Inqilab Logo

শুক্রবার, ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ০৬ বৈশাখ ১৪৩১, ০৯ শাওয়াল ১৪৪৫ হিজরী

বাণিজ্যিক নগরে বিপর্যস্ত বাণিজ্য

| প্রকাশের সময় : ২৬ জুলাই, ২০১৭, ১২:০০ এএম

খাতুনগঞ্জ আগ্রাবাদে ৫শ’ কোটি টাকার ক্ষয়ক্ষতি : কাদা-পানি বালি আবর্জনায় সয়লাব : সর্বত্র জনদুর্ভোগ চরমে
শফিউল আলম : বন্দরনগরী চট্টগ্রামকে বলা হয় প্রাচ্যের রাণী আর বাণিজ্যিক রাজধানী। সেই পরিচয় বিলুপ্ত হয়ে যেতে বসেছে কিনা? এটাই এ মুহূর্তে ৬০ লাখ নগরবাসীর প্রশ্ন আর উদ্বেগ-উৎকণ্ঠার সাথে ব্যাপক আলোচনা-পঃম হবংি ৫-২৫-০৭-১৭সমালোচনার বিষয়ে পরিণত হয়েছে। সামুদ্রিক জোয়ার-ভাটার সময়সূচি এবং আকাশের দিকে তাকিয়ে বৃষ্টি-বাদলের মতিগতি রুটিন হিসেবে ধরে নিয়ে জীবনযাত্রা চলছে লাখ লাখ মানুষের। সেভাবেই যার যার বাড়িঘর, ব্যবসা-বাণিজ্য প্রতিষ্ঠান, দোকান-পাট, কল-কারখানা, অফিস-আদালত, ব্যাংক-বীমা, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, মসজিদ’ হাসপাতালসহ সর্বত্র আসা-যাওয়ার ‘নিয়ম’ হয়ে গেছে। এমনকি বিয়ে-শাদিসহ সামাজিক অনুষ্ঠানেও পড়েছে তার বিরূপ প্রভাব। গরীব দিনমজুরদের জীবন-জীবিকা থমকে যাচ্ছে যখন নগরের বড় একটি অংশ ডুব-ভাসি করছে প্রায়ই। বৈরী প্রকৃতির পাশাপাশি অপরিণামদর্শী মানবসৃষ্ট দুর্যোগের পরিণতিতে চট্টগ্রাম মহানগরী বার বার ডুবছে। ভরা বর্ষায় শুধুই নয়, প্রাক-বর্ষায় এবং বর্ষা মওসুমের পরেও নিয়মিত প্লাবিত হচ্ছে নগরীর বিশাল এলাকা। চট্টগ্রামের ব্যাপকাংশ জোয়ার ও বর্ষণে তলিয়ে যাওয়ার মাত্রা গত ৩-৪ বছর যাবত ক্রমশ আশঙ্কাজনক পর্যায়ের দিকেই ধাবিত হচ্ছে। এ নিয়ে তীব্র ক্ষোভ-অসন্তোষ আর হতাশার ব্যক্ত করেছেন চট্টগ্রামের সর্বস্তরের ব্যবসায়ী-শিল্পোদ্যোক্তারা। তবে মারাত্মক পানিবদ্ধতার সঙ্কট থেকে মুক্তির আপাতত কোন পথ দেখছেন না চট্টগ্রামবাসী। বরং দিন দিন সমস্যা আরো ঘনীভূত হচ্ছে।
গতকালসহ (মঙ্গলবার) টানা তিন দিনের বর্ষণের সাথে অমাবস্যার বর্ধিত প্রভাবে সামুদ্রিক প্রবল জোয়ারের চাপ যোগ হয়ে হাঁটু থেকে কোমর সমান পানিতে ডুবেছে বিস্তীর্ণ এলাকা। এখনও অনেক জায়গায় পানিবদ্ধতায় অবর্ণনীয় দুর্ভোগে দিনাতিপাত করছেন লাখো নগরবাসী। গত তিন দিনে বন্দরনগরী চট্টগ্রামের ব্যবসা-বাণিজ্যে বিপর্যয় নেমে এসেছে। যা বলতে গেলে লালবাতি জ্বলার উপক্রম। এরইমধ্যে ব্যবসায়ী সংগঠনগুলোর প্রাথমিক হিসাবে নগরীর দেড়শত বছরের ঐতিহ্যবাহী দেশের প্রধান পাইকারি ও ইন্ডেন্টিং বাজার চাক্তাই, খাতুনগঞ্জ, আছদগঞ্জ এবং প্রধান বাণিজ্যিক এলাকা আগ্রাবাদ ও হালিশহরে এ যাবত কমপক্ষে ৫শ’ কোটি টাকার সমপরিমান আর্থিক ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে। খাতুনগঞ্জ ট্রেড অ্যান্ড ইন্ডাষ্ট্রিজ অ্যাসোসিয়েশনের সাধারণ সম্পাদক সৈয়দ ছগীর আহমদ এবং চিটাগাং চেম্বারের পরিচালক মাহফুজুল হক শাহ ইনকিলাবকে জানান, ২৬ বছর আগে ১৯৯১ সালের ২৯ এপ্রিলে সংঘটিত শতাব্দীর প্রলয়ংকরী ঘূর্ণিঝড় ও জলোচ্ছ¡াসের সময়ও যেসব পাইকারি দোকান-পাট ও গুদামে পানি ঢুকেনি এবার গত তিন দিনে সেগুলো পর্যন্ত কোমর এমনকি বুক সমান পানিতে ডুবে গেছে।
খাতুনগঞ্জ, আছদগঞ্জে প্রায় ২ হাজার দোকান ও গুদাম রয়েছে। এরমধ্যে গতকাল পর্যন্ত জোয়ার ও বর্ষণের পানির তোড়ে প্রায় ৯০ শতাংশই প্লাবিত হয়েছে। এখনও ডুবে আছে অধিকাংশ দোকান-পাট গুদাম। আমদানিকৃত বিভিন্ন ধরনের নিত্যপণ্য, খাদ্য ও ভোগ্যপণ্য যেমন- চিনি, চাল, ডাল, গম, আটা-ময়দা, ভোজ্যতেল, পেঁয়াজ, রসুন, মসলা, মরিচ, আদা, ছোলা, ঢেউটিন, স্টিল সামগ্রী, শুটকি প্রভৃতির বলতে গেলে ধ্বংসলীলা হয়ে গেলো। চাক্তাই খাল উপচিয়ে এতই দ্রæতবেগে জোয়ারের পানিতে দোকান ও গুদামগুলো ডুবে যায় যে, মালামাল সরানোর কোন উপায়ই ছিল না ব্যবসায়ীদের কাছে। চোখের সামনে চোখের পানিতেই যেন সবই ভিজে ডুবে বিনষ্ট হয়ে গেলো। অথচ খাতুনগঞ্জ থেকে প্রতিবছর প্রায় দেড় হাজার কোটি টাকার রাজস্ব যোগান যায় সরকারের কোষাগারে। একইভাবে আগ্রবাদ এক্সেস রোডের প্রায় ৫-৬শ’ দোকান-পাট গুদাম আড়ত জোয়ার ও অতিবর্ষণে প্লাবিত হয়। চাক্তাই খাতুনগঞ্জ আছদগঞ্জ ও আগ্রাবাদের ক্ষতিগ্রস্ত ব্যবসায়ীরা এখন দিশেহারা। চট্টগ্রামের প্রবীণ বনেদী শিল্পোদ্যোক্তা চিটাগাং চেম্বারের সাবেক সভাপতি মীর্জা আবু মনসুর জানান, পরিকল্পিতভাবে ব্যবসা-বাণিজ্য ও শিল্প-বিনিয়োগের বান্ধব করে চট্টগ্রামকে গড়ে তোলা হয়নি। সময়ের প্রয়োজনে নীতিনির্ধারকদের তা করাই উচিৎ ছিল। পরিতাপের সাথে তিনি বলেন, চাটগাঁর ‘নাভি’ হিসেবে আগ্রাবাদ এবং বাংলার ‘ওয়ালস্ট্রিট’ ও ‘সওদাগরী বাণিজ্য পাড়া’ হিসেবে চাক্তাই খাতুনগঞ্জ আছদগঞ্জ নিয়ে আমরা এককালে গর্ব করতে পারতাম। অনাদরে-অবহেলায় যা এখন হারিয়ে যেতে বসেছে। পরিত্যক্ত হতে চলেছে ব্যবসা-বাণিজ্যের এই ‘আদর্শ স্থান’। সুষ্ঠু পরিকল্পনা ও সমন্বয় নিয়েই পানিবদ্ধতা নিরসন করে ব্যবসা-বাণিজ্যকে জাতীয় স্বার্থে গতিশীল রাখতে হবে।
পানিবন্দী চট্টগ্রাম : জনদুর্ভোগ
গতকাল সকাল পৌনে ৯টায় দিনের পালায় প্রথম সামুদ্রিক জোয়ার শুরু হয়। সেই সাথে টানা ভারী বর্ষণ ও পাহাড়ি ঢল অব্যাহত থাকে। এতে করে সমগ্র চট্টগ্রামে ব্যাপক পানিবদ্ধতায় জনজীবন হয়ে পড়ে বিপর্যস্ত। গতকাল সকাল ৬টা পর্যন্ত ২৪ ঘণ্টায় পতেঙ্গা আবহাওয়া অফিস ২২৩ মিলিমিটার বৃষ্টিপাত রেকর্ড করে। যা সারাদেশের সর্বোচ্চ বর্ষণ। তবে দিনভর থেমে থেমে কম বর্ষণ থাকায় সন্ধ্যা পর্যন্ত বৃষ্টিপাত ছিল ২৯ মিমি। বৃষ্টিপাত আগের দু’দিনের তুলনায় কম থাকলেও আগের বর্ষণজনিত ঢল এবং সেই সাথে জোয়ারের পানি যোগ হয়ে বন্দরনগরীর উপকূলবর্তী ও নিম্নাঞ্চল এবং বৃহত্তর চট্টগ্রামের অনেক এলাকা হাঁটু থেকে কোমর সমান পানিতে তলিয়ে যায়। পানিবন্দী রয়েছে এখনও লাখো মানুষ। আগামী ২ দিনেও মাঝারি থেকে ভারী বর্ষণ অব্যাহত থাকার পূর্বাভাস দেয়া হয়েছে। জোয়ার ও বৃষ্টিতে অফিস, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ও বিভিন্ন কর্মস্থলমুখী অগণিত মানুষের ভোগান্তির শেষ নেই। আগ্রাবাদ হালিশহরে জোয়ার ও বর্ষণে প্লাবিত সড়ক রাস্তাঘাট পাড়ি দিতে গিয়ে কর্মস্থলমুখী অগণিত মানুষের কষ্ট-দূর্গতির যেন শেষ নেই।
এদিকে অব্যাহত অতিবর্ষণে উজানের ঢলের তোড়ে দেশের দক্ষিণ-পূর্ব পার্বত্য অববাহিকায় (চট্টগ্রাম অঞ্চল) নদ-নদী ও শাখা-উপনদী, খালসমূহের পানি ক্রমাগতভাবে বৃদ্ধি পাচ্ছে। খরস্রোতা দক্ষিণ চট্টগ্রামের সাঙ্গু নদী দোহাজারী পয়েন্টে গতকাল সকালে বিপদসীমার ২০ সেন্টিমিটার উপরে গিয়ে বিকেল নাগাদ ফের ১০ সেমি নিচে নেমে আসে। শেষ খবর পাওয়া পর্যন্ত মাতামুহুরী নদী পার্বত্য বান্দরবানের লামা পয়েন্টে সকালে বিপদসীমার উপরে গেলেও বিকেল নাগাদ ৩৬ সেমি নিচে নেমে গেছে। তবে কক্সবাজারের চিরিঙ্গা পয়েন্টে আরও বেড়ে গিয়ে বিপদসীমার ১১৩ সেমি উপরে প্রবাহিত হচ্ছিল। কাপ্তাই বাঁধের পানির চাপ কমাতে স্পিলওয়ে দিয়ে অতিরিক্ত পানি ছাড়ার কারণে কর্ণফুলী নদীর পানির চাপ বেড়ে গেছে ভাটিতে। এরফলে অনেক এলাকা প্লাবিত হচ্ছে। বিকেলে কর্ণফুলী চট্টগ্রাম পয়েন্টে ভাটিতে বিপদসীমার ৪১ সেমি উপর দিয়ে প্রবাহিত হয়। জোয়ার ও বর্ষণে চট্টগ্রামের ব্যবসা-বাণিজ্য, বন্দর কার্যক্রম, পণ্য পরিবহন, যোগাযোগ ব্যবস্থা স্থবির হয়ে পড়ে টানা তিন দিন। পশ্চিমবঙ্গে বিরাজমান সুস্পষ্ট লঘুচাপ এবং সক্রিয় মৌসুমি বায়ু উত্তর বঙ্গোপসাগরে জোরালো অবস্থায় থাকার কারণে সাগর উত্তাল রয়েছে। সমুদ্র বন্দরসমূহকে ৩নং সতর্ক সঙ্কেত এবং চট্টগ্রামের পাহাড়ি এলাকায় ভূমিধসের সতর্কতা জারি রাখা হয়েছে। চট্টগ্রাম জেলা প্রশাসন দুর্যোগকালীন কন্ট্রোল রুম চালু করেছে। চট্টগ্রাম জেলা প্রশাসক মোঃ জিল্লুর রহমান চৌধুরী পাহাড় ধস, জোয়ার, বন্যাসহ যে কোন সম্ভাব্য দুর্যোগের ঝুঁকি এড়ানোর জন্য চট্টগ্রামবাসীকে ফের সতর্ক করে দিয়ে নিরাপদ স্থানে থাকার পরামর্শ দেন।
ভারী বর্ষণের সাথে পাহাড়ি ঢলে চট্টগ্রাম জেলার মীরসরাই, ফটিকছড়ি, হাটহাজারী, রাউজান, রাঙ্গুনিয়া, সীতাকুন্ড, সাতকানিয়া, বাঁশখালীসহ বিভিন্ন স্থানে ব্যাপক এলাকা প্লাবিত হয়েছে। বন্দরনগরী ও চট্টগ্রাম জেলার পাহাড়ি এলাকাগুলোতে বিরাজ করছে পাহাড়-টিলা ধসের আতঙ্ক। তবে এখনও সতর্কবাণী উপেক্ষা করে বৃহত্তর চট্টগ্রামে বর্ষণে পাহাড় ধসের ঝুঁকি নিয়েই বসবাস করছে লাখ লাখ মানুষ। শেষ খবর পাওয়া পর্যন্ত বৃহত্তর চট্টগ্রামের আকাশ ছিল ঘনঘোর মেঘে ঢাকা। থেমে থেমে হালকা কিংবা মাঝারি কোথাও ভারী বর্ষণ এবং পাহাড়ি ঢল, জোয়ারও অব্যাহত থাকে। গতকাল রাতের পালায় দ্বিতীয় দফায় জোয়ারের সময় (৯টা ২০ মিনিট) কি পরিস্থিতি দাঁড়ায় এ নিয়ে চট্টগ্রাম মহানগরীর পানিবন্দী বিভিন্ন এলাকার অগণিত মানুষের মাঝে বিরাজ করছে সীমাহীন উৎকণ্ঠা-দুশ্চিন্তা। হাজার হাজার মানুষ এখনও নিজেদের বসতঘর দোকান-পাট শো-রুম ও গুদামের কাদা-পানি ময়লা-আবর্জনা অপসারণ করতে গিয়ে গলদঘর্ম হচ্ছেন। আগের দুই দিনের পানিবদ্ধতা না কাটতেই গতকাল তৃতীয় দিনের মতো বৃষ্টি ও জোয়ারে প্লাবিত বিভিন্ন এলাকার মধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে- আগ্রাবাদ, হালিশহর, পতেঙ্গা, সাগরিকা, চান্দগাঁও, বাকলিয়া, চাক্তাই খাতুনগঞ্জ, আছাদগঞ্জ, রাজাখালী, মিয়াখান নগর, বহদ্দারহাট, কাপ্তাই মোড়, মোহরা, শোলকবহর, চকবাজার, কাতালগঞ্জ। গতকাল বৃষ্টিপাত তুলনামূলক কম থাকলেও এসব এলাকায় জোয়ার ও আগের আটকে থাকা পানি জনজীবনে দুর্ভোগ সৃষ্টি করেছে।



 

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

ঘটনাপ্রবাহ: বন্যা

১৫ অক্টোবর, ২০২২

আরও
আরও পড়ুন
এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ
গত​ ৭ দিনের সর্বাধিক পঠিত সংবাদ