Inqilab Logo

শনিবার, ২০ এপ্রিল ২০২৪, ০৭ বৈশাখ ১৪৩১, ১০ শাওয়াল ১৪৪৫ হিজরী

রাজধানীতে মাদকের রমরমা ব্যবসা

| প্রকাশের সময় : ৭ মে, ২০১৭, ১২:০০ এএম

স্টাফ রিপোর্টার ঃ রাজধানীতে বানের ¯্রােতের মত আসছে মাদকের বড় বড় চালান। বিশেষ করে ইয়াবাতে রাজধানী এখন সয়লাব। প্রতিদিনই টেকনাফ, কক্সবাজার চট্রগ্রামসহ বিভিন্ন সীমান্ত পথে হয়ে রাজধানীতে আসছে ইয়াবাসহ বিভিন্ন ধরনের মাদক। সড়ক, রেল ও নৌপথে আসছে ইয়াবার বড় বড় চালান। আর এসব নগরীর অলিগলিতে প্রকাশ্যে মুড়ি মুড়কির মতো বিক্রি হচ্ছে । তরুণ তরুণীরা আশনকাজনক হারে আসক্ত হচ্ছে মাদক সেবনে। বিশেষ করে ইয়াবাতেই সর্বনাশ হচ্ছে সকল শেণীর পরিবাব। অভিভাবকেরা পড়েছে বিপাকে। র‌্যাব পুলিশ প্রায়ই উদ্ধার করছে ইয়াবাসহ ুিবভিন্ন ধরনের মাদক । তারপরেও থেমে নেই মাদক ব্যবসা। অতীতের যে কোন সময়ের চেয়ে রাজধানীতে মাদকের ব্যবসা এখন রমরমা বলে জানিয়েছেন নগরীরর বিভিন্ন এলাকার স্থানীয় সাধারন মানুষ।
পুলিশের একাধিক কর্মকর্তা জানিয়েছেন, আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কঠোর নজরদারি সত্তে¡ও কোনোভাবেই রোধ করা যাচ্ছে না ইয়াবা ব্যবসা। প্রতিদিন বিজিবি, কোস্টগার্ড, র‌্যাব ও গোয়েন্দা পুলিশের জালে ধরা পড়ছে ইয়াবার বড় বড় চালান। পাশাপাশি থানা পুলিশও বসে নেই। তাদের হাতেও নিয়মিত ধরা পড়ছে ইয়াবা ব্যবসায়ী ও ইয়াবার চালান। এরপরও প্রতিযোগিতামূলকভাবে পাড়া-মহল্লায় চলছে ইয়াবা ব্যবসা। গত ১৬ই এপ্রিল টেকনাফে ৯ লাখ ৮০ হাজার পিস ইয়াবা জব্দ করেছে বর্ডার গার্ড বাংলাদেশ (বিজিবির) সদস্যরা। সকাল ৮টার দিকে টেকনাফ উপজেলার সাবরাং ইউনিয়নের নয়াপাড়া এলাকা থেকে এসব ইয়াবা উদ্ধার করা হয়। যার আনুমানিক মুল্য ২৯ কোটি ৪০ লাখ টাকা। এ নিয়ে গত দুদিনে ১৩ লাখ ৩০ হাজার পিস ইয়াবা জব্দ করেছে বিজিবি ও কোস্টগার্ড সদস্যরা। এসব ইয়াবার আনুমানিক বাজার মূল্য প্রায় ৪০ কোটি টাকা বলে জানিয়েছেন সংশ্লিষ্ট সূত্র। এছাড়া র‌্যাব গত ৬ মাসে কয়েক কোটি পিস ইয়াবা উদ্ধার করেছে। তারপরেও সাগর পথে ট্রেনে-বাসে আসছে ইয়াবার চালান।
মাদক দ্রব নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের একাধিক কর্মকর্তা বলেছেন, মাদক আমদানি, সরবরাহ ও বিপণনব্যবস্থা নির্বিঘœ রাখতে একের পর এক কৌশল পাল্টাচ্ছে মাদক ব্যবসায়ীরা। এসব নিত্যনতুন কৌশলে পাচার হওয়া মাদক ধরতে হিমশিম খাচ্ছে প্রশাসন। ইদানীং বাকপ্রতিবন্ধীদের (বোবা) মাধ্যমেও পাচার হচ্ছে ইয়াবা। এতে ইয়াবাসহ বোবারা ধরা পড়লেও তারা মূল মাদক ব্যবসায়ীর নাম-পরিচয় কিছুই জানাতে পারে না, দিতে পারে না স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি। অন্যদিকে একশ্রেণির হিজড়া আনা-নেওয়া করছে ফেনসিডিল। তাছাড়া নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেটের স্টিকার, জেলা প্রশাসন ও পুলিশের স্টিকার লাগানো গাড়ি ব্যবহার করেও মাদক পাচার করছেন ব্যবসায়ীরা। দেশের অভ্যন্তরীণ ৪৭টি রুটের যানবাহন ও ট্রেনে অবাধে আনা-নেওয়া চললেও খুবই সীমিত পরিমাণ মাদক আটক করতে পারে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী।
জানা যায়, এক চিত্রনায়িকার স্বামী এখন বনানীতে ইয়াবা বাণিজ্যের একচ্ছত্র নিয়ন্ত্রক হয়ে উঠেছেন। থানা পুলিশ ও মাদক নিয়ন্ত্রণ অধিদফতরের কতিপয় কর্মকর্তার সঙ্গে মাসোহারা লেনদেন থাকায় তার সিন্ডিকেট ধরাছোঁয়ার বাইরে থাকছে। তার সরবরাহ করা ইয়াবায় বনানী ও এয়ারপোর্ট রোডসংলগ্ন বিভিন্ন আবাসিক হোটেল যেন মাদকের হাটে পরিণত হয়েছে। এই সিন্ডিকেটের অন্তত ৩০ সদস্য ইয়াবা কেনাবেচায় সক্রিয় রয়েছে।
মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তর ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর বিভিন্ন সূত্রমতে, রাজধানীতে সবচেয়ে বড় মাদকের বাজার তেজগাঁওয়ের রেলওয়ে কলোনী। রেলপথ ঘিরে প্রতিদিন অর্ধকোটি টাকার মাদকের লেনদেন হয় ওই এলাকায়। মাত্র আট মাস আগেই রেলপথের এই জায়গায় অবৈধ স্থাপনা উচ্ছেদ করে রেলপুলিশ। মাছবাজার উচ্ছেদ হওয়ার সঙ্গে মাদক ব্যবসাও তখন বন্ধ হয়ে যায়। কিন্ত কিছু দিন পরেই আবার পুরোদমে শুরু হয়েছে মাদক কেনা বেচা। রেল পথ সড়ক পথ নৌ পথ বিভিন্ন পথে প্রতি দিনেই ওই এলাকায় আসছে ইয়াবা ও ফেন্সিডিলের বড় বড় চালান। ওই মাদকের স্পট থেকে নিয়মিত চাঁদা নিচ্ছেন এক শ্রেণীর পুলিশ, স্থানীয় মাস্তান, চাঁদাবাজ। মাদক বিক্রেতা মামুন গতকাল এমনটি জানিয়েছেন। তিনি জানান, থান পুলিশসহ স্থানীয় কিছু প্রভাবশালী ব্যক্তিদের নিয়মিত টাকা দিতে হয়। এ তালিকায় আছেন সাংবাদিক নামদারী কিছু ব্যক্তি। মামুন বলেন, এ ব্যবসা চলবেই। তেজগাঁও রেল লাইন এলাকা যাদের নিয়ণত্রণে তারা প্রভাবশঅলী, আমরা ব্যবসা বন্ধ করে দিলে অন্য লোকজন দিয়ে এ ব্যবসা চালানো হবে। প্রভাবশালী কারা জানতে চাইলে তিনি তাদের নাম প্রকাশ করতে অপারগতা প্রকাশ করেন।
সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের সঙ্গে কথা বলে এবং অনুসন্ধানে জানা গেছে, বারবারই এ জায়গা দখল নেওয়া হয় মাদক ব্যবসার জন্যই। কারণ মাদক কেনা-বেচার জন্য জায়গাটি বেশ সুবিধার। এফডিসি রেলক্রসিং ও কারওয়ান বাজারের দিকে একাধিক রাস্তা থাকায় এখানে সহজে গা-ঢাকা দেওয়া যায়। তাই মাদকের ক্রেতাও বেশি। তাছাড়া মাদকবিরোধী অভিযান হলে বিক্রেতারা ছোট ছোট বস্তিঘরে লুকিয়ে পড়তে পারেন। ধাওয়া খেয়ে কারওয়ান বাজারের পথচারীদের মধ্যেও মিশে যেতে অসুবিধা হয় না তাঁদের।
আবুল কালাম নামের স্থানীয় এক চা বিক্রেতা জানান, টেকনাফ থেকে ইয়াবার চালানগুলো চট্টগ্রাম হয়ে ট্রেনে করে রাজধানীতে আনা হয়। তবে ইয়াবার এসব চালান কমলাপুর যাওয়ার আগেই তেগাঁও রেল স্টেশনের আগে নামানো হয়। আবার কেউ কেউ বিমানবন্দর রেল স্টেশনের আগেই ইয়াবার চালান খালাস করেন। সেখান থেকে হাত বদল হয়ে ইয়াবার চালান চলে যায় তেজগাঁসহ নগরীর বিভিন্ন স্থানে। নানা ধরনের সুযোগ সুবিধার কথা বিবেচনা করেই কারওয়ান বাজারের কাছের রেলপথকে বেছে নিয়েছে মাদক বিক্রেতারা।
কারওয়ান বাজারের শুটকী ব্যবসায়ী রাজু জানান, কক্সবাজর, চট্রগ্রাম এবং টেকনাম থেকে প্রতি সপ্তাহেই শুটকির চালান আসছে কারওয়ান বাজারসহ রাজধানীর বিভিন্ন বাজারে। এক শ্রেণীর শুটকি ব্যবসায়ীও শুটকি ব্যবসার আড়ালে উয়াবার চালান এনে বিক্রি করছে। আইন শৃংখলা বাহিনীর সদস্যরাও বিষটি জানেন। রাজু জানান, শুঁটকির বাজারও মাদক ব্যবসায়ীদের আরেকটি বাড়তি সুবিধার কারণ। টেকনাফ থেকে শুঁটকির চালান এখানকার দোকানে আসে। এই চালানের ভেতর ইয়াবা সহজে বহন করা যায়। মাদক নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের এক কর্মকর্তা জানান, শুঁটকির ভেতর ইয়াবার গন্ধ ও সন্ধান কিছুই পাওয়া যায় না।
সরেজমিনে দেখা গেছে, ইয়াবা ছাড়াও গাঁজা, ফেনসিডিল, হেরোইন এসব মাদক এখানে খুব সহজেই মেলে। তবে ইয়াবার ব্যবসা এখন বেশ রমরমা।
মাদক দ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের এক কর্মকর্তা বলেন, লেল লাইনের পাশে যত বস্তি আছে সবই উচ্ছেদ করার প্রয়োজন। এসব বস্তি ও ছোট ছোট ঘরেই বেশিরভাগ সময় ইয়াবা ব্যবসায়ীরা আশ্রয় নিয়ে তাদের ব্যবসা চালিয়ে যাচ্ছে। তেজগাঁও এফডিসি ক্রসিং থেকে শুরু করে কারওয়ান বাজারের শুঁটকিপট্টি পর্যন্ত রেললাইনে মাদকের ব্যবসা চলে তুলনামূলক বেশি। সন্ধ্যা থেকে গভীর রাত পর্যন্ত নানা বয়সের নারীদের হাতে প্যাকেট নিয়ে রেললাইনের ওপর হাঁটতে দেখা যায়। পথচারী দেখলেই তাঁরা বলা শুরু করেন, ‘কোনটা লাগব, যাঁদের প্রয়োজন, ইশারাতেই তাঁরা বুঝে ফেলেন। মাঝে মধ্যে এদের বিরুদ্ধে অভিযান চালানো হলেও বন্ধ হচ্ছে না মাদক ব্যবসা।
মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তর সূত্র জানায়, রেল লাইনের পাশের বস্তি উচ্ছেদ অভিযান চালানোর পর এই রেললাইনে মাদকের ব্যবসা বেশ কমে গিয়েছিল। কিছুদিন পর মাদক ব্যবসায়ীরা আবারও ফিরে আসে রেললাইনের ওপর। এর পাশের স্থাপনাগুলোও দখলদারদের আয়ত্তে চলে যায়। বাঁশ-টিন দিয়ে দোকান বসানোর কাজও চলছে। মাছ ব্যবসায়ীরাও বড় বড় বাক্স ফেলে রেখে জায়গা দখলে রেখেছেন। পাশের নাখালপাড়া, আরজতপাড়ার রেললাইনের পাশে উচ্ছেদ হওয়া দোকানপাট ও রিকশা গ্যারেজ আবার গড়ে উঠেছে। স্থানীয় যুবলীগ একটি কার্যালয় বসিয়েছে একেবারে এফডিসি রেলক্রসিংয়ের পাশে। এখান থেকেই বর্তমানে এই মাদকের ব্যবসা নিয়ন্ত্রণ করা হয় বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে।

**********



 

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

আরও পড়ুন
এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ
গত​ ৭ দিনের সর্বাধিক পঠিত সংবাদ