Inqilab Logo

শনিবার, ২৭ এপ্রিল ২০২৪, ১৪ বৈশাখ ১৪৩১, ১৭ শাওয়াল ১৪৪৫ হিজরী

চট্টগ্রামকে রক্ষায় রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত গ্রহণের তাগিদ

| প্রকাশের সময় : ২৬ জুলাই, ২০১৭, ১২:০০ এএম

পানিবদ্ধতা পাহাড় ধস মানবসৃষ্ট বিপর্যয়
চট্টগ্রাম ব্যুরো : পানিবদ্ধতা ও পাহাড় ধসে গণমৃত্যুকে মানবসৃষ্ট বিপর্যয় উল্লেখ করে বিশেষজ্ঞরা চট্টগ্রামকে রক্ষায় দ্রুত রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত গ্রহণের তাগিদ দিয়েছেন। তারা বলেন, কয়েক ঘন্টার ভারী বর্ষন আর প্রবল সামুদ্রিক জোয়ারে ডুবছে দেশের বাণিজ্যিক রাজধানী চট্টগ্রাম। একদিনের প্লাবনে শত শত কোটি টাকার সম্পদ বিনষ্ট হচ্ছে। বিপর্যস্ত হচ্ছে জনজীবন। পাহাড় ধসে বেঘোরে প্রাণহানীর ঘটনা ঘটছে প্রতিনিয়ত। দিনে দিনে পরিস্থিতি ভয়াবহ হচ্ছে। তাই জাতীয় স্বার্থে চট্টগ্রামকে সচল রাখতে তড়িৎ সিদ্ধান্ত গ্রহণ করতে হবে। তারা এই ক্ষেত্রে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সরাসরি হস্তক্ষেপও কামনা করেন। চট্টগ্রামকে দেশের অর্থনীতির মূলচালিকা শক্তি উল্লেখ করে তারা বলেন, চট্টগ্রামের এ বিপর্যয় মোকাবেলায় প্রয়োজনে মেগাপ্রকল্প গ্রহণ করতে হবে।
প্রকৌশলীদের সংগঠন ইঞ্জিনিয়ার্স ইনস্টিটিউশন, বাংলাদেশ (আইইবি) চট্টগ্রাম কেন্দ্র আয়োজিত ‘জলাবদ্ধতা ও পাহাড় ধস’ বিষয়ক এক সেমিনারে বিশেষজ্ঞরা এ আহবান জানান। সোমবার রাতে আইইবি চট্টগ্রাম কেন্দ্রে অনুষ্টিত সেমিনারে প্রকৌশলীরা বলেন, ১৯৯৫ সালে প্রণীত ড্রেনেজ মাষ্টারপ্ল্যান বাস্তবায়ন না হওয়ায় চট্টগ্রাম নগরী বৃষ্টি আর জোয়ারের পানিতে ডুবছে। মাষ্টারপ্ল্যানে মহানগরীর খাল, নালা, প্রাকৃতিক ছরা উদ্ধারসহ বড় বড় খালের মুখে জোয়ারের পানি আটকাতে ¯øুইস গেইট বসানোর কথা ছিল। পাহাড় থেকে নেমে আসে পানির সাথে বালির আস্তরণ ঠেকাতে পাহাড়ের পাদদেশে বালির ফাঁদ বসানোর পরিকল্পনাও ছিল। কিন্তু বিশ বছরেও ওই মাস্টারপ্ল্যান বাস্তবায়ন হয়নি।
মহানগরীর প্রাকৃতিক খাল নালা বেদখল হয়ে গেছে। অপরিকল্পিত নগরায়নের ফলে বাস অযোগ্য হয়ে পড়ছে মহানগরী। নির্বিচারে পাহাড় কেটে উজাড় করা হচ্ছে। রাজনৈতিক সিদ্ধান্তহীনতায় পরিবেশ প্রকৃতি ও নগরবিধংসী এই তান্ডবের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তোলা যায়নি। রাজনৈতিক ও প্রশাসনিক ব্যর্থতার ভারে এখন ডুবছে চট্টগ্রাম মহানগরী। সেই সাথে ডুবছে দেশের সামগ্রিক ব্যবসা-বাণিজ্য, আমদানি-রফতানি ও দেশি-বিদেশী বিনিয়োগের সম্ভাবনাও। এই প্রেক্ষাপটে বিশেষজ্ঞরা ভয়াবহ এ বিপর্যয় রোধে ড্রেনেজ মাস্টারপ্ল্যান রিভিউ করে তা দ্রæত বাস্তবায়নের তাগিদ দেন। পাহাড় সুরক্ষায় ২০০৭ সালে প্রনীত জেনারেল মতিন কমিশনের সুপারিশ বাস্তবায়ন না হওয়ায় পাহাড় ধসে মৃত্যু ঠেকানো যাচ্ছে না উল্লেখ করে তারা পাহাড় ধস ঠেকাতে এই মুহুর্তে বৃহত্তর চট্টগ্রামে পাহাড় কাটা বন্ধ করার কার্যকর উদ্যোগ নিতে বলেন।
সেমিনারে পানিবদ্ধতা ও পাহাড় ধস বিষয়ে দুটি মূল প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন চট্টগ্রাম প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের (চুয়েট) সাবেক ভিসি অধ্যাপক ড. প্রকৌশলী মোহাম্মদ জাহাঙ্গীর আলম। মহানগরীর পানিবদ্ধতা প্রসঙ্গে তিনি বলেন, প্রবল বর্ষণের সময় পাহাড় থেকে নেমে আসা পানি দ্রুত সরতে না পারায় নগরী প্লাবিত হচ্ছে। আর সেই সময় জোয়ার থাকলে ভয়াবহ পানিবদ্ধতার সৃষ্টি হচ্ছে। খাল নালা বেদখল হয়ে যাওয়ায় এবং পাহাড় থেকে ঢলের সাথে নেমে আসা পানির সাথে বালি ও কাদা জমে পানি নিস্কাশন ব্যবস্থা আরও সংকুচিত হচ্ছে। অন্যদিকে জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে জোয়ারের তীব্রতা বাড়ছে। ফলে বৃষ্টি আর জোয়ারে চট্টগ্রাম তলিয়ে যাচ্ছে। তিনি বলেন, চট্টগ্রাম মহানগরীতে বৃষ্টির পানি কর্ণফুলী নদীতে যাবে এর কোন বিকল্প নেই। দ্রুত খাল নিষ্কাশনের জন্য খাল নালা উদ্ধার করে তা সংস্কার করতে হবে।
পানিবদ্ধতা ও জোয়ারের প্লাবন থেকে পরিত্রাণ পেতে ১৯৯৫ সালে প্রনীত ড্রেনেজ মাস্টারপ্ল্যানের আলোকে নগরীর খাল, নালা ও ছরা দখলমুক্ত করার পাশাপাশি জোয়ারের পানি ঠেকাতে বড় বড় খালের মুখে সøুইস গেইট বসাতে হবে। তিনি বলেন বেদখল খাল নালা উদ্ধারে এখনই ক্রাশ পোগ্রাম নিতে হবে। অবৈধ স্থাপনা গুড়িয়ে দিতে হবে। আর এ জন্য দরকার রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত। রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত নিতে পারলে এই সংকট দ্রুত সমাধান করা সম্ভব বলেও মন্তব্য করেন তিনি। মাষ্টারপ্ল্যানের মেয়াদ ২০১৫ সালে শেষ হয়ে গেলেও এখন এটিকে রিভিউ করে বাস্তবায়নের সুযোগগ আছে জানিয়ে তিনি বলেন, খাল নালা উদ্ধার আর জোয়ার ঠেকাতে খালের মুখে ¯øুইস গেইট বসানো ছাড়া পানিবদ্ধতা থেকে মুক্তির আর কোন বিকল্প নেই। তাই এটি বাস্তবায়ন করতে প্রচুর অর্থের প্রয়োজন হলেও তা করতে হবে। কারণ একদিনের বৃষ্টিতেই চট্টগ্রামে শত শত কোটি টাকা সম্পদ বিনষ্ট হচ্ছে। পানিবদ্ধতা সমস্যা কেটে গেল চট্টগ্রাম জাতীয় অর্থনীতিতে আরও বেশি ভূমিকা রাখতে পারবে।
পাহাড় সুরক্ষায় অবৈধ স্থাপনা উচ্ছেদ করে পাহাড়ে বিদ্যুৎ কেন্দ্র স্থাপন করার পরামর্শ দেন প্রফেসর জাহাঙ্গীর আলম। বিশ্বের কয়েকটি দেশের উদাহারণ টেনে তিনি বলেন, পাহাড়ে মিনি হাইড্রো পাওয়ার প্ল্যান্ট ও সৌর বিদ্যুৎ প্রকল্প বসিয়ে ২৫ হাজার মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদন সম্ভব। এই প্রকল্পে পাহাড়ের আশপাশের বাসিন্দাদের সম্পৃক্ত করা হলে তারাই এর অংশিদার হবে। এতে করে পাহড় সুরক্ষা যেমন হবে তেমনি পাহাড় নিধনও বন্ধ হবে। জেনারেল মতিন কমিশনের সুপারিশ উল্লেখ করে তিনি বলেন, পাহাড় ধসের পর পাহাড়ের মালিক ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানকে এর দায় নিতে এ সুপারিশ বাস্তবায়ন হলেও পাহাড় নিধন বন্ধ করা যাবে। তিনি বলেন, সরকারি বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের পাহাড় বেদখল হয়ে গেছে। সিডিএ, সিটি কর্পোরেশন ও পুলিশের জানামতে পাহাড় কাটা চলছে। অথচ এসব সংস্থা নির্বিকার। এ অবস্থা অবসান না হলে চট্টগ্রামকে বড় ধরনের বিপর্যয় থেকে রক্ষা করা যাবে না।
সেমিনারে প্রধান অতিথি সিটি মেয়র আ জ ম নাছির উদ্দীন বলেন, চট্টগ্রামকে পানিবদ্ধতার সংকট থেকে উদ্ধার করতে কর্পোরেশন সাধ্যমত প্রচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। বেশকিছু প্রকল্প নেয়া হয়েছে উল্লেখ করে তিনি বলেন, এসব প্রকল্প বাস্তবায়নের জন্য যে অর্থের প্রয়োজন তা সরকারকেই বরাদ্দ দিতে হবে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এ ব্যাপারে আন্তরিক উল্লেখ করে তিনি বলেন, আশা করি এসব প্রকল্প বাস্তবায়ন করা হলে এ সংকট কেটে যাবে।
সেমিনারে সম্মানিত অতিথি ছিলেন মোহাম্মদ নুরুল ইসলাম। প্যানেল আলোচক ছিলেন আইইবি চট্টগ্রাম কেন্দ্রের প্রাক্তন চেয়ারম্যান প্রকৌশলী এম. আলী আশরাফ, প্রকৌশলী মো: দেলোয়ার হোসেন ও প্রকৌশলী মোহাম্মদ হারুন। বক্তব্য রাখেন চসিকের প্রধান প্রকৌশলী লে. কর্ণেল মহিউদ্দিন আহমেদ ও সাবেক প্রধান প্রকৌশলী এম আই খান। আয়োজকরা জানান, সেমিনারে গৃহীত প্রস্তাবনার কপি কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণের জন্য প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বরাবর প্রেরণ করা হবে। চট্টগ্রামের পানিবদ্ধতা ও পাহাড় ধস রোধে তড়িৎ উদ্যোগ গ্রহণ করতে রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ ও সুশীল সমাজের সাথেও মতবিনিময় করবে প্রকৌশলীদের সংগঠন আইইবি।



 

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

ঘটনাপ্রবাহ: চট্টগ্রাম

৩০ জানুয়ারি, ২০২৩

আরও
আরও পড়ুন
এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ
গত​ ৭ দিনের সর্বাধিক পঠিত সংবাদ