Inqilab Logo

শনিবার, ২০ এপ্রিল ২০২৪, ০৭ বৈশাখ ১৪৩১, ১০ শাওয়াল ১৪৪৫ হিজরী

জটে স্থবির চট্টগ্রাম বন্দর

| প্রকাশের সময় : ২০ জুলাই, ২০১৭, ১২:০০ এএম

জাহাজের অলসকাল বেড়েই চলেছে : রফতানি ব্যাহত- বিপুল অঙ্কের ক্ষতি সিসিটির অচলদশা, যন্ত্রপাতির সঙ্কট ও গিয়ারলেস জাহাজের আধিক্য
বিশেষ সংবাদদাতা, চট্টগ্রাম ব্যুরো : চট্টগ্রাম বন্দরে আরো জটিল আকার ধারণ করেছে কন্টেইনার ও জাহাজের জট। অব্যাহত জটে স্থবির হয়ে পড়েছে বন্দরের স্বাভাবিক কার্যক্রম। আমদানি-রফতানি পণ্যসামগ্রী উঠানামার জন্য খালি জায়গা অবশিষ্ট নেই কোথাও। গতকাল (বুধবার) পর্যন্ত বহির্নোঙরে সারি সারি কন্টেইনারবাহী জাহাজের অলস অপেক্ষাকাল ক্রমাগত বেড়েই চলেছে। জাহাজের পরিচালন ব্যয়ও বেড়ে গেছে। বিদেশি অপারেটররা চট্টগ্রাম বন্দরের রুটে জাহাজ পারিচালনার ক্ষেত্রে কনজেশন সারচার্জ আরোপ করেছে। বন্দরজটের সুরাহা শিগগিরই হওয়ার আশা দেখা যাচ্ছে না। গত মঙ্গলবার নৌ পরিবহন মন্ত্রণালয়ের অনুষ্ঠিত বৈঠকে হতাশার চিত্র এবং ব্যবসায়ী নেতা ও রফতানিকারকদের তীব্র ক্ষো-অসন্তোষ ব্যক্ত করা হয় বিদ্যমান জটের অবনতিতে। এদিকে বন্দরজটের কারণে রফতানি ব্যাহত হচ্ছে। বিশেষত গার্মেন্টস খাত পড়েছে মারাত্মক সঙ্কটে। সব মিলিয়ে বিভিন্ন সেক্টরে বিপুল অঙ্কের লোকসান হচ্ছে। এর পেছনে গত ২৫ জুন বিদেশী জাহাজের আঘাতে সিসিটির জেটিতে দু’টি ভারী ও অত্যাবশ্যকীয় কী গ্যান্ট্রি ক্রেন বিধ্বস্ত হয়ে টার্মিনালের অচলদশা, বন্দরে যন্ত্রপাতির তীব্র সঙ্কট ও গিয়ারলেস (ক্রেনবিহীন) জাহাজ আগমনের আধিক্য, সামগ্রিকভাবে বন্দর-সংশ্লিষ্টদের সমন্বয়হীনতা, চরম অদক্ষতা-অব্যবস্থাপনা, সিদ্ধান্তহীনতা, গত ঈদ থেকে চলে আসা পণ্য খালাসে কতিপয় আমদানিকারকের অব্যাহত গড়িমসি, মাঝেমধ্যে বৈরী আবহাওয়া, বেসরকারি আইসিডির অব্যবস্থাপনা দায়ী বলে মনে করেন পোর্ট-শিপিংখাতের অভিজ্ঞজনেরা।
তারা আরও বলেছেন, দেশের প্রধান এই সমুদ্র বন্দরে কন্টেইনার হ্যান্ডলিং হয়েছে সর্বশেষ ২০১৬-১৭ অর্থবছরে ২৪ লাখ ১৯ হাজার টিইইউএস। এক্ষেত্রে বার্ষিক প্রবৃদ্ধির হার ১২ থেকে সাড়ে ১৫ শতাংশ করে হচ্ছে গত দশ বছরের পরিসংখ্যনে। শিপিং পরিবহনে কন্টেইনারে নির্ভরতা ক্রমাগত বেড়েই যাচ্ছে। অথচ চট্টগ্রাম বন্দরে অত্যাবশ্যকীয় ভারী যান্ত্রিক সরঞ্জাম এবং কন্টেইনার টার্মিনালসহ অবকাঠামো প্রকৃত চাহিদার তুলনায় সীমিত হয়ে পড়েছে। কিন্তু নৌ পরিবহন মন্ত্রণালয়ের অদূরদর্শিতা, যখন-তখন বন্দর ব্যবস্থাপনায় মাত্রাতিরিক্ত হস্তক্ষেপ এবং সর্বোপরি বন্দরে কতিপয় অদক্ষ কর্মকর্তার কারণে ও ভিশনের অভাবে বন্দরের সুষম উন্নয়ন মুখ থুবড়ে পড়েছে। এ অবস্থা অব্যাহত থাকলে বন্দর আরও ভয়াবহ জটের কবলে পড়ে অচলাবস্থার দিকে ধাবিত হতে পারে বলে তাদের আশঙ্কা।
এদিকে চট্টগ্রাম বন্দরে অব্যাহত কন্টেইনার ও জাহাজের জটের কারণে গত প্রায় দুই মাস ধরে জাহাজের অলস অপেক্ষাকাল বেড়েই চলেছে। এসব জাহাজকে ফিক্সড অপারেটিং কস্ট বাবদ প্রতিদিন ৬ থেকে ১২ হাজার ডলার হারে ডেমারেজ বা লোকসান দিতে হচ্ছে। আর বন্দরের সক্ষমতা ও দক্ষতার সবক’টি সূচক নি¤œগামী হচ্ছে। জটে আটকে পড়া প্রতিটি জাহাজকে জেটি-বার্থে ভিড়ার জন্য ১২-১৩ দিন পর্যন্ত। এখন দৈনিক গড়ে ১৫টি জাহাজ বন্দরের বহির্নোঙরে অলস অপেক্ষায় বসে থাকে। অথচ জটবিহীন স্বাভাবিক অবস্থায় গড়ে এক থেকে দুই দিন থাকার কথা নয়। জেটি-বার্থে ভিড়ার জন্য সিডিউল না পেয়ে এলোমেলো হয়ে যাচ্ছে সবক’টি কন্টেইনার জাহাজের বার্থিং সিডিউল। আর রফতানিকারকরা পণ্য শিপমেন্ট করতে গিয়ে দিনের পর দিন অপেক্ষা করতে হচ্ছে। এ কারণে রফতানি অর্ডার বাতিল কিংবা স্টক লট হওয়ার আশঙ্কা দেখা দিয়েছে।
একই সাথে বন্দরের ইয়ার্ডসমূহে জমে গেছে কন্টেইনারের পাহাড়। কন্টেইনারের স্বাভাবিক ধারণক্ষমতা হচ্ছে ৩৬ হাজার ৩৫৭টি। অথচ বন্দরে কন্টেইনারের জমে আছে প্রায় ৪০ হাজার ৩শ। স্বচ্ছন্দে পণ্য হ্যান্ডলিংয়ের জন্য আদর্শ বন্দর ব্যবস্থাপনার নিয়মে যেখানে অন্তত ৩০ শতাংশ জায়গা সবসময়ই খালি থাকা এবং তা আঙ্কটাড বিধিতেও পূর্বশর্ত হিসেবে গণ্য। সেখানে ছাড়িয়ে গেছে কন্টেইনার ধারণক্ষমতা। বন্দরে জাহাজ ও পণ্য তথা কন্টেইনার জটের কারণে সার্বিক উৎপাদনশীলতা হ্রাস পাচ্ছে।
চট্টগ্রাম বন্দরে ভারী যান্ত্রিক সরঞ্জামের সঙ্কটকে প্রকট করে তুলেছে। সময়োচিত ও দূরদর্শী পদক্ষেপের অভাবে চট্টগ্রাম বন্দর যন্ত্রপাতির সংকটে ধুকছে। যান্ত্রিক সঙ্কটের সুবাদে দুর্নীতিবাজরা ঘুষ, বকশিশ, স্পিডমানির আদায় করছে যথেচ্ছ হারে। সময়োচিত পদক্ষেপ নেয়া হলে বন্দরে ভারী যান্ত্রিক সরঞ্জামের ঘাটতি হতো না। বন্দরে অত্যাধুনিক ভারী যান্ত্রিক সরঞ্জাম (ইকুইপমেন্টস) সংগ্রহ বার বার জটিলতায় আটকে যাচ্ছে। বন্দর কর্তৃপক্ষের (চবক) নিজস্ব তহবিল থেকে অর্থায়নে ১১শ’ ২০ কোটি টাকা ব্যয়ে ৬১ ধরনের অত্যাধুনিক ভারী যন্ত্রপাতি কেনার উদ্যোগ নেয়া হয়েছিল। এরমধ্যে ১০টি কী গ্যান্ট্রি ক্রেন ছাড়াও আছে রাবার টায়ারড গ্যান্ট্রি (আরটিজি) ক্রেন, স্ট্র্যাডল ক্যারিয়ার, রীচ স্ট্র্যাকার, কন্টেইনার মোভার, রেল মাউন্টেড গ্যান্ট্রি ক্রেন। এর সবগুলোই কন্টেইনার হ্যান্ডলিংয়ের উপযোগী ভারী যন্ত্রপাতি। দীর্ঘ এক যুগ পর চট্টগ্রাম বন্দরে এসব সরঞ্জাম সংগ্রহের উদ্যোগ নেয়া হলেও ডাইরেক্ট প্রকিউরমেন্ট পদ্ধতিতে, উন্মুক্ত টেন্ডারে কোন প্রক্রিয়ায় কেনা হবে তা নিয়ে চলে আসছে টানাপোড়েন। তবে বন্দর কর্তৃপক্ষ জানায়, আগামী ৩ মাসের মধ্যে বন্দরে ২শ’ ৫০ কোটি টাকার যান্ত্রিক সরঞ্জাম এসে যাবে। আর রফতানিকারকররা বলছেন, এই তিন মাসে বন্দরে জটের পরিস্থিতি আরও ভয়াবহ আকার ধারণ করবে।



 

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

ঘটনাপ্রবাহ: চট্টগ্রাম


আরও
আরও পড়ুন
এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ
গত​ ৭ দিনের সর্বাধিক পঠিত সংবাদ