Inqilab Logo

শুক্রবার, ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১, ১৬ শাওয়াল ১৪৪৫ হিজরী

আরব ও মুসলমানদের ঐক্য বিরোধি ষড়যন্ত্র

| প্রকাশের সময় : ২৪ মে, ২০১৭, ১২:০০ এএম


জামালউদ্দিন বারী : মধ্যপ্রাচ্য পরিস্থিতি এবং চীন-রাশিয়ার নতুন অর্থনৈতিক ও আঞ্চলিক বাণিজ্যিক মহাপরিকল্পনার মধ্য দিয়ে বিশ্ব রাজনীতিতে দ্রুত একটি নতুন মেরুকরণ ঘটতে চলেছে। এখন প্রাচ্য-প্রতীচ্যের অনেক রাষ্ট্রশক্তির গতানুগতিক চিন্তাধারায় এক প্রকার মোহভঙ্গের সুর শোনা যাচ্ছে। বিশেষত: ব্রেক্সিট বা বৃটিশদের ইউরোপীয় ইউনিয়ন ছেড়ে যাওয়াসহ  ইউরোপীয় ইউনিয়ন এবং পশ্চিমা অর্থনৈতিক স্টেকহোল্ডারদের মধ্যে যে নতুন ভাবধারা সূচিত হয়েছে সেখানে ইসলাম হয়ে উঠছে পুঁজিবাদি সংস্কৃতির নতুন টার্গেট। পশ্চিমা রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক সংস্কৃতির কপোর্রেট তৎপরতায় ইসলাম ও মুসলমানকেন্দ্রিক প্যারাডাইম শিফ্টিং শুরু হয়েছিল সোভিয়েত ইউনিয়ন ও আমেরিকার বাইপোলার স্নায়ুযুদ্ধ শেষ হওয়ার আগেই। ইসলামি সংস্কৃতি অর্থনৈতিক আধিপত্যের শিক্ষা দেয়না। অর্থনৈতিক বা পুঁজিবাদি শক্তি দিয়ে এই সংস্কৃতির মোকাবেলাও সম্ভব নয়। এমনকি অত্যাধুনিক সমর প্রযুক্তি এবং ব্যাপক বিদ্ধংশি মারনাস্ত্র দিয়েও যে এই সংস্কৃতির মোকাবেলা সম্ভব নয়। মধ্যপ্রাচ্যে গত তিন দশক ধরে চলমান পশ্চিমা সামরিক আগ্রাসনের ফলাফল থেকেও তা’ প্রতিয়মান হয়েছে। মূলত: পঞ্চাশের দশকের কোরীয় যুদ্ধ থেকে শুরু করে ভিয়েতনামযুদ্ধসহ কোন যুদ্ধেই শুধুমাত্র সামরিক শক্তি ও সমরপ্রযুক্তিবলে পশ্চিমারা বিজয় অর্জন করতে পারেনি। দুর্বল রাষ্ট্রগুলোতে বছরের পর ধরে হাজার হাজার কোটি ডলারের সামরিক শক্তি ব্যয় করেও দশকশেষে লেজ গুটিয়ে পালিয়ে যেতে হচ্ছে। ফিলিস্তিন-ইসরাইল বা আরব-ইসরাইল সংঘাতের বিষয়টিকে আলোচনার বাইরে রাখলেও লেবানন, ইরাক,আফগানিস্তান, সিরিয়া, লিবিয়া, সুদান, সোমালিয়ার মত দেশগুলোতেও পশ্চিমা মদদপুষ্ট সন্ত্রাসবাদ সেখানকার জনগনের কাছে কোন আবেদন রাখতে পারেনি, পাত্তা পায়নি। এসব তিক্ত অভিজ্ঞতার আলোকে পশ্চিমা সা¤্রাজ্যবাদিরা মুসলমান জনসংখ্যাগরিষ্ঠ রাষ্ট্রগুলোতে এক ধরনের গোপন মিশন চালিয়ে যাচ্ছে। ইরাকে আগ্রাসন চালিয়ে সাদ্দাম হোসেনকে উৎখাত করার আগে মার্কিন প্রশাসন সেখানে গণতন্ত্র এবং শান্তি-শৃঙ্খলার নতুন দৃষ্টান্ত স্থাপনের প্রতিশ্রæতি দিয়েছিল। প্রেসিডেন্ট সাদ্দাম হোসেনের নেতৃত্বে যে ইরাক একটি সম্ভাবনাময় আঞ্চলিক রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক শক্তি হয়ে উঠেছিল, ইরাক যুদ্ধের দেড় দশক পেরিয়ে এসে সে দেশ এখন ইতিহাসের সবচে অনিরাপদ-বিশৃঙ্খল এবং ক্ষুধা-দারিদ্র্য পীড়িত রাষ্ট্র হিসেবে আবির্ভূত হচ্ছে। সাদ্দামবিহিন ইরাকে, তালেবানবিহিন আফগানিস্তানে, গাদ্দাফিমুক্ত লিবিয়ায় গণতন্ত্র ও মানবাধিকারের নহর বইয়ে দেয়ার প্রতিশ্রæতিকে ভুলিয়ে দিতে মার্কিনীরা শান্তিকামী জনগনের সামনে আইএস’র মত আরো খারাপ প্রতিপক্ষ সৃষ্টি করেছে। মধ্যপ্রাচ্যসহ সারাবিশ্বে ইসলাম ও মুসলমানদের সম্পর্কে ভীতি ছড়িয়ে দিতে পশ্চিমাদের প্রোপাগান্ডা ম্যাকানিজম পেন্টাগনের সামরিক কর্মসূচিরই অংশ। আফগানিস্তানে সোভিয়েত দখলদারিত্বের বিরুদ্ধে তালেবানদের প্রতিরোধ সংগ্রামে সর্বাত্মক সহযোগিতা নিয়ে পাশে দাড়িয়েছিল নিজেদের স্বার্থেই। তালেবান যোদ্ধাদের সহযোগিতা করতে ওসামা বিন লাদেনের আল কায়েদা গঠন এবং তাদেরকে ট্রেনিং ও অস্ত্র সহায়তা দিয়ে কার্যকর করে তোলার মধ্য দিয়ে সোভিয়েত বাহিনীকে আফগানিস্তান ত্যাগ করতে বাধ্য করা হয়েছিল। নিউইয়র্ক ও পেন্টাগনে নাইন-ইলেভেন সন্ত্রাসী হামলার ঘটনা সম্পর্কে মার্কিন প্রশাসন গত ১৬ বছরেও মার্কিন জনগন ও বিশ্বসম্প্রদায়ের সন্দেহ ও অস্বচ্ছতা দূর করতে না পারলেও তাদের সৃষ্ট আল কায়েদার উপর দোষ চাপিয়ে যে নজিরবিহিন সামরিক সন্ত্রাস শুরু করেছিল, তা এখনো অব্যাহত ও সম্প্রসারিত করে চলেছে। ইরাক, সিরিয়া,তুরস্ক, লিবিয়ায় নতুন নতুন সন্ত্রাসী গ্রæপ সৃষ্টি করে পুরো মধ্যপ্রাচ্য জনগন ও শাসকদের মধ্যে আতঙ্ক ও ভীতিকর পরিবেশ তৈরী করা হয়েছে। একদিকে অবৈধ রাষ্ট্র ইসরাইলের নিরাপত্তা অন্যদিকে মধ্যপ্রাচ্যের তেলসম্পদ এবং তেল বিক্রি করে অর্জিত হাজার হাজার কোটি ডলার লুণ্ঠন করাই মধ্যপ্রাচ্যে এই আতঙ্কজনক পরিস্থিতি সৃষ্টির মূল কারণ।
মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের হাতে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং বিশ্ব নিরাপদ নয় বলে দাবী করছেন পশ্চিমা সামরিক ও রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের অনেকে। নির্বাচনে প্রার্থী হিসেবে ঘোষনা দেয়ার পর থেকে ইসলাম ও মুসলমান বিদ্বেষি ভূমিকা নিয়ে হাজির হয়েছেন ট্রাম্প। এক অস্বাভাবিক বাস্তবতার মধ্য দিয়ে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হওয়ার পর সাতটি মুসলমান রাষ্ট্রের নাগরিকদের  জন্য মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে ভ্রমন ও ভিসা নিষেধাজ্ঞা জারি করাই ছিল মার্কিন প্রেসিডেন্ট হিসেবে ট্রাম্পের প্রথম সবচে গুরুত্বপূর্ণ রাষ্ট্রীয় সিদ্ধান্ত। নাইন-ইলেভেন সন্ত্রাসী হামলার শুরু থেকেই ওসামা বিন লাদেনসহ সউদি আরবের নাগরিকদের সংশ্লিষ্টতার কথা বিভিন্ন সময়ে উঠে আসলেও মার্কিন প্রশাসন এই অভিযোগকে কখনো পাত্তা না দিয়ে সউদি আরবের সাথে সুসম্পর্ক বজায় রেখেছে শুধুমাত্র জ্বালানী নিরাপত্তা ও অর্থনৈতিক স্বার্থে। এর অর্থ এই নয় যে, সউদি নাগরিকরা নাইন-ইলেভেন সন্ত্রাসী হামলা করেছিল এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র তা’ বুঝেও না বোঝার ভান করছে। মূলত: এই সন্ত্রাসী হামলার ঘটনা এবং পরবর্তি ওয়ার অন টেররসহ সামগ্রিক কর্মপরিকল্পনার সাথে বৃহত্তর ও দীর্ঘমেয়াদি সা¤্রাজ্যবাদী নীলনকশা রয়েছে। ন্যাটো ও মার্কিন বাহিনী দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর বৃহত্তম সমরশক্তির সমাবেশে প্রথমেই আফগানিস্তান ও ইরাক দখল করে শাসকদের হত্যা করে যে ভীতি সৃষ্টি করেছিল তা ছিল  ঝি কে মের বৌকে শেখানোর মত। ইরাক ও আফগানিস্তান দখলের সময়ই সউদি আরব, সংযুক্ত আরব আমিরাতসহ মধ্যপ্রাচ্যের অন্য দেশগুলোতেও আগ্রাসন সম্প্রসারণ অথবা আলকায়েদাসহ বিভিন্ন জঙ্গিবাদি গোষ্ঠির আক্রমন থেকে তাদের নিরাপত্তার দোহাই দিয়ে সে সব দেশে মার্কিন সামরিক বাহিনীর উপস্থিতি নিশ্চিত করা হয়েছিল। আইএস সহ সন্ত্রাসী গোষ্ঠিগুলোর কথিত নৃশংসতার ভিডিও অনলাইনে ছেড়ে দিয়ে বিশ্বের কাছে ইসলাম ও মুসলমানদের সম্পর্কে ভীতি ছড়িয়ে দেয়া হয়েছে। অন্যদিকে এসব সন্ত্রাসী জঙ্গিবাদি ও বিদ্রোহী গ্রæপগুলো পশ্চিমা সামরিক গোয়েন্দা শাখার কাছ থেকে কোটি কোটি ডলারের অস্ত্র, প্রশিক্ষণ ও রিক্রুটিং সহায়তা পাচ্ছে বলে নির্ভরযোগ্য তথ্য প্রমান পাওয়া যাচ্ছে। পশ্চিমা গণমাধ্যমে প্রকাশিত বিভিন্ন রিপোর্টে এ সম্পর্কিত তথ্য পাওয়া যাচ্ছে। মার্কিন ও বৃটিশ সামরিক বাহিনী আইএস জঙ্গিদের কাছে হেলিকপ্টার থেকে অস্ত্র সরবরাহ করেছে বলে আফগানিস্তানের সাবেক প্রেসিডেন্ট হামিদ কারজাই সম্প্রতি এক বক্তব্যে অভিযোগ করেছেন। বিশেষত: আইএস’র তৎপরতার কারণে বিশ্ববাজারে জ্বালানী তেলের মূল্য অর্ধেকেরও নিচে নেমে গেছে। আইএস ও সন্ত্রাসীগ্রæপগুলোর নিয়ন্ত্রনাধীন এলাকা থেকে নামমাত্র মূল্যে লাখ লাখ ব্যারেল তেল নিয়ে তেলের মজুদ বাড়াচ্ছে ইসরাইল এবং পশ্চিমা তেলকোম্পানীগুলো। এর ফলে তেল আমদানীকারক পশ্চিমা দেশগুলোর বাজেট ও বাণিজ্য ঘাটতি অনেকটা কমে এলেও সউদি আরবের মত তেল রাজস্ব নির্ভর দেশের অর্থনীতির বারটা বেজে যাচ্ছে। সাম্প্রতিক বছরগুলোতে সউদি আরবের বাজেট ঘাটতি ২০ শতাংশের বেশী। জ্বালানী তেলের মূল্য ও রাজস্ব না বাড়লে এবং এ হারে বাজেট ঘাটতি অব্যাহত থাকলে ২০২০ সালের মধ্যে মধ্যপ্রাচ্যের সবচে সমৃদ্ধ অর্থনীতির দেশ সউদি আরব দেউলিয়া হয়ে যেতে পারে বলে আইএমএফ’র একটি রিপোর্টে উল্লেখ করা হয়েছিল।
আরব-ইসরাইল বিরোধ নিস্পত্তিসহ ফিলিস্তিন সমস্যার দ্বিরাষ্ট্রভিত্তিক সমাধানের নীতি থেকে সরে আসার একটি প্রচ্ছন্ন ইঙ্গিত দেয়ার পাশাপাশি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে মুসলমানদের ভ্রমন ও ভিসার অধিকার খর্ব করার সম্ভাব্য তালিকা থেকে সউদি আরবকে বাইরে রাখার মোজেজা বোঝা গেল ডোনাল্ড ট্রাম্পের সউদি আরব সফরে। উল্লেখ্য, প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হওয়ার পর এটিই ট্রাম্পের প্রথম বিদেশ সফর। এই সফরে ট্রাম্প তার অর্থনৈতিক সাফল্যের মুকুটে একটি অতি মূল্যবান পালক সংযোজন করতে সক্ষম হয়েছেন। যে সময় সউদি অর্থনীতি অব্যাহত বাজেট ঘাটতির সম্মুখীন হচ্ছে, এমন এক সময়ে ডোনাল্ড ট্রাম্প সউদি আরবের সাথে ৩৮ হাজার কোটি ডলারের অস্ত্র, বিনিয়োগ ও বাণিজ্য চুক্তি স্বাক্ষর করেছেন। নির্বাচিত হওয়ার আগেই ট্রাম্প মার্কিন অর্থনীতিতে একটি ইতিবাচক ধারা সূচনার প্রতিশ্রæতি দিয়েছিলেন। নিজের প্রথম বিদেশ সফরে সউদি আরবের সাথে ৩৮ হাজার কোটি ডলারের চুক্তি স্বাক্ষরের মধ্য দিয়ে ট্রাম্প তার প্রতিশ্রæতি রক্ষায় বেশ বড় এক ধাপ এগিয়ে গেলেন। বাণিজ্য, কর্মসংস্থান ও বিনিয়োগের দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনার পাশাপাশি ১১ হাজার কোটি ডলারের অস্ত্রচুক্তির বিষয়টি চোখ কপালে ওঠার মত বিষয়। গত শত বছরে বিশ্বের পরাশক্তিগুলোর সামরিক-অর্থনৈতিক  প্রতিযোগিতা অনেক দেখা গেছে। কিন্তু বিশ্বের বৃহত্তম সামরিক ও অর্থনৈতিক পরাশক্তি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সাথে কোন একক দেশের বৃহত্তম অস্ত্রচুক্তিটি স্বাক্ষর করল সউদি আরব। একমাত্র ইসরাইল ছাড়া মধ্যপ্রাচ্যের আর কোন দেশের উপর ইরানের পক্ষ থেকে হুমকি না থাকলেও ইরানের প্রভাব বৃদ্ধি ও হুমকি মোকাবেলার অজুহাত তুলে সউদি আরবের জন্য কার্যত অপ্রয়োজনীয় থাড ক্ষেপনাস্ত্র ব্যবস্থাসহ বিশাল সামরিক ব্যয় চাপিয়ে দেয়া হচ্ছে। এসব ক্ষেপনাস্ত্র ব্যবস্থা এবং প্রতিরক্ষা সরঞ্জাম স্বাভাবিক মূল্যের চাইতে অনেক বেশী ধরা হয়েছে বলে প্রশ্ন উঠেছে। চীন,জাপান, রাশিয়া যখন এশিয়া ও আফ্রিকার উন্নয়নশীল দেশগুলোতে হাজার হাজার কোটি ডলারের বিনিয়োগসহ কারখানা ও ব্যবসায় বাণিজ্য স্থানান্তর করছে, মুসলিম বিশ্বের প্রানকেন্দ্র সউদি আরবের শাসকরা তখন তাদের সম্পদ ও বিনিয়োগ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে সরিয়ে নিচ্ছে। যদিও ১১ হাজার কোটি ডলারের মার্কিন অস্ত্র ক্রয় সউদি আরবের নিরাপত্তা অথবা তথাকথিত ৯/১১ তদন্ত রিপোর্টের আলোকে ভিকটিম পরিবারগুলো সউদি আরবের বিরুদ্ধে ক্ষতিপুরণ মামলা করতে পারবেনা এমন গ্যারান্টি পাওয়া যায়নি। অর্থাৎ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র চাইলে যে কোন সময় সউদি সরকারের উপর হাজার হাজার কোটি ডলারের ক্ষতিপুরণ মামলা ও সামরিক বাণিজ্যিক নিষেধাজ্ঞার থড়গ নেমে আসতে পারে। এমনটা হয়তো তখনি ঘটবে যখন সউদি আরবের তেল সম্পদের প্রভাব এবং অর্থনৈতিক সামর্থ্য গৌণ হয়ে পড়বে। পশ্চিমা সা¤্রাজ্যবাদের কুশীলবরা সউদি আরবকে সে দিকেই ঠেলে দিতে চাইছে। নাইন-ইলেভেন সন্ত্রাসী বিমান হামলার অনেক আগে থেকে সউদি রির্জাভ ফান্ডের শত শত বিলিয়ন ডলার মার্কিন ট্রেজারিতে জমা আছে। নাইন ইলেভেনের পর এ বিশাল সম্পদের ভাগ্য নিয়ে এক ধরনের ধোঁয়াশা ও অস্বচ্ছতা সৃষ্টি হয়েছে। মার্কিন যুদ্ধবাদি অর্থনীতির কুশীলবরা সন্ত্রাস জঙ্গিবাদের প্রোপাগান্ডার মাধ্যমে মধ্যপ্রাচ্যের শাসকদের ভীত-সন্ত্রস্ত ও চাপ সৃষ্টি করে তাদের সব সম্পদের উপর কর্তৃত্ব  ও অধিকার প্রতিষ্ঠার পথ তৈরী করেছে।
ডোনাল্ড ট্রাম্পের মাইল ফলক সউদি আরব সফর উপলক্ষে রিয়াদে দুইদিনব্যাপী ৫৬ জাতির আরব- ইসলামিক-আমেরিকান(এআইএ) কনফারেন্সের উদ্বোধনী সেশনে মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড  ট্রাম্প তথাকথিত ইসলামিক এক্সট্রিমিজম মোকাবেলায় আরব দেশগুলোকে ঐক্যবদ্ধ হওয়ার আহ্বান জানান এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সহায়তা বা এগিয়ে আসার অপেক্ষা না করে নিজেরাই নিজেদের সমস্যা নিরসনে উদ্যোগ নেয়ার আহ্বান জানান । এই সম্মেলনে প্রদত্ত ভাষনে প্রথম বারের মত তিনি উগ্র ইসলামিক সন্ত্রাস বা ‘র‌্যাডিকেল ইসলামিক টেরর’ শব্দগুলো পরিহার করেন। আপাত: দৃষ্টিতে এআইএ সম্মেলনে মুসলমানদের ঐক্যবদ্ধ হওয়ার আহ্বান জানালেও এর পশ্চাতে ডোনাল্ড ট্রাম্প মুসলমানদের মধ্যে একটি সুস্পষ্ট বিভাজন রেখা ও আঞ্চলিক বৈরিতা সৃষ্টির চেষ্টা করেছেন। ট্রাম্পের বক্তৃতায় ইরানকে জঙ্গি-সন্ত্রাসবাদের আশ্রয়দাতা হিসেবে উল্লেখ করে  সউদি আরবসহ অপরাপর আরব ও মুসলিম দেশগুলোকে ঐক্যবদ্ধভাবে ইরানের প্রভাব মোকাবেলা করার পরামর্শ দেন। ইরানকে বিচ্ছিন্ন ও একঘরে করে রাখার তাকিদ দিয়েছেন।  যেখানে দেড় দশকের বেশী সময় ধরে মার্কিন ও ন্যাটো বাহিনী সর্বশক্তি নিয়ে লড়াই করেও আল কায়েদা বা তালেবানদের শক্তি খর্ব করতে এবং আফগানিস্তান ও ইরাকে সামরিক রাজনৈতিক বিজয় অর্জন করতে শুধু ব্যর্থ হয়নি, এখন তালেবানদের সাথে সমঝোতা করে সেইফ এক্সিট খুঁজতে ব্যস্ত হয়ে পড়েছে সেই মুহুর্তে মধ্যপ্রাচের সবচে শক্তিশালী রাষ্ট্র ইরানকে সরাসরি সামরিক লক্ষ্যবস্তু হিসেবে টার্গেট করার সাহস পাচ্ছেনা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র। সউদি আরবের কাছে হাজার হাজার কোটি ডলারের সমরাস্ত্র বিক্রির পাশাপাশি আরব রাষ্ট্রগুলোকে ইরানের বিরুদ্ধে উস্কে দিয়ে কাঁটা দিয়ে কাঁটা তোলার পন্থা গ্রহন করছে। তবে আশির দশকে ৮ বছরব্যাপী ইরান-ইরাক যুদ্ধের অভিজ্ঞতাকে সামনে রেখে ইরান, সউদি আরব বা আরব নেতারা মার্কিনীদের পাতা ফাঁদে পা দেয়ার মত বোকামি হয়তো আর করবেনা। পরিবর্তিত বিশ্ব প্রেক্ষাপটে ইরানের সাথে আরব নেতাদের মত পার্থক্য দূর করে একটি কৌশলগত ঐক্য গড়ে তোলাই এখন সময়ের দাবী। আধুনিক তুরস্কের অবিসম্বাদিত নেতা রিসেপ তাইয়েপ এরদোগান ইতিমধ্যে ইউরোপীয় ইউনিয়নের সদস্য হিসেবে তুরস্কের অন্তর্ভুক্তির দাবী ও প্রত্যাশা পরিত্যাগ করেছেন। তার ধারনা, শুধুমাত্র মুসলমান হওয়ার কারনেই তুরস্ক কখনো ইইউ মেম্বার হতে পারবেনা। গত শনিবার ইস্তাম্বুলের ইবনে খালদুন বিশ্ববিদ্যালয়ের একটি সিম্পোজিয়ামে বক্তৃতাকালে তুর্কি প্রেসিডেন্ট বলেন, তুরস্ক সন্ত্রাসী এবং সন্ত্রাসবাদের প্রচারনার বিরুদ্ধে লড়াই করছে। অন্যদিকে মুক্ত চিন্তার নামে বিশ্বের বিভিন্ন স্থানে পরিকল্পিতভাবে সন্ত্রাসী প্রচারনা ছড়িয়ে দেয়া হচ্ছে বলে এরদোগান দাবী করেন। গত বছরের শেষদিকে মার্কিন দৈনিক ইউএসএ টুডে প্রকাশিত এক রিপোর্টে জানা যায়, আফগানিস্তানের নাগরিকদের মধ্যে মনস্তাত্বিক প্রচারনা চালানোর লক্ষ্যে ইনফরমেশন অপারেশন প্রোগ্রাম নাম দিয়ে একটি প্রকল্পে নতুন করে ৪২৫ মিলিয়ন ডলারের বরাদ্দ দিয়েছে। ব্রডকাস্ট, বিলবোর্ড, প্যাম্ফলেট প্রচারের মাধ্যমে তারা মার্কিনীদের অনুকুলে আফগান নাগরিকদের মধ্যে মনোজাগতিক পরিবর্তন আনতে চায়। একই ধরনের প্রোগ্রাম সিরিয়াসহ অন্যান্য আরব দেশে চালিয়ে যাচ্ছে পেন্টাগন। আইএস’ র নামে কথিত ওয়েব সাইট এবং ভাইরাল ভিডিও ফুটেজগুলো নির্মানের পেছনেও নাকি শত শত মিলিয়ন ডলার খরচ মেটানো হচ্ছে মার্কিন সামরিক গোয়েন্দা দফতর থেকে। এসব তৎপরতার উদ্দেশ্য ইসলামোফোবিয়া বা ইসলাম ও মুসলমানদের সম্পর্কে বিরূপ ধারনা তৈরী করা।  মধ্যপ্রাচ্যে মার্কিন পৃষ্ঠপোষকতায় সন্ত্রাস বিরোধি  সামরিক জোট গঠন করে মাসের পর মাস কথিত বিমান হামলা চালিয়েও যখন আইএস’র শক্তিকে খর্ব করা যাচ্ছিল না তখন ইরান ও রাশিয়ার হস্তক্ষেপে মাত্র দু’ সপ্তাহের মধ্যেই সিরিয়া ও ইরাকের চালচিত্র পাল্টে গিয়েছিল। অথবা ইসরাইল যখন জাতিসংঘসহ বিশ্বের কোন কনভেনশনই মানছেনা দরিদ্র ফিলিস্তিনিদের উপর নির্মম অবরোধ ও বিমান হামলার বিরুদ্ধে হেজবুল্লাহ ও হামাসের প্রতিরোধের মুখে বিশ্বের সবচে শক্তিশালী সামরিক বাহিনী হিসেবে খ্যাত আইডিএফ পরাজিত হয়ে পালিয়ে যেতে বাধ্য হয় এমন পটেনশিয়াল শক্তির বিরুদ্ধে আরব ও মুসলিম বিশ্বকে ক্ষেপিয়ে তোলার পশ্চিমা ষড়যন্ত্রের বিরুদ্ধে মুসলমান ও শান্তিকামি বিশ্বসম্প্রদায়কে  সচেতন থাকতে হবে।
[email protected]



 

Show all comments
  • ২৫ মে, ২০১৭, ১০:৪১ পিএম says : 0
    100%ঠিক কথা
    Total Reply(0) Reply

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

আরও পড়ুন
গত​ ৭ দিনের সর্বাধিক পঠিত সংবাদ