Inqilab Logo

শনিবার, ২০ এপ্রিল ২০২৪, ০৭ বৈশাখ ১৪৩১, ১০ শাওয়াল ১৪৪৫ হিজরী

অহিদুজ্জামান ডায়মন্ড-এর কলাম কার চলচ্চিত্র কে রক্ষা করবে?

| প্রকাশের সময় : ১৬ জুন, ২০১৭, ১২:০০ এএম

সত্তর, আশি বা নব্বই দশকে অথবা তার আগের চলচ্চিত্র সংশিষ্ট ব্যক্তিরা কোন দিন ভাবেননি, স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশে এমন একটা সময় আসবে যখন নিজ দেশের চলচ্চিত্র কিছু স্বদেশী অর্থ লোভী মানুষের কারণে ভারতের চলচ্চিত্রের কাছে কোণঠাসা হয়ে পড়বে। আজকে আমাদের প্রায় সাড়ে তিন›শ পরিচালক, ডজন ডজন প্রযোজক, শত শত অভিনেতা অভিনেত্রী হাজারও কলাকুশলী এবং কোটি কোটি দেশপ্রেমিক দর্শক যারা সিনেমায় নিজ দেশের গল্প দেখে অভ্যস্ত তারাও কখন ভাবেনি এমন প্রতিকুল স্রোতের বিপরীতে আমাদেরকে সাঁতার কাটতে হবে। কি আশ্চর্য্য, যখনই আমাদের কোনো ছবি মুক্তির জন্য একটি সপ্তাহকে বেছে নেয়া হয় ঠিক তখন সাথে সাথে ওই সপ্তাহেই কোত্থেকে উড়ে এসে জুড়ি বসে ভারতীয় তথা কলকাতার বাংলা ছবি। তারপর, নিজ দেশের ছবি পায় দশ থেকে বারোটা হল আর কলকাতার ছবি পায় এক›শোরও অধিক হল। অথচ কলকাতায় তারা নিজেদের দেশে এত হল পায় কি না সন্দেহ। এই পরিস্থিতিতে বাংলাদেশে কোন পরিচালক প্রযোজক আছেন যিনি সাহস করে তার ছবি মুক্তি দিবেন? নিকট অতীতে এর যথেষ্ট উদাহরণ আমাদের সামনে রয়েছে। দেশীয় ছবি মুক্তির সাথে কলকাতার ছবি রিলিজ করে কি ভাবে নিজ দেশের সিনেমাকে দাবিয়ে দেয়া হচ্ছে। একটি মহলের এযেন নিজের দেশের চলচ্চিত্রের সাথে প্রকাশ্যে যুদ্ধ ঘোষণা! এটা বাংলাদেশর চলচ্চিত্রকে ধ্বংসের কোনো গভীর ষড়যন্ত্রের অংশ কিনা কে জানে! আমার দেশের সমাজ ব্যবস্থা আমার ইতিহাস ঐতিহ্য আর ভারতের কালচার একতো নয়। আমার গল্পে, ইতিহাসে, কাঙ্গাল হরিনাথ আছেন, লালন আছেন, আছেন পাগলা কানাই। আমাদের আছে ত্রিশ লক্ষ শহীদের রক্তের বিনিময়ে যুদ্ধ জয়ের ইতিহাস, আছে বীরাঙ্গনার গৌরবময় আত্মকাহিনী, আছে পারিবারিক অটুট বন্ধনের গল্প, আরো কত কি! আমাদের ছবি দেখে আমরা নায়কের প্রশংসা করবো না হয় বকা দিবো, নায়িকার দুর্বল অভিনয়ের জন্য সমালোচনা করবো অথবা ভালো অভিনয়ের জন্য সুনাম করবো। গালি দিয়ে পরিচালকে তুলা ধুনা করবো তারপরেও দেশের কাহিনী দেশের ছবি, মানে আমার ছবি। যারা কলকাতার বাংলা ছবি আমদানি করে দেশের বাংলা ছবির বারোটা বাজাচ্ছেন তাঁরাই আবার গলা উঁচু করে বলেন কলকাতা থেকে ছবি না আসতে দিলে বাংলাদেশের চলচ্চিত্র ধ্বংস হয়ে যাবে। এতো পাগলের প্রলপ! এখন তো কলকাতার পরিচালকরা নিজেরাই তাদের বাংলা চলচ্চিত্র মুক্তি নিয়ে চোখে সরিষার ফুল দেখছেন। এইত সেদিন সাউথ ইন্ডিয়া থেকে বাহুবালি-২ এসে কলকাতার যেকটা হলে বাংলা ছবি ছিলো সব উল্টে দিলো! কই গেলো বাহুবালি ২ এর কাছে কলকাতার বাংলা সিনেমা? ১৩ জুন ২০১৭ কলকাতার শক্তিধর অভিনেতা চিরঞ্জিৎ আনন্দ বাজার পত্রিকার কাছে হতাশা ব্যক্ত করে বলেন, ‘ছবি ফ্লপের ধাক্কা থেকে ইন্ডাস্ট্রিটা বাঁচান।’ তিনি আরো বলেন, ‘ইন্ডাস্ট্রি মরে যাচ্ছে, তাই বাঁচানোর জন্য ‹বস টু›, ‹চ্যা¤প› হিট হওয়া ভীষণ প্রয়োজন।’ এবার বুঝুন কোন ইন্ডাস্ট্রির জন্য এখানকার মায়া কান্না। কাকে বাঁচাতে কার দৌড় ঝাঁপ। ক্ষমতা এবং সদিচ্ছা থাকলে আনেন বাহুবালি ২, আনবেন না, কারণ ওটা আনতে একদিকে পয়সা বেশি লাভ কম, অন্যদিকে উপকার কলকাতার না সাউথের। একদিকে কম পয়সায় বেশি লাভের আশায় কলকাতা থেকে ছবি এনে নিজ দেশের ছবি মুক্তির পথ রুদ্ধ করা হচ্ছে, আরেক দিকে বলা হচ্ছে কলকাতার ছবি না আসতে দিলে আমাদের চলচ্চিত্র ধ্বংস হয়ে যাবে। কী হাস্যকর কথা! বলুন, আমাদের কাঁধে চড়ে এদেশে ছবি মুক্তি না দিতে পারলে হয়ত কলকাতার ছবিই একদিন ধ্বংস হয়ে যাবে। সুযোগ পেলে এদেশের মানুষকে কত ভাবেই না বোকা বানানো যায়। কলকাতার চলচ্চিত্র সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা অনেক আগেই বুঝতে পেরেছিলেন তাদের বাজার একদিন সাউথ ইন্ডিয়ার হাতে চলে যাবে। নতুন বাজার সৃষ্টির শপথ নিয়ে প্রসেনজিৎ বাবু দলবল সহ ২০১৫ সালে পশ্চিম বঙ্গ রাজ্য সরকারের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দোপাধ্যায়কে সাথে নিয় বাংলাদেশে এসে হাজির হলেন, অথবা প্রসেনজিৎদের সাথে নিয়ে মমতা বন্দোপাধ্যায় রাষ্ট্রীয় সফরে ঢাকায় উপস্থিত হলেন। উদ্দেশ্য পশ্চিম বঙ্গের সাথে ঢাকার ব্যবসা বাণিজ্যের উন্নতি সাধন। টিভি দেখে মনে হয়েছে মমতার এই সফরে তার সফর সঙ্গী হিসেবে অনান্য সেক্টরের তুলনায় বেশি ছিলেন অভিনয় শিল্পী, যার অধিকাংশই ছিলেন চলচ্চিত্র ব্যক্তিত্ব। নিশ্চয় মমতা বন্দপাধ্যায় সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের মধ্য দিয়ে তিস্তার পানি বাংলাদেশকে দেয়ার জন্য শিল্পী বহর নিয়ে ঢাকায় আসেননি? বরং তিনি খুব ভালো করেই জানতেন বাংলাদেশে গেলে, বাংলার মানুষ তাঁকে পানি প্রসঙ্গে প্রশ্ন করবে। তিস্তা চুক্তির ব্যাপারে তাঁর মনোভাব জানতে চাইবে। উত্তরটা যদিও সেদিন তিনি সাথে করে নিয়েই এসেছিলেন, ‘আমার উপর ভরসা রাখুন’। ভরসা রেখে আজও বাংলার মানুষ তিস্তার পানির জন্য পরম মমতায়, মমতার ঝোলানো মুলার দিকে চেয়ে আছে। মমতা যখন ঢাকা সফরে এসে বিভিন্ন রাষ্ট্রীয় কর্মসূচিতে অংশ গ্রহণে ব্যস্ত তখন রাষ্ট্রীয় অতিথি ভবনে বসে প্রসেনজিৎ আর দেব বাবুরা আমাদের দেশের চলচ্চিত্রের কর্তা ব্যক্তিদের সাথে বৈঠক করেছিলেন ছবি আদান-প্রদানের নামে বাংলাদেশের চলচ্চিত্রের বাজার দখল আর হল দখলের লক্ষ্যে। সেদিন কেনো আমাদের ওই প্রতিনিধি দল বুঝতে পারেননি কি হতে যাচ্ছে? ভারতের পক্ষ থেকে আজ পর্যন্ত যা হয়েছে তা শুধু প্রদানই হয়েছে, আদান হয়েছে কয়টি? হয়ে থাকলে তার ফলাফল কি? ক›দিন আগে আমাদের এক অভিনেত্রী অভিযোগের সুরে বললেন কলকাতায় আমাদের যে ছবি দেখানো হয় তাতে ওখানকার দর্শক দেখেনা। প্রশ্ন উঠে, কার ছবি? কোন ছবি? কলকাতার কোথায়, কোন হলে মুক্তি দেয়া হয়েছে? অথচ বাংলাদেশের জনগণের সব চেয়ে বড় উৎসব ঈদ। যেখানে ঈদকে ঘিরে প্রতি বছর পাঁচ থেকে ছয়টা নিজ দেশের ছবি মুক্তির একটা প্রচলন আজীবন ধরে চলে আসছে। এই সময় নিজ দেশের নানা রংয়ের গল্প বাংলার দর্শক সিনেমার পদ্মায় দেখতে অভ্যস্ত। অথচ এখন দেশের ছবি মুক্তির সুযোগ সঙ্কুচিত করে, প্রসেনজিৎ তথা কলকাতার ছবি বাংলাদেশের অধিকাংশ হল কামড়ে ধরার চেষ্টা চলে। থাকো ঘরে বন্দি স্বদেশের ছবি! আরো ভয়ংকর ব্যাপার পবিত্র মাহে রমযানে ‹আল্লাহ মেহেরবান› গানের সুরে নুসরাত ফারিয়া নামের এক শিল্পীর অর্ধউলঙ্গ নৃত্য বাংলাদেশকে কোথায় নিয়ে যাচ্ছে? যদিও দেশের ফুঁসে উঠা জনগণের প্রতিবাদ আর আইনি নোটিশের মাধ্যমে নুসরাতের এই অশ্লীলতাকে জাতি প্রতিরোধ করেছে। যে অশ্লীলতার বিরুদ্ধে একদিন আমাদেরকে আন্দোলন করতে হয়েছিল, যে অশ্লীলতার বিরুদ্ধ মরহুম কর্নেল গুলজারকে একের পর এক হল এবং অশ্লীল ছবি সংশ্লিষ্ট অফিসগুলোতে অভিযান চালিয়ে উদ্ধার করতে হয়েছিল কাটপিস নামক অশ্লীল সিনেমা ফুটেজ; এতদিন পর যৌথ প্রযোজনায় হোক আর সাফটার আওতায় ভারতীয় ছবিই হোক, আবার কি আমরা সেই অবস্থার দিকে ফিরে যাচ্ছি? যদি তাই হয়, তাহলে একদিন যে অশ্লীলতার অভিযোগে মুয়রী, পলি, মুনমুনদেরকে এফডিসিতে অবাঞ্চিত ঘোষণা করা হয়েছিল আজ তাদেরকে কি বলা হবে? কি বলা হবে ওই সব ছবির নির্মাতাদের? এতদিন যারা দাবি করেছেন যৌথ প্রয়োজনার ছবির ক্ষেত্রে তাদের কোনো প্রকার অনিয়ম বা প্রতারনা নাই, স¤প্রতি তাদেরই যৌথ প্রযোজনার ‹বস ২› ছবিটি প্রিভিউ বোর্ডের কাছে অনিয়ম প্রমাণিত হয়েছে বলেরিপোর্ট করলে ওই প্রতিষ্ঠানর কর্নধার নাখোশ হয়ে, প্রিভিউ বোর্ডের একজন সদস্য, পরিচালক সমিতির বর্তমান সভাপতি মুশফিকুর রহমান গুলজারের পদত্যাগ দাবি করেছেন। ব্যাপারটা এই রকম, আমরা যা খুশি করবো তোমরা দেখার কে? আর যদি দেখ তাহলে পদত্যাগ করো, না হয় অপসারিত হও। এবার বলবো, আমাদের ভবিষৎ প্রজন্মের ভবিষ্যৎ চিন্তার কথা। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা, তিস্তা চুক্তির ক্ষেত্রে মমতা বন্দপাধ্যায় বাংলার মানুষের উদ্দেশ্যে আপনার সামনে বলেছিলেন তাঁর প্রতি ভরসা রাখার জন্য, আপনি ভরসা রেখেছেন, বাংলার ষোল কোটি মানুষ ভরসা রেখেছে, কিন্তু মমতা কথা রাখেননি। তিনি কলকাতা ফিরে গিয়ে বরং উল্টো বলেছেন, তার রাজ্যই জল পায় না তিনি বাংলাদেশকে কোত্থেকে জল দিবেন। তিস্তার বিষয়ে মমতাকে দোষারোপ করে সময় অসময় দিল্লীর দু›একজন মন্ত্রীও বলেছেন, তিস্তা চুক্তির পক্ষে যেমন বাংলাদেশের হাসিনা সরকার, তেমন চুক্তির পক্ষে দিল্লী সরকারও কিন্তু পশ্চিম বঙ্গ রাজ্য সরকারের আপত্তির কারণেই এটা এতদিন ধরে হচ্ছেনা। ঠিক। আমরা যে কেউ যদি মমতার স্থানে দাঁড়াই, তাহলে দেখবো দেশের স্বার্থে, দেশের জনগণের স্বার্থে মমতার এই মমত্ববোধ বা সিদ্ধান্ত সঠিক। যদিও ওটা গায়ের জোরে, কেননা প্রাকৃতিকভাবে প্রবাহিত নদীর ক্ষেত্রে আন্তর্জাতিক আইন বলে ভিন্ন কথা। সে যাই হোক, মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা, আপনি দেশের স্বার্থে, দেশের জনগণের স্বার্থে সঠিক সিদ্ধান্ত নিন, ভারতীয় চলচ্চিত্র বাংলাদেশে প্রবেশ নিষিদ্ধ করুন। আপনারও এই সিদ্ধান্ত হবে স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশের জন্য, বাংলার মানুষের জন্য, ভবিষৎ প্রজন্মের জন্য উত্তম সিদ্ধান্ত। কেননা একটি দেশের চলচ্চিত্র শুধু পণ্য নয় শিল্পও বটে। তাই আমাদেরকেই আমাদের চলচ্চিত্র রক্ষা করতে হবে। কলকাতা পারেনি সাউথ ইন্ডিয়া থেকে নিজেদের রক্ষা করতে, কিন্তু আমরা যেন পারি কলকাতা থেকে আমাদেরকে রক্ষা করতে। দুই দেশের সামান্য কটা মানুষের হাতে বন্দি হয়ে সত্যি যেন চলচ্চিত্র ধ্বংস না হয়ে যায়। বরং স্ব স্ব স্থানে দুই দেশের ছবিই বেঁচে থাকুক, বেঁচে থাকুক ছবির মানুষগুলো। অটুট থাকুক সব দেশ, সব মানুষের সাথে আমাদের সৌহাদ্যপূর্ণ স¤পর্ক।
লেখক: জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কারপ্রাপ্ত নির্মাতা।



 

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

ঘটনাপ্রবাহ: চলচ্চিত্র


আরও
আরও পড়ুন
গত​ ৭ দিনের সর্বাধিক পঠিত সংবাদ