Inqilab Logo

বুধবার, ১৭ এপ্রিল ২০২৪, ০৪ বৈশাখ ১৪৩১, ০৭ শাওয়াল ১৪৪৫ হিজরী

ওবায়দুল কাদের প্রধান বিচারপতির বাসায় : উদ্বিগ্ন মির্জা ফখরুল

| প্রকাশের সময় : ১৪ আগস্ট, ২০১৭, ১২:০০ এএম

স্টাফ রিপোর্টার : সংবিধানের ষোড়শ সংশোধনী বাতিলের রায়ে আপিল বিভাগের পর্যবেক্ষণ নিয়ে তোলপাড় চলছে। আইনজীবীরা পাল্টাপাল্টি কর্মসূচি দিয়েছেন; সরকার রায়ের কিছু শব্দের এক্সপাঞ্জের দাবির পাশাপাশি আইনিভাবে মোকাবেলার ঘোষণা দিয়েছে। মন্ত্রীরা প্রধান বিচারপতি এস কে সিনহার বিরুদ্ধে নিত্যদিন বক্তৃতা দিচ্ছেন; এমনকি ইতিহাস বিকৃতির অভিযোগ তুলে প্রধান বিচারপতির পদত্যাগ দাবি করছেন। অন্যদিকে দেশের সংবিধান বিশেষজ্ঞরা রায়কে ঐতিহাসিক এবং যুগান্তকারী হিসেবে অবিহিত করছেন। এ ছাড়াও মাঠের বিরোধী দল হিসেবে পরিচিত বিএনপি রায়ের মাধ্যমে সরকারের ভিত নড়ে গেছে অভিযোগ তুলে মাঠ গরম করছে। কিন্তু প্রধান বিচারপতি রায় নিয়ে উভয় পক্ষকে রাজনীতি না করার অনুরোধ জানিয়ে বলেছেন, ‘আমরা কারো ফাঁদে পা দেবো না। এই যখন অবস্থা, তখন আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের প্রধান বিচারপতি এস কে সিনহার বাসায় গিয়ে তাঁর সঙ্গে বৈঠক করেছেন। সেখানে প্রধান বিচারপতির কাছে রায় নিয়ে আওয়ামী লীগের অবস্থান তুলে ধরেছেন। এ খবর মিডিয়ায় প্রকাশের পর উদ্বেগ প্রকাশ করে বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেছেন, মাননীয় প্রধান বিচারপতির সঙ্গে মন্ত্রী ওবায়দুল কাদেরের বৈঠকে আমরা শঙ্কিত, বিএনপি উদ্বিগ্ন। এর আগে ৬ আগস্ট প্রধান বিচারপতি সুরেন্দ্র কুমার সিনহার সঙ্গে দেখা করেন আওয়ামী লীগের প্রেসিডিয়াম সদস্য সাবেক আইনমন্ত্রী আবদুল মতিন খসরু, সাবেক আইনমন্ত্রী ব্যারিস্টার শফিক আহমেদ ও আওয়ামী লীগের উপদেষ্টা মন্ডলীর সদস্য সিনিয়র আইনজীবী অ্যাডভোকেট ইউসূফ হোসেন হুমায়ুন।
পারিবারিক অনুষ্ঠান হিসেবে প্রধান বিচারপতি এস কে সিনহার কাকরাইলের বাসায় গত শনিবার নৈশভোজের আয়োজন করা হয়। পারিবারিক ওই অনুষ্ঠানে অন্যান্যের মধ্যে ওবায়দুল কাদের অংশ নেন। প্রধান বিচারপতি নৈশভোজ আপাতদৃষ্টিতে সামাজিক অনুষ্ঠান মনে হলেও এর রাজনৈতিক গুরুত্ব পায় ওবায়দুল কাদেরের উপস্থিতি। বিশেষ করে ষোড়শ সংশোধনীর রায় নিয়ে যখন তোলপাড়, তখন প্রধান বিচারপতির নৈশভোজে ক্ষমতাসীন দলের দ্বিতীয় গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তির উপস্থিতি খুবই তাৎপর্যপূর্ণ। আওয়ামী লীগের এই নেতা ওই নৈশভোজে যাওয়ার আগে বিষয়টি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে অবহিত করেন। তবে প্রধান বিচারপতির সঙ্গে আওয়ামী লীগের গুরুত্বপূর্ণ ওই নেতার কী কী বিষয়ে আলোচনা হয়েছে, তার বিস্তারিত জানা যায়নি। তবে সড়ক ও সেতু মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র তথ্য কর্মকর্তা আবু নাসের সাংবাদিকদের জানান, প্রধান বিচারপতির বাসভবনে সড়ক যোগাযোগ ও সেতু মন্ত্রীর এই সাক্ষাতে ষোড়শ সংশোধনী বাতিল রায়ের পর্যবেক্ষণের বিষয়ে আলোচনা হয়েছে। সরকারি কর্মকর্তা মন্ত্রী ওবায়দুল কাদেরকে উদ্ধৃত করে বলেন, উনার (মন্ত্রী) সাথে মাননীয় প্রধান বিচারপতির দেখা হয়েছে, সাক্ষাৎ হয়েছে। রায়ের অবজারভেশনে যেসব বিষয় এসেছে, সেসব বিষয়ে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের যে বক্তব্য, তা তিনি তুলে ধরেছেন। উনি (মন্ত্রী) বলেছেন, আলোচনা আরো হবে।
জানা গেছে, শনিবার রাত ৮টা থেকে ১০টা পর্যন্ত অত্যন্ত আন্তরিক পরিবেশে একান্তে আলাপ করেন প্রধান বিচারপতি এস কে সিনহা ও ওবায়দুল কাদের। এ সময় প্রধান বিচারপতি আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদেরকে জানান, ষোড়শ সংশোধনী বাতিলের রায়ে তিনি কোথাও বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান এবং জাতীয় সংসদকে অসম্মান করে কোনো বক্তব্য-মন্তব্য লেখেননি। যারা এগুলো বলছেন, তারা পূর্ণাঙ্গ রায় না পড়ে কয়েকটা লাইন পড়েই সমালোচনা করছেন। এ ছাড়া তিনি আলাপকালে আইনমন্ত্রী আনিসুল হক এবং আইন সচিবের বিভিন্ন কর্মকান্ডে নিজের ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়ার কথা জানান। আলোচনায় আইন কমিশনের চেয়ারম্যান বিচারপতি খায়রুল হকের প্রতিক্রিয়া জানানোর বিষয়টিও স্থান পায়। অন্যদিকে আপিল বিভাগের পূর্ণাঙ্গ রায়ের পর্যবেক্ষণে কিছু বিষয় নিয়ে ওবায়দুল কাদের আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীদের ক্ষোভের বিষয়টি প্রধান বিচারপতির দৃষ্টিতে আনেন। রায়ের পর্যবেক্ষণের আপত্তিকর অংশগুলো প্রত্যাহারের জন্যও প্রধান বিচারপতির সঙ্গে আলোচনা করেছেন আওয়ামী লীগের এই নেতা বলে জানা যায়। ৭৯৯ পৃষ্ঠার দীর্ঘ এ রায়ের কিছু অংশ দেখে সুযোগসন্ধানীরা সুযোগ নিতে পারে বলেও প্রধান বিচারপতিকে জানিয়েছেন তিনি।
হাইকোর্টের বিচারকদের অপসারণের ক্ষমতা সংসদের হাতে ফিরিয়ে নিতে সংবিধানের ৯৬ অনুচ্ছেদের যে পরিবর্তন ষোড়শ সংশোধনীতে আনা হয়েছিল; তা ‘অবৈধ’ ঘোষণার বাতিল করে দেয় হাইকোর্ট। গত পহেলা আগস্ট আপিল বিভাগের পূর্ণাঙ্গ রায় প্রকাশ করা হয়। ওই রায়ের পর্যবেক্ষণে দেশের রাজনীতি, সামরিক শাসন, নির্বাচন কমিশন, দুর্নীতি, মুক্তিযুদ্ধে নেতৃত্ব, সংসদ, সুশাসন ও বিচার বিভাগের স্বাধীনতাসহ বিভিন্ন বিষয়ে সমালোচনা করে সার্বিক চিত্র তুলে ধরা হয়। ওই রায় প্রকাশের পর থেকেই অভিনন্দন এবং বাদ-প্রতিবাদ চলছে। রায়ে সংক্ষুব্ধ হয়ে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ প্রধান বিচারপতির কড়া সমালোচনা করলেও দেশের সংবিধান বিশেষজ্ঞ, সুশীলসমাজ ও বিএনপি একে বলছে ‘ঐতিহাসিক’।
রায় নিয়ে সুপ্রিম কোর্ট আইনজীবী সমিতি গত সপ্তাহে সংবাদ সম্মেলন আয়োজন করলে সেখানে আওয়ামী লীগ ও বিএনপিপন্থী আইনজীবীদের মধ্যে তুমুল হট্টগোলের ঘটনা ঘটে। সাবেক প্রধান বিচারপতি বর্তমানে আইন কমিশনের চেয়ারম্যান এ বি এম খায়রুল হক সরকারি চাকরিবিধি লঙ্ঘন করে সংবাদ সম্মেলনে এই রায়কে ‘পূর্ব ধারণাপ্রসূত’ এবং প্রধান বিচারপতি এস কে সিনহার পর্যবেক্ষণকে ‘অপরিপক্ব’ আখ্যায়িত করেন। একই সঙ্গে তিনি বিচারপতিদের যোগ্যতা নিয়েও প্রশ্ন তোলেন। পরদিন আইনমন্ত্রী আনিসুল হক এক সংবাদ সম্মেলনে বলেন, মামলার ‘ফ্যাক্ট অব ইস্যু’ সঙ্গে সম্পর্কিত নয় এমন ‘অনেক অপ্রাসঙ্গিক কথা’ প্রধান বিচারপতি তার রায়ে বলেছেন বলে অভিযোগ তোলেন। তিনি রায়ে ইতিহাস বিকৃতির অভিযোগ তুলে প্রধান বিচারপতির অগ্রহণযোগ্য (আইনমন্ত্রীর ভাষায়) বক্তব্য এক্সপাঞ্জ করার উদ্যোগ নেয়া এবং আইনি-প্রক্রিয়ার মাধ্যমে মোকাবেলার কথাও বলেন। তবে রায় নিয়ে অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিতের ঐদ্ধত্যপূর্ণ বক্তব্য ‘আদালত যতবার ষোড়শ সংশোধনী বাতিল করবে, আমরা ততবার সংসদে বিল পাস করব। আমরা বিচারপতিদের চাকরি দেই। তারা সংসদের উপর পোদ্দারি করবে’কে বাচালতা অবিহিত করে উড়িয়ে দেন সকল পক্ষই।
চাকরি বিধি লঙ্ঘন করে সংবাদ সম্মেলনে প্রধান বিচারপতির সমালোচনা করায় আইন কমিশনের চেয়ারম্যান সাবেক প্রধান বিচারপতি খায়রুল হকের অপসারণের দাবিতে জাতীয়তাবাদী আইনজীবী ফোরাম তিন দিনের কর্মসূচি দিয়েছে। অন্যদিকে ষোড়শ সংশোধনী বাতিলের রায়ে প্রধান বিচারপতির অপ্রাসঙ্গিক বক্তব্য, পর্যবেক্ষণের প্রতিবাদ এবং তা প্রত্যাহারের দাবিতে কর্মসূচি দিয়েছে আওয়ামী লীগ সমর্থক আইনজীবীদের সংগঠন বঙ্গবন্ধু আওয়ামী আইনজীবী পরিষদ।
প্রধান বিচারপতির বাসায় আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদেরের যাওয়া এবং বৈঠকের ঘটনায় উদ্বেগ প্রকাশ করে বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেছেন, পত্রিকার নিউজে দেখেছি, আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের প্রধান বিচারপতি সুরেন্দ্র কুমার সিনহার বাসায় গিয়েছেন। এতে আমরা উদ্বিগ্ন ও শঙ্কিত না হয়ে পারি না। গতকাল নয়াপল্টনে দলের কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে বিএনপি চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়ার রোগমুক্তির জন্য ছাত্রদল আয়োজিত দোয়া মাহফিলে তিনি এই উদ্বেগ প্রকাশ করেন। তিনি অভিযোগের সুরে বলেন, সরকার রায় নিয়ে প্রধান বিচারপতির ওপর ‘চাপ সৃষ্টির চেষ্টা করছে’। আমরা শঙ্কিত হয়ে গেছি পত্রিকার এই খবর দেখে। ওবায়দুল কাদের সাহেব গতকাল শনিবার রাতে প্রধান বিচারপতির কাকরাইলের বাসায় গেছেন। কখন গেছেন? আওয়ামী লীগের ওয়ার্কিং কমিটির মিটিং করে তারপরে তিনি প্রধান বিচারপতির বাসভবনে গেছেন। আমি আরো বিস্মিত হলাম, সেখানে তিনি নৈশভোজ করেছেন।



 

Show all comments
  • সুমন শাহা ১৪ আগস্ট, ২০১৭, ৩:৪৭ এএম says : 0
    বিষয়টি আসলেও উদ্বেগের ...........
    Total Reply(0) Reply
  • এস এম নাসের ১৪ আগস্ট, ২০১৭, ৬:১৭ এএম says : 0
    এ রায় স্বার্থান্নেষী কোন দলের পক্ষে গ্রহনযোগ্য না হলে ও অন্তত দেশের সাধারন জনগনের বাক শক্তি স্বাধীনতার প্রতিফলন ঘটেছে।
    Total Reply(0) Reply
  • farjana ১৪ আগস্ট, ২০১৭, ৯:০৯ এএম says : 0
    আসলে রাজনীতিক person এর chief justice এর বাসায় যাওয়া ঠিক হয়নি বলে আমি মনে করি।
    Total Reply(0) Reply
  • নিজাম ১৪ আগস্ট, ২০১৭, ২:৩০ পিএম says : 0
    ষোড়শ সংশোধনী বাতিলের বিষয়ে আদালতের রায় নিয়ে কিছু মন্ত্রী এমপিদের বক্তব্য আমার কাছে আদালতের অবমাননা মনে হচ্ছে।
    Total Reply(0) Reply
  • Noman ১৪ আগস্ট, ২০১৭, ২:৩১ পিএম says : 0
    Deshe je ki suru holo kisu e bujtesi na
    Total Reply(0) Reply
  • Nazim ১৪ আগস্ট, ২০১৭, ৫:১১ পিএম says : 0
    bisoyti nea khub basi barabari hosse
    Total Reply(0) Reply

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

ঘটনাপ্রবাহ: ষোড়শ সংশোধনী

৫ নভেম্বর, ২০১৭
১৪ সেপ্টেম্বর, ২০১৭

আরও
আরও পড়ুন
এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ
গত​ ৭ দিনের সর্বাধিক পঠিত সংবাদ