Inqilab Logo

শুক্রবার, ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ০৬ বৈশাখ ১৪৩১, ০৯ শাওয়াল ১৪৪৫ হিজরী

চট্টগ্রামে চোরাপথে আসা স্বর্ণ ঘিরে সক্রিয় অপরাধী চক্র

| প্রকাশের সময় : ২৬ মে, ২০১৭, ১২:০০ এএম


রফিকুল ইসলাম সেলিম : আমদানির ক্ষেত্রে সুস্পষ্ট কোন নীতিমালা না থাকায় চোরাই পথেই আসছে স্বর্ণ। এতে একদিকে সরকার বিপুল অংকের রাজস্ব বঞ্চিত হচ্ছে, অন্যদিকে চোরাই স্বর্ণ ঘিরে অপরাধী চক্রের বেপরোয়া দাপট বেড়েই চলছে। সমৃদ্ধ হচ্ছে অপরাধীদের অর্থনীতির ভিত। হুন্ডি ব্যবসায়ী ও আন্তর্জাতিক মুদ্রা পাচারকারীরাও স্বর্ণের বার ব্যবহার করছে। অস্ত্র, মাদকসহ চোরাচালানি পণ্যের দাম হিসাবে ব্যবহার হচ্ছে স্বর্ণের বিস্কুট। মিয়ানমারে যাচ্ছে স্বর্ণ, আসছে ইয়াবা। আবার ভারত থেকে স্বর্ণের বিনিময়ে ফেনসিডিলসহ হরেক চোরাইপণ্য আসার তথ্য রয়েছে আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারি বাহিনীর কাছে। সীমান্তে স্বর্ণের বারসহ অনেকে ধরাও পড়েছে। স্বর্ণ চোরাচালান আর চোরাই স্বর্ণের ব্যবসার সাথে জড়িয়ে পড়ছে পুলিশ, বিমানকর্মীসহ অনেকে।
বৈধপথে আমদানির সুযোগ না থাকায় মূলত: চোরাইপথে আসা স্বর্ণ দিয়েই চলছে জুয়েলারী ব্যবসা। চট্টগ্রামের ৮ হাজারের বেশি স্বর্ণের দোকান রয়েছে। জুয়েলারীর চাহিদা মিটিয়ে চোরাই স্বর্ণের একটি অংশ চলে যাচ্ছে চোরাকারবারি ও অপরাধীদের হাতে। চোরাচালান পণ্য বিশেষ করে মাদক ও অস্ত্র আনতে স্বর্ণের বার ব্যবহার করা হচ্ছে। বিভিন্ন সময়ে র‌্যাব পুলিশের অভিযানে চোরাচালানীদের আস্তানা থেকে স্বর্ণের বারও উদ্ধার হয়েছে।
চট্টগ্রাম রেঞ্জের একজন কর্মকর্তা জানান, ভারত থেকে স্বর্ণের বিনিময়ে গরুসহ চোরাইপণ্য আনার তথ্য আমাদের কাছে আছে। ওপারে স্বর্ণ যাচ্ছে, বিনিময়ে আসছে মাদক ও মসলা। স্বর্ণের বদলে মিয়ানমার থেকে ইয়াবার চালান আসার খবরও আছে পুলিশের কাছে। তিনি বলেন, চোরাইপথে আসা স্বর্ণের কারণে অপরাধীদের অর্থনৈতিক ভিত শক্তিশালী হচ্ছে। এতে অপরাধ প্রবণতাও বাড়ছে। যা দেশের জন্য ক্ষতিকর।
চট্টগ্রাম শাহ্ আমানত আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে প্রায়ই স্বর্ণের চালান ধরা পড়ছে। সম্প্রতি এধরনের চালান কম ধরা পড়লেও গত তিন চার বছর বেশ কয়েকটি বড় বড় চালান ধরা পড়ে। চট্টগ্রাম কাস্টম হাউসের হিসেবে শুধুমাত্র ২০১৪ সালেই ২৫৪ কেজি স্বর্ণ ধরা পড়ে শাহ আমানত বিমানবন্দরে। এসব স্বর্ণ পাচারের সাথে বিমানকর্মীদের জড়িত থাকারও অভিযোগ রয়েছে। অভিযোগ প্রমানিত হওয়ায় অনেকের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থাও নেওয়া হয়েছে।
বিমানবন্দরের বাইরেও বিভিন্ন সময়ে স্বর্ণের বড় বড় চালান ধরা পড়ে। পুলিশের কাছেও পাওয়া যায় স্বর্ণের বার। চোরাই স্বর্ণের ব্যবসা যারা করেন তাদের কাছ থেকে বিভিন্ন সময়ে স্বর্ণ ছিনতাইয়ের অভিযোগও উঠে পুলিশের বিরুদ্ধে। কারা এসব স্বর্ণের ব্যবসায় জড়িত তা জানে পুলিশ ও শুল্ক কর্মকর্তারা। ফলে ব্যবসা নিরাপদ করতে তাদের নিয়মিত বখশিস দিতে হয়।
বিগত ১৫  সালে নগরীর স্টেশন এলাকা থেকে ৫৬টি স্বর্ণের বারসহ একজনকে আটক করে ডিবি পুলিশ। সেখান থেকে ২৮টি বার লুকিয়ে রাখে এক ডিবি কর্মকর্তা। পরে বিষয়টি স্বর্ণ ব্যবসায়ীরা পুলিশের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের জানালে পুলিশ তার বাসায় তল্লাশি চালিয়ে ২৮ বার উদ্ধার করে। আবু হোসেন নামে ওই ডিবি কর্মকর্তাকে পরে সাময়িক বরখাস্ত করা হয়।
নগরীতে বিভিন্ন সময়ে পুলিশের হাতে স্বর্ণের বারসহ ব্যবসায়ী ধরা পড়ে। কয়েকটি ঘটনায় দেখা গেছে ব্যবসায়ীরা দাবি করছে এসব স্বর্ণ তাদের জুয়েলারীর। তবে তারা বৈধ কোন কাগজপত্র দেখাতে পারেনা। এই সুযোগ কাজে লাগিয়ে কিছু পুলিশ সদস্য তাদের আটক করে। একজন স্বর্ণ ব্যবসায়ী বলেন, বেশিরভাগ ক্ষেত্রে এই ধরনের ঘটনা আপোস হয়ে যায়। পুলিশের হাতে কিছু বিস্কুট ধরিয়ে দিলে তারা কেটে পড়ে। তবে যেসব ব্যবসায়ী বিস্কুটের ভাগ দিতে রাজি না মূলত তাদেরই গ্রেফতার দেখানো হয়।
অপর একজন স্বর্ণ ব্যবসায়ী জানান, চোরাপথে আসা স্বর্ণ দিয়ে জুয়েলারী চলছে এটা সকলের জানা। তবে এক্ষেত্রে বড় বড় ব্যবসায়ীরা সব সময় কিছু অসাধু পুলিশ ও শুল্ক কর্মকর্তাদের কুনজরে থাকেন। তাদের ধারণা এসব ব্যবসায়ীদের হাতে বিপুল স্বর্ণ আছে। তাদের কাছ থেকে নিয়মিত মাসোহারা আদায় করা হয়। এমন কয়েকজন ব্যবসায়ীকে অপহরণও করা হয়। নগরীর হাজারি গলির স্বর্ণ ব্যবসায়ী মৃদুল কান্তিকে র‌্যাব পরিচয়ে তুলে নেওয়ার ঘটনা ছিল পুরো দেশে আলোচিত। আরও কয়েকজন ব্যবসায়ীকে তুলে নিয়ে যাওয়া। জানা যায় তুলে নেওয়ার পর তাদের কাছে মুক্তিপণ হিসাবে স্বর্ণের বিস্কুট চাওয়া হয়।
হুন্ডি ব্যবসায়ীরাও স্বর্ণের বিস্কুট ব্যবহার করছে। গত বছরের জানুয়ারি মাসে নগরীর রেয়াজুদ্দিন বাজার থেকে ৬০ লাখ টাকা ও আড়াইশ স্বর্ণের বার ভর্তি একটি সিন্দুক উদ্ধার করে পুলিশ। পরে পুলিশ নিশ্চিত হয় সিন্দুকের মালিক চোরাচালানি এবং হুন্ডি ব্যবসায়ী। রেয়াজুদ্দিন বাজারে স্বর্ণ, হুন্ডি ও ইয়াবা ব্যবসায়ীদের একাধিক সিন্ডিকেট রয়েছে। এমন সিন্ডিকেটের একজন নেতাকে অপহরণ করে কোটি টাকা মুক্তিপণ আদায় করে অপহরণকারীরা।
তার আগে রেয়াজউদ্দিন বাজারের বানিয়ার টিলায় এক ব্যবসায়ীর বাসা থেকে ২৫টি স্বর্ণের বার, ১৭ লাখ টাকা ও তিন লাখ টাকার সমপরিমাণ বিদেশী মুদ্রা উদ্ধার করেছে র‌্যাব ও শুল্ক গোয়েন্দা অধিদপ্তর। এ সময় ব্যবসায়ী জাফর আহমেদকে (৪৫) আটক করা হয়। আটক জাফরকে আন্তর্জাতিক মুদ্রা পাচারকারী চক্রের সদস্য বলে জানিয়েছিল শুল্ক গোয়েন্দারা।
বৈধপথে স্বর্ণ আমদানির সুযোগ না থাকায় স্বর্ণ ব্যবসায়ীরাও স্বাচ্ছন্দ্যে ও নিরাপদে ব্যবসা করতে পারছেন না জানিয়ে চট্টগ্রাম জুয়েলারী মালিক সমিতির সাধারণ সম্পাদক স্বপন চৌধুরী বলেন, সবাই আমাদের সন্দেহের চোখে দেখে। ব্যবসায়ীদের নানাভাবে হয়রানি করা হচ্ছে। তিনি বলেন, বৈধপথে স্বর্ণ আমদানি করা হলে সরকার বিপুল রাজস্ব পাবে। আর এ ব্যবসা নিয়ে সন্দেহ ও গোজামিলেরও অবসান ঘটবে।
আমরা সরকারকে নিয়মিত ভ্যাট ও ট্যাক্স দিচ্ছি। আমাদের কাছে ব্যবসার লাইসেন্স রয়েছে। বছর বছর লাইসেন্স নবায়ন ফি হিসেবেও সরকারের কোষাগারে মোটা অঙ্কের জমা হচ্ছে। সরকার স্বর্ণ ব্যবসায়ীদেরকে আমদানির অনুমতি দিতে পারে। তা না দিলে সরকার নিজেই স্বর্ণ আমদানি করে তা ব্যবসায়ীদের কাছে বিক্রি করতে পারে। বৈধপথে স্বর্ণ আমদানি নিশ্চিত করা ছাড়া চোরাচালান আর অপরাধীদের তৎপরতা বন্ধ হবে না বলে মনে করেন তিনি।



 

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

ঘটনাপ্রবাহ: চট্টগ্রাম

৩০ জানুয়ারি, ২০২৩

আরও
আরও পড়ুন
এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ
গত​ ৭ দিনের সর্বাধিক পঠিত সংবাদ