Inqilab Logo

বৃহস্পতিবার, ২৮ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০, ১৭ রমজান ১৪৪৫ হিজরী

বর্ষা মৌসুমে মা মাছের ডিম ছাড়ায় সর্বত্র বাধাগ্রস্ত বৃহত্তর খুলনাঞ্চলে দেশীয় মাছের অস্তিত্ব সংকটাপন্ন

| প্রকাশের সময় : ২ জুলাই, ২০১৭, ১২:০০ এএম

বাজার দখল চাষের পাঙ্গাস, কৈ, তেলাপিয়া আর সামুদ্রিক মাছে
আবু হেনা মুক্তি : মৎস্য প্রজনেনর অভয়ারণ্য বলে খ্যাত বৃহত্তর খুলনাঞ্চলে মাছের বাজারে আগুন। মিঠা পানির মাছ যেন বাজার থেকে উধাও। খোদ সুন্দরবনের নদ নদী ও খালে মাছ ধরা এখন নানাভাবে নিয়ন্ত্রিত করা হয়েছে। সুন্দরবনাঞ্চলে মাছ ধরাকে নিরুৎসাহিত করা হচ্ছে। বর্ষা মৌসুমে মা মাছের ডিম ছাড়ায় সর্বত্র বাধাগ্রস্ত হচ্ছে। এ অবস্থা প্রায় একযুগের। অনেক মৎস্য চাষী ঘেরে লোকসান গুনে পেশা পরিবর্তন করে এখন রবি ফসলের দিকে ঝুকেছে। শহরে বন্দরে উচ্চ মূল্যে তাও মাছ কেনা সম্ভব। কিন্তু গ্রামাঞ্চলে পয়সা দিলেও এখন মাছ মিলছে না। জনসংখ্যা বৃদ্ধির কারণে গ্রামে সেই আগের মত পুকুর আর দীঘি নেই। খাল আর বিলগুলো কৃত্রিমভাবে নিয়ন্ত্রন করছে এক শ্রেনীর গুটি কয়েক ম্যাসেল ম্যানেরা। তারপর পুজিপতিদের লবন পানি তুলে মাছ চাষের প্রবনতা বৃদ্ধি পেয়েছে। আর নদ নদীতে এখন প্রচন্ড লবন। লবনের বিষে জর্জরিত গোটা উপকুলীয়াঞ্চল। এছাড়া জলবায়ুর পরিবর্তন, প্রাকৃতিক দুর্যোগ, অসচেতনতা, অবাধে লবণ পানি তুলে বাগদা চিংড়ি চাষ, ফসলের ক্ষেতে ক্ষতিকর কীটনাশক ও রাসায়নিক সারের যথেচ্ছা ব্যবহার এবং মিঠাপানির অভাবে মৎসখনি খ্যাত খুলনাঞ্চলে ৫৫ প্রজাতির মিঠাপানির দেশীয় মাছের অস্তিত্ব বিলীন হতে চলেছে। সুস্বাদু দেশীয় মাছ এখন আর তেমন মিলছে না। বাজারে যদি বিদেশী ক্রস ও কার্প জাতীয় মাছ না থাকতো তাহলে আমিষের চাহিদা মিটানো সম্ভবপর ছিলোনা। শহর বন্দর গ্রামে গঞ্জে সর্বত্রই দেশীয় মাছের চরম সংকট। যা পাওয়া যায় তাও তার অগ্নিমূল্য। বাজার দখল করে আছে চাষের পাঙ্গাস, কৈ, তেলাপিয়া আর সামুদ্রিক মাছ।
মৎস্য বিভাগের সাথে সংশ্লিষ্ট বিশেষজ্ঞরা বলছেন, গত একযুগে মৎস্য সেক্টরকে আধুনিক রিমডেলিং করা হয়নি। মান্ধাতা আমালের প্রকল্পগুলো নিয়ে চলছে হরিলুট। পারস্পারিক সম্পর্কিত এক বিভাগ অন্য বিভাগকে দায়ী করে অনেক প্রকল্প সফলভাবে বাস্তবায়ন হয়নি। আধুনিক কোন মহাপরিকল্পনা বিগত সরকার যেমন গ্রহণ করেনি আর বর্তমানেও এ সেক্টরে বাস্তবভিত্তিক প্রকল্পর সংখ্যা নিতান্তই অপ্রতুল। সঠিক পরিকল্পনা গ্রহণ ও বাস্তবায়নের অভাবে অতি গুরুত্বপূর্ণ সম্ভাবনাময় এ খাতটি এখন বিপর্যয়ের মুখোমুখি। গত ৪টি অর্থবছরে মৎস্য অধিদপ্তর ও কিছু দেশীয় এনজিও ঋন, ক্ষুদ্র প্রকল্প গ্রহণ, প্রশিক্ষন সহ কিছু কর্মসূচী হাতে নিলেও তা প্রয়োজনের তুলনায় নগন্য। তবে ইলিশ প্রজনন ধরা ও বিপননের জন্য সরকার বেশ কঠোর অবস্থান নিয়েছে। যার সুফল পাওয়া যাচ্ছে। মৎস্য বিজ্ঞানীদের মতে কয়েক দশক পুর্বেও এ অঞ্চলে আড়াইশত প্রজাতির মিঠাপানির মাছ ছিল। কিন্তু মনুষ্যসৃষ্ট নানা প্রতিবন্ধকতার কারণে এসব মাছের অনেক প্রজাতি এখন চোখে পড়ে না। তাছাড়া বর্ষা মৌসুমের সময় নদী-খাল-বিল থেকে কারেন্ট জালের মাধ্যমে ব্যাপকহারে ডিমওয়ালা মাছ ধরার কারণে দেশীয় মিঠা পানির বিভিন্ন প্রজাতির মাছের অস্তিত্ব বিলীন হয়ে যাচ্ছে। তৃনমুল পর্যায়ে সব অব্যবস্থাপনাকে মোকাবেলা করা সম্ভব হচ্ছে না। তাই মিঠা পানির মাছগুলো এখন ধীরে ধীরে ধীরে অস্তিত্ব শুন্য হয়ে পড়ছে।
সূত্রমতে, খুলনা বাগেরহাট ও সাতক্ষীরা জেলায় দু’দশক পূর্বে প্রায় আড়াইশ প্রজাতির মিঠা পানির মাছের অস্তিত্বের কথা স্বীকার করেছেন মৎস্য অধিদপ্তর। এ অঞ্চলের খুলনার রূপসা, তেরখাদা, দিঘলিয়া, বটিয়াঘাটা, ডুমুরিয়া, পাইকগাছা, কয়রা, ফুলতলা, বাগেরহাটের ফকিরহাট, রামপাল, চিতল মারী, মোল্লাহাট এবং সাতক্ষীরার তালা, কলারোয়া, দেবহাটা, আশাশুনি, কালীগঞ্জ ও খুলনাঞ্চলের সন্নিকটস্থ উপক‚লীয় অঞ্চলে প্রায় আড়াইশ’ প্রজাতির মিঠাপানির মাছ পাওয়া যেত। যার মধ্যে শোল, টাকি, কৈ, গজাল, টেংরা, চিতল, শিং, খয়রা, বাটা, পাইশ্যা, কালিবাউশ, বাইল্যা, কাজলি, সরপুটি, পাবদা, খৈলশা, ডগরি, জাবা, ভোলা, বাগাড়, বাশপাতা, ভাঙ্গান, কাইন, খল­া, দেশী পুটি, গোদা চিংড়িসহ ৫৫ প্রজাতির মিঠাপানির মাছ এখন বিলুপ্তির পথে। এ সকল মাছ স্বাদে ও পুষ্টি গুনে ছিল ভরপুর। এ অঞ্চলের গ্রামে-গঞ্জের কয়েকশ’ বিল, খাল নদী থেকে এসকল মাছ সংগ্রহ করতো জেলে স¤প্রদায়। সারা বছর তারা মৎস শিকার করে নিজ পরিবারের চাহিদাপূরণ সহ জীবিকা নির্বাহ করত। শুষ্ক মৌসুমে খাল বিল হাওরের পানি কমে গেলে চলত মাছ ধরার উৎসব। দেশের দূর দূরান্তের বাজার সমূহে খুলনাঞ্চল থেকে বিপুল পরিমান মাছ সরবরাহ করা হত। কিন্তু এখন খুলনাঞ্চলে চট্রগ্রাম কক্সবাজার থেকে মাছ এনে চাহিদা পূরন করা হয়। সামুদ্রিক মাছ আসছে দেদারসে ।
প্রতি বছর বর্ষা কালের আগে বৈশাখ জৈষ্ঠ থেকে খালে বিল নদীতে মাছ ডিম্ব নিঃস্বরন শুরু করে। কারেন্ট জালের ব্যাপকতায় খাল, বিল নদীতে এ মাছের রেনু ধরা পড়ে মাছের প্রজনন প্রচন্ডভাবে বাধাগ্রস্ত হচ্ছে। জালে ধরা পড়ে নষ্ট হচ্ছে হাজার হাজার রেনু মাছ। পরিবেশ ও মৎস বিজ্ঞানীদের মতে খুলনাঞ্চলে মৎস প্রজাতি বিলুপ্তির কারন হচ্ছে, অপরিকল্পিততভাবে জলাধারে বাধ দেয়ায় ভরা বর্ষা মৌসুমে ডিম ছাড়ার মা মাছ আসতে বাঁধা পায়। মাছের স্বাভাবিক চলাচলে বাঁধা তদুপরি খাল, বিলগুলো ক্রমান্বয়ে ভরাট হয়ে যাওয়ায় প্রতিনিয়ত মাছের প্রজনন ক্ষেত্র সংকুচিত হয়ে আসার কারণে মাছের বংশ বৃদ্ধি বাধাপ্রাপ্ত হচ্ছে। তাছাড়া বিভিন্ন কারণে পানি দুষণ জলাশয়ের গভীররা হ্রাস, ছোট মাছ ধরার জন্য কারেন্ট জালের ব্যবহারের কারণেও মাছে প্রজাতি ধ্বংস হচ্ছে। অথচ এক সময় ভৈরবে পাওয়া যেত ৫ থেকে ৬ কেজি ওজনের বোয়াল ও আইড় মাছ। এমন কোন মাছ ছিল না যা এ অঞ্চলের বিল ডাকাতিয়া অথবা নলামারা, বাইশোর বিলে পাওয়া যেতনা। নলামারা বিলে ১০-১২ কেজি ওজনের কালিবাউশ মাছ তারা জাল দিয়ে ধরেছেন পর্যন্ত। বাইল­া, ডগরা, কাজলি, ভাঙ্গান, ভোলা প্রভৃতি মাছ তারা খাওয়ার অযোগ্য মনে করে ধরার পর ফেলে দিতেন। আর এখন মাছের আকাল।



 

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

আরও পড়ুন
এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ
গত​ ৭ দিনের সর্বাধিক পঠিত সংবাদ