্তি ঘটে। আমি সামনে অগ্রসর হয়ে দেখলাম যে, একজন লোক উপুড় হয়ে পড়ে আছে। অপর একটি লোক লোহার মুদপর তাক করে তার পাশে দাঁড়িয়ে আছে। এর দ্বারা সে তার চোয়ালে, থুঁতনিতে, তার চোখের ওপর এবং কোমর পর্যন্ত সর্বাঙ্গে আঘাত করে। প্রথম একদিকে, তারপর অপরদিকে সে আঘাত করতে থাকে। তারপর আমি আরও সামনে অগ্রসর হয়ে দেখলাম; জ্বলন্ত চুলার মতো আগুন দাউ দাউ করে জ্বলছে এবং কতিপয় নারী ও পুরুষ এতে উলঙ্গ হয়ে পড়ে রয়েছে এবং এর স্ফুলিঙ্গ বর্ধিত হয়ে তাদের দিকে ধাওয়া করলে তারা চিৎকার করতে থাকে। আমি সামনে অগ্রসর হয়ে আরও দেখলাম যে, রক্তের মতো একটি লাল নদী বয়ে চলেছে, এবং একটি লোক এর মাঝে সাঁতার কাটছে। নদীর কিনারে একটি লোক দাঁড়িয়ে আছে। তার কাছে অনেক পাথর রাখা আছে। সাঁতার কাটা লোকটি সাঁতার কেটে যখন তার কাছে আসে, তখন সে একটি পাথর এত জোরে নিক্ষেপ করে যে, উহা লোকটির মুখের ওপর পতিত হয়ে পেট পর্যন্ত পৌঁছে যায়।
এরপর আমি আরও সামনে অগ্রসর হলাম। দেখলাম একটি সবুজ-শ্যামল তরতাজা ফুলের বাগান। যার মাঝে বসন্তের প্রতিটি কলি ফুটেছিল। বাগানের সামনে একজন লম্বা লোককে দেখলাম। যার মাথা ছিল আকাশে। তার চারপাশে বহু ছোট ছোট ছেলেমেয়ে দেখলাম। আরও অগ্রসর হয়ে অপর একটি বৃহৎ বাগান দেখলাম। এর চেয়ে বড় এবং সুন্দর বাগান আমি আর কখনো দেখিনি। এখানে পৌঁছে নিজের উভয় সাথীর কাঁধে ভর করে একটি শহর দেখতে পেলাম। যার দেয়াল স্বর্ণের এবং এর মেঝেতে রূপার ইট লাগানো। আমরা উহার ফটকে উপস্থিত হলাম এবং দরজা খোলানো হলো। এরপর আমরা ভিতরে প্রবেশ করলাম। সেখানে কতিপয় লোক দেখলাম, যাদের অর্ধেক শরীর খুবই সুন্দর এবং অর্ধেক খুবই কুৎসিত। সাথীদের মাঝে কয়েকজন তাদেরকে সামনে প্রবহমান একটি স্বচ্ছ সলিলা নদী দেখিয়ে বলল যে, যাও এই নদীতে গোসল করে এসো। তারা সেখানে গোসল করার পর তাদের সম্পূর্ণ দেহই সুন্দর হয়ে গেল। সাথীরা আমাকে জানাল যে, এটাই হচ্ছে ‘জান্নাতে আদন’। এটাই আপনার দৌলতখানা। আমি নজর করে দেখলাম, সাদা ঘন মেঘের মতো একটি মহল দেখা যাচ্ছে। তারপর আমি সেই সহযাত্রীদের লক্ষ্য করে বললাম, আজ আমি অনেক আশ্চর্য বস্তু দেখেছি। এখন তোমরা বলে দাও, আমি কী কী বস্তু দেখেছি। তারা উত্তরে বলল, প্রথম ব্যক্তি যার মাথা পাথর দ্বারা চূর্ণ-বিচূর্ণ করতে দেখছেন, সে হলো ওই ব্যক্তি যে কোরআন পাঠ করে এর নির্দেশ পালনে অস্বীকার করেছিল এবং সকালের ফরজ নামাজ হতে গাফেল হয়ে শুয়ে থাকত। দ্বিতীয় ব্যক্তি যার চোখ, মস্তক ও থুঁতনী চূর্ণবিচূর্ণ করা হচ্ছে, সে ছিল মিথ্যাবাদী এবং মিথ্যাকে সে সারা পৃথিবীতে প্রচার করত। আর অনলকুÐে যে সকল নর-নারীকে জ্বলতে দেখেছেন, তারা ব্যভিচারী পুরুষ ও নারী। আর রক্তের নদীতে সাঁতার কাটতে ও মুখে পাথর গিলতে যাকে দেখেছেন, সে হলো সুদখোর। তাছাড়া পরিপূর্ণ বসন্তের বাগানে যে দীর্ঘকায় লোকটি দেখেছেন, তিনি হলেন হযরত ইব্রাহীম (আ.)। তার আশেপাশে যে সকল ছোট ছেলেমেয়ে দেখেছেন, তারা হলো অল্প বয়সে মৃত সন্তানাদি। জনৈক সাহাবি জিজ্ঞেস করলেন, ইয়া রাসূলাল্লাহ! মুশরিকীনদের ছেলে-মেয়ে? ইরশাদ হলো, মুশরিকীনদের ছেলে-সন্তানও। আর যাদের অর্ধেক শরীর সুন্দর এবং অর্ধেক কুৎসিত দেখেছেন, তারা ওই সকল ব্যক্তি যারা কিছু ভালো কাজ করেছিল। আল্লাহপাক তাদের গোনাহসমূহ ধুয়ে দিয়েছেন। (সহিহ বুখারী)
বরযখের এ সকল শাস্তির ওপর চিন্তা করলে বোঝা যাবে যে, এগুলোর শ্রেণি এবং পর্যায় তাদের কর্মকাÐের সাথে সম্পূর্ণ সঙ্গতিপূর্ণ ও সাদৃশ্যমূলক। সুখ নিদ্রায় বিভোর ব্যক্তির মস্তক বিচূর্ণ হওয়া, মিথ্যাবাদীর মস্তক ও গÐদেশ ছিঁড়ে ফেড়ে একাকার করে দেয়া, ব্যভিচারী নারী ও পুরুষ উলঙ্গ অবস্থায় অনলকুÐে প্রজ্বলিত হওয়া, রক্তশোষক সুদখোর রক্তের নদীতে সাঁতার কাটা, নিজের উদরপূর্তির লক্ষ্যে সকল গরিবের হক কুক্ষিগত করে যে ব্যক্তি অশুভ পাঁয়তারায় লিপ্ত ছিল, তার পাথর ভক্ষণ করা ইত্যাদি মূলত দুনিয়ার কর্মকাÐের সাদৃশ্যমূলক চিত্রাবলী। আর পুণ্য কর্মের ফলে অর্ধেক দেহের সুন্দরাকৃতি এবং পাপকর্মের ফলে বাকি অর্ধাংশের কদাকৃতি খুবই সঙ্গতিপূর্ণ। অনুরূপভাবে স্বচ্ছ সুন্দর ও পরিচ্ছন্ন নহরের আকারের রহমত ও মাগফিরাতের বিকাশ এরই ফলশ্রæতি মাত্র।
(হুজ্জাতুল্লাহিল বালেগাহ : শাহ ওয়ালী উল্লাহ)
এখন পর্যন্ত পৃথিবী যে উন্নতি করেছে, তা ‘নফস’ বা প্রাণ হতে বহির্ভূত ‘আফাকী’ (অর্থাৎ নিজের বাইরের উপাদান) দুনিয়ার বস্তুনিচয়ের বৈশিষ্ট্য ও গুণাবলী সংক্রান্ত। যার সাথে বিজ্ঞানের নব আবিষ্কার ও উদ্ভাবনের সংযোগ রয়েছে। কিন্তু এখনো এর চেয়েও বিস্তৃত এক দুনিয়া মানুষের মাঝেই পড়ে রয়েছে। যাকে আল কোরআনে আনফুছ বলা হয়েছে। এই আনফুছ অথবা আরওয়াহের গুনাবলী ও বৈশিষ্ট্যের জ্ঞান এখন পর্যন্ত সামান্যই রয়ে গেছে। আমাদের মনোবিজ্ঞান এখনো প্রাথমিক স্তরেই পড়ে রয়েছে এবং এর মাঝে আধ্যাত্মিকতা, প্রতারণা ও তেলেসমাতির এমন এক অত্যাশ্চর্য সূত্রে গ্রথিত হয়ে পড়েছে, যেভাবে বর্তমান যুগের সামান্যতম বৈজ্ঞানিক পরীক্ষা-নিরীক্ষাও পূর্বেকার লোকেরা জাদু ও অতিরঞ্জিত বলে মনে করত। মোটকথা, এখন পর্যন্ত ‘নফস’ ও ‘রূহ’ সংক্রান্ত বিষয়াবলির ওপর অত্যাশ্চর্য কঠিন আবরণ পড়ে রয়েছে। এই একটিমাত্র সমস্যা যে, বস্তুর বিশ্বাস এবং তার বাহ্যিক অস্তিত্বের মাঝে কি সম্পর্ক রয়েছে? এটা এখনো অন্ধকারেই ঢাকা পড়ে আছে। অনেক হিন্দু দার্শনিক, কোনো কোনো মুসলমান সুফী এবং বর্তমান যুগের বিখ্যাত দার্শনিক বার্কলের মতেÑ কানও বস্তুর বিশ্বাস এবং বাহ্যিক অস্তিত্ব কিংবা এভাবেও বলা যায় যে, মানসিক ও বাহ্যিক অস্তিত্বের মাঝে পার্থক্য খুবই কম; বরং এমনও বলা যায় যে, পার্থক্য মোটেই নেই। মোটের ওপর মানব প্রাণের অভ্যন্তরীণ শক্তির জ্ঞান যদিও এখন পর্যন্ত পরিপূর্ণতা অর্জনের জন্য বহুল পরিমাণে মুখাপেক্ষী তবু এতটুকু সুস্পষ্ট যে, কোনও বস্তুর কাল্পনিক বিশ্বাস এবং এর বাহ্যিক অস্তিত্বের মাঝে গভীর সম্পর্ক নিহিত আছে। জাদুবিদ্যা যা মূলত এই নিয়মতান্ত্রিকতার ওপরই নির্ভরশীল এই বিশেষত্বকে বহুলাংশে জমা করেছে। এর দ্বারা বোঝা যাবে যে, ধর্ম সর্বপ্রথমে একিন ও ঈমানের ওপর এতখানি জোর কেন দিয়েছে? এবং এর কারণই বা কি?
কোরআনুল কারিম একিনকে দুটি পর্যায়ে বিভক্ত করেছে : (১) এলমুল একিন এবং (২) আইনুল একিন। কোনও বস্তুর দলিল-প্রমাণসমূহ শ্রবণ করে অথবা কোনও চিহ্ন অবলোকন করে এর অস্তিত্বের স্বীকৃতি প্রদান করা হলে, তা হবে ‘এলমুল একিন’ বা জানাসুলভ বিশ্বাস। আর যদি সে বস্তুটি স্বয়ং তোমার অনুভূতি এবং প্রত্যক্ষ দর্শনের সামনে এসে যায়, যার মাঝে দ্বিধাদ্বন্দে¦র কোনোই অবকাশ নেই, তাহলে তা হবে ‘আইনুল একিন’ বা প্রকৃত একিন ও দর্শনসুলভ একিন। কোরআনুল কারীমে এই উভয় প্রকার একিনের স্বরূপ সূরা তাকাছুরে বিবৃত করেছে। ইরশাদ হচ্ছে : “তোমাদেরকে দৌলত ও নিয়ামতের প্রাচুর্য গাফিলতিতে নিমজ্জিত করেছে এ পর্যন্ত যে, তোমরা কবর জিয়ারত কর; কখনো না, অবশ্যই তোমরা জানবে, তারপর কখনো না, অবশ্যই তোমরা জানবে, যদি তোমরা এলমুল একিন লাভ কর তাহলে অবশ্যই দোজখকে প্রত্যক্ষ করবে, পরবর্তীতে আইনুল একিনও তোমরা লাভ করবে।” (সূরা তাকাছুর, রুকু-১) এই আয়াতের নিরিখে মানুষ যদি নিজের মাঝে এলমুল একিন হাসিল করতে পারত যা পরিপূর্ণ ঈমানের উচ্চতর, মর্তবা, তাহলে অভ্যন্তরীণ চোখের দ্বারা স্বীয় দোজখ এখানেই দেখতে পেত। “কখনো না, যদি তোমাদের এলমুল একিন হয় তাহলে তোমরা নিঃসন্দেহে দোজখকে অলোকন করবে।” (সূরা তাকাছুর)
অবিশ্বাসী কুরাইশরা রাসূলুল্লাহ (সা.)-এর কাছে আজাবকে প্রত্যক্ষ দর্শনের জন্য অনুরোধ করত। আল্লাহপাকের অহি তাদের জিজ্ঞাসার উত্তর এভাবে প্রদান করছে। ইরশাদ হচ্ছে : “তারা তোমার নিকট জলদি আজাব তলব করছে, অথচ জাহান্নাম অবিশ্বাসীদেরকে পরিবেষ্টন করে রেখেছে।” (সূরা আনকাবুত : রুকু-৬) অপর এক আয়াতে আছে যে, মুনাফিকরা নিজেদের ধারণা অনুযায়ী পরীক্ষার ভয়ে জিহাদে অংশগ্রহণ করতে ওজন প্রকাশ করছে। এর উত্তরে তাদেরকে বলে দেয়া হয়েছে যে, তারা এখনই পরীক্ষায় নিপতিত এবং দোজখ তাদেরকে পরিবেষ্টন করে রেখেছে। ইরশাদ হচ্ছে : “তাদের মাঝে কেউ এমনও আছে, যে বলে, আমাকে জিহাদে অংশগ্রহণ না করার অনুমতি দিন এবং পরীক্ষায় নিপতিত করবেন না, কিন্তু হাঁ, তারা পরীক্ষায় পড়েই রয়েছে এবং অবশ্যই জাহান্নাম অবিশ্বাসীদেরকে পরিবেষ্টন করে রেখেছে।” (সূরা তাওবাহ : রুকু-৭) (চলবে)



 

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

আরও পড়ুন
এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ
গত​ ৭ দিনের সর্বাধিক পঠিত সংবাদ