Inqilab Logo

শনিবার, ২০ এপ্রিল ২০২৪, ০৭ বৈশাখ ১৪৩১, ১০ শাওয়াল ১৪৪৫ হিজরী

অবৈধ পথে প্রতিদিন পাচার হচ্ছে বিপুল পরিমাণ ছোট কাঁকড়া

| প্রকাশের সময় : ২৯ এপ্রিল, ২০১৭, ১২:০০ এএম

রবিউল ইসলাম, কালিগঞ্জ (সাতক্ষীরা) থেকে : নতুন করে হুমকির মুখে পড়েছে বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনের অন্যতম প্রধান খাত কাঁকড়া শিল্প। রপ্তানি নীতিমালা উপেক্ষা করে বিভিন্ন এক্সপোর্টার্সরা সাপ্লাইয়ারদের মাধ্যমে মাঠ পর্যায়ে হানা দিয়ে মাত্র ৪০ গ্রাম থেকে শুরু করে কাঁকড়া ক্রয় করে বিদেশে পাচার করছে। এতে করে মারাত্মক বিরূপ প্রভাব পড়েছে কাঁকড়া শিল্পের ওপর। বিশেষ করে কাঁকড়া চাষিরা তাদের হ্যাচারিতে অবমুক্তর জন্যও ছোট কাঁকড়া পাচ্ছেন না। ব্যবসায়ীরা বলছেন, ছোট কাঁকড়া শিপমেন্ট করায় আকস্মিক হ্যাচারি থেকে আশঙ্কাজনকভাবে হ্রাস পেয়েছে বড় কাঁকড়া। গত মৌসুমের এমন সময় মোকাম প্রতি যেখানে ১৫/২০ মেঃটন করে কাঁকড়া আহরণ হতো সেখানে চলতি ভরা মৌসুমে প্রতিদিন ৩/৫ মেঃটনও আহরিত হচ্ছে না। এমন অবস্থা চলতে থাকলে আগামী ১/২ মাসের মধ্যে হ্যাচারিগুলো কাঁকড়া শূন্য হয়ে যাবে। তাদের আশঙ্কা, আন্তর্জাতিকভাবে কোনো চক্র অবৈধ উপায়ে বাংলাদেশের সম্ভাবনাময় কাঁকড়া শিল্প ধ্বংস করতে এদেশের মুনাফালোভীদের সাথে হাত মিলিয়ে সিন্ডিকেটের মাধ্যমে দেশকে কাঁকড়া শূন্য করতে তাদের অপকর্ম চালিয়ে যাচ্ছে। বাংলাদেশ লাইভ এন্ড চিল্ড এক্সপোর্টার্স এসোসিয়েশন ও তৃণমূলের সংশ্লিষ্ট ব্যবসায়ীরা জানান, ১৯৮৭ সাল থেকে বাংলাদেশ থেকে জীবিত কাঁকড়া ও কুঁচে রপ্তানি শুরু হয়। বর্তমানে ১৪৩টি প্রতিষ্ঠান কার্গো বিমানের মাধ্যমে প্রতিদিন ২৫/৩০ টন জীবিত কাঁকড়া ও কুঁচে পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে রপ্তানি করে থাকে। এর আগে বন অধিদপ্তরের বন্য প্রাণী ও প্রকৃতি সংরক্ষণ আইনের আওতায় ১৯৯৮ সালে এ নিয়ে তৈরি হয় একটি প্রাণী রপ্তানি নীতিমালা। যাতে বলা হয়েছে, পুরুষ কাঁকড়া প্রতিটি ২শ গ্রাম ও স্ত্রী কাঁকড়া কোন ভাবেই ১শ ৩০ গ্রামের নিচে রপ্তানি করা যাবে না। নীতিমালানুযায়ী শুল্ক গোয়েন্দা কর্মকর্তারা সম্প্রতি প্রায় ৩ হাজার কেজির দু’টি কাঁকড়ার চালান আটক করে লাইভ এন্ড চিল্ড এক্সপোর্টার্স এসোসিয়েশনের কাছে হস্তান্তর করে। পরে এসোসিয়েশনের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা আটককৃত কাঁকড়া পরীক্ষা করে দেখেন দুটি চালানের মোট ৫/৬ ভাগ কাঁকড়া প্রতিটি ৫/১০ গ্রাম করে কম আছে। এছাড়া টানা-হেঁচড়া ও সময়ক্ষেপণের ফলে মোট কাঁকড়ার প্রায় ৩০ শতাংশ বিমান বন্দরের কার্গোতেই মারা যায়। পরে তা চীনে রপ্তানি করলে দেখা যায়, সেখানে আরো ৩০ শতাংশ কাঁকড়া মারা যায়। ফলে চীন থেকে ফেরৎ পাঠানো হয় পুরো শিপমেন্ট। অবস্থা যখন এমন তখন কীভাবে সাপ্লাইয়াররা মোকাম থেকে সর্বনি¤œ ৪০ গ্রাম পর্যন্ত কাঁকড়া ক্রয় করছেন? আর তা কীভাবে কোন পথে কোথায় রপ্তানি হচ্ছে? এমন পরিস্থিতিতে শুল্ক গোয়েন্দা কর্মকর্তরাইবা করছেনটা কি? এমন বহু প্রশ্নের মুখে প্রতিদিন বাংলাদেশ থেকে হাজার হাজার মেঃটন ছোট কাঁকড়া পাচার হচ্ছে বিদেশে। এ ব্যাপারে দক্ষিণাঞ্চলের বিশিষ্ট কাঁকড়া ব্যবসায়ী ও এক্সপোর্টার্স নয়ন এন্টাপ্রাইজের স্বত্বাধিকারী শেখ আনারুল ইসলাম বলেন, কাঁকড়া সাধারণত উপক‚লীয় এলাকা সাতক্ষীরা, বাগেরহাট ও খুলনা অঞ্চলে চাষাবাদ হয়ে থাকে। প্রতিদিন এসব এলাকা থেকে একশ্রেণির অসাধু মুনাফালোভী এক্সপোর্টার্সরা তাদের সাপ্লাইয়ারদের মাধ্যমে সরকারের কাঁকড়া রপ্তানি নীতিমালা উপেক্ষা করে বিপুল পরিমাণ ছোট কাঁকড়া ক্রয় করে সিন্ডিকেটের মাধ্যমে শিপমেন্ট করছে। এসময় তারা আরো বলেন, বর্তমানে কাঁকড়ার গ্রেডগুলোর মধ্যে রয়েছে যথাক্রমে ডাবল এফ-১ ২শ গ্রাম, সিঙ্গেল এফ-১ ১শ ৮০ গ্রাম, কেএসএল-১ ১শ ৮০ গ্রাম, এফ-২ ১শ ৬০ গ্রাম, এফ-৩ ১শ ৪০ গ্রাম, ডাবলএক্সএল-৫শ গ্রাম, সিঙ্গেল এক্সএল-৪শ গ্রাম, এল-৩শ গ্রাম, এম-২শ ৫০ গ্রাম, এসএম-২শ গ্রাম, ডাবলএক্সএল পিডি-৫শ গ্রাম, এক্সএল পিডি-৪শ গ্রাম, এলপিডি-৩শ গ্রাম, এমপিডি-২শ ৫০ গ্রাম ওজনের কাঁকড়া তারা ক্রয় করে রপ্তানি করছেন। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক সাপ্লাইয়ারদের অনেকে বলেন, বিদেশের বাজারে ২শ ও ১শ ৩০ গ্রাম কাঁকড়ার চাহিদার তুলনায় অপেক্ষাকৃত ছোট কাঁকড়ার চাহিদা বেশি। বিশেষ করে বাংলাদেশের কাঁকড়ার বাজার চীন, জাপান, তাইওয়ান কিংবা থাইল্যান্ডের চেয়ে কম ওজনের কাঁকড়ার চাহিদাই বেশি। তবে ওজন সংশ্লিষ্ট কোন নীতিমালা না থাকায় এই সুযোগে আমাদের প্রতিযোগী দেশ ভারত, মিয়ানমারসহ অন্যান্য দেশগুলো বিদেশে অপেক্ষাকৃত ছোট কাঁকড়া রপ্তানি করে সেখানে বাংলাদেশের কাঁকড়ার বাজারগুলো দখল করছে বলেও জানান তারা। তাদের প্রজেক্টে অবমুক্ত’র কাঁকড়াও খুঁজে পাবে না। বর্তমান প্রেক্ষাপটে হ্যাচারি টিকিয়ে রাখতে মালিকদের সাপ্লাইয়ারদের চাইতে বেশি দামে কাঁকড়া ক্রয় করতে হচ্ছে। এতে করে পূর্বের চেয়ে কয়েকগুণ বেশি দামে কাঁকড়া কিনতে হচ্ছে তাদের। জানা গেছে, আন্তর্জাতিক বাজারে বর্তমানে ৫০ থেকে ১২০ গ্রাম ওজনের কাঁকড়ার চাহিদা ভাল। এই সুযোগকে কাজে লাগিয়ে দেশের ভেতরে ও বাইরে এক শ্রেণির অসাধু মুনাফালোভী চক্র সিন্ডিকেটের মাধ্যমে ছোট কাঁকড়া চোরা পথে পাচার ও সংশ্লিষ্ট প্রশাসনকে ম্যানেজ করে শিপমেন্ট করছে। এ জন্য তারা দেশের কক্সবাজার, সাতক্ষীরা, খুলনা, পাইকগাছাসহ বিভিন্ন এলাকাকে বেছে নিয়েছে। তারা সংশ্লিষ্ট প্রশাসনকে ম্যানেজ করে ৫০/১২০ গ্রাম ওজনের কাঁকড়া চট্টগ্রাম ও মংলা বন্দরের মাধ্যমে রপ্তানি ও বিভিন্ন চোরা পথে ভারতসহ বিভিন্ন দেশে পাচার করছে। চিংড়ির থেকে কম সময় ও খরচে ভাল ফলাফল পাওয়ায় গত কয়েক বছরে বহু লোক কাঁকড়া চাষে সম্পৃক্ত হয়েছেন। নতুন করে বহু লোকও আগ্রহী হচ্ছেন কাঁকড়া চাষে। তবে মাঝ পথে নানাবিধ প্রতিবন্ধকতা ও আশঙ্কায় বাজার হারানোর পাশাপাশি কাঁকড়া চাষে আগ্রহ হারাচ্ছেন অনেকেই। কাঁকড়া আহরণ, চাষি ও ব্যবসা সংশ্লিষ্টরা বলেন, বাংলাদেশে কাঁকড়ার চ‚ড়ান্ত প্রজননকাল মে-জুন মাস। অথচ রপ্তানি নীতিমালায় কাঁকড়ার প্রজননকাল জানুযারি-ফেব্রæয়ারি মাস উল্লেখ করে ওইসময়ে বনবিভাগ থেকে কাঁকড়া আহরণের উপর নিষেধাজ্ঞা জারি করা হয়েছে। যার বিরূপ প্রভাবও খাতটির উপর জেঁকে বসেছে। কাঁকড়া রপ্তনিকারকরা জানান, সাধারণত কাঁকড়া উৎপাদন ও রপ্তানির বিষয়টি পরিবেশ অধিদপ্তর নিয়ন্ত্রণ করে থাকে। তবে সুন্দরবন এলাকায় কাঁকড়ার চাষ করলে তা নিয়ন্ত্রণ করে বন বিভাগ। ফলে দ্বৈত শাসনের যাঁতাকলে পিষ্ঠ হচ্ছে দেশের বর্তমান সময়ের সম্ভাবনাময় কাঁকড়া শিল্পটি।



 

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

আরও পড়ুন
গত​ ৭ দিনের সর্বাধিক পঠিত সংবাদ