Inqilab Logo

শুক্রবার, ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ০৬ বৈশাখ ১৪৩১, ০৯ শাওয়াল ১৪৪৫ হিজরী

ঈদ্-উল্-ফেৎর প্রসঙ্গে যা মনে পড়ে

| প্রকাশের সময় : ২৪ জুন, ২০১৭, ১২:০০ এএম

শেখ দরবার আলম

 \ এক \

শৈশব, বাল্যে এবং কৈশোরে আমার রোজার দিনগুলো এবং ঈদ-উল-ফেৎরের দিনগুলো কেটেছে এক সুবিশাল, সুসংহত এবং জাতীয়তাবাদী মজবুত হিন্দু সমাজ প্রধান স্বাধীন ভারতে পশ্চিমবঙ্গে। চব্বিশ পরগনার পারুলিয়ায়। পাড়ায় আব্বা-আম্মার সংসারে এবং অন্য আত্মীয়-পরিজনদের মধ্যে থেকে তখন ঈদ করতাম। অর্থনৈতিক চিন্তাও তখন ছিল না। তখন ঈদের মধ্যে থেকে ঈদের অনেক দিন আগে থেকে সে সবের আয়োজন ছিল।
দুর্গা পূজার ষষ্ঠীর দিন পাঁচেক আগে মহালয়ার দিন অল ইন্ডিয়া রেডিওর কলকাতা কেন্দ্রে বীরেন্দ্রকৃষ্ণ ভদ্রের কণ্ঠে চন্ডী পাঠ হতো সাতচল্লিশের মধ্য আগস্টের অনেক আগে থেকে। কবি কাজী নজরুল ইসলামের জীবদ্দশায় সুস্থাবস্থায় ১৯৪২-এও হয়েছে। কিন্তু অল ইন্ডিয়া রেডিওর কলকাতা কেন্দ্রে সাহরির সময় এবং ইফতারির সময় কোনো অনুষ্ঠান হতো না। সাহরির সময় এবং ইফতারির সময় রেডিও পাকিস্তানের ঢাকা কেন্দ্রের অনুষ্ঠান শোনার স্বাধীনতা স্বাধীন ভারত রাষ্ট্রে ছিল। সাহরির সময়ের আগে থেকে এবং ইফতারির সময়ের আগে থেকে আমরা রেডিও পাকিস্তানের ঢাকা কেন্দ্রে অনুষ্ঠান শুনে প্রয়োজন মেটাতাম।
১৯৪৭-এর ১৫ই আগস্টের পর স্বাধীন ভারতের পশ্চিমবঙ্গের স্কুল- কলেজ-ইউনিভার্সিটির পাঠ্য তালিকায় মুসলমান সমাজের ইতিহাস ঐতিহ্য ও ইসলামী সংস্কৃতির পরম্পরা এবং এই পরম্পরাভিত্তিক মুসলিম জাতিসত্তা সংশ্লিষ্ট সাহিত্য সংগীত যেমন অচ্ছুত হয়ে আছে, ঠিক তেমনি ১৯৪৭-এর ১৪ই আগস্ট থেকে ১৯৭১এর ১৬ ডিসেম্বর পর্যন্ত সেই পাকিস্তান আমলেই আবার ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাঙলা বিভাগের এমএ ক্লাসে মুসলমান সমাজের ইতিহাস-ঐতিহ্য ও ইসলামী সংস্কৃতির পরম্পরা এবং এই পরম্পরাভিত্তিক মুসলিম জাতিসত্তা সংশ্লিষ্ট সাহিত্য সংগীত অচ্ছুৎ হয়েছিল। এরই অংশ হিসেবে নজরুল সাহিত্য অবশ্য পাঠ্য ছিল না। যে কোনো ছেলে-মেয়ে নজরুল সাহিত্য না পড়েও বাংলায় ফার্স্ট ক্লাস ফার্স্ট হয়ে আবার ঐ বিশ্ববিদ্যালয়েরই শিক্ষক হতে পারতেন। ১৯৪৭-এর ১৪ আগস্ট থেকে ১৯৭১-এর ১৬ ডিসেম্বর পর্যন্ত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাঙলা বিভাগের এমএ ক্লাসে পাঠ্য ছিল কেবল হিন্দু সমাজের ইতিহাস-ঐতিহ্য ও হিন্দুদের ধর্মীয় সংস্কৃতির পরম্পরা এবং এই পরম্পরাভিত্তিক হিন্দু জাতিসত্তা সংশ্লিষ্ট সাহিত্য। বৈষ্ণব পদাবলী এবং শ্রীকৃষ্ণ কীর্তনও ১৯৪৭-এর ১৪ আগস্ট থেকে ১৯৭১ -এর ১৬ ডিসেম্বর পর্যন্ত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাঙলা বিভাগের এমএ ক্লাসে অবশ্য পাঠ্য ছিল।
এ সবই হতে পেরেছিল ঋষি বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের ‘আনন্দমঠ’ (১৮৮২) উপন্যাসের সন্তান দলের আদের্শ গঠিত অনুশীলন সমিতির সভ্য মনিসিংহের নেতৃত্বাধীন পূর্ব পাকিস্তান কমিউনিস্ট পার্টির অনুশীলন সমিতির সভ্যদের, যুগান্তর দলের সভ্যদের ও অন্যান্য সন্ত্রাসবাদী গুপ্ত সশস্ত্র স্বাধীনতা সংগ্রামী সংগঠনের সভ্যদের প্রভাবে এবং অনুশীলন সমিতির সভ্য মহারাজ ত্রৈলোক্যনাথ চক্রবর্তীর নেতৃত্বাদীন পূর্ব পাকিস্তান সোসল্যালিস্ট পার্টি অনুশীলন সমিতির সভ্যদের, যুগান্তর দলের সভ্যদের ও অন্যান্য সন্ত্রাসবাদী গুপ্ত সশস্ত্র স্বাধীনতা সংগ্রামী সংগঠনের সভ্যদের প্রভাবে।
অনুশীলন সমিতির সভ্যরা ঋষি বঙ্কিমচন্দ্র চট্টপাধ্যায়ের ‘আনন্দমঠ’ (১৮৮২) উপন্যাসের সন্তান দলের আদর্শে বৈদিক ব্রাহ্মণ শাসিত বর্ণ ও অধিকার ভেদাশ্রয়ী মনুসংহিতার সমাজ প্রধান তামাম ভারতীয় উপমহাদেশে ইসলাম ও মুসলিমমুক্ত এক হিন্দু ধর্মাবলম্বী স্বাধীন ভারত রাষ্ট্র কায়েম করার লক্ষ্যে কাজ করতে চেয়েছিলেন। অবিভক্ত বাঙলায় অনুশীলন সমিতি (১৯০২) থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে ‘যুগান্তর দল’ (১৯০২) ও অন্যান্য সন্ত্রাসবাদী গুপ্ত সশস্ত্র স্বাধীনতা সংগ্রামী সংগঠন গঠিত হয়েছিল। অনুশীলন সমিতির সভ্য ও ভারতের জাতীয় কংগ্রেসের সদস্য এবং কলকাতা ন্যাশনাল মেডিকেল কলেজের এক সময়কার ছাত্র ডাক্তার কেশব বলিরাম হেডগেওয়ার ১৯২৫ খ্রিষ্টাব্দে বিজয়া দশমীর দিন নাগপুরে তামাম ভারতীয় উপমহাদেশ থেকে ইসলাম ও মুসলিম উৎখাতকামী সংগঠন রাষ্ট্রীয় স্বয়ং সেবক সংঘ (আরএসএস) প্রতিষ্ঠা করেছিলেন।
এই পরিবেশ-পরিস্থিতিতেও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাঙলা বিভাগের মতো রেডিও পাকিস্তানের ঢাকা কেন্দ্র বোধহয় পুরোপুরি প্রভাবিত হয়নি। রেডিও পাকিস্তানের ঢাকা কেন্দ্র থেকে সাহরির সময় এবং ইফতারির সময় আদি গ্রামোফোন রেকর্ড থেকে কবি কাজী নজরুল ইসলামের লেখা ইসলামী গান পরিবেশিত হতো। শৈশবে, বাল্যে ও কৈশোরে রোজার সময়ে তখন হিন্দু সমাজ প্রধান স্বাধীন ভারতে থেকেও সেই সব গান আমি মুগ্ধ হয়ে শুনতাম। আমার মানসিকতা গঠনে এসব গান বিশাল এবং ব্যাপক অবদান রেখেছে। বিভিন্ন ধর্মীয় সমাজের সাম্য ও সহাবস্থানের নীতিতে ইসলামকে আমি সেই তখন থেকে ভালোবেসেছি, মুসলমান সমাজের ইতিহাস-ঐতিহ্যকে ভালোবেসেছি, ইসলামী সংস্কৃতির পরম্পরাকে আমি ভালোবেসেছি, মুসলিম জাতিসত্তাকে আমি ভালোবেসেছি, ইসলামী জীবন বিধানকে আমি ভালোবেসেছি। অর্থনেতিক সাম্য ও সামাজিক সাম্য এবং বিভিন্ন ধর্র্মীয় সমাজের অর্থনৈতিক, সাংস্কৃতিক, শিক্ষাগত, আইনগত, সামাজিক ও রাজনৈতিক সহাবস্থানের কবি আমাদের জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলামকে আমি ভালোবেসেছি এবং এভাবেই আমি মনুষ্যত্ববোধে উদ্বুদ্ধ হয়েছি। সাম্য ও সহাবস্থানকামী মানুষ হয়েছি আমি।
\ দুই \
আমার শৈশবে, বাল্য এবং শৈশোরে আমাদের পারুলিয়া গ্রামে ঈদ যথার্থই আনন্দদায়ক ছিল। আমাদের পারুলিয়া গ্রামে বড় পুকুর পাড়ে ঈদের নামাজ পড়তাম। পাশে রাস্তায় প্রতিবেশী বড় সমাজের মানুষরা দাঁড়িয়ে দেখতেন। ভাবতেন আমরা কত সুশৃঙ্খল জাতি!
রমজান মাসের রোজার শেষে আসে ঈদ-উল-ফেৎর। গ্রামোফোন কোম্পানী হিজ মাস্টার্স ভয়েসের রেকর্ডে পিলুকার্ফায় আব্বাস উদ্দীন আহমদের গাওয়া নজরুল সঙ্গীত ‘ও মন রমজানের ঐ রোজার শেষে’ সেই ব্রিটিশ আমলে বের হয়েছিল। ১৯৩২-এর ফেব্রæয়ারি মাসে। রেকর্ড নম্বর : এন ৪১১১। নজরুল সঙ্গীত গ্রন্থ ‘জুলফিকার’-এর অন্তর্ভুক্ত এই গানের বাণীতে আছে :
‘ও মন রমজানের ঐ রোজার শেষে এলো খুশির ঈদ।
তুই আপনারে আজ বিলিয়ে দে শোন আসমানী তাগিদ\
তোর সোনাদানা বালাখানা সব রাহে লিল্লাহ,
দে জাকাত, মুর্দা মুসলিমের আজ ভাঙাইতে নি’দ\

তুই পড়বি ঈদের নামাজ রে মন সেই সে ঈদ গাহে
যে ময়দানে সব গাজী মুসলিম হয়েছে শহীদ\
আজ ভুলে গিয়ে দোস্ত দুশমন হাত মিলাও হাতে,
তোর প্রেম দিয়ে কর বিশ্ব নিখিল ইসলামে মুরীদ\

যারা জীবন ভরে রাখছে রোজা নিত উপবাসী
সেই গরীবে এতিম মিসকিনে দে যা কিছু মফিদ\
ঢাল হৃদয়ের তোর তশতরীতে শিরনী তৌহিদের,
তোর দাওয়াত কবুল করবেন হজরত, হয় মনে উমীদ\

তোরে মারল ছুড়ে জীবন জুড়ে ইট পাথর যারা
সেই পাথর দিয়ে তোল রে গড়ে, প্রেমেরি মসজিদ\

\ তিন \
ইসলামকে নজরুল মেকানিক্যাল রিচুয়ালস বা যান্ত্রিক পদ্ধতির অনুষ্ঠানসর্বস্ব ধর্মাচারণের বিষয় বলে মনে করতেন না। ইসলামকে তিনি অত্যন্ত আন্তরিকভাবে একটা পূর্ণাঙ্গ জীবন বিধান হিসেবে গ্রহণ করেছিলেন। ঈদের আনন্দ কেবলমাত্র মুষ্টিমেয় ধনী ব্যক্তির বা আর্থিক দিক দিয়ে সচ্ছল ব্যক্তির হবে, ধনী বা সচ্ছল ব্যক্তিরা রোজা এক মাস করবেন এবং গরিব, চালচুলোহীন নিঃস্ব মানুষেরা সারা বছর ধরে প্রতিদিন উপবাসী থাকবেন, ইসলামী অর্থনৈতিক ব্যবস্থা, প্রকৃত মুসলমানদের কাছে অর্থনৈতিক ব্যবস্থা যে এ রকম হওয়ার কথা নয়, সে বিষয়ে নজরুল নিশ্চিত ছিলেন।
সব মানুষের অর্থনৈতিক নিরাপত্তা বিধানের কাজটাকে নজরুল মনুষ্যত্ববোধে উত্তীর্ণ প্রকৃত মুসলমানের কাজ যথার্থ ঈমানদার মুসলমানের কাজ বলে মনে করতেন। নজরুল বিশ্বাস করতেন যে, যথার্থই যিনি আল্লাহর প্রকৃত বান্দা এবং নবীর প্রকৃত উম্মত হবেন, তিনি অত্যন্ত আন্তরিকভাবেই অর্থনৈতিক বৈষম্য এবং সামাজিক বৈষম্য দূর করার চেষ্টা করবেন। এবং ধর্ম, বর্ণ, ভাষা ও অঞ্চল নির্বিশেষে সব মানুষকে নিয়ে অত্যন্ত আন্তরিকভাবেই সহাবস্থানকামী হবেন। এসব বিষয়ে নির্বিকার ও উদাসীন থেকে কেবল কলেমা উচ্চারণ ও নামাজ, রোজা হজ করাটাকেই নজরুল ইবাদতের সমস্ত কিছু বলে মনে করতেন না। এ দিকটার কথা স্মরণ করে নজরুল জাকাত ব্যবস্থার ওপর অত্যন্ত গুরুত্ব দিতেন। কেবল জাকাত ব্যবস্থা নয়, নজরুল মনে করতেন যে দানবীর হাজী মোহাম্মদ মহসীনের মতো প্রকৃত মুসলমান কোনো কোনো অবস্থায় দান-খয়রাত করবেন হাতে কিছু না রেখে, উদার হস্তে। কবি কাজী নজরুল ইসলামের ব্যক্তিগত জীবনে এ রকম দান-খয়রাতের অনেক দৃষ্টান্ত, ‘রাহে লিল্লাহ’ আপনাকে ‘বিলিয়ে’ দেয়ার এ রকম দৃষ্টান্ত অনেক আছে। নিজেকে এভাবে বিলিয়ে দেয়ার সময় তিনি নিঃস্ব মানুষের, মিসকিন মানুষের ধর্ম কী, বর্ণ কী, ভাষা কী, তিনি কোন অঞ্চলের মানুষ, এসব কিছুই দেখতেন না। মানুষে মানুষে অর্থনৈতিক বৈষম্য যারা কাক্সিক্ষত মনে করতেন, তাদেরকে নজরুল প্রকৃত মুসলমান বলে মনে করতেন না। আসমান জমিন অর্থনৈতিক বৈষম্য তিনি মুসলমান সমাজের ঐক্য ও সংহতির পথে প্রধান অন্তরায় বলে মনে করতেন। মুসলমানদের মধ্যে যে কোনো রকম অনৈক্য নজরুল অত্যন্ত অনাকাক্সিক্ষত বলে মনে করতেন।
\ চার \
ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির আমলে (১৭৫৭-এর ২৩ জুন থেকে ১৭৭২), ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির ঔপনিবেশিক সরকারের আমলে (১৭৭২ থেকে ১৮৫৮-এর ৩১ আগস্ট) এবং ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক সরকারের আমলে (১৮৫৮-এর ৩১ আগস্ট থেকে ১৯৪৭-এর মধ্য আগস্ট)। ক্রুসেডের চেতনাসম্পন্ন ব্রিটেনের ইংরেজভাষী শ্বেতাঙ্গ খ্রিষ্টান জাতীয়তাবাদীদের সহযোগী সমাজ হিসেবে সম্মানজনক জীবিকার এবং সম্মানজনক জীবিকার্জনের সহায়ক শিক্ষার ক্ষেত্রে একচেটিয়াভাবে সুযোগ-সুবিধা পেয়ে এগিয়ে গিয়েছিলেন ভারতীয় উপমহাদেশের মুসলমানদের প্রতিবেশী বড় সমাজ অর্থাৎ বৈদিক ব্রাহ্মণ শাসিত বর্ণ ও অন্ধকার ভেদাশ্রয়ী মনুসংহিতার সমাজ। অন্যদিকে ক্রুসেডের চেতনাসম্পন্ন ব্রিটেনের ইংরেজভাষী শ্বেতাঙ্গ জাতীয়তাবাদী সমাজের প্রতিপক্ষ ও শত্রæ সমাজ হিসেবে চিহিত হওয়ার কারণে ভারতে ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির, ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির ঔপনিবেশিক সরকারের এবং ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক সরকারের আমলে সম্মানজনক জীবিকার এবং সম্মানজনক জীবিকার্জনের সহায়ক শিক্ষার ক্ষেত্রে অধিকার বঞ্চিত হয়ে সমাজহীন মুসলমান সমাজ হতদরিদ্র, অশিক্ষিত, অসচেতন, অসংগঠিত হয়ে লক্ষ্যভ্রষ্ট ও লক্ষ্যহীন এবং অদূরদর্শী ও অপরিণামদর্শী হয়ে মানবেতর জীবনযাপনে বাধ্য হয়েছেন।
ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির আমলে ১৭৯৩ থেকে ইংরেজ সহযোগী হিন্দুর জমিদারি কেনার অনেক পরে দু-একটা মুসলমান জমিদারি কিনেছিলেন, দু-একটা মুসলান ছোটখাটো ব্যবসায়ী হয়েছিলেন। মুসলিম মধ্যবিত্ত শ্রেণী বলে কোনো শ্রেণী তখন গড়ে ওঠেনি। অধিকাংশ মুসলমান ছিলেন ভ‚মিহীন ক্ষেতমজুর। অন্যান্য পেশায়ও কিছু নিঃস্ব মেহনতি মুসলমান ছিলেন। এ অবস্থায়ও প্রিন্সিপাল ইব্রাহীম খাঁকে লেখা একটা চিঠিতে নজরুল ক্ষোভ প্রকাশ করে লিখেছিলেন যে, মুসলমানরা ধনে কাঙাল কি না তা তিনি জানেন না; কিন্তু মনের দিক দিয়ে যে কাঙাল এ বিষয়ে তিনি শতভাগ নিশ্চিত।
বর্ণ, ভাষা, অঞ্চল নির্বিশেষে দুটো ঈদ তো সারা দুনিয়ার মুসলমানদের দুটো উৎসব। এই উৎসব দুটোর যে কোনো একটির কথা লিখতে বা বলতে গেলে নজরুলের সব সময়ই মনে পড়ত অধিকার বঞ্চিত নিঃস্ব মুসলমানদের কথা। তাদের কথা বাদ দিয়ে ঈদ উপলক্ষে কবিতা, গান, ঈদের নাটক, এসব তিনি লেখেননি।
পটস ডিজিজে পত্মী প্রমীলা নজরুল ইসলাম ১৯৩৭ খ্রিষ্টাব্দে অসুস্থ হয়ে পড়ার বছর পাঁচেক পর ঋণগ্রস্ত হওয়ায় এবং দারিদ্র্যের কষাঘাতে, শারীরিক ও মানসিক আঘাতে হজরত মুহম্মদ সাল্লাহাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের জীবনী অবলম্বনে তার একটি অত্যন্ত মূল্যবান গ্রন্থ ছাপার ব্যবস্থা করে কিছু টাকা পাওয়ার সংস্থান করে দেবেন বলে নিয়ে গিয়ে ১৯৪২-এর অক্টোবরে আর একজন কবি নিজের নামে ছেপে নেয়ার আলজাইমার্স ডিজিজে অসুস্থ কবি ১৯৪২-এর ৯ অক্টোবর তারিখে খুব বেশি অসুস্থ হয়ে পড়েছিলেন। এ দিন থেকে নিঃসঙ্গ ও অসহায় কবির মানসিক সুস্থিতি হারিয়ে ফেলার মতো অবস্থাও হয়েছিল। সম্ভবত নিজের মূল্যবান গ্রন্থটি অন্যের নামে ছাপা হয়ে যাওয়ার কারণে। এরই ঠিক বছর দেড়েক আগে ১৯৪০-এর ডিসেম্বরে টুইন কোম্পানি থেকে বের হয়েছিল কবি কাজী নজরুল ইসলামের সুরে কাজী নজরুল ইসলামেরই ফেলা ‘ঈদ” নাটিকার অবিস্মরণীয় গান : ‘নাই হলো মা জেওর লেবাস বসন ভূষণ এই ঈদে আমার।’ রেকর্ড নম্বর : এফটি-১৩৪৯৬। এই ঈদের গানটির অপূর্ব অবিস্মরণীয় বাণী খুব মনোযোগ দিয়ে লক্ষ করলে কবি কাজী নজরুল ইসলামের ঈদ ভাবনটা উপলব্ধি করা যাবে। কবি লিখেছেন :
‘নাই হলো মা জেওর লেবাস বসন ভূষণ এই ঈদে আমার।
আল্লাহ আমার মাথার মুকুট রসুল গলার হার\
নামাজ রোজার ওড়না শাড়ি ওতেই আমায় মানায় ভারী
কলমা আমার কপালে টিপ, নাই তুলনা তার\
হেরা গুহার হীরার তাবিজ কোরআন বুকে দোলে,
হাদিস, ফেকা বাজুবন্দ দেখে পরান ভোলে\
হাতে সোনার চুড়ি যে মা হাসান হোসেন মা ফাতেমা,
(মোর) অঙ্গুলিতে অঙ্গুরি মা, নবীর চার ইয়ার\’
মুসলমান সমাজের ইতিহাস-ঐতিহ্য ও ইসলামী সংস্কৃতির পরম্পরা এবং এই পরম্পরাভিত্তিক মুসলিম জাতিসত্তা সংশ্লিষ্ট এই গানের বাণীর কী অপরূপ ঐশ্বর্য! এর সঙ্গে আছে উপযুক্ত সুর-তাল। এ রকম ঐশ্বর্যমন্ডিত গান লেখার মতো মানুষ নজরুলের আগে কেউ আসেনি। নজরুলের পরেও কেউ নয়। এ দেশেরও বিভিন্ন জায়গায় মুসলমানরা তো দুটো ঈদের আগে অন্তত দুটো ঈদ সম্মেলন করতে পারেন। সেখানে নজরুলের ঈদ সংশ্লিষ্ট কবিতা, গান, নাটিকা, প্রবন্ধ, অভিভাষণ ইত্যাদি ব্যাপকভাবে প্রচারের বন্দোবস্ত করে মুসলমানদেরকে আবার মুসলমান সমাজের ইতিহাস, ঐতিহ্য ও ইসলামী সংস্কৃতির পরম্পরা এবং ওই পরম্পরাভিত্তিক মুসলিম জাতিসত্তার আশ্রয়ে ফিরিয়ে দিয়ে সুস্থ জীবনবোধ এবং গঠনমূলক চিন্তা-ভাবনা পেতে সহায়তা করা যায়। সেটা করা গেলে এখনকার এই অবাধ লুণ্ঠন, লাগামহীন দুর্নীতি, অনৈতিকতা, অসততা, অনুভূতিহীনতা, উচ্ছৃঙ্খলতা এবং অরাজক পরিস্থিতি থাকবে না। ভোগবাদী দৃষ্টিভঙ্গি থাকবে না। যুবকরা এখন নারীর শরীর নিয়ে রিরংসা প্রবৃত্তি চরিতার্থ করার কথা ভাববে না। নারীর শরীর নিয়ে ভাববে না। নারীর মন নিয়ে ভাববে। নারীকেও মানুষ হিসেবে দেখবে। জ্ঞান চর্চার প্রয়োজনীয়তা অত্যন্ত আন্তরিকভাবেই উপলব্ধি করবে।
স্কুল-কলেজ-ইউনিভার্সিটির পাঠ্য তালিকায় এবং এ বিষয়ে স্বউদ্যোগী মুসলমান সমাজের ইতিহাস ঐতিহ্য ও ইসলামী সংস্কৃতির পরম্পরা এবং এই পরম্পরাভিত্তিক মুসলিম জাতিসত্তা সংশ্লিষ্ট সাহিত্য সঙ্গীত উপযুক্ত মর্যাদায় রাখা দরকার। এসব করা গেলে দেশের সন্তানরা সুস্থ জীবনবোধ নিয়ে বড় হওয়ার সুযোগ পাবে। বিকৃত রুচির, বিকৃত মানসিকতার ধর্ষক হবে না, লুটেরা হবে না, দুর্বৃত্ত হবে না। সুস্থ জীবনবোধ ও গঠনমূলক চিন্তা-ভাবনাসম্পন্ন মানুষ হবে।
\পাঁচ\
এখন একটি বহুল প্রচারিত দৈনিকেও দেখি, ঈদকে তারা ইসলাম বর্জিত অনুষ্ঠান হিসেবে দেখতে মুসলমানদের অভ্যস্ত করতে চাইছেন।
কবি কাজী নজরুল ইসলামের কাছে ঈদ কোনো ইসলাম বর্জিত উৎসব ছিল না। তিনি স্মরণ রাখতেন যে, ঈদ একটা উৎসব ঠিকই; কিন্তু এটা ইসলামেরই একটা উৎসব। তিনি বলতেন যে, তিনি আল্লাহর বান্দা এবং নবীর উম্মত; কিন্তু তিনি কবি সব সমাজের মানুষের। তবে তার জীবন ও সৃষ্টির তারিখ তথ্য কালানুক্রমিকভাবে সাজিয়ে খুব স্পষ্টভাবেই উপলব্ধি করা যায় যে, মুসলমান সমাজের ইতিহাস ঐতিহ্য ও ইসলামী সংস্কৃতির পরম্পরা এবং এই পরম্পরাভিত্তিক মুসলিম জাতিসত্তা ছিল তার আশ্রয়। তিনি চাইতেন যে, ইসলামী জীবন ব্যবস্থা মুসলমানদের যথার্থই আশ্রয় এবং নিরাপত্তা দিক। কিন্তু তার সময়ে মুসলমান সমাজ কোনো সুসংবদ্ধ সমাজ হিসেবে গড়ে ওঠেনি। আর সাতচিল্লশের মধ্য আগস্টের বিভাজনের পর এখন তো বিভিন্ন (পলেটিক্যাল) পার্টি সমাজে বিভক্ত মুসলমান সমাজ পুরোপুরি একটা সমাজহীন সমাজ। সমস্যাটা একটু গভীরভাবে দেখার দিকে মনোযোগ দিই।
\ছয়\
কলকাতার আনন্দবাজার পত্রিকা লিমিটেডের ২রা ফেব্রুয়ারি ২০১৭ তারিখের ‘দেশ’ পত্রিকায় ১৯২ পৃষ্ঠায় জানুয়ারি-মার্চ ২০১৭’র ‘বইয়ের দেশ’-এর একটা বিজ্ঞাপন ছাপা হয়েছে। সেখানে দেখছি, ‘দেশ’ পত্রিকার সম্পাদক হর্ষ দত্তর সঙ্গে সাক্ষাৎকারে বাংলাদেশের স্বনামধন্য অধ্যাপক গোলাম মুরশিদ সাহেব বলেছেন :
প্রথম থেকে শেষ পর্যন্ত নিজেকে আমি একজন মানুষ হিসেবে দেখতে চাই। দেখিও। এর বাইরে আমার আরও একটা পরিচয় আছে- বাংলা আমার মাতৃভাষা এবং সেই মুবাদে আমি ‘বাঙালি’। কোনো রাষ্ট্রীয় অথবা রাজনৈতিক পরিচয় দিয়ে আমি চি‎িহ্নত হতে চাই না।’
যে কোনো মানুষের যে কোনো মত প্রকাশের অধিকারকে আমি শ্রদ্ধা করি, সম্মান করি। অধ্যাপক গোলাম মুরশিদ সাহেবের এই মত প্রকাশের অধিকারকে আমি সম্মান করি এবং শ্রদ্ধা করি। এখানে একটা লক্ষণীয় বিষয় উল্লেখ করার প্রয়োজনে আমি তার বক্তব্যের উদ্ধৃতি পেশ করেছি। একজন অধ্যাপক রাজনৈতিক পরিচয় দিয়ে চিহ্নিত হতে চান না, সেটা নিঃসন্দেহেই খুবই ভালো কথা। ‘রাষ্ট্রীয়’ ‘পরিচয় দিয়ে’ ‘চিহ্নিত হতে’ চান না, এরও কোনো গভীর জ্ঞান-গম্যিপ্রসূত কারণ থাকতেই পারে। তিনি যে শেষ পর্যন্ত নিজেকে একজন মানুষ হিসেবে দেখতে চান এটা খুবই প্রয়োজনীয় কথা।
তবে তার এই ‘মানুষ’ পরিচয় ছাড়াও তার আরো একটা পরিচয়ের কথা উল্লেখ করেছেন। সেটা ‘বাঙালি’ পরিচয়। এই উল্লেখের মধ্য দিয়ে স্পষ্টতই তিনি তার মুসলিম পরিচয়টা অস্বীকার করেছেন। তার এই ‘বাঙালি’ পরিচয়ের মধ্যে ইসলাম বিবর্জিত একটি সাংস্কৃতিক দিক আছে। এই বিষয়টিই এ ক্ষেত্রে স্পষ্টতই লক্ষণীয়।
বিশেষ করে বহুল প্রচারিত দৈনিক কাগজ ‘প্রথম আলো’-‘যুগান্তর’ এসব পড়ে স্পষ্টতই ধারণা হয় যে, অধ্যাপক গোলাম মুরশিদ সাহেবের মতো জীবন বোধসম্পন্ন মানুষ, অধ্যাপক গোলাম মুরশিদ সাহেবের মতো দৃষ্টিভঙ্গিসম্পন্ন মানুষ আমাদের শিক্ষাঙ্গনের, সাহিত্যাঙ্গনের, সংস্কৃতিকাঙ্গনের, সাংবাদিকতার আঙ্গিনার এবং রাজনৈতিকাঙ্গনের প্রতিষ্ঠিত ও প্রভাবশালী ব্যক্তিদের মধ্যে অনেক আছেন। ইসলামবিরোধী কোন কোনো ইস্যুতে দৈনিক কাগজে প্রায়ই এদের বক্তব্য এবং বিবৃতি দেখা যায়। এরা বেড়ে উঠেছেন ১৯৪৭-এর ১৪ আগস্টের পর প্রতিষ্ঠিত অনুশীলন সমিতির সভ্য মনি সিংহের নেতৃত্বাধীন পূর্ব পাকিস্তান কমিউনিস্ট পার্টি অনুশীলন সমিতির সভ্যদের ও যুগান্তর দলের সভ্যদের প্রভাবে এবং অনুশীলন সমিতির সভ্য মহারাজ ত্রৈলোক্যনাথ চক্রবর্তীর নেতৃত্বাধীন পূর্ব পাকিস্তান সোস্যালিস্ট পার্টি অনুশীলন সমিতির সভ্যদের ও যুগান্তর দলের সভ্যদের প্রভাবে। এরা কি দুটো ঈদকে ইসলামের দুটো উৎসব হিসেবে দেখেন? ইসলামে বিশ্বাসী মানুষদের এসবই খুব গভীরভাবে ভেবে দেখে আত্মসমালোচনা করার আছে।
যদি কেউ ১৯৪৭-এর মধ্য আগস্টের আগের পুরনো পত্র-পত্রিকা দেখেন তাহলে তিনি উপলব্ধি করতে পারবেন যে, ১৯৪৭-এর ১৪ আগস্টে ভারতীয় উপমহাদেশের দশ শতাংশ জায়গায় সমাজহীন মুসলিম সমাজের জন্য সাময়িকভাবে একটা মুসলিম প্রধান দেশ যদি সৃষ্টি না হতো তাহলে ভাষাভিত্তিক জাতীয়তাবাদী আন্দোলনে এবং ধর্মনিরপেক্ষতার আন্দোলনে এই মুসলিম প্রধান দেশের মুসলমান ঘরের সন্তানদের মাতিয়ে মুসলমান সমাজের ইতিহাস ঐতিহ্য ও ইসলামী সংস্কৃতির পরম্পরা এবং এই পরম্পরাভিত্তিক মুসলিম জাতিসত্তা থেকে সরিয়ে নিয়ে যাওয়া সম্ভব হতো না। অন্তত প্রতিটি ঈদের পর ঈদ সম্মেলনের আয়োজন করে মুসলমানদের এসব বিষয়ে খুব খোলাখুলি আলোচনা করা উচিত। এটা একটা অপরিহার্য প্রয়োজন।
লেখক : নজরুল গবেষক, ইতিহাসবিদ।



 

Show all comments
  • এন এইচ মাসুম ১২ এপ্রিল, ২০১৮, ১০:২২ এএম says : 0
    অসাধারন লিখেছেন। আপনার এই লেখা আমাকে দারুন অনুপ্রেরণা যুগিয়েছে।
    Total Reply(0) Reply

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

আরও পড়ুন