Inqilab Logo

বৃহস্পতিবার, ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১, ১৫ শাওয়াল ১৪৪৫ হিজরী

সাযযাদ কাদির : একজন আলোকিত মানুষ

শ্রদ্ধাঞ্জলি

| প্রকাশের সময় : ২৮ এপ্রিল, ২০১৭, ১২:০০ এএম

শুভ্র আহমেদ
‘...সবাই আরও উপরে উঠতে চায়, আরও ক্ষমতা চায়/ সবাই আরও সামনে যেতে চায়, সবকিছুতে প্রথম হতে চায়/সবাই আরও বেশি দখল করতে চায়, আরও বেশি বেশি জিততে চায়/আমার অত কিছু চাওয়া ছিল না কখনো...।’ (লাল-নীল পরী)
একজন লাল-নীল পরীকে ভালোবেসে, লাল-নীল পরীর ভালোবাসার ছোঁয়ায় শান্তি ও স্বস্তির সাধ্য ও দুঃসাধ্যের মধ্যে বিলীন হতে চেয়েছিলেন পরমায়ু (১৪ এপ্রিল ১৯৪৭-৬ এপ্রিল ২০১৭) গত সত্তর বছর ধরে। ষাট দশকের টালমাটাল দ্ব›দ্ব-সংকট কাটিয়ে প্রথাকে অস্বীকার করে ঐতিহ্যের সূচিশুভ্রতায় অবগাহিত হয়ে স্বকীয়তায় জেগে উঠেছিলেন তিনি অপরাপর তরুণদের সাথে। কবি ছিলেন তিনি। ছিলেন সম্পাদক। প্রবন্ধ-নিবন্ধ-কলাম, ছোটগল্প-উপন্যাস, বিচিত্র বিষয়ের সংকলন ইত্যাদি কত কিছুই না তিনি অকৃপণ দিয়েছেন তার পাঠককে, বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের দিগদিগন্ত তার অফুরন্ত দানে-দাক্ষিণ্যে জেগে উঠেছে পলিসঞ্চিত উর্বর সুন্দর চরের সাহসিকতায়। গবেষণায় তিনি নিয়ে এসেছিলেন নতুন মাত্রা। বিষয়সমূহ জটিল, কিন্তু উপস্থাপনার নান্দনিকতায় সে সমস্তই হয়ে উঠেছে সাধারণের আনন্দপাঠ। এ এক বিস্ময়। বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের শিক্ষক (১৯৭২-১৯৭৬) ছিলেন। আবার ইচ্ছেবদল ঘটিয়ে দুঃসাহসিকতার পাখনায় ভর করে সাংবাদিকতার রোমাঞ্চকর জীবন বেছে নিতে শিক্ষকতাকে বিদায় জানাতেও কার্পণ্য করেননি একটি দিনও। গণচীনের রেডিও পেইচিং এ ভাষা বিশেষজ্ঞ (১৯৭৮-৮০), বাংলা ডেস্কটপ পাবলিকেশনের অন্যতম পথিকৃৎ ছিলেন তিনি। সাহিত্যকে সাথে নিয়ে একজন ভালো সংগঠক হিসেবেও সফল তিনি। জাতীয় কবিতা পরিষদ এবং কবিতা উৎসবের প্রতিষ্ঠাকালে আহŸায়কের গুরুদায়িত্ব তাই তার কাঁধে প্রথম অর্পিত হতে দেখি আমরা। সময়ের প্রয়োজনে সেই গুরুদায়িত্ব বহনে তিনি যেমন ছিলেন সদাশিব, সদা চঞ্চল তেমনি সময়ের কারণেই আবার একসময় সংগঠন ত্যাগও করেছিলেন, গড়ে তুলেছিলেন নিজের মতো করে ‘বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের বিকাশ কেন্দ্র’ নামক ছোট্ট অথচ নক্ষত্র সদৃশ্য সাহিত্যের আঁতুরঘর।
যাকে নিয়ে এই যে এতো কথা বলা, কথা বলার শেষেও মনে হয় তার সম্পর্কে এখনও কিছুই বলা হয়নি তিনি হচ্ছেন, প্রিয় পাঠক এতক্ষণে নিশ্চয়ই বুঝে গেছেন- সাযযাদ কাদির, যাতে সত্যিকার অর্থে প্রতিভার বহুমাত্রিকতায় একমাত্র ‘সব্যসাচী’ অভিধায় চিত্রিত করা যায়।
দুই
‘মৃত্যু সুন্দর না কুৎসিত, মহৎ না মন্দ, শিল্প না অশিল্প জানি না। কারণ মৃত্যুর দেয়াল পার হয়ে কেউ জীবনে ফিরে আসেনি, আসবে না।’ মৃত্যু হচ্ছে পিচ্ছিল পথে পাহাড়ে ওঠার মতোই অনিশ্চিত সময়। আমরা অবশ্য ধর্মে, ধর্মগ্রন্থে, ধর্মানুভবে, মৃত্যুর শোভন-পবিত্র, মঙ্গলময় ছবির অনুভবে ভয়ের বিষকাঁটাগুলোকে সরিয়ে সাহস যাচ্না করি। ‘জীবনের-জন্মের সব পথ মৃত্যুতে এসে অবশিত’ কেনো অথবা মৃত্যু চেতনা নামক ভাবসম্পদটির মাখামাখি রৌদ্র-বৃষ্টির দাপটে নৈতিক-অনৈতিকতার বিচার ছাড়িয়ে একিলিস, আগামেমনন বিয়াত্রিচে, ওথেলো-ডেসডিমনা, হাসান-হোসেন-ইয়াজিদদের মৃত্যু যখন বিশেষ কিছু হিসেবে বাহিত হতে থাকে প্রজন্ম থেকে প্রজন্মে তখন এবং এখনও, সাযযাদ কাদিরও এক সময় চলে যান অবিনশ্বরতায়। চলে যান অবশ্য রেখে যান অযুত নিযুত শব্দ বাক্যের বারুদে ঠাসা প্রজ্ঞা-মনন-সৃজনের শতক-সহস্রের ইতিহাস, ইতিকথা। যেখানে নদীর স্রোতের মতো চঞ্চল, সমুদ্রের ঢেউয়ের মতো উত্তাল, মৌন পাহাড় অথবা তিলোত্তমা ফসলের বিনত মাঠের মতো উঠে আসে বিবর্তনের ধারাক্রমিক প্রাচ্য ও পাশ্চাত্যের দার্শনিক সংঘাতের নিকট বৈপরীত্যের গ্রহণ ঋণ, নারী-পুরুষের সংবেদনশীলতার বহুবর্ণিল জীবন, তাদের প্রতিদিনকার প্রতি মুহূর্তের দুঃখ-হতাশা-আনন্দের বিহঙ্গছবি, আগ্নেয় জীবন সংগ্রামের প্রাণময় উপস্থাপনা ইত্যাদির। অসম্ভব একজন মেধাবী পুরুষ সাযযাদ কাদির। তত্ত¡ ও তথ্যের ধারণ সক্ষমতায় তিনি প্রায় যন্ত্রমানব। বিষয় বৈচিত্র্যের সাহসিকতায় তিনি শেষ পর্যন্ত হয়ে উঠেছিলেন আন্তর্জাতিক। ষাটের অধিক গ্রন্থে তার লেখা যতটা না প্রকাশিত তারচেয়ে অনেক বেশি শেষ পর্যন্ত রয়ে গেছে করোটিবদ্ধ নিউরণের জৈবিক পাতায়। তবু এক নজরে দেখে নেয়া যাক পছন্দের তালিকা :
কবিতা : যথেচ্ছ ধ্রæপদ; রৌদ্রে প্রতিধ্বনি; দূরতমার কাছে; দরজার কাছে নদী, মণিমালা সিরিজ, বৃষ্টিবিলীন।
গল্প : চন্দনে মৃগপদচিহ্ন, অপর বেলায়।
উপন্যাস : অন্তর্জাল, অনেক বছর পরে, জলপাহাড়।
প্রবন্ধ-গবেষণা : ভাষাতত্ত¡ পরিচয়, হারেমের কাহিনী : জীবন ও যৌনতা, ম্যাঙ্গো পিপল উবাচ
সংলকন : রাজরূপসী, নারীঘটিত।
শিশুতোষ : তেপান্তর, মনপবন, ইউএফও : গ্রহান্তরের আগন্তুক, সাগরপার।
ভাষান্তর : লাভ স্টোরি, রসচৈনিক।
স্মৃতিকথা : নানা রঙের দিন।
সম্পাদনা : শক্তি চট্টোপাধ্যায়ের শ্রেষ্ঠ কবিতা, দুষ্প্রাপ্য প্রবন্ধ।
তিন
কবি সাযযাদ কাদিরের কবিতার সাথে আমার ঘনিষ্ঠতা দীর্ঘদিনের হলেও ব্যক্তি সাযযাদ কাদিরের সাথে পরিচয়, আলাপ, ঘনিষ্ঠতার বয়স এক যুগের বেশি নয়। পরিচয়ের প্রায় নাটকীয় মুহূর্তটি ছিল এ রকম : সাযযাদ ভাই তখন প্রেস ইনস্টিটিউটের পরিচালক। সাংবাদিকতা বিষয়ক এক বিশেষ কর্মশালায় এসেছেন অতিথি হিসেবে, সাতক্ষীরাতে। কবি এবং প্রশাসনিক কর্মকর্তা শাহাবুদ্দীন ভাই টেলিফোনে জানালেন ঢাকা থেকে একজন কবি এসেছেন, তিনি সাতক্ষীরার কবিদের সাথে আড্ডা দিতে চান, জানতে চান সাতক্ষীরায় কবিতার পূর্ব-পশ্চিম, নাড়ি নক্ষত্র।
গাজী শাহ্জাহান সিরাজ আর আমি সেই সন্ধ্যায় পৌঁছলাম সাতক্ষীরা সার্কিট হাউসে। কবির জন্য নিলাম ফুল আর কবিতার বই। সার্কিট হাউসে পৌঁছে রেজিস্ট্রারের পাতায় চোখ বুলিয়ে হতাশ হলাম। কারণটাও বলি, সেখানে লেখা নাম, শাহ নূর মোহাম্মদ। এ নামে কোনো কবির কবিতা পড়েছি বলে মনে করতে পারলাম না। এমনকি নামটাও। শাহবুদ্দিন ভাই বললেন দোতলায় পূর্বদিকের ঘরে কবি আপনাদের জন্য অপেক্ষা করছেন।
অগত্যা। দরজা ঠেলে ভিতরে ঢুকতেই হাত বাড়িয়ে মধ্যবয়সী ফর্সা মানুষটি নিজের পরিচয় দিয়ে বললেন, আমি সাযযাদ কাদির। তার পিছনে সামান্য দূরে খাটের উপরে বসে মিটিমিটি হাসছিলেন যিনি আমাদের বুঝতে অসুবিধে হয়নি ইনিই ভাবি। পরে পরিচয়ের নিবিড় সখ্যতায় জেনেছি ভাবি প্রকৃত অর্থেই সাযযাদ ভাই এর অর্ধাঙ্গিনী, সহধর্মিণী।
আমি তখন বিস্মিত। এই তাহলে কবি সাযযাদ কাদির। ষাট, সত্তর কোনো দশকেই যাকে বৃত্তাবদ্ধ করা চলে না। তার আগমন ধ্বনি ঘোষিত হয়েছে একজন সম্পাদক, আলোকিত মানুষ আবদুল্লাহ আবু সায়ীদের মুখে এভাবে : ‘এই সময়ে কণ্ঠস্বরে তিনজন প্রতিভাবান কবি লিখতে শুরু করেন, কবি নির্মলেন্দু গুণ নেত্রকোনা থেকে আসতেন। বরিশালের ছিলেন হুমায়ুন কবির আর টাঙ্গাইলের সাযযাদ কাদির।’
তখন পর্যন্ত পত্র-পত্রিকায় ইতস্তত ছড়িয়ে ছিটিয়ে প্রকাশিত কবিতাগুলো ছাড়াও যথেচ্ছ ধ্রæপদ, রৌদ্রে প্রতিধ্বনি, দূরতমার কাছে, এই যে আমি প্রভৃতি কবিতার বইগুলো পড়েছি মাত্র। সেই দ্রæতলয়ের পঠনে আমি তার কবিতায় এক ধরনের সৌন্দর্যবোধ খুঁজে পেয়েছিলাম। আমার মনে হয়েছিল এই কবি তার কবিতায় নিরন্তর পরীক্ষা-নিরীক্ষার মাধ্যমে শৈল্পিক নকশা এঁকে এঁকে ক্রমশ সত্য নামক এক অজানা সুখী গন্তব্যে পৌঁছতে চান। সেজন্য ক্রমাগত তিনি চিত্রকল্প আঁকেন। জীবনের সংগ্রাম আর উত্থান-পতন অভিজ্ঞতাগুলোর সদাচঞ্চল ছবি সেই চিত্রকল্পগুলো তার প্রজ্ঞা-মনন-পরিশ্রম-জ্ঞানে সমীকরণে ঋদ্ধ।
আমার আরো মনে হয়েছিল তার কবিতায় এক বিশাল অংশজুড়ে রয়েছে প্রকৃতি। প্রকৃতিকে তিনি ভিন্ন মাত্রায় অবলোকন করেছেন। আর সে কারণেই তিনি সমসাময়িক কবিদের থেকে স্বতন্ত্র। শিল্প ও জীবনের প্রতি সমান দায়বদ্ধতায় তার কণ্ঠস্বর উচ্চকিত নয় ততটা যতটা উচ্চকিত হলে কবিতা হয়ে ওঠে সেøাগান সর্বস্ব, গণমুখী ও জনপ্রিয়। নতুন কাব্যভাষা নির্মাণে তিনি যতœশীল সাবধানী।
তার কবিতা মাঠের নয় খাটের, ঘরের; কোলাহলের নয়, নির্জন পবিত্রতার। সৎ কবিতার প্রধান দুটি লক্ষণ হচ্ছে মানুষকে শিল্পের সীমানায় নিয়ে এসে শিল্পের শ্রেষ্ঠত্ব অক্ষুণœ রাখা এবং বারংবার সংবেদনশীলতার বদল ঘটিয়ে কবিতাকে নতুন করে তোলা। সাযযাদ কাদিরের কবিতায় আমরা উপরোক্ত দুটি লক্ষণই সনাক্ত করতে পারি। আত্মকেন্দ্রিক আধ্যাত্মিকতা থেকে রাজনীতির নষ্ট পাঠ, পীড়ন যদি তার কবিতার প্রথম বদলের বাঁক হয় তবে নারীর প্রতি আত্মনিবেদন নিশ্চয়ই আরো অনেক বাঁকের সমাপ্তির মূল্যসূচক। আধ্যাত্মিকতা তার কবিতার অন্যতম অনুসঙ্গ হলেও আধ্যাত্মিকতার সাথে মনোবিকলনের সংমিশ্রণে পরাবাস্তবতার আলো-আঁধারিতে লুকোচুরি খেলতে দেখা যায় তার কবিতার সবচেয়ে উজ্জ্বল পঙ্ক্তিগুলোকে। পরিবর্তনের দুটি ধারা :
১. মউমাছি ফিরে গেছে, রোদরঙা মাছি, কোনও দিন
   ঝলমলে উৎসবে একখÐ ছায়া ফেলে দেবে।
                  (শত্রæ শত্রæ, যথেচ্ছ ধ্রæপদ)
২. দূর দূরান্তে তাকাই; কোনও নদী নেই
   চোখে তবু তীর তীব্র স্রোতের দৃশ্য:
   বুকে পাড় ভাঙার শব্দ।
          (দরজার কাছে নদী, দূরতমার কাছে)
সাযযাদ কাদির মনে করেন একমাত্র কবিরাই সার্বভৌম শক্তির অধিকারী। চির উন্নত শির, সভ্যতার বিবেক। কবিরা যখন নষ্ট হয়, নষ্ট মানুষ, নষ্ট শাসকের সাথে দীর্ঘ পথ চলে তখন প্রকৃত কবির পলায়ন করা ছাড়া আর কোনো বিকল্প থাকে না। সাযযাদ কাদিরও তাই আশ্রয় খোঁজেন মনিমালার কাছে। মনিমালা এক আশ্চর্য শরীরী স্পর্শ নিয়ে ধরা দেয় কবির কাছে:
‘মনিমালা ছড়িয়ে দেয় আলোর হাসি
বলে, এই আমি নেমে এলাম দেখো।’
                                    (জ্যোৎøা, মনিমালা সিরিজ)
যাই হোক সাযযাদ ভাই এর পরও সাতক্ষীরায় এসেছেন বেশ কয়েকবার। শেষবার এলেন বিজয় সাহিত্য সম্মেলনে অতিথি হয়ে। সেবার যতদূর মনে পড়ছে তার সাথে ছিলেন কথাশিল্পী ও সম্পাদক হাসান মোস্তাফিজুর রহমান, কথাশিল্পী ও রবীন্দ্র বিশেষজ্ঞ শচীন দাশ, কবি ও ছড়াশিল্পী অপূর্ব রায় প্রমুখ। সেই আমার সাযযাদ ভাই এর সাথে শেষ দেখা। মৃত্যুর মাত্র সপ্তাহ খানেক আগেও তার সাথে টেলিফোনে কথা হয়েছে। জানিয়েছিলেন শরীরটা ভালো যাচ্ছে না, বলেছিলেন ঢাকা এলে যেনো অবশ্যই তার সাথে দেখা করি। হলো না, কিছুই হলো না আর।
চার
সাযযাদ কাদির মানুষ হিসেবেও মহৎ ছিলেন, মানবিক বোধের ট্রামে চড়ে সর্বদাই চলেছেন সত্য-সুন্দরের শৈল্পিক পৃথিবীর খোঁজে। ক্লান্তিহীন সে যাত্রা থেমে গেলো সত্তরে এসে।
সাযযাদ কাদির শুধু পদ্যে, কবিতায় নয় গদ্যেও রামধনুর মতো বহু রঙিন অথচ দীর্ঘ সময়ের। গল্প বা উপন্যাস, কাহিনী বিন্যাস থেকে শুরু করে চরিত্রসমূহের চিত্রন পর্বেও রেখেছেন অভিনবত্বের ছাপ। সাধারণ নমুনায়নে ‘অন্তর্জাল’ উপন্যাসটিকে বেছে নিয়ে আলোচনাটাকে আরেকটু এগিয়ে নেয়া যায়। উপন্যাসে জীবন ও শিল্পের বিপরীত বাস্তবতায় ক্ষত-বিক্ষত কয়েকজন মানুষ যখন পাহাড়ের শীর্ষে মিলিত হয়ে পরাবাস্তব জগত সৃষ্টি করেন তখন সাযযাদ কাদির সুকৌশলে গবেষকের একাগ্রতায় হাজির করেন একের পর এক পরিসংখ্যানিক দলিল, প্রাচীন ভারতবর্ষের সাথে আধুনিক বিশ্ব মিলেমিশে একাকার হয় মিথিক সম্পর্কে, আবার প্রেসের শক্তির কথাও তিনি শোনান যেন বা অনিচ্ছা সত্তে¡ও। অথবা স্তন বন্দনার মতো তুচ্ছ জৈবিক বিবরণও তার শৈল্পিক সক্ষমতায় হয়ে ওঠে দুই সংস্কৃতির সম্পর্কের ইতিবৃত্ত : ‘তবে স্তন বন্দনার জন্য কেবল ইয়াঙ্কি আর জাপানীদের এতো সুখ্যাতি কেন ‘কুচকুম্ভ’ নিয়ে কি বাঙালির উম্মাদনা কম’ (অন্তর্জাল, পৃষ্ঠা-৫৭)
পাঁচ
সমাজ জীবন নিয়ে সাযযাদ কাদিরের পর্যবেক্ষণ সর্বদাই দ্বা›িদ্বক ও অন্তর্দৃষ্টিসম্পন্ন। ইতিহাসের নন্দিত-নিন্দিত নারী-রাজবধূ-রাজকন্যা-রাজপরিবার ও রাজসভার সুন্দরী রাণী-রাজা ও রাজন্যগণের প্রণয়ী ও রক্ষিতাদের বিচিত্র জীবন কথা সপ্তসিন্ধু দশদিগন্ত মন্থন করে তুলে নিয়ে বসিয়েছেন ‘রাজরূপসী; ‘নারীঘটিত’ ‘হারেমের কাহিনী’ নামক গ্রন্থত্রয়ীর প্রায় ছয়শত পাতায়। প্রসঙ্গক্রমে তিনি নারীর ক্ষমতায়ন, একাল ও সেকালের তুলাদÐে আলোচনা করার পর প্রচলিত অনেক বিশ্বাসকে বিদ্রæপ করেছেন, নতুন ভাবনায় জারিত করেছেন তার পাঠককে।
ভারত উপমহাদেশ, অবশিষ্ট এশিয়া, ইউরোপ এবং আটলান্টিক পারের জীবন কথা নিয়ে লেখা ‘সহস্রক’ নামক গ্রন্থ। সাযযাদ কাদির যে সর্বদাই সমাজ-সাহিত্য-সংস্কৃতির শিল্পযাপন খুঁজে ফিরতেন, শুধু আলোকিত স্থানসমূহে নয় কুয়াশার পর্দা সরিয়ে অনিশ্চিত গলিপথেও ছিল তার স্বতঃস্ফ‚র্ত  দোলকযাত্রা। সাযযাদ কাদিরের সবচেয়ে বড় অবদান বিশেষত গবেষণার ক্ষেত্রে, তার ব্যতিক্রমী বিশ্লেষণ-ব্যাখ্যা-টিকা-টিপ্পনী সমকালীন অনুসন্ধিৎসু মানুষের কাছে যেমন বিশেষ উপভোগ্য হয়ে ওঠে, একই সাথে তা পরবর্তী গবেষকদের পথ দেখায়, তত্ত¡ ও তথ্যে সমৃদ্ধ করে। এ মাটির অন্যতম শ্রেষ্ঠ সন্তান সাযযাদ কাদির এভাবেই পুনঃজন্মে বেঁচে ওঠেন বারবার।
ছয়
সাযযাদ কাদির এপিটাফ লিখেছিলেন এভাবে :...কোনও পত্রিকায় ছাপা হবে না খবরটি,/ছবি সহ তো নয়ই; /শোক সংবাদ : শিরোনামে প্রকাশিত / দুতিনটি খবরের নিচেও জায়গা হবে না  / ওই খবরের / পরদিনের পত্রিকায় ‘শোক প্রকাশ’ শোকসভা ইত্যাদি/ শিরোনামের নিচেও থাকবে না খবরটি।/ তবুও ঠিক জেনে যাবে তুমি। (শেষ খবরের পর)
সাযযাদ কাদির আমাদের প্রিয় সাযযাদ ভাই আর লিখবেন না। এখন প্রয়োজন তার প্রকাশিত-অপ্রকাশিত লেখাসমূহের একত্র প্রকাশ। সমগ্রের অপেক্ষায় সমবেতভাবে অপেক্ষমান আমরা।



 

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

আরও পড়ুন