Inqilab Logo

শুক্রবার, ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ০৬ বৈশাখ ১৪৩১, ০৯ শাওয়াল ১৪৪৫ হিজরী

মাও মান্নান হুজুর ও এক গ্রাম সাংবাদিকের বেড়ে উঠার গল্প

| প্রকাশের সময় : ৪ জুন, ২০১৭, ১২:০০ এএম

ম হ সি ন আ লী রা জু : আমার পরিবারের কোন শাখা-প্রশাখার কোনও অংশেই সাংবাদিকতার সংশ্লেস নেই, খুব সঙ্গত কারণেই তাই শৈশবে আমার মনোজগতের পেশাগত চিন্তার কোথাও সাংবাদিকতা করার কোন স্বপ্ন বা আশা-আকাক্সক্ষার লেশমাত্র ছিল না। কখনও ভাবিনি সাংবাদিকতা হবে আমার ধ্যান-জ্ঞান কিংবা তার চেয়েও বেশি কিছু!
সম্ভবত মানুষ কখনও কখনও যা চায় তাই পায়। আবার কখনও কখনও যা চায় না তাই পায়। পেশা জীবনে আমার প্রাপ্তিটা দ্বিতীয় রকমের। আমি একজন গ্রাম সাংবাদিক সার্টিফিকেট নেম মোঃ মহসিন আলী। আর মরহুম মাওঃ আলহাজ্ব এম এ মান্নানের প্রতিষ্ঠিত সারা পৃথিবীর বাংলা ভাষাভাষি সংবাদপত্র ইনকিলাব পাঠকদের (অনলাইন বা প্রিন্ট ভার্সণ যারা পড়েন) কাছে আমি আজ পরিচিত একজন ‘মহসিন রাজু’ হিসেবে। যা আমার কাছে খুব সম্মানের-তৃপ্তির-স্বতঃস্ফূর্ত আনন্দের বা তার চেয়েও বেশি কিছু। খুব নাটকীয় কিছু না ঘটলে ইনকিলাব যতদিন থাকবে আমি বেঁচে থাকাকালীন সক্রিয় বা নিষ্ক্রিয় যে আঙ্গীকেই হোক না কেন ‘বগুড়া থেকে মহসিন রাজু বা মহসিন রাজু বগুড়া থেকে’ পরিচয়ে লিখেই যাব ইনশাল্লাহ।
কেন আমি ইনকিলাবে আছি, কেন অন্য কোথাও যাই না, নাকি যাওয়ার চান্স পাই না? অথবা কবে কখন কিভাবে ইনকিলাবে যুক্ত হলাম? এই প্রশ্ন প্রফেশনাল সেক্টরের ছোট বড় অনেকেই করেন। উত্তর খুঁজে বলতে গিয়ে আমি ও ভাবি আসলেই তো কেন আমি ইনকিলাবে আছি কিসের মোহে?
ভাবতে গেলে মনে পড়ে যায় সেই একজন মহৎ মানুষের কথা, যিনি দুটি সরকারের মন্ত্রী-প্রতিমন্ত্রী ছিলেন। যিনি ৮০ র’ দশকে মাঝামাঝি বিখ্যাত বাংলাদেশী সংবাদপত্র ইত্তেফাকের পাশাপশি লাখ লাখ পাঠকের কাছে ইনকিলাবকে তুলে ধরেছিলেন। ইনকিলাব এখন বাংলাদেশে ও বাংলাদেশের বাইরে একটি ‘স্বীকৃত প্রভাবশালী সংবাদপত্র’। প্রকাশ লগ্ন থেকেই অন্য সবার মত মত আমিও ছিলাম ইনকিলাবের পাঠক। সেই সূত্রে জানতাম ইনকিলাব প্রতিষ্ঠাতা মাওঃ এম এ মান্নান হুজুরের নাম। কত পজেটিভ-নেগেটিভ কথা শুনতাম তাঁর সম্পর্কে।
ইনকিলাব প্রতিষ্ঠার বাইরে তাঁর আর একটি পরিচয় হল তিনি ছিলেন, ব্রিটিশ শাসনামলেই বাংলা আসাম অঞ্চলের উচ্চ পর্যায়ের আধ্যাত্মিক আলেমদের দ্বারা গঠিত মাদ্রাসা শিক্ষকদের সংগঠন জমিয়াতুল মোদার্রেছীন এর সভাপতি। এই সংগঠনের একটি সভায় যোগ দিতে (সম্ভবত ১৯৮৮) সালে তিনি বগুড়ার করনেশেন হাইস্কুল ময়দানে আসেন। আমি তখন বগুড়ার সরকারি আযিযুল হক কলেজের অনার্স পড়–য়া ছাত্র কাম স্থানীয় দৈনিক বাংলাদেশ পত্রিকার নির্বাহী সম্পাদক। সঙ্গত কারণেই মান্নান হুজুরের সমাবেশে রিপোর্টার-কাম ফটোগ্রাফার যাওয়াটাই স্বাভাবিক হলেও কেন জানি আমি নিজেই সেখানে গেলাম। সভাস্থলে হুজুরের আগমনের আগে একটি মহলকে নানান অজুহাতে সভা-সমাবেশটি ভÐুল করে দেবার অপচেষ্টা করতে দেখলাম। এক পর্যায়ে তো আমার মনেই হল হয়তো হুজুর সমাবেশ স্থলে আসতেই পারবেন না। সমাবেশও হবে না। এই রকম পরিস্থিতির মধ্যেই হুজুর বগুড়ার ঠনঠনিয়া দরবার শরীফের পীরজাদা মরহুম ওসমান গণী ছাহেবের সাথে সভাস্থলে এলেন। ঘোষকের সাদ আহŸানে মঞ্চে বসলেন। যারা সভা হতে দেবেন না বলে যুদ্ধংদেহী ভাব দেখাচ্ছিলেন কেন যেন তারা মিইয়ে গেলেন। ¤্রয়িমান মুখে তখনও কেউ কেউ বলছিলেন আমরা প্রশ্ন করবো দেখি কেমন করে উনি উত্তর দেন?
কিন্তু মাওঃ মান্নান বক্তব্য শুরু করতেই সভাস্থলে পিন পতন নিরবতা নেমে এল। বক্তব্যেই তাঁর এমন মেসেজ ছিল যারা প্রশ্ন করার নামে হুজুরকে বিব্রত করতে চাচ্ছিলেন তারা তাঁর বক্তব্যেই উত্তর পেয়ে গেলেন, আর উত্তরের মর্ম অনুধাবণ করে নিজেরাই বিব্রত-লজ্জিত হলেন।
সভা শেষে ওই সমাবেশ স্থলে উপস্থিত সুবেশি-মার্জিত আচরণের ফটো সাংবাদিক মাহমুদ আওরঙ্গজেব ও আমাকে কাছে ডেকে ¯েœহ ভরে কিন্তু তীক্ষè দৃষ্টিতে আপাদ মস্তকে দেখলেন। নাম পরিচয় জিজ্ঞেস করে বললেন তোমাদের ইনকিলাবে নেব বুঝলা, আমা সাথে যোগাযোগ রেখ। দু’জনই হ্যাঁ সুলভ মাথা নেড়ে উনার কাছ থেকে সরে আসলাম।
এর এক বছরের মাথায় ৮৯ সালে রাগের বশে চাকরি ছাড়লাম দৈনিক বাংলাদেশের। তখনই মনে পড়লো মান্নান হুজুরের কথা। কেন যেন মনে হল আচ্ছা ইনকিলাবে যোগ দিলে কেমন হয়? খোঁজ নিয়ে জানলাম বগুড়ায় তখনও কাউকে এপয়েন্ট করা হয়নি। তাই নিউজ প্রিন্টের এক টুকরো কাগজে সম্পাদক মহোদয় বরাবরে সংবাদ পাঠাবার অনুমতি চেয়ে চিরকুট লিখে পোষ্ট করে দিলাম চিঠি। ইমেইল-ইন্টারনেট-সিসি-কাট-কপি-পেষ্ট কালচার তখনও শুরু হয়নি সাংবাদিকতায়। সংবাদ পাঠাবার জন্য জরুরি হলে টেলিফোন বা টেলিগ্রামই তখন ভরসা গ্রাম সাংবাদিকের। সাধারণত হাতে লিখে পোষ্ট করেতে হত সংবাদ। কেউ কেউ অবশ্য ১০ টাকা খরচে কুরিয়ার করতো। ৯১ সালে ফ্যাক্স প্রযুক্তি শুরু হলে মফস্বল সাংবাদিকতায় পরিবর্তন আসলো। বাড়লো প্রতিযোগিতা পাশাপাশি শুরু হল সিন্ডিকেটিং রিপোর্ট। গুরুত্ব সহকারে আমার রিপোর্ট ছাপা হতে শুরু করলে জানতে পারলাম বগুড়া থেকে তখন ৮ জন নিয়মিত সংবাদ পাঠায় ইনকিলাবে। একবার ঢাকা অফিসে গেলাম। দেখা করলাম প্রবীণ মফস্বল সম্পাদক হাবিবুর রহমানের সাথে, তার সাথে কথা বলে হতাশই হলাম, মনে হল ইনকিলাবে আমার হবে না। পরে একদিন বগুড়া প্রেসক্লাবের তৎকালীন পিয়ন মরহুম বশির চাচা বললেন, দেখেন তো চাচা মিয়া চিঠিটা কার (তিনি পড়তে জানতেন না)। চিঠি হাতে নিয়ে দেখি ইনকিলাবের খাম উপরে আমার নাম লেখা। খুলে পড়ে দেখি জেলা সংবাদদাতা পদে আমার নিয়োগপত্র!
তখন আমার নিজস্ব টেলিফোন সংযোগ না থাকায় বগুড়া প্রেসক্লাব ও স্থানীয়ভাবে আমার তৃতীয় কর্মস্থল দৈনিক চাঁদনী বাজার পত্রিকার টেলিফোন নম্বর দিয়ে রেখেছিলাম ইনকিলাব অফিসে। ফোনেই মাঝে মাঝে খোঁজ নিতেন হুজুর, দিতেন সাংবাদিকতার বিষয়ে ডাইনামিক সব দিকনির্দেশনা। বলতেন ‘তুমি ভাল কাজ কর কিন্তু হেড অফিসের সাথে যোগাযোগ ঠিকমত রাখো না।’ একদিন তিনি আমাকে বললেন তুমি কি জান বিমানের পাইলট কিভাবে গ্রাউন্ড কন্ট্রোলের মাধ্যমে বিমান পরিচালনা করে? বললাম না। তিনি সুন্দরভাবে বুঝিয়ে দিয়ে বললেন, তুমি যতই ভাল পাইলট হওনা কেন বিমান চালাতে পারবা না, যদি কন্ট্রোল রুমের (হেড অফিস) সাথে ভাল যোগাযোগ না থাকে।’
৯২-৯৩ এ তিনি আর একবার আসলেন বগুড়ায়। এবার ঠনঠনিয়া দরবার শরীফেই জমিয়াতুল মোদার্রেছীনের সভা করলেন। ততদিনে মাদ্রাসা শিক্ষকদের মান-মর্যাদা অনেক বেড়েছে, বেড়েছে বেতন। সমাবেশে এক পর্যায়ে বললেন, ‘আমি চাই এই দেশে একদিন মাদ্রাসার হুজুররা এত বেশি টাকা বেতন পাবে যে তারা যখন বাজার করবে তখন সেই বাজারের ব্যাগ বহন করতে হবে আরেকজনকে।’
তিনি অসুস্থ অবস্থাতেই শেষবার ২০০৩ সালে বগুড়ায় এসেছিলেন। সেবার বগুড়ার শহীদ টিটু মিলনায়তনে অনুষ্ঠিত হল জমিয়াতুল মোদার্রেছীনের বিশাল সমাবেশ। একদিন আগেই হুজুর এলেন অবস্থান করলেন বগুড়া সার্কিট হাউজের ভিআইপি। এই সফরের সময় তার সফর সঙ্গী ছিলেন ইরাকের সেই সময়কালীন চার্জ দ্য অ্যাফেয়ার্স (রাষ্ট্রদূত) এম, হাতাব সুলতান। দীর্ঘ সময় ধরে আলাপ হল আমাদের মধ্যে। ইরাক ও সমকালীন বিশ্ব রাজনীতি নিয়ে সেদিন সেখানে ইরাকী দূতের সাথে যেভাবে আরবীতে কথা বললেন হুজুর মনে হল তিনি যেন জন্মগতভাবেই আরবী ভাষাভাষি মানুষ! পরে জেনেছি আরবীর মতই ইংরেজী-ফারসী ও উর্দু ভাষার উপর হুজুরের দখল ছিল সমান। বগুড়ার ওই সমাবেশে তিনি আশঙ্কা প্রকাশ করেছিলেন এটাই তার শেষ সফর হতে পারে! আসলে বাস্তবে হয়েছেও তাই। ওই সমাবেশে উপস্থিত মাদ্রাসা প্রধানরা আজও বলেন, সেদিন মরহুম মগফুর হুজুর (রহঃ) মাদ্রাসা শিক্ষা, আরবী শিক্ষার প্রসার নিয়ে এবং মাদ্রাসার প্রধান ও শিক্ষকদের নিয়ে যে স্বপ্ন দেখিয়েছিলেন, তখন তারা ভাবতেই পারেননি সেই স্বপ্নের বাস্তবায়ন তারা নিজের চোখে দেখে যেতে পারবেন। কিন্তু এখন তারা স্বীকার করেন, হুজুরের দেখানো স্বপ্নগুলো আসলে অবাস্তব ছিল না।
আমার কাজের উপর কখনও কখনও অসন্তুষ্টও হতেন তিনি। কেন জানি তিনি বুঝেছিলেন, আর্থিক ব্যাপারে আমি উদাসীন। চাকরি সংক্রান্ত ব্যাপারে অনেকবারই গুরুতর সমস্যা হলে তিনি কেন জানি সরাসরি আমার পক্ষে স্ট্যান্ড নিতেন। আজ সেই দুঃসহ মুহূর্তগুলোর কথা মনে হলে আমার মনে হয়, তিনি মানব চরিত্রের অনেক গুঢ় রহস্য বুঝতেন। না হলে সত্যিই আমি ইনকিলাবে টিকে থাকতে পারতাম না।
বিশাল হৃদয়ের উদার এই মানুষটির প্রাণ উজাড় করা আপ্যায়ন ও আতিথেয়তার ব্যক্তিগত বিবরণ দেয়া নিষ্প্রোয়জন বলে মনে করি। ইনকিলাবের সব ব্যুরো ও আঞ্চলিক প্রধান এবং জেলা সংবাদদাতাদের বিষয়ে সম্যক অবগত ছিলেন তিনি। আমার বিশ্বাস আমাদের মফস্বলের সবারই সম্পর্কে তাঁর গভীর রিডিং ছিল নির্ভুল। তিনি চাইতেন মফস্বলে কর্মরত ইনকিলাবের সব রিপোর্টারই যেন পরিবার নিয়ে দুধে ভাতে থাকুক (স্বীকার্য যে ইনকিলাব সম্পাদক আলহাজ্ব এ এম এম বাহাউদ্দীনের মনোভাবই ঠিক একই রকম বলে আমার স্থির বিশ্বাস)। মরহুম হুজুর ও তাঁর সু-সন্তান ইনকিলাব-এর সুযোগ্য সম্পাদকের স্নেহ ও প্রশ্রয়েই আজ আমি মহসিন আলী কিংবা মহসিন আলী রাজু থেকে ‘মহসিন রাজুতে’ পরিণত হয়েছি। ইনকিলাবের অন্য সবার ক্ষেত্রেও একই কথা প্রযোজ্য বটে।
লেখক : আঞ্চলিক প্রধান দৈনিক ইনকিলাব, বগুড়া অফিস



 

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

আরও পড়ুন