Inqilab Logo

শুক্রবার, ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ০৬ বৈশাখ ১৪৩১, ০৯ শাওয়াল ১৪৪৫ হিজরী

বুনো ফুল

| প্রকাশের সময় : ২ জুন, ২০১৭, ১২:০০ এএম


তাহমিনা কোরাইশী : জাহিদ আজ কি খালি হাতেই বাসায় ফিরবে? বাসা থেকে বের হওয়ার সময় চুমকি ফর্দটা হাতে ধরিয়ে বলেছিল—অফিস থেকে ফেরার পথে এগুলো নিয়ে আসবে। কীভাবে যে চোখের পলকে এমন অঘটন ঘটে গেল ভেবে পায় না জাহিদ। ধানমণ্ডির মিরপুর রোডে বিশাল ডিপার্টমেন্টাল স্টোর। ফর্দ অনুযায়ী সামগ্রী কিনছিল জাহিদ। সেই সময় একজন ভদ্রমহিলা ওর গা ঘেঁষে দাঁড়িয়ে এটা ওটার দাম-দর করছিল। আগবাড়িয়ে জাহিদের সাথে ঘনিষ্ঠ হওয়ার চেষ্টা ছিল তার। জাহিদও ঐ মেজাজেরই মানুষ। তালেতাল মিলে গেল। সেও হাসি মুখে মহিলার দৃষ্টি কাড়ে। মহিলাও একইভাবে দৃষ্টি কাড়ে। ফর্দ অনুযায়ী আটা, ময়দা, চিনি, দুধ, চানাচুর, বিস্কুট, টুথপেস্ট, চাপাতা, সসেজ, মেয়োনেস, চিজ ইত্যাদি নিচ্ছিল। মহিলাও কিছু নেওয়ার ভান করছিল। আর জাহিদের ফর্দ থেকে ঐ প্রডাক্টের ওটা ভালো ঐ কোম্পানির ওটা ভালো বলে জিনিসপত্র বাছাই করে দিচ্ছিল। ওদের আলাপচারিতায় দোকানীরা ভেবেই নিয়েছে স্বামী-স্ত্রী। গা ঘেঁষে দাঁড়ানোর ভঙ্গি দেখে। গায়ের সাথে গা ঘেঁষে পুলক অনুভ‚তিতে বেশ ভালো মুডেই ছিল জাহিদ। স্ত্রী না ভাবলেও ভাবতে পারে বহুদিনের পরিচিত প্রেমিকা। মোটামুটি ভাবে সবগুলো প্যাকেট করা শেষ। জাহিদ বিল-পে করতে ক্যাশ কাউন্টারে ক্রেডিট কার্ড এগিয়ে দিয়ে দাঁড়ায়। পে-স্লিপ সাইন করে। বিলের রিসিটটা জাহিদের হাতে দিতে দিতে দোকানেরই এক কর্মচারীকে বলে, স্যারের মালপত্র গাড়িতে তুলে দিয়ে আয়।
ঐটুকু সময়ের মধ্যে মহিলা কেটে পরেছে মালসমেত। দোকানের হেলপার ছেলেটা ভেবেছে উনার স্ত্রী। মহিলাও সুযোগের সন্ধানে ছিল—বলল এই ছেলে মালপত্রগুলো ঐ কালো ট্যাক্সি ক্যাবে তুলে দাও। তড়িৎ গতিতে মহিলা ঐ গাড়িতে ওঠে। মালপত্র সমেত চলে যায়। হেলপার ছেলেটার সন্দেহ হয়। স্যার তো এখনও দোকানে মহিলা না বলে চলে গেল মালপত্র সমেত। সে নিজে থেকেই দোকানে ঢুকে স্যারকে বলল সদাইপাতি ম্যাডামের গাড়িতে তুইল্যা দিলাম। ম্যাডাম গাড়ি নিয়ে চইল্যা গেছে স্যার। জাহিদ একেবারে ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে দাঁড়িয়ে রইল। পরক্ষণে চিৎকার করে বলল—এবসার্ট। করেছ কী? এই ছেলে তুমি আমাকে বলবে না! ঐ মহিলাকে আমি চিনি না। দোকানি দেখলো মহাবিপদ। নিজেদের সেইফ করতে দোকানী বলল, স্যার আমরাও তো ভেবে ছিলাম উনি আপনার সাথেই এসেছেন। সব জিনিস উনিই পছন্দ করে দিচ্ছিলেন। আপনাদের একসাথে দেখে এ ছেলেটা ভেবেছে....বলে থেমে যায়।
জাহিদ একেবারে রেগেমেগে অস্থির হয়ে বলে—আমি কারো সাথে কথা বললেই সে আমার স্ত্রী হবে না কি? স্টুপিড, আপনারাও পারেন কথা প্যাঁচাতে। এই ছেলে তোমার কি উচিত ছিল না আমাকে জিজ্ঞাসা করা? এই তো সামনে আমার এলিয়েন গাড়িটা দাঁড়ানো।
ছেলেটা মাথা নিচু করে বলল—আমার কী দোষ স্যার? ঐ ম্যাডাম আমারে কইল ঐ কালো গাড়িটায় মালপত্র তুলে দাও। তার কথা মতো ট্যাক্সি ক্যাবে তুইল্যা দিলাম। মহিলা যে গাড়ি নিয়া চইল্যা যাইবো কে জানে? জাহিদ অগত্যা জানতে চাইল—মাঝে মাঝে কি এমন হয়? আপনাদের দোকানে? দোকানে সেলসম্যান ছেলেটা বলল—না স্যার এই প্রথম। আমাদের রিপুটেশন আছে না? আমাদের স্টোরের ছেলেগুলো পুরনো। তবুও ওদের সাবধান করে দিয়ে বলে। যে টাকা পেমেন্ট করে তার কাছে জিজ্ঞাসা না কইর‌্যা মাল তুলবি না। দেখছস কী সর্বনাশ হইল। বিনয়ের সাথে জাহিদকে জিজ্ঞাস করে স্যার যা যাওয়ার তা চইল্যা গেছে। এটা কি আর পাইবেন? নতুন কইর‌্যা কিছু দিয়ে দিবো স্যার?
মাথা নিচু করে গজগজ করতে করতে বেরিয়ে যায় স্টোর থেকে জাহিদ। নিজের চুল নিজেরই ছিঁড়তে ইচ্ছে করছে। পুরো দোষটা ওর নিজেরই। দোকানের ঐ ছেলেটাকে বকে কী লাভ? মহিলা পেলেই একবারে ফিদা হয়ে যায়। রসে ডুবে একেবারে রসগোল­া হয়ে যায়। চরিত্রের দুর্বল দিকটা দোকানীরা বুঝে গেল। ভারি লজ্জা করছে জাহিদের। তার ওপর এতোগুলো টাকার সদাইপাতি গচ্চা গেল। জাহিদ ভাবে স্ত্রী চুমকিকে এ নিয়ে কিছুই বলা যাবে না। চুমকি একেবারে মারমুখো আচরণ করবে। বলবে আজতো তোমার মালপত্র নিয়েছে কোনোদিন তোমাকে নিয়ে যায় দেখ। দারুণ বাঁচা বেঁচেছো। মেয়ে দেখলেই এতোটা নেশায় ডুবে যাও? এতোটা অসতর্ক। মহিলা কি বেশি সুন্দরী ছিল? তোমাদের মতো পুরুষদের সুন্দর অসুন্দর লাগে নাকি? মহিলা হলেই হলো, মানে মেয়েমানুষ হলেই হলো। আর আজেবাজে শব্দ ব্যবহার করবে। না-না অসম্ভব, কিছুই বলবে না বাসায়। নিজের লজ্জা নিজেকেই লুকোতে হবে। ঘরে যতটা ঝামেলা মুক্ত থাকা যায় ততই মঙ্গল। বলবে—মনে নেই জিনিসগুলো আনতে। কাল এনে দেবো। অফিসে অনেক কাজ ছিল ইত্যাদি ইত্যাদি বলে রেহাই পাবে।
নিজেকে নিজেই বিবেকের বেত দিয়ে কষে নেয়। আর নয় হেংলামোপানা। আসলে জাহিদের কপালটা খারাপ। যখনই কারও সঙ্গ চেয়েছে তখনই কোন না কোন নাজেহালে পড়তে হয়েছে। চেনা মেয়েগুলোর সাথে বাঁদরামি করা ওর ইথিক্সে পড়ে না। তাই অচেনা মুখের পেছনে ধাওয়া করে। এটা কি অন্যায়? চেনা মেয়েগুলো আগ বাড়িয়ে ভাইয়্যা নতুবা আঙ্কেল পাতিয়ে ফেলে তাদের সাথে অন্যায় কাহন-কিচ্ছা করা সম্ভব নয়। তাই হাত বাড়ায় অজানায় অচেনায়। এই তো এর কয়েক মাস আগে রোজার ঈদের সময়। শপিংমলগুলোতে ছিল লোকে লোকারণ্য। মানুষের গা ঠেলে ঠেলে শপিং করতে হয়েছে। জাহিদ তার স্ত্রীকে খুশি করার জন্য ধানমণ্ডির এক শপিংমলে ঢুকে পড়ে। শাড়ি কিনতে। তাকে না জানিয়ে দামী একটা শাড়ি উপহার দেওয়ার উদ্দেশ্যে। চুমকিকে যখনই শাড়ির কথা বলেছে তখনই ও বলেছে, কী দরকার দামী শাড়ির, ওগুলো শুধু তুলে রাখা হয়। একটু কমে দুটো শাড়ি নিলে দু’এক জায়গায় পরা যাবে ওটাই বেশি ভালো। কিন্তু জাহিদের পছন্দ বম্বের নায়িকাদের শাড়ি। সাধ আছে দীঘল শ´খচিলের ডানা সাধ্য চড়ইডানা ওতেই উড়া উচিত। মন বোঝে না। যাক সেদিন জাহিদ বড় একটা শাড়ি হাউজে মানে রঙধনু সাত রঙ ঐ স্টোরেই ঢুকে পরে। কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে বড় অসহায় বোধ করছে জাহিদ। মহিলাদের দাপটে ওর ত্রাহিত্রাহি অবস্থা। বিশ হাজার ত্রিশ চলি­শ হাজারের শাড়ি মেলে বসে আছে সেলাইম্যানরা। জাহিদের বাজেট তিন বা চার হাজার করে দুটো শাড়ি নেবার ইচ্ছা। এ মুহ‚র্তে দেবদূতের মতো পাশে এসে দাঁড়ালো এক মহিলা। মোটামুটি সুন্দর গোছের হাল্কাপাতলা গায়ের গড়ন। গা ঘেঁষে দাঁড়িয়ে জাহিদের দিকে তাকিয়ে পছন্দ হচ্ছে না? না কি ঠাঁই নেই ঠাঁই নেই আমাদের ঐ বিশাল শাড়ি তরীতে। ভাবীর জন্য শাড়ি নেবেন বুঝি? পছন্দ করে দেবো? জাহিদ একেবারে অবাক মেঘ না চাইতেই জল। দীর্ঘশ্বাস নিয়ে বলল—সত্যি ম্যাডাম আমাকে এ যাত্রায় বাঁচিয়েছেন। খুশি হবো যদি দুটো শাড়ি পছন্দ করে দেন। জাহিদও অচেনা মহিলাকে এমন সাচ্ছন্দে বলেই বসলো। জাহিদ ভেবে নিলো এই মহিলা চুমকির বান্ধবী বা পরিচিত কি না। পরিচয়ে লিস্টে কোথাও খুঁজে পেলো না। মহিলার আচরণ একেবারেই পুরুষ ঘেষা। এমন পোজে দাঁড়িয় সে একেবারে স্বামী-স্ত্রীর মতো। গা ঘেঁষে। কখন হাত ছুঁয়ে কথা বলছে। জাহিদও পুলকিত। সুখ-সুখ অনুভূতিতে নড়েচড়ে বসে। আবছে আসা জিনিস মানে সাধাল²ী পায়ে ঠেলতে নারাজ জাহিদ। আরও কাছে আসে মহিলার। মহিলা গায়ে শাড়ি চড়িয়ে একটার পর একটা করে দেখছে লুকিং গ্লাসে আর জাহিদের চোখ আয়নার। মিটিমিটি করে হাসছে ওরা চোখের ভাষায়। অনেকগুলো শাড়ি দেখা হলো। জাহিদের আর ঐ মহিলার বেশি পছন্দ হলো যে দুটো শাড়ি। তারই দাম-দর শুরু হলো—একটি ৪ হাজার অন্যটি ৬ হাজার। জাহিদ ভাবল ২০ হাজার ৩০ হাজার থেকে এই শাড়িগুলো কম সুন্দর নয়। জাহিদ খুব খুশি হলো শাড়ি দুটো নিতে পেরে। মহিলা প্যাকেটগুলো হাতে নিয়ে দাঁড়িয়ে এদিক ওদিক আরও শাড়ি দেখার চেষ্টা করছে। জাহিদ ওর ক্রেডিট কার্ড এগিয়ে দেয় ক্যাশ কাউন্টারে ক্যাশিয়ার দশ হাজার টাকা রিসিট কেটে নেয়। ক্রেডিট কার্ড আর ক্যাশমেমো এগিয়ে দেয় জাহিদের দিকে। তৃপ্তির হাসি হেসে বিদায় নেওয়ার জন্য ঘাড় ফেরায় সেই মহিলার দিকে। কৃতজ্ঞতা প্রকাশের জন্য এবং সাথে করে বসে তার সাথে এককাপ কফি খাওয়ার জন্য  প্রোপোজ করবে ভাবে মনে মনে। মতলবও আটার চেষ্টা করে মনে মনে।
কোথায় সে? কোথায় গেল সেই আগন্তুক মহিলা। জাহিদ ভাবল স্টোরের সামনে হয়তো-বা। দৌঁড়ে যায় দরজার সামনে এদিক ওদিক কোথায়ও নেই সে। এত তাড়াতাড়ি হাওয়া হয়ে গেল কিভাবে? আবার স্টোরের ভেতরে ঢোকে খোঁজে কিছুক্ষণের জন্য পাওয়া সেই মুখ। মহিলাদের ভেতরে ভেতরে তাকে খোঁজার চেষ্টা করে। অস্বিস্তিকর ব্যাপার। তাও করতে হচ্ছে। অগত্যা দোকানী এবং ক্যাশিয়ারকে জিজ্ঞেস করে, কোথায় গেল বলেন তো সেই মহিলাটি। দেখছি না কোথাও।
ক্যাশিয়ার দোকানীরা সবাই অবাক—কী বলেন স্যার? আমরা ভেবেছি আপনার সাথেই এসেছেন। আর তাঁর জন্য দুটো শাড়ি কিনেছেন। আরেক সেলসম্যান লোকটি বলল শাড়ির প্যাকেট উনি নিয়ে গেল আমার হাত থেকে। স্যার আমরা ভেবেছি আপনার স্ত্রী, জাহিদের মাথায় হাত! ওদের সাথে কথা বাড়ানো মানে আরো বোকামি। তবুও আস্তে আস্তে নিচু গলায় বলেন, আপনারা কি চেনেন ওনাকে?
—না স্যার, আমাদের চেনার প্রশ্নই ওঠে না। এমন মহিলারা তো ঈদের চাঁদে আসে। ঈদের এই মাসে যারা কোথাও বের হয়নি এমন মানুষও আসে। এরা হলো মৌসুমের অতিথি পাখি। আর যারা রেগুলার কেনাকাটা করে সে রকম কাস্টমারদের সাথে আমাদের পরিচয় থাকে। তাদের ফোন নম্বরও ঠিকানাও থাকে। স্যার আমাদের দোকানের রেপুটেশন আছে না। আমরাই বা এমন মানুষকে প্রশ্রয় দেবো কেনো?
এর মধ্যে ক্যাশিয়ার ডেকে সবাইকে সর্তক করে দেন বুঝে শুনে কাজ করতে। প্যাকেট দেওয়ার সময় সাবধান থাকতে। যার মাল তাকে বুঝিয়ে দিতে। বুঝেছ? রাগত স্বরে সেলসম্যানগুলোকে  বলে।
আমও গেল ছালাও গেল। চুমকীকে সারপ্রাইজ দেবে। নিজেই সারপ্রাইজ হয়ে খালি হাতে বাসায় ফিরতে হবে। একটু ভুলের খেসারত এমন ভাবেই দিতে হচ্ছে জাহিদকে। একটু স্পর্শ তাকে অচেতন নেশাবুঁদ করেছিল। সম্মোহিত করেছিল। সেজন্য মহিলার পালিয়ে যাওয়া টের পায়নি। এমন কথা জাহিদ স্ত্রী চুমকিকেও বলতে পারবে না। সে শুনিয়ে দেবে। ওহ্ আমি কি সুন্দরী নই। এর জন্য আমাকে নিয়ে শাড়ির দোকানে যেতে তোমার লজ্জা। অন্য মহিলাকে নিয়ে মোজ করে শাড়ি কিনতে গিয়েছিলে। নিশ্চয় তোমার কুমতলব ছিল মহিলা টের পেয়ে রাস্তা গুটিয়েছে। এই ঈদের সময় দশ হাজার টাকা খুইয়ে এসেছ। ওহ্ চালাকি না। কোন প্রেমিকাকে শাড়ি কিনে দিয়ে এসেছে আর এই আবল-তাবল গল্প ফেঁদে বসেছো না? তোমার নাড়ী-নক্ষত্র চিনি। একদিন হয়তো একটা জলজ্যান্ত বাচ্চা এনে আমার কাছে বলবে ভুল করে একটা বিয়ে করে ফেলেছিলাম। বাচ্চার মা বাচ্চাকে ফেলে পালিয়ে গেছে। এই বাচ্চাটা ধর এটাই তোমার সারপ্রাইজ। তাই না?                              .(অসমাপ্ত)



 

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

আরও পড়ুন