Inqilab Logo

শুক্রবার, ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১, ১৬ শাওয়াল ১৪৪৫ হিজরী

পোশাক শিল্পখাতের দুর্দিন

| প্রকাশের সময় : ১৫ আগস্ট, ২০১৭, ১২:০০ এএম

আবুল কাসেম হায়দার : দেশে তৈরি পোশাক শিল্প কর্মসংস্থান সৃষ্টিতে বিগত বেশ কয়েক বছর ধরে র্শীষে রয়েছে। বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনে তৈরি পোশাক শিল্পখাত এখনও প্রথম স্থানে। দেশে কর্মসংস্থান তৈরিতে পোশাক খাত একটা জায়গায় এসে থেমে গেছে। বিশেষ করে, ২০১০ সালের পর থেকে কর্মসংস্থান তৈরির ক্ষেত্রে খাতটি আর আগের মতো ভূমিকা রাখতে পারছে না। অবস্থা বেশি খারাপ হয়েছে ২০১৩ সালের পর থেকে। কর্মসংস্থান তৈরিতে পোশাক খাতের অবদান নিয়ে ১৯৯০ থেকে ২০১৫ পর্যন্ত ২৫ বছরের একটি চিত্র তুলে ধরা হয়েছে সম্প্রতি প্রকাশিত একটি প্রতিবেদনে। তাতে বলা হয়েছে, ২৫ বছর আগে ১৯৯০ সালে পোশাক খাতে কর্মসংস্থান হয় ৫ লাখের মতো লোকের। আর ২০১৫ সালে কর্মসংস্থান হয় ৪০ লাখ লোকের, যার বড় অংশই নারী। তবে এই সময়ে একই গতিতে কর্মসংস্থানের প্রবৃদ্ধি হয়নি। প্রতিবেদনটিতে বলা হয়েছে, ১৯৯০-৯৫ সময়ে কর্মসংস্থান তৈরিতে পোশাক খাতের বার্ষিক প্রবৃদ্ধি ছিল ২৯ দশমিক শূন্য ৭ শতাংশ। কিন্তু পরের পাঁচ বছরে অর্থাৎ ১৯৯৫-২০০০ সময়ে প্রবৃদ্ধি নেমে দাঁড়ায় ৫ দশমিক ৯২ শতাংশে। ২০০০-০৫ সময়ে আরও কমে হয় ৪ দশমিক ৫৬ শতাংশ। তবে ২০০৫-১০ সময়ে এ প্রবৃদ্ধি আবার ঘুরে দাঁড়ায়। এই পাঁচ বছরে বার্ষিক প্রবৃদ্ধি বেড়ে দাঁড়ায় ১১ দশমিক ৫০ শতাংশ। ২০১০ সালের পর থেকে কর্মসংস্থান তৈরিতে পোশাক খাতের বার্ষিক প্রবৃদ্ধি উল্লেখযোগ্য হারে কমে নেমে আসে ১ দশমিক শূন্য ২ শতাংশে।
গ্যাস-বিদ্যুতের সংকটে নতুন কারখানা গড়ে না ওঠাকে পোশাক খাতে কর্মসংস্থান তৈরির প্রবৃদ্ধি কমার অন্যতম কারণ। একদিকে পোশাকের বিশ্ব চাহিদা কমে গেছে, অন্যদিকে কমে গেছে দাম। নতুন কারও পক্ষে কারখানা করে এখন মুনাফা অর্জন সত্যিই কঠিন। ফলে খুবই স্বাভাবিক যে, কর্মসংস্থান তৈরিতে এ খাতের অবদান কমবে এবং আরও কমার শঙ্কা রয়েছে। ১৯৮৪ সালে দেশের মোট রপ্তানি আয়ে পোশাক খাতের অবদান ছিল মাত্র ৩ দশমিক ৮৯ শতাংশ। ছয় বছরের ব্যবধানে ১৯৯০ সালে রপ্তানি আয়ে এ খাতের অবদান বেড়ে দাঁড়ায় ৩২ দশমিক ৪৫ শতাংশ। এরপর ২০ বছরের ব্যবধানে রপ্তানি আয়ে পোশাক খাতের অবদান ২০১০ সালে ৭৫ দশমিক ৬১ শতাংশ এবং ২০১৬ সালে দাঁড়ায় ৮২ দশমিক শূন্য ৫ শতাংশে।
নব্বইয়ের দশকের প্রথম পাঁচ বছরে পোশাক খাতের কর্মসংস্থান প্রবৃদ্ধিটা ভালো হলেও এর পরের ১০ বছরে গতিটা নিম্নমুখী হয়। তবে ২০০৫-২০১০ সময়ে এ গতি আগের ১০ বছরের তুলনায় ঊর্ধ্বমুখীই হয়নি শুধু, প্রায় দ্বিগুণ বেড়ে যায়। গতিটা একটা জায়গায় এসে আটকে যায় ২০১০ সালের পরে এবং সবচেয়ে খারাপ অবস্থা দাঁড়ায় ২০১৩-১৫ সময়ে। পোশাক খাতকে কর্মসংস্থান তৈরির প্রধান উৎস হিসেবে ভাবা হয়, নীতিনির্ধারকেরা নিশ্চয়ই এ খবরে হতাশ হবেন, ২০০৫-১০ সময়ের প্রবৃদ্ধিকে উল্লেখযোগ্য বলে উল্লেখ করা যায়। কারণ, এই সময়টা হচ্ছে ২০০৫ সালে মাল্টি ফাইবার অ্যারেঞ্জমেন্টের (এমএফএ) আওতায় কোটাপ্রথা বাতিল হওয়ার পরের সময়। অনেকের আশঙ্কা কাটিয়ে এই সময়ে পোশাক খাত নিজের অবস্থান বরং আরও পোক্ত করেছে।
জেনারেল অ্যাগ্রিমেন্ট অন ট্যারিফ অ্যান্ড ট্রেডের (গ্যাট) টেক্সটাইল কমিটির অধীনে উন্নয়নশীল দেশগুলোর বাণিজ্য ঘাটতি পূরণে ১৯৭৪ সালে এমএফএ নামে একটা নীতি করা হয়। ১৯৯৫ সালে বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থা (ডবিøউটিও) গঠিত হওয়ার পর নীতিটির মেয়াদ বাড়ে ২০০৫ পর্যন্ত। এই নীতির আওতায় শুল্ক ছাড়সহ উন্নত দেশে পণ্য রপ্তানিতে উন্নয়নশীল দেশগুলোর জন্য কোটা বেঁধে দেওয়া হয়। তখন এই সুযোগটিই কাজে লাগায় বাংলাদেশ।
মূলত সস্তাা শ্রমের সুযোগে দেশের পোশাক খাত যতদূর সম্ভব প্রতিযোগিতাসক্ষম হয়। বলা হয়, ভবিষ্যতে সস্তাা শ্রমের ওপর নির্ভর করে আর এগোনো সম্ভব হবে না। সরকার ঘোষিত ৫০ বিলিয়ন ডলারের (পাঁচ হাজার কোটি ডলার বা চার লাখ কোটি টাকা) রপ্তানি লক্ষ্য পূরণ করতে গেলে তা আরও অসম্ভব হয়ে উঠবে। এ জন্য যে দক্ষ শ্রমশক্তির দরকার পড়বে, তা পাওয়াও একটা বড় চ্যালেঞ্জ।
মুক্তিযোদ্ধা এম নূরুল কাদের (দেশের প্রথম সংস্থাপন সচিব) ১৯৭৭ সালে প্রথম কোরিয়ার দাইয়ু কোম্পানির সঙ্গে যৌথভাবে গড়ে তোলেন রপ্তানিমুখী কারখানা দেশ গার্মেন্টস। দেশ গার্মেন্টসকেই পোশাক খাতের অগ্রগামী উদ্যোগ বলা হয়। পরের বছরই রপ্তানিমুখী কারখানা গড়ে ওঠে ৯টি। বিজিএমই-এর হিসাবে বর্তমানে কারখানা ৪ হাজার ৩২৮টি।
পোশাক খাতে কর্মসংস্থান প্রবৃদ্ধি কমে যাওয়ার আলোচনার সঙ্গে উৎপাদনশীলতার প্রবৃদ্ধিকেও রাখতে হবে। ২৫ বছরের মধ্যে ব্যতিক্রম দেখা গেছে শেষ পাঁচ বছরে (২০১০-১৫)। এই সময়ে উৎপাদনশীলতার প্রবৃদ্ধি বেশি বেড়েছে। এর কারণও আছে। এই সময়ে শ্রমিকদের দক্ষতা বেড়েছে ও কারখানায় উন্নত প্রযুক্তির ব্যবহার বেড়েছে। একজন শ্রমিক ১৯৯৫ সালে উৎপাদন করতে পারতেন ১ হাজার ৮৫৬ ডলারের পণ্য, আর ২০১৫ সালে উৎপাদন করেন ৬ হাজার ৬৭৩ ডলারের পণ্য। কারখানায় আরও উন্নত প্রযুক্তির ব্যবহার বাড়লে কর্মসংস্থান তৈরিতে পোশাক খাতের প্রবৃদ্ধি আরও কমবে।
কী উদ্যোগ নেওয়া প্রয়োজন:
১. কী কারণে তৈরি পোশাক শিল্প খাতের অগ্রগতি থেমে গেলো, তা আমাদের এখন গবেষণার বিষয়। দ্রুত গবেষণা করে কারণ নির্ধারণ করা জরুরি। কারণসমূহ চিহ্নিত করে, দ্রুত ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে। উপরে উল্লেখিত প্রতিবেদনে কিছু কিছু কারণ চিহ্নিত হয়েছে। তবে বিষয়টি আরও বিশদ গবেষণার দাবি রাখে। কারণ এখনই উদ্যোগ না নিলে দেশের অর্থনীতিতে নেতিবাচক প্রভাব পড়া শুরু করবে। দেশের এই খাতের উপর মোট বস্ত্র শিল্পখাত নির্ভরশীল। বস্ত্রখাতে ধস নামলে দেশের পুরো অর্থনীতি হুমকির সম্মুখীন হবে।
২. বিগত ১০ বছর ধরে দেশে তৈরি পোশাক শিল্পের আভ্যন্তরীণ উন্নয়ন, সংস্কার ও সম্প্রসারণ চলেছে। তাতে ছোট ছোট সকল তৈরি পোশাক শিল্প প্রায় বন্ধ হয়ে গেছে। কিছু কিছু বৃহৎ আকারের তৈরি পোশাক শিল্প গড়ে উঠেছে। কিন্তু যে হারে ছোট ছোট তৈরি পোশাক শিল্প বন্ধ হয়েছে, সেই হারে নতুন নতুন তৈরি পোশাক শিল্প প্রতিষ্ঠান গড়ে উঠেনি। কারণ কি? অনেক কারণ রয়েছে। প্রধান কারণ হচ্ছে দেশে গ্যাস, বিদ্যুৎ তথা জ্বালানি স্বল্পতা। জ্বালানি চাহিদা পূরণে সরকার ব্যর্থ। দ্বিতীয় হচ্ছে, এখন বৃহৎ আকারের তৈরি পোশাক শিল্প স্থাপনে অনেক বেশি পুঁজির প্রয়োজন হয়। বেশি পুঁজি সম্পন্ন দক্ষ বিনিয়োগকারীর স্বল্পতা দেশে রয়েছে। বিদেশি বিনিয়োগকারীও তেমন এই খাতে এগিয়ে আসতে পারেনি। তাই চাহিদা অনুযায়ী শিল্প স্থাপন করা সম্ভব হয়নি। এই কারণেও বিনিয়োগ বৃদ্ধি হচ্ছে না। তাই কর্মসংস্থানও বাড়েনি। সেই কারণে প্রবৃদ্ধিও তেমন অর্জন করা সম্ভব হচ্ছে না। তৃতীয় হচ্ছে, দেশের রাজনৈতিক স্থিতিশীলতার অভাব। এ ক্ষেত্রে সুষ্ঠু, নিরপেক্ষ ও অংশগ্রহণমূলক জাতীয় নির্বাচন না হওয়াই বড় কারণ। দ্রুত সুষ্ঠু, নিরপেক্ষ জাতীয় নির্বাচন প্রয়োজন। বিনিয়োগকারীদের জন্য এটি জরুরি।
৩. ‘কমপ্লাইন’ ইস্যুতে দেশে তৈরি পোশাক শিল্প ধাক্কা খেয়েছে। দ্রুত সম্প্রসারণ, অতি বিনিয়োগ এই খাতকে এগিয়ে নিতে তেমন সহযোগিতা করতে পারেনি। ছোট ছোট তৈরি পোশাক শিল্পের উদ্যোক্তগণ পুঁজির অভাবে শিল্প ছেড়ে দিতে বাধ্য হয়েছে। যে সকল উদ্যোক্তা অতিরিক্ত বিনিয়োগ করতে পেরেছেন, তাদের শিল্প ইউনিট ঠিক আছে। সম্প্রসারিত হয়েছে ব্যবসা। কমপ্লাইন ইস্যু যেমন তৈরি পোশাক শিল্পকে মজবুত, দক্ষ ও আধুনিক করেছে। কিন্তু বৃহৎ আকারের নতুন নতুন তৈরি পোশাক শিল্প তেমন গড়ে উঠতে পারেনি। তাই কর্মসংস্থান বৃদ্ধি পায়নি। এই অবস্থার দ্রুত পরিবর্তন হওয়া প্রয়োজন রয়েছে। তা না-হলে ভবিষ্যতে অগ্রগতি থেমে যাবে।
৪. শুধু তৈরি পোশাক শিল্প নয়, সকল শিল্পখাতে গ্যাস, বিদ্যুৎ তথা জ্বালানি স্বল্পতার জন্য বিনিয়োগ আসছে না। বিদেশি বিনিয়োগ এগিয়ে আসতে পারছে না। এই অবস্থার পরিবর্তনের জন্য গ্যাস ও বিদ্যুতের চাহিদা মোতাবেক প্রাপ্তি নিশ্চিত করতে হবে। সরকার বিদ্যুৎ উৎপাদন বৃদ্ধির জন্য নানা উদ্যোগ গ্রহণ করছে। কিছুটা ফলাফলও পাওয়া গিয়েছে। তবে চাহিদা মোতাবেক বিদ্যুতের উৎপাদন বৃদ্ধি এখনো হয়নি। নজর দিতে হবে সেদিকেও।
লেখক: সাবেক সহসভাপতি এফবিসিসিআই, বিটিএমএ, বিজেএমইএ এবং প্রতিষ্ঠাতা চেয়ারম্যান, ইস্টার্ন ইউনিভার্সিটি।



 

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

আরও পড়ুন
গত​ ৭ দিনের সর্বাধিক পঠিত সংবাদ