Inqilab Logo

মঙ্গলবার, ২৩ এপ্রিল ২০২৪, ১০ বৈশাখ ১৪৩১, ১৩ শাওয়াল ১৪৪৫ হিজরী

ইসলামে সংলাপ ও এর প্রয়োজনীয়তা

প্রকাশের সময় : ৮ মার্চ, ২০১৬, ১২:০০ এএম

মো. মাছউদুর রহমান

॥ শেষ কিস্তি ॥
৯ম মূলনীতি : কোনো প্রচ্ছন্ন বা অস্পষ্ট বিষয়ে না বুঝে সংলাপে লিপ্ত না হওয়া। অনেককে দেখা যায়, কোনো বিষয় সম্পর্কে স্পষ্ট জ্ঞান না রেখেই শুধু নিছক ধারণার উপর ভিত্তি করে সে বিষয়ে অন্যের সাথে সংলাপে লিপ্ত হয়ে পড়ে। শুধুমাত্র নিজের ইলম ও বাক-চতুরতা প্রদর্শন করার জন্য সংলাপ করাকেই নিজের শখে পরিণত করে থাকে। প্রকৃত বিষয়টি এমন নয়, বরং সত্যিকার জ্ঞানী সে, যে কোন বিষয়ে তথ্যানুসন্ধান ছাড়া বক্তব্য দেয় না এবং সংলাপেও লিপ্ত হয় না। অন্যের সাথে বিতর্কে লিপ্ত হওয়ার আগে জানা দরকার এ বিষয়ে যথাযথ জ্ঞান ও প্রকৃত বিশ্লেষণ নিজের কাছে সুস্পষ্ট কিনা। অন্যথায় সংলাপে লিপ্ত না হওয়াই হচ্ছে সংলাপের দাবি।
সংলাপ ও বিতর্কের শিষ্টাচার
সংলাপ ও বিতর্কের অনেকগুলো শিষ্টাচার রয়েছে। সংলাপকে ফলপ্রসূ করার জন্য এসব শিষ্টাচার মেনে চলা দরকার। তাই সংলাপে লিপ্ত হওয়ার আগে সংলাপে ইচ্ছুক ব্যক্তি, গোষ্ঠীকে এর শিষ্টাচার ও সৌজন্যতা সম্পর্কে জেনে নিতে হবে। তাই আমরা কিছু শিষ্টচার তুলে ধরলামÑউত্তমভাবে কথা বলা, কথা বলার ক্ষেত্রে চ্যালেঞ্জ ছুঁড়ে না দেয়া; ঔদ্ধত্যপূর্ণ আচরণ না করা। আল্লাহ বলেন- “তাদের সাথে বিতর্ক কর সর্বোত্তম পন্থায়।” (সূরা নাহল : ১৬ : ১২৫)
কথা বলার ক্ষেত্রে সময় ও পরিবেশের সীমাবদ্ধতা বিবেচনা করা। বল্গাহীন কথা বলার মধ্যে সংলাপের যোগ্যতা নিহিত আছে এ কথা ঠিক নয়, বরং কম কথা বলার মাধ্যমেও উত্তমভাবে সংলাপ করা যেতে পারে। এ ক্ষেত্রে সময় ও পরিবেশের কথা চিন্তা না করেই কথা বললে অন্যদের উপর যুলুম বা সীমালঙ্ঘন করা হয়, যা সংলাপের প্রকৃত চিন্তাধারার পরিপন্থী।
বিপক্ষ বা ভিন্নমত পোষণকারীকে সম্মান ও মর্যাদা দেয়া, তাকে কোনোভাবে তুচ্ছজ্ঞান না করা।
বক্তব্য উত্তমভাবে শ্রবণ করা এবং অন্যের বক্তব্যের সময় নীরবতা রক্ষা করা। সীমাবদ্ধ ও নির্দিষ্ট পরিসরে সংলাপ করা। ব্যাপক জনসমাবেশ ও বহু জনসমষ্টি নিয়ে সংলাপ করা যায় না। যোগ্যতা ও বিবেচনার দিক থেকে সমপর্যায়ের লোকদের নিয়ে সংলাপ করা।
সংলাপের মাধ্যমে কল্যাণ, সংস্কার ও সংশোধনকে টার্গেট করা। ব্যক্তি প্রতিষ্ঠা, আত্মপ্রচার অথবা কারো বক্তব্য প্রতিষ্ঠা করা সংলাপের মূল লক্ষ্য হিসেবে নির্ধারণ না করা। অপ্রয়োজনীয় ও শিষ্টাচার বহির্ভূত সংলাপে লিপ্ত না হওয়া। বাড়াবাড়ি, ঝগড়া-বিবাদ ও কথা কাটাকাটিতে লিপ্ত না হওয়া। এ মর্মে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এরশাদ করেন-“আমি ঐ ব্যক্তির জন্য জান্নাতের মাঝে একটি ঘরের জামিন হব, যে বাক-বিত-া পরিহার করে অথচ সে সত্যাশ্রয়ী বা হকের উপর প্রতিষ্ঠিত। আর তার জন্য জান্নাতের মধ্যখানে একটি জামিন হব, যে মিথ্যাচার পরিহার করে, এমনকি ঠাট্টা-বিদ্রƒপ করা অবস্থায়ও। আর তার জন্যও জান্নাতের সর্বোচ্চ স্থানে একটি ঘরের জামিন হব, যে তার চরিত্রকে উত্তম ও সৌন্দর্যম-িত করে।” (বাইহাকী, সুনানে কুবরা : ২১৭০৮)
কথা বলা ও বক্তব্য তুলে ধরার ক্ষেত্রে বিনয়ী হওয়া; উদারতা প্রদর্শন করা, ইনসাফভিত্তিক কথা বলা এবং উত্তম চরিত্র প্রদর্শন করা। বিনয় মানুষের মর্যাদা বৃদ্ধির সোপান। কোমলতা সকল ক্ষেত্রেই সৌন্দর্য বৃদ্ধি করে। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এরশাদ করেন- “যে আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য বিনয়ী হয়, আল্লাহ তার মর্যাদা সুউচ্চ করে দেন।”
অন্য একটি হাদীসে বলেন- “হে আয়িশা! তুমি কোমলতাকে নিজের উপর বাধ্যতামূলক করে নাও। কেননা, কোমলতা কোনো বিষয়ের মধ্যে প্রবেশ করেছে, সে বিষয়কে সৌন্দর্যম-িত করেছে। আর যে বিষয় থেকে কোমলতা তুলে নেয়া হয়েছে, তা সে বিষয়কে অসুন্দর করে দিয়েছে।” (আদাবুল মুফরাদ : ৪৬৯)
অশ্লীল কথা-বার্তা, গালি-গালাজ ও রাগারাগি না করা। আমরা জানি ফের‘আউনের মতো অভিশপ্ত ব্যক্তির কাছে মহান আল্লাহ তা‘আলা যখন দু’জন নবীকে প্রেরণ করলেন তাদেরকে এভাবে নির্দেশ দিলেন- “আর তোমরা উভয়ে তাকে বিনম্র কথা বলবে, যাতে সে উপদেশ গ্রহণ করে অথবা ভয় পায়।” (সূরা ত্বহা : ২০ : ৪৪)। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের অবস্থান বর্ণনা করতে গিয়ে আনাস ইবনে মালিক রাদিয়াল্লাহু আনহু বলেন- “রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম গালি-গালাজ করতেন না। অশ্লীল কথা বলতেন না। অভিশাপ দিতেন না। তিনি আমাদের কাউকে ভর্ৎসনা করতে গিয়ে শুধু এভাবে বলতেন, তার কি হলো? তার পার্শ¦দেশ ধূলি-ধূসরিত হোক।” (বুখারী : ৬০৩১, মুসনাদে আহমাদ : ৩/১২৬, আল আদাব লিল বাইহাকী : ৩৩৪)
বিপক্ষ বা ভিন্নপক্ষের বক্তব্যের জন্য তাড়াহুড়ো না করে তাদের উপলব্ধি ও বুঝার জন্য প্রয়োজনীয় সময় প্রদান করা। কেননা তাড়াহুড়ো চিন্তার দিগন্তকে সঙ্কীর্ণ করে দেয়। মানুষ সত্য ও সঠিক সিদ্ধান্তে পৌঁছতে অপারগ হয়ে যায়।
সংলাপের ক্ষেত্রে মুখলিস বা নিষ্ঠাবান হওয়া। নিছক কোন স্বার্থ, গোপন কোন এজেন্ডা বা দলীয় সঙ্কীর্ণতার জন্য সংলাপ না করে সত্যনিষ্ঠা ও দ্বীনের খাতিরে সংলাপে উপনীত হওয়া।
মূলত ইখলাস এমন একটি বিষয়, যা একজন মানুষকে সকল ক্ষেত্রে সত্য ও সঠিক পথের দিকে পরিচালিত করে থাকে। সংলাপকারীর ইখলাসের উপর নির্ভর করে সংলাপের প্রকৃত ফলাফল। তাইতো আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন- “আল্লাহ তোমাদের দেহ আকার-আকৃতি লৌকিক সৌন্দর্যের দিকে তাকান না, তিনি তোমাদের অন্তরের দিকে দেখেন।” (মুসলিম : ২৫৬৪)
বর্তমান সময়ে আমাদের দেশের উদ্ভূত রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, কূটনৈতিক ও জাতীয় নিরাপত্তা বিষয়ক সমস্যা সমাধান, ইসলামী সভ্যতার পুনর্জীবিতকরণ, সমসাময়িক পুনর্জাগরণের উত্থান এবং গবেষণামূলক দৃষ্টিভঙ্গিকে গুরুত্ব প্রদান করে পরস্পরের সাথে এ সংলাপ বেশি জরুরি।
এ মহান লক্ষ্য বাস্তবায়নে, বিশ্ববিদ্যালয়, গবেষণা প্রতিষ্ঠান, থিংকট্যাঙ্ক প্রতিষ্ঠান, শিক্ষামূলক সংগঠনসমূহ এবং গবেষণার কাজে নিয়োজিত বোর্ডগুলোর উচিত খুব দ্রুত উদ্যোগ গ্রহণ করা। উভয় পক্ষের প্রতিনিধিদেরকে একত্রিত করা। নির্ধারিত বিষয়ে আলোচনা-পর্যালোচনার ব্যবস্থা করা। যা কোনো প্রকার উস্কানি বা পক্ষপাতিত্ব ছাড়াই সম্পূর্ণ গঠনমূলক সৃজনশীল, সৌহার্দ্যপূর্ণ পরিবেশে অনুষ্ঠিত হবে। এভাবেই এক পক্ষের প্রতি অন্য পক্ষে ভালোবাসা এবং শ্রদ্ধাবোধ জন্ম নেবে। অন্তত ঘৃণাবোধ কমবে বা উপশম হবে।
লেখক : লেকচারার, এশিয়ান
ইউনিভার্সিটি অব বাংলাদেশ
শিক্ষক, জামিয়া সাঈদিয়া কারীমিয়া।



 

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

ঘটনাপ্রবাহ: ইসলামে সংলাপ ও এর প্রয়োজনীয়তা
আরও পড়ুন
গত​ ৭ দিনের সর্বাধিক পঠিত সংবাদ