Inqilab Logo

শুক্রবার, ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১, ১৬ শাওয়াল ১৪৪৫ হিজরী

বাঙালির চিরায়ত কৌত‚হলের ইতিবৃত্ত

| প্রকাশের সময় : ৪ জুন, ২০১৭, ১২:০০ এএম

গো লা ম মা ও লা র নি : মহামতি সম্রাট আলেকজান্ডারের আগে তার মতো সুবিখ্যাত কোনো বিদেশি, বিজেতা এবং পর্যটক এ অঞ্চলে এসেছিলেন বলে ইতিহাসে কোনো নজির পাওয়া যায় না। তার আগে আর্যরা এসেছিলেন এবং তার পরে এসেছিলেনর বহু জাতি, গোষ্ঠী, দল এবং সম্প্রদায়। ব্যক্তিগত পর্যায়েও অনেক সুবিখ্যাত মানুষ আমাদের দেশে এসেছিলেন। কেউ এসেছিলেন শাসন করার জন্য, কেউবা ব্যবসা-বাণিজ্যের জন্য, আবার অনেক এসেছিলেন সুজলা সুফলা শষ্য-শ্যামল বাংলার অপরূপ রূপবৈশিষ্ট্য অবলোকন করার জন্য। সবেচেয়ে আশ্চর্য ঘটনা হলো- হাজার হাজার বছরের ইতিহাসে পৃথিবীর নানা অঞ্চল থেকে বহু গোষ্ঠী বঙ্গে এসেছিল কেবল চুরি, ডাকাতি, অপহরণ এবং লুটপাটের জন্য। ইতিহাস সাক্ষ্য দেয়- ওসব বাজে মানুষের আগমণের আগে আমাদের দেশের লোকজনের আচার-ব্যবহার চিন্তা-চেতনা, সততা, ন্যায়পরায়ণতা এবং বিশ্বাসযোগ্যতার মান ছিল রীতিমতো কিংবদন্তী পর্যায়ে। আজকের আলোচনায় বাঙালি জাতির সেই গৌরবময় ইতিবৃত্ত না বলে বরং সেই কথা বলব, যার কারণে আমাদের অনেক কিছু হারাতে হয়েছে। আমাদের সেই চিরায়ত অভ্যাসের নাম কৌত‚হল।
বাঙালির কৌত‚হল দেখে আলেকজান্ডার যেমন আশ্চর্য হয়েছিলেন, তেমনি ইবনে বতুতা, ফা হিয়েন, হিউ এন সাংয়ের মতো মনীষীরাও কম আশ্চর্য হননি। তবে, সবচেয়ে বেশি আশ্চর্য হয়েছিলেন ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির সেনাপতি রবার্ট ক্লাইভ। পলাশীর যুদ্ধে জয় লাভ করে তিনি যখন তার সামান্য কয়েক হাজার সৈন্যসামন্ত নিয়ে রাজধানী মুর্শিদাবাদের রাস্তা দিয়ে রাজপ্রাসাদের দিকে অগ্রসর হয়েছিলেন, তখন পথের দুপাশের অলিগলি, বাড়িঘরের ছাদে কয়েক লাখ কৌত‚হলী জনতা দাঁড়িয়ে তামাশা দেখতে আরম্ভ করল। রবার্ট ক্লাইভ তার আত্মজীবনীতে লিখেছেনÑ মুর্শিদাবাদের লাখ লাখ উৎসুক জনতার কৌত‚হল ভরা হই চই দেখে আমরা ভয় পেয়ে গিয়েছিলাম। কারণ সেদিনের জনতা যদি একটি করে ঢিল ছুড়তো তবে আমাদের সামান্য সংখ্যক সৈন্য নিশ্চিহ্ন হয়ে যেত। ইংরেজ যমানায় বাঙালির অযাচিত কৌত‚হল নিয়ে বহু রসালো কাহিনী লোকমুখে শোনা যেত। তেমনি একটি কাহিনী আজকের নিবন্ধের শেষাংশে উল্লেখ করব। এবার শিরোনাম প্রসঙ্গে কিছু বলা যাক।
বাঙালির অন্তর সবসময়ই নিরন্তর কৌত‚হলে ভরা থাকে। তারা আবিষ্কারের জন্য কিংবা কোনো কিছু জানার জন্য খুব বেশি কৌত‚হলী হয় না। তারা কোনো কিছু দেখে সহজে অবাক হয় না। উল্টো কোনো আশ্চর্য জিনিস দেখার পর এমন একটা ভাব দেখায়, যেন এমনতরো আরো বহু ঘটনা তারা অহরহ দেখেন। তারা না জেনে প্রায়ই সব জান্তা শমসেরের মতো আচরণ করে এবং না বুঝেই আগেভাগে পাÐিত্য জাহির করার জন্য মন্তব্য করে বসে। মানবজাতির ক্রম উন্নয়নের অন্যতম চাবিকাঠি হলোÑ অবাক হয়ে যাওয়া বিস্ময় প্রকাশ করা এবং প্রশ্ন জিজ্ঞাসা করা। মানুষ অবাক হয়ে হাজার হাজার বছর চাঁদের দিকে তাকিয়ে থেকেছে। চাঁদ নিয়ে হাজার গল্প-কবিতা-উপন্যাস লিখেছে এবং এক সময়ে চাঁদ জয় করে ফেলেছে। একইভাবে পৃথিবীর মানুষ বিস্ময়ে হতবাক হয়ে মাউন্ট এভারেস্ট, আল্পস পর্বতমালা চ‚ড়া অথবা উত্তর মেরু-দক্ষিণ নিয়ে চিন্তাভাবনা করতে করতে একসময় সবগুলো দুর্গম ও দুর্ভেদ্য অঞ্চল জয় করে ফেলেছে।
মানব সভ্যতার উন্নয়ন, সভ্যতার বিকাশ এবং অসভ্যতাকে দুরীভ‚ত করার জন্য মানুষের মধ্যকার সবচেয়ে উন্নততর কৌত‚হল হলোÑ প্রশ্ন করা। পৃথিবীর সব সভ্যতা, সব আবিষ্কার এবং সব সফলতার পেছনে লুকায়িত ছিল মানবমনের কতগুলো বুদ্ধিদীপ্ত প্রশ্ন। স্যার আইজ্যাক নিউটন, গ্যালিলিও, টমাস আলভা এডিসন অথবা আলবার্ট আইনস্টাইনের মনে যদি প্রশ্নগুলোর উদ্রেক না হতো, তবে বর্তমান সভ্যতার কোনো কিছুই সৃষ্টি হতো না। মুসলমানদের স্বর্ণযুগে অর্থাৎ মধ্যযুগেরও আগে জাবির ইবনে হাইয়ান, ইবনে সিনা, ফারাবি, আলকেমি প্রমুখ মহামানব যদি বিজ্ঞানের দিকে দৃষ্টি নিবন্ধ না করতেন, তবে পৃথিবী হয়তো নিউটন, এডিসন এবং আইনস্টাইনের মতো মহামানব পেত না।
বাঙালির কৌত‚হল, বাঙালির অবাক হওয়া এবং প্রশ্ন করার ধরণ ও প্রকৃতি পৃথিবীর অন্য অঞ্চলের মানুষের মতো নয়। একটি সত্য এবং বাস্তব উদাহরণ দিলে বিষয়টি অনেকের নিকট পরিস্কার হয়ে যাবে। ঘটনাটি ষাটের দশকের তাও আবার সংবাপত্র জগতের। কিংবদন্তীর বাঙালি সম্পাদক তোফাজ্জল হোসেন মানিক মিয়া বেশ কিছু দিন ধরে তার সাংবাদিকদের প্রতি মহাবিরক্ত। ইত্তেফাক তখন বাংলাদেশের সর্বাধিক পঠিত এবং সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ পত্রিকা। কিন্তু সম্পাদক সাহেব তাতে সন্তুষ্ট হতে পারছিলেন না। কারণ প্রতিদিনের পত্রিকায় অসংখ্য বানান ভুল হতো এবং তিনি যতই ভুল পরিহার করার জন্য তাগিদ দিচ্ছিলেন ততই ভুলের পরিমাণ বেড়ে যাচ্ছিল। এ অবস্থায় তিনি একদিন সব সাংবাদিকদের ডেকে একটি সাধারণ সভার আয়োজন করেন। সিনিয়র সাংবাদিকরা সম্পাদকের সামনে বসা ছিলেন এবং তরুণরা সব দাঁড়িয়ে কথাবার্তা শুনছিলেন। আলাপ-আলোচনার এক পর্যায়ে সম্পাদক বললেন, অফিসে এতবড় একটি লাইব্রেরি আছেÑ এতগুলো ডিকশনারি! তারপরও কেন ভুল হবে? তোমাদের যদি সন্দেহ হয় যে বানানটি ভুল হতে পারে, সেক্ষেত্রে প্রথমে ডিকশনারিতে খোঁজ করো, সেখানে না পেলে আমাকে জিজ্ঞাসা করো, আমি তো সব সময় অফিসেই থাকি।
সাংবাদিকরা সবাই চুপচাপ থেকে মানিক মিয়ার বক্তব্য শুনছিলেন। এ পর্যায়ে পেছনে দাঁড়ানো এক সাংবাদিক মাথা নীচু করে বলে উঠেন, স্যার ডিকশনারিতে খোঁজ করা তো অনেক পরের ব্যাপার, আমাদের প্রথম সমস্যা হলোÑ একটি শব্দের বানানটি যে ভুল, তা আমাদের মনেই হয় না, মনে হয় সব কিছু ঠিক আছে। সাংবাদিকের কথা শুনে সম্পাদক মহোদয় কি বলেছিলেন তা আমার জানা নেই। তবে এ ব্যাপারে আমার কিছু বলার আছে। অর্থাৎ আমরা এই বাঙালিরা কোনো কিছুর ভুল বা ভ্রান্তি ধরতে পারি না। তবে একটি ভালো জিনিসের খুঁত ধরার ক্ষেত্রে আমাদের জুড়ি নেই। বাংলাদেশে মশা-মাছির আক্রমণ শুরু হয়েছে সেই আদিকাল থেকে। কিন্তু আমরা প্রশ্ন করতে শিখিনি মশা কেনো কামড়ায়, মশা কামড়ালে কি হয় এবং কিরূপে মশার কামড় থেকে রক্ষা পাওয়া যায়। আমরা হাজার হাজার বছর ধরে মশা মাছির অত্যাচারে অতিষ্ঠ হয়ে দুটো বিখ্যাত প্রবাদবাক্য রচনা করেছি যথাÑ মশা মারতে কামান দাগা এবং মাছি মারা কেরানি। কিন্তু একটি মশারি আবিষ্কারের মতো সাধারণ কর্মটিও নিজেরা করতে পারিনি। মশার দ্বারা বাহিত জীবাণু এবং সেই জীবাণুর আক্রমণে প্রাণঘাতি রোগ ম্যালেরিয়া ও ডেঙ্গুর ওষুধ আবিষ্কার তো দূরের কথা, রোগগুলোর নামকরণও আমরা করতে পারিনি।
মশা মাছি নিয়ে আমাদের যথেষ্ট কৌত‚হল ছিল এবং এখনো আছে। কিন্তু এগুলো নিয়ে সুচিন্তিত কোনো প্রশ্ন আমরা করতে পারিনি। ফালে বিদেশিরা এসে বলে গেছে, কিভাবে মশার বংশবিস্তার হয়Ñ কোন জায়গায় মশার প্রজনন হয় এবং কিভাবে মশার হাত থেকে রক্ষা পাওয়া যায়। আমাদের উঁচু নাক ও বিরাট জাতাভিমানের কারণে আমরা আজও বিদেশিদের দেয়া মশা মাছি সংক্রান্ত তথ্য ও গবেষণার ব্যাপারে জানতে আগ্রহী হই না। বরং কার টাক মাথায় মাছি পড়ল এবং কবে গালে মশা বসল এসব নিয়ে কৌত‚হলোদ্দীপক কথাবার্তা বলতেই বেশি পছন্দ করি। মাছির ভন ভন শব্দ, মশার গুন গুন শব্দ এবং মশার ডানা নিয়ে আমরা গল্প কবিতা লিখি। মশার ঠ্যাংকে ব্যবহার করে আমরা প্রতিপক্ষকে ঠাট্টা-মশকরা করি এবং সময়-সুযোগ পেলে প্রতিপক্ষের শক্তিমত্তাকে মশা মাছির শক্তিমত্তার সঙ্গে তুলনা করে এক ধরনের আত্মতৃপ্তির ঢেঁকুর তুলি।
আমাদের কৌত‚হলের প্রধান লক্ষ্য এবং উদ্দেশ্যই হলো তামাশা করা এবং তামাশা দেখা। অর্থাৎ নিজে আনন্দ লাভ করার জন্য অথবা অন্যকে আনন্দ দেয়ার জন্য আমরা বেশির ভাগ ক্ষেত্রে কৌত‚হল প্রদর্শন করি। আবার অনেক ক্ষেত্রে বিনা প্রয়োজনে আমরা অযাচিতভাবে কৌত‚হলী হয়ে নিজেদের সর্বনাশ ডেকে আনি। সপ্তদশ শতাব্দীতে বাংলাদেশের উপক‚লীয় অঞ্চলে বিদেশি জলদস্যূদের ভয়াবহ তাÐব শুরু হয়ে যায়। বার্মিজ, মগ, পতুর্গিজ, ডাচ, ইংরেজ প্রভৃতি জাতের লোকেরা বড় বড় জাহাজ নিয়ে আমাদের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের বড় নদী বা সমুদ্র তীরবর্তী জনবহুল এলাকায় নোঙর করত। তারা বাহারি পণ্যের পসরা সাজাত, নাচ-গান, ক্রীড়া-কৌতুক এবং ঢং সেজে স্থানীয় কৌত‚হলী নর-নারী এবং শিশুদের সমবেত করত। তারপর সুযোগ বুঝে আশপাশের এলাকা লুট করত এবং মহিলা, শিশু এবং যুবকদের অপহরণ করে নিয়ে যেতো দাস-দাসী হিসেবে বিক্রি করার জন্য। সম্মানিত পাঠক হয়তো প্রশ্ন করতে পারেন, এ ধরনের ঘটনায় কৌত‚হল কিরূপে দায়ী হতে পারে। ঐতিহাসিকবৃন্দ লিখেছেনÑ বিদেশিদের সাদা চামড়া দেখার জন্য এবং তাদের অজানা ভাষা শোনার জন্য নেহায়েত কৌত‚হলবশে স্থানীয় লোকজন ভিড় জমাত। তারা উপযাচক হয়ে ভিনদেশিদের কাছে ঘেঁষতো এবং এটা ওটা বলতে গিয়ে ঘরের কথা পরের কাছে প্রকাশ করে দিত।
আবহমান বাংলার চিরায়ত কৌত‚হলের আরো কয়েকটি বৈশিষ্ট রয়েছে। অন্যের একান্ত ব্যক্তিগত ও গোপন বিষয় জানার জন্য বাঙালির আকাক্সক্ষা অদম্য। পাশের বাড়ির মেয়েটা, ছেলেটা, বউটা বা লোকটাÑ কি করে মোটাসোটা হলো, কি দিয়ে ভাত খেলো এবং ঘুমানোর সময় কিভাবে হাই তুলল তা নিয়ে কৌত‚হলী গবেষকের অন্ত নেই। এ দেশে একজনের সফলতা অন্যজনকে পাগল করে দেয়। একাজে তারা কৌত‚হলী হয় প্রথমত ঈর্ষার কারণে। দ্বিতীয়ত, অন্যের সফলতার কথা জেনে সেটিকে নকল করে খুব সহজে এবং অতিদ্রæত গতিতে সফলতা অর্জন করার মানসে। বাঙালির কৌত‚হলের ঈর্ষা এবং নকল করার প্রবণতার কারণে সমাজে উদ্ভাবনী শক্তির অধিকারী সফল মানুষরা প্রায়ই শারিরীক, মানসিক ও আর্থিক ক্ষতির সম্মুখীন হয়। বাজারে একটি পণ্যের গুণগত মান একটু প্রশংসা এবং গ্রহণযোগ্যতা পাওয়া মাত্র অন্যরা সেটি নকল করার জন্য ওঠেপড়ে লাগে।
এ দেশের কৌত‚হলের আরেকটি বিষয় হলোÑ মানুষ অন্তত কিছু দেখলেই তা দ্বারা আকৃষ্ট হয়ে পড়ে। কেউ যদি মাথার চুলে একটু জট পাকিয়ে উদোম শরীরে প্রকাশ্য রাস্তা দিয়ে কয়েকবার হাঁটাচলা করে, তবে অতি অল্প সময়ের মধ্যে তার অনেক ভক্ত-অনুরাগী জুটে যাবে, যারা তাকে দয়াল বাবা, কামিল বাবা ইত্যাদি বলে ভক্তি-শ্রদ্ধা, আবেদন-নিবেদন, নাচন-কুর্দন শুরু করবে। আমাদের দেশের ছাগল, ভেড়া, অবোধ শিশু, ষাঢ় গরু, বট গাছ, নিম গাছ, তেতুঁল গাছ, পরিত্যক্ত কবর, শ্বশ্মান ঘাট ইত্যাদিতে লোকজন অলৌকিকত্ব খুঁজে পায়। মানুষ তার স্বাভাব্কি কাজকর্ম, পরিশ্রম, বিদ্যা অর্জন ইত্যাদির মাধ্যমে জীবন-জীবিকা অর্জনের প্রচেষ্টা বাদ দিয়ে অলৌকিক কোনো কিছুর পেছনে ছুটে মূলত বিনা পরিশ্রমে অমূল্য কিছু পাওয়ার লোভে। যাদু-টোনা, বান, হস্তরেখা দেখে ভবিষ্যৎ বলা, সোলেমানি আংটি পরিধান, আসমানি গ্রহ-নক্ষত্রের সাহায্য লাভ অথবা গ্রহ-নক্ষত্রের রাহুগ্রাস থেকে বাঁচার জন্য নানা ফন্দি-ফিকিরের পেছনে মানুষের অদম্য কৌত‚হল এবং আগ্রহের কারণে এদেশে এসব জিনিসের ব্যবসা এবং বাণিজ্য বড়ই রমরমা এবং লাভজনক।
দুই মাথাওয়ালা সাপ। সাপের মাথার মনি, আলাদিনের চেরাগ, গ্রামের বাঁশঝাড়ের মাটির নীচের গুপ্তধন, দয়াল বাবার আর্শিবাদ, জ্বিন, পরী, দৈত্য-দানব এমনকি শয়তানের খোঁজে এ দেশের লক্ষ লক্ষ মানুষ ঘুমায় না। মুসলমান নামধারীরা কালীমন্দিরে গিয়ে দেবতার আরাধনা করে, আবার হিন্দুরা দেবালয় বাদ দিয়ে জটাধারী মুসলমানের আস্তানায় এসে গাঁজার নেশায় বুদ হয়ে অলৌকিক কিছু পাওয়ার নেশায় কাজকর্ম বাদ দিয়ে নিজের ও পরিবারের সর্বনাশ ঘটায়। এর বাইরে আরেকটি কৌত‚হলের নাম হলোÑ অপ্রয়োজনীয় কৌত‚হল। রাস্তায় চলতে গিয়ে কোনো ছোটখাটো জটলা দেখলে দাঁড়িয়ে যাওয়া এবং খোঁজ খবর নেয়াÑ ব্যাপারখানা কি? অথবা পথ চলতে গিয়ে হঠাৎ দেখা গেল তিন-চারজন লোক ঊর্ধ্বশ্বাসে দৌঁড়াচ্ছে। এ দৃশ্য দেখার পর কৌত‚হলী লোকজন কোনো প্রশ্ন না করেই দৌড়রত লোকজনের পদাঙ্ক অনুসরণ করবে এবং দৌড়ের মিছিলকে দীর্ঘ থেকে দীর্ঘতর করে তুলবে। এই পর্যায়ে কৌত‚হলের আরো একটি বৈশিষ্ট বলে ব্রিটিশ যমানার গল্পটির অবতারণা করে আজকের নিবন্ধ শেষ করব।
কিশোরগঞ্জের ছেলে নগেন্দ্র নাথ বহু কষ্টে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের দর্শন শাস্ত্রে ভর্তি হয়ে প্রথম প্রথম কয়েকটি ক্লাস করল। শিক্ষক মহোদয় বললেন, প্রকৃতির প্রতিটি আচরণের মধ্যে যুক্তি এবং যথাযথ কারণ রয়েছে। সেই হতে পারবে উত্তম দার্শনিক, যে কিনা আশপাশের মানুষ, জন্তু-জানোয়ার, গাছপালা এমনকি যানবাহনের ছুটে চলার গতির মধ্যে যুক্তি এবং কারণ খুঁজে বের করতে পারবে। নগেন্দ্র নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্লাস শেষে হেঁটে পার্ক স্ট্রিট হয়ে তার মেসের দিকে ফিরছিল, আর অত্যন্ত সতর্ক দৃষ্টি মেলে আশপাশের সবকিছু দেখছিল দার্শনিকের দৃষ্টি নিয়ে। হঠাৎ লক্ষ্য করল, রাস্তার পাশের ফুটপাতের এক কোনে মধ্যবয়সী এক ভবঘুরে অঘোরে ঘুমোচ্ছে। লোকটির দু’পাশের দু’টি নেড়ি কুকুর এমনভাবে ঘুমোচ্ছে যেন তারা সবাই হরিহর আত্মা। লোকটি ডানদিকে কাত হয়ে একটি কুকুরকে অনেকটা কোলবালিশের মতো জড়িয়ে ধরে আছে। অন্য দিকের কুকুরটি লোকটির পিঠ ঘেঁষে এমনভাবে অঘুরে ঘুমোচ্ছে যা চোখে না দেখলে বিশ্বাস করা অসম্ভব।
নগেন্দ্র নাথ হঠাৎ দাঁড়িয়ে পড়ল। রাস্তা দিয়ে তুমুল বেগে নানা ধরনের গাড়ি ছুটে চলছিল। পাবলিক বাস, ট্রাক, ট্রাম এবং ব্যক্তিগত গাড়ি। কোনো গাড়িই ভেঁপু বাজাচ্ছিল না, কেবল ব্যক্তিগত গাড়ি ছাড়া। কলকাতার রাস্তায় তখন ব্যক্তিগত গাড়ির সংখ্যা একেবারেই হাতেগোনা। যারা এসব গাড়ির মালিক ছিলেন, তারা নিজেদের অতীব সফল এবং সৌভাগ্যবান ভাবতেন। আর তাই রাস্তায় চলতে গিয়ে ঘনঘন ভেঁপু বাজিয়ে নিজেদের সফলতা এবং সৌভাগ্যের জানান দিতেন। নগেন্দ্র নাথ লক্ষ্য করল, নানা ধরনের গাড়ির অনবরত আওয়াজ এবং ভেঁপুর শব্দের মধ্যেও ভবঘুরে লোকটি এবং কুকুর দু’টি অঘোরে ঘুমোচ্ছে। হঠাৎ রাস্তা দিয়ে একটি পুলিশের গাড়ি চলতে গেলে নিঃশব্দ চলে গেল, আর ঠিক সেই সময়টিতে একটি কুকুর ঘুমন্তÍ চোখে চোখ বন্ধ অবস্থায় দুই-তিনবার হালকা ঘেউ ঘেউ শব্দে ডেকে উঠল এবং তারপর আগের মতো ঘুমোতে লাগল। কুকুরটির কাÐ দেখে নগেন্দ্র নাথ ভারী আশ্চয় হয়ে গেল। তার দর্শনের চিন্তা তাকে ভীষণভাবে কৌত‚হলী করে তুলল। সে নিজেকে প্রশ্ন করল, আচ্ছা ভবঘুরে লোকটি এবং কুকুর দু’টির মধ্যে কি সম্পর্কÑ গাড়ির শব্দে তারা কিভাবে নির্বিকারভাবে ঘুমোচ্ছে? ঘুমন্ত কুকুরটি কি করে পুলিশের গাড়ির ছুটে যাওয়ার দৃশ্য দেখল, আর সেটি কেনইবা ঘেউ ঘেউ করে উঠল? অন্য কুকুরটি কেনো ওমনভাবে ঘেউ ঘেই করল না।
নগেন্দ্র নাথ মেসে ফিরে তার অভিজ্ঞতার কথা সবাইকে বলল এবং প্রশ্নগুলোর জবাব জানার চেষ্টা করল। তার কথা শুনে সবাই হাসল এবং রীতিমতো ঠাট্টা-মশকরা শুরু করল। তার এক সহপাঠী বেশ গম্ভীর কণ্ঠে তাকে পরামর্শ দিলো নিকটস্থ থানায় গিয়ে পুলিশের সঙ্গে বিষয়টি নিয়ে আলাপ করার জন্য। পূর্ববঙ্গের কিশোরগঞ্জের পোলা নগেন্দ্র নাথ ভাড়–জ্যে তার বন্ধুর পরামর্শ শুনে কালবিলম্ব না করে নিকটস্থ থানায় চলে গেল। থানার বড়বাবু বাইরে ছিলেন। একজন হাবিলদার ডিউটি অফিসার হিসেবে আগত লোকজনের কথাবার্তা শুনছিলেন। তিনি নগেন্দ্র নাথ পরিচয় এবং প্রশ্ন শুনে ভারী আশ্চর্য হলেন এবং ভাবলেন, লোকাটি নিশ্চয়ই বড় কিছু হবে। হাবিলদার বললেন, নগেন্দ্র বাবু আমি আপনার প্রশ্নের উত্তর জানি না, তবে বড়বাবু নিশ্চয়ই জানেন, উনি এক্ষুণি এসে যাবেন! এতটু অপেক্ষা করুন। বড়বাবু থানায় ঢোকামাত্র হাবিলদার পরম উৎসাহে নগেন্দ্রকে নিয়ে তার কামরায় ঢুকলেন এবং নিজেই নগেন্দ্রর হয়ে বড়বাবুকে সব কিছু খুলে বললেন। বড়বাবু মুচকি হাসলেন এবং বললেন, শালাকে লকআপে ঢুকিয়ে ২৪ ঘণ্টা আটকে রাখো। তারপর সকালে ও নিজেই বুঝবে পুলিশের গাড়ি কুত্তায় কেন এবং কিভাবে ঘুমন্ত অবস্থায় চিনেছিল।



 

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

আরও পড়ুন