Inqilab Logo

শনিবার, ২০ এপ্রিল ২০২৪, ০৭ বৈশাখ ১৪৩১, ১০ শাওয়াল ১৪৪৫ হিজরী

খাদ্য সংকট এবং আঞ্চলিক-আন্তর্জাতিক রাজনীতি

| প্রকাশের সময় : ১৬ আগস্ট, ২০১৭, ১২:০০ এএম

জামালউদ্দিন বারী : দেশের খাদ্য নিরাপত্তা সামগ্রিক রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক নিরাপত্তার অন্যতম অনুসঙ্গ। রাষ্ট্রের কোষাগারে বৈদেশিক মূদ্রার রিজার্ভ যতই বাড়ুক, সেনাবাহিনী যতই অত্যাধুনিক সমরাস্ত্রে সজ্জিত হোক, দেশের মানুষকে উপযুক্ত কর্মসংস্থান এবং দু’বেলা খাদ্যের নিশ্চয়তা দেয়া না গেলে রাষ্টীয় ও সামাজিক স্থিতিশীলতা হুমকির মুখে পড়তে বাধ্য। কোন জাতিকে দাবিয়ে রাখার মোক্ষম অস্ত্র হচ্ছে তার খাদ্য ও জ্বালানী নিরাপত্তাকে বিপন্ন করে তোলা। এ ক্ষেত্রে সত্তুরের দশকে পশ্চিমা সাম্রাজ্যবাদের পুরোধা ব্যক্তিত্ব হেনরী কিসিঞ্জারের সেই উক্তিটিকে আবারো স্মরণ করা যেতে পারে, তিনি বলেছিলেন. ‘কন্ট্রোল অয়েল ইউ কন্ট্রোল ন্যাশনস; কন্ট্রোল ফুড অ্যান্ড ইউ কন্ট্রোল দ্য পিপল’। অবশ্য ষাটের দশকের শুরু থেকেই তথাকথিত সবুজ বিপ্লবের মাধ্যমে খাদ্য উৎপাদন ও নিরাপত্তা ব্যবস্থার উপর কর্পোরেট নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠার মধ্য দিয়ে বিশ্বের রাজনৈতিক- অর্থনৈতিক ব্যবস্থার উপর নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠার চক্রান্ত বাস্তবায়িত হতে শুরু করেছিল। মিলিটারী ইন্ডাসট্রিয়াল কমপ্লেক্স, বিশ্ববাণিজ্য সংস্থা, কর্পোরেট এগ্রোবিজনেস এবং ফার্মাসিউটিক্যাল কর্পোরেশন থেকে জলবায়ু পরিবর্তনের ঝুঁকি ও ইনিশিয়েটিভ পর্যন্ত রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক ব্যবস্থার প্রতিটি ধাপেই রয়েছে বিশ্বের সব মানুষের উপর নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠার সাম্রাজ্যবাদী অভিপ্সা। দ্বিতীয় মহাযুদ্ধোত্তর নয়া বিশ্বব্যবস্থায় আভ্যন্তরীণ, আঞ্চলিক ও আন্তর্জাতিক রাজনৈতিক আধিপত্যবাদের কুশীলবরা একেকটি জাতির ঘাড়ে খাদ্যাভাব ও অর্থনৈতিক পরাধীনতার শৃঙ্খল পরিয়ে দেশের স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্বের ধারনাকে অকার্যকর ও খেলো বস্তুতে পরিনত করা হয়েছে। মধ্যপ্রাচ্যের জ্বালানী তেলসমৃদ্ধ দেশগুলোর পর বাংলাদেশের মত ঘনজনবসিতর দেশগুলোই তাদের প্রাথমিক লক্ষ্য। যদিও কর্পোরেট এগ্রো কোম্পানীগুলোর অপতৎপরতা তাদের নেটিভ কান্ট্রি ইউরোপ-আমেরিকা থেকেই শুরু করেছিল। প্রেসিডেন্ট নিক্সনের পররাষ্ট্রমন্ত্রী হেনরি কিসিঞ্জার উন্নয়নশীল দেশগুলোর খাদ্য ঘাটতির সংকটকে পুঁজি করে খাদ্য সহায়তার নামে তাদের উপর প্রভাব বৃদ্ধির কৌশলগত নীতি গ্রহন করেছিলেন। গ্যাট চুক্তির মধ্য দিয়ে মূলত: উন্নয়নশীল দেশগুলোর খাদ্য উৎপাদন, আমদানী-রফতানী ব্যবস্থার উপর পশ্চিমা কর্পোরেট নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করা হয়েছিল। উৎপাদন বৃদ্ধির মূলা ঝুলিয়ে দেশগুলোর খাদ্য উৎপাদনের ট্রাডিশনাল আভ্যন্তরীণ ব্যবস্থাপনাকে ভেঙ্গে দিয়ে সর্বক্ষেত্রে পরনির্ভরশীল করে তোলা এবং খাদ্যবাণিজ্য ও নিরাপত্তাব্যবস্থার উপর মার্কিন কোম্পানীগুলোর অবস্থান নিরঙ্কুশ করতে তারা সম্ভাব্য সব কিছুই করেছে। খাদ্য উৎপাদন বাড়ানোর নামে উচ্চফলনশীল ও নানা ধরনের সুবিধাজনক বীজের তকমা ঝুলিয়ে সারাবিশ্বের কৃষকদের কাছ থেকে বীজের স্বত্ব কেড়ে নেয়া হয়েছে। হাজার হাজার প্রজাতির ইনডিজেনাস কৃষিবীজ কৃষকের হাতছাড়া হয়ে গেছে। গত চার-পাঁচ দশকে বিশ্বের জনসংখ্যা বেড়ে দ্বিগুন হয়েছে। প্রয়োজনের তাগিদে খাদ্য উৎপাদনও দ্বিগুন হয়েছে। সত্তুরের দশকে বাংলাদেশের লোকসংখ্যা ছিল সাত কোটি । চার দশক পর এখন তা’ ১৬কোটিতে পৌছেছে। তবে লক্ষ্যনীয় বিষয় হচ্ছে, যখন বিশ্বের জনসংখ্যা সাড়ে ৩০০ কোটি ছিল তখন যেমন কোটি কোটি মানুষকে অভুক্ত অবস্থায় রাত্রি যাপন করতে হতো। এখন জনসংখ্যা দ্বিগুন হওয়ার সাথে সাথে পাল্লা দিয়ে খাদ্য উৎপাদন বৃদ্ধির পরও প্রায় শতকোটি মানুষকে দিনান্তে অভুক্ত রাত্রিযাপন করতে হচ্ছে। এর বিপরীত চিত্রটিও প্রায় একই রকম। এক সময় খাদ্য রফতানীকারক দেশগুলো খাদ্যমূল্য ঠিক রাখতে লাখ লাখ টন খাদ্যসশ্য নষ্ট করে ফেলতো বলে অভিযোগ আছে, আজো বায়োডিজেল প্রকল্পের নামে বছরে লাখ লাখ টন খাদ্যসশ্য নষ্ট করা হচ্ছে। এখনো ধনী দেশগুলোতে হোটেলে, বাড়ির খাবার টেবিলে প্রতিদিন লাখ লাখ মানুষের খাদ্য অপচয় ও নষ্ট হচ্ছে। অতিভোজনের কারণে ধনী ও শিল্পোন্নত দেশগুলোতে শিশু থেকে বৃদ্ধ পর্যন্ত কোটি কোটি মানুষ অবেসিটি বা মুটিয়ে যাওয়ার শিকার হচ্ছে। এদের বেশীরভাগই হৃদরোগ, ডায়াবেটিসসহ নানা ধরনের রোগ ব্যাধির শিকার হয়ে ধুকে ধুকে বেঁচে থাকতে বাধ্য হচ্ছে। আবার আফ্রিকা, ক্যারিবিয়া, ল্যাটিন আমেরিকা ও এশিয়ার দরিদ্র দেশগুলোতে কোটি কোটি মানুষ খাদ্যাভাব ও পুষ্টিহীনতার শিকার হয়ে পীড়িত জীবন যাপনে বাধ্য হচ্ছে।
যুদ্ধ ও আঞ্চলিক বিরোধের কারণে এই মহুর্তে বিশ্বের অন্তত: ১০টি দেশের অন্তত ২০ কোটি মানুষ মারাত্মক খাদ্যসংকট ও দুর্ভীক্ষের শিকার। বিশ্ব সম্প্রদায় জরুরী উদ্যোগ নিতে ব্যর্থ হলে সিরিয়া, ইয়েমেন, ইরাক, ইথিওপিয়া, উগান্ডা, সোমালিয়ার লাখ লাখ শিশুকে বাঁচিয়ে রাখা অসম্ভব হতে পারে বলে ইতিমধ্যে বিভিন্ন সংস্থার তরফ থেকে আশঙ্কা প্রকাশ করা হয়েছে। তবে গত বছর বিশ্ব খাদ্য ও কৃষি সংস্থা (এফএও)’র এক রিপোর্টে বিশ্বের ৩৪টি দেশ সংকটজনক খাদ্যঘাটতির মধ্যে রয়েছে বলে জানায়। এদের বেশীরভাগই আফ্রিকার দেশ হলেও আমাদের প্রতিবেশী ও সার্কভুক্ত দেশ আফগানিস্তান, নেপাল ও মিয়ানমার এই তালিকায় স্থান পেলেও সেখানে বাংলাদেশের নাম ছিলনা। খাদ্য সংকটের কারণ হিসেবে ২০১৬ সালে বিশ্বের গম উৎপাদন আগের বছরের চেয়ে কমপক্ষে১০ মিলিয়ন টন কম হওয়াকে দায়ী করেছে বিশ্বখাদ্য সংস্থা। চলতি বছর বাকি দুনিয়ার অবস্থা যা’ই হোক, বছরের শুরুতেই বাংলাদেশের খাদ্য(ধান) উৎপাদনে বড় ধরনের বিপর্যয় নেমে এসেছে। ভারত থেকে আসা আকষ্মিক ঢল এবং অতিবৃষ্টিতে হাওরের বাঁধগুলো ভেঙে ও প্লাবিত হয়ে শুধুমাত্র হাওরাঞ্চলেই অন্তত ১০ লাখ টন ধান নষ্ট হয়েছে। দেশের উত্তর ও মধ্যাঞ্চলে প্রথম দফা বন্যায় হাজার হাজার হেক্টর ধানসহ নানা ধরনের ফসল নষ্ট হওয়ার পর এখন আরেকটি বন্যার আশঙ্কা করা হচ্ছে। উপর্যুপরি বন্যায় লাখ লাখ টন খাদ্যসশ্য নষ্ট হয়ে এই মুহুর্তে দেশের খাদ্য নিরাপত্তা চরম ঝুঁকিতে রয়েছে। প্রায় দেড় দশক আগে ২০০২ সালেই বাংলাদেশ সরকার খাদ্যে স্বয়ংসম্পুর্ণতা অর্জনের দাবী করেছিল। এরপর ২০০৭-৮ সালে বাংলাদেশ চরম খাদ্য সংকটের মুখোমুখি হয়। সে সময় হু হু করে বাড়তে থাকে চাল-আটার দাম। সীমান্তবাণিজ্যের মাধ্যমে প্রতিবেশী দেশ ভারত থেকে খাদ্য ও কৃষিপণ্যের ঘাটতি পুরণের দীর্ঘ ঐতিহ্য থাকলে ২০০৭ সালে সেনা সমর্থিত তত্বাবধায়ক সরকারের সাথে ভারতের বিশেষ সুসম্পর্ক থাকা সত্বেও সে সময় কোন পূর্ব ঘোষনা বা আভাস না দিয়ে হঠাৎ করেই বাংলাদেশে খাদ্য রফতানী বন্ধ করে দিয়ে দেশের কোটি কোটি মানুষকে চরম খাদ্য ঝুঁকির মধ্যে ঠেলে দেয়। চালের মূল্যে ক্রমবর্ধমান ঊর্ধ্বগতির সাথে সাধারণ দরিদ্র মানুষের আয়ের সঙ্গতি না থাকায় দেশের বিভিন্ন স্থানে অস্থিতিশীলতা দেখা দেয়ার পাশাপাশি কোথাও কোথাও খাদ্যদাঙ্গা দেখা দেয়। খাদ্যের উর্ধ্বমূল্য সাধারণ মানুষের জন্য দুর্বহ হয়ে পড়ার বাস্তবতাকে পুঁজি করে সে সময় বাংলাদেশের আসন্ন নির্বাচনে প্রধান রাজনৈতিক দলগুলোর নির্বাচনী মেনিফেস্টোতে চালের মূল্য কমানোর প্রতিশ্রুতি দিতে দেখা গেছে। বলাবাহুল্য ১০ টাকা কেজিতে চাল এবং ঘরে ঘরে চাকুরি দেয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়ে ক্ষমতায় এসে মহাজোট সরকার এসব প্রতিশ্রুতি বাস্তবায়ন করতে না পারলেও ২০১৪ সালের জানুয়ারীতে কার্যত বিনাভোটের নির্বাচনে ক্ষমতায় টিকে থাকা নিশ্চিত করে। ক্ষমতার এই ধারাবাহিকতা দেশে এক ধরনের রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা সৃষ্টি হলেও এই স্থিতিশীলতা দেশে কাঙ্খিত বৈদেশিক বিনিয়োগ, দেশি-বিদেশি কর্মসংস্থান এবং জনগনের জীবনমান উন্নয়নে তেমন কোন ইতিবাচক ভ’মিকা রাখতে পারেনি। সরকারের দ্বিতীয় মেয়াদের শেষ পর্যায়ে এসে এক দশক পর দেশে আবারো বড় ধরনের খাদ্য সংকট দেখা দিয়েছে। বেশ কয়েক বছর ধরেই সরকার দেশকে খাদ্যে স্বয়ংসম্পুর্ণ করার দাবীকে আরো জোরালোভাবে উপস্থাপন করে আসছে। তবে ধানের বাম্পার ফলন এবং ভরা মওসুমেও ভারত থেকে চাল আমদানীর সুযোগ অবারিত রেখে দেশের কৃষকদের ধানের ন্যায্য মূল্য থেকে বঞ্চিত করার অভিযোগও উঠেছে।
খরা, বন্যা, দুর্র্ভিক্ষে আমাদের জাতিগত অভিজ্ঞতা অনেক পুরনো। অতীতের সে সব মহামারি অভিজ্ঞতার আলোকে আমাদের কৃষক সমাজ, আমাদের সরকার খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে গিয়ে অনেক নির্বিচার পদক্ষেপ নিয়েছে যা’ ইতিমধ্যে আত্মঘাতি বলে প্রমানীত হয়েছে। বিদেশি কর্পোরেট এগ্রো কোম্পানী উদ্ভাবিত উচ্চফলনশীল, জিএমও কৃষিবীজের চাষাবাদ প্রচলন করতে গিয়ে আমাদের খাদ্য, কৃষিব্যবস্থা, জীববৈচিত্র্য ও প্রাণ-প্রকৃতি বহুমুখী সঙ্কটের মুখোমুখি দাঁড়িয়েছে। যেখানে হাজার বছর ধরে স্বাভাবিক বর্ষার পানিতেই এ দেশের কৃষকরা দেশীয় নানা জাতের ধান ফলিয়ে অভ্যস্থ সেখানে নতুন উফসি জাতের ধান চাষ করতে গিয়ে একেক কেজি ধানের জন্য হাজার হাজার লিটার পানি ব্যবহার করতে হচ্ছে। ইতিমধ্যে আমাদের দেশের রাজনৈতিক মানচিত্র বদলে যাওয়ার পর উজানের দেশ ভারত অভিন্ন নদীর উপর বাঁধ নির্মান করে নদীর স্বাভাবিক গতি রুদ্ধ করে দিয়ে বাংলাদেশের জন্য সবচেয়ে বড় বিপর্যয় সৃষ্টি করেছে। পশ্চিমা রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক এজেন্ডার আওতায় ষাটের দশকে যে সব বড় বড় সেচ প্রকল্প গ্রহন করা হয়েছিল। নদ নদী শুকিয়ে যাওয়ায় শুকনো মওসুমে এসব সেচ প্রকল্পের পানির বিকল্প হিসেবে ভূ-গর্ভে গভীর-অগভীর পাইপ ও পাম্প বসিয়ে প্রতিদিন কোটি কোটি লিটার পানি টেনে তোলা হয়। এর ফলে আমাদের ভূ-গর্ভস্থ পানির স্তর দ্রুত নিচে নেমে যাচ্ছে। ভূ-গর্ভস্থ পানির উপর অতিমাত্রায় নির্ভরশীলতার কারণে দেশের বিভিন্ন স্থানে ভূ-গর্ভস্থ পানিতে ভয়াবহ আর্সেনিক দূষণ ঘটেছে। বর্ষায় উজান থেকে বয়ে আনা পলিমাটির উপর ধানবীজ রোপণ করে বৃষ্টির পানিতে অথবা সামান্য সেচে সোনা ফলানো কৃষকরা এখন অতিমাত্রায় সেচ নির্ভর, বিদেশি বীজ নির্ভর, রাসায়নিক সার, পেস্টিসাইড, ফাঙ্গিসাইড, হার্বিসাইড বিষনির্ভর কৃষিব্যবস্থা অতিমাত্রায় ব্যয়বহুল এবং জনস্বাস্থ্য জীববৈচিত্র্যের জন্য যে ধরনের হুমকি সৃষ্টি করেছে তা’ থেকে উত্তরণের কোন পথ এখন আর দেখা যাচ্ছেনা। কৃষিতে অতি মাত্রায় সেচনির্ভরতার হাত ধরে প্রতিবছর শত শত কোটি টাকার সেচপাম্প যন্ত্রপাতি আমদানী করতে হয়, সেচ পাম্প চালানোর জ্বালানী হিসেবে অতিরিক্ত লাখ লাখ ব্যারেল ডিজেল আমদানী করতে হয়। অর্থাৎ আমাদের খাদ্য নিরাপত্তার সাথে জড়িত হয়ে পড়েছে বছরে হাজার হাজার কোটি টাকার আমদানী বাণিজ্য যা’ একদিকে খাদ্য উৎপাদনকে ব্যয়বহুল অন্যদিকে আমাদের মাটি, পানি, বাতাস ও জনস্বাস্থ্যের জন্য বিপর্যয় সৃষ্টি করছে। নিজেদের ট্রাডিশনাল কৃষিবীজগুলো পরিত্যাগ করে আমাদের কৃষকরা এখন বিদেশি কর্পোরেট এগ্রো কোম্পানীর কাছে জিম্মি হয়ে পড়েছে। ভ’-গর্ভস্থ পানির উৎস, মাটি, পানি ও জনস্বাস্থ্যের ঝুঁকি সম্পর্কে বেপরোয়া হয়ে যেনতেন প্রকারে বাম্পার ধান উৎপাদনের পরও কৃষকের ভাগ্যের পরিবর্তন হয়না, এমনকি কখনো কখনো উৎপাদন খরচও উঠেনা। দারিদ্র্য, স্বাস্থ্য সমস্যা এবং মহাজনী ঋণের জালে বন্দি কৃষকরা কখনো কখনো আত্মহত্যার পথ বেছে নিতে বাধ্য হয়।
জনসংখ্যা বৃদ্ধির সাথে সাথে অনাবাদি, পতিত জমি কৃষির আওতায় এনে কৃষিজমির পরিমান বাড়িয়ে কৃষি উৎপাদন বাড়ানো হয়েছে। এরপরও খাদ্যপণ্যের মূল্য দরিদ্র মানুষের আয়ের সাথে সঙ্গতি রেখে ক্রয়ক্ষমতার বাইরে চলে যাওয়ার বাস্তবতা রোধ করা যাচ্ছেনা। প্রাকৃতিক কারণে ২০০৭ সালে কৃষি উৎপাদন ব্যহত হওয়ায় শুধু বাংলাদেশসহ অনেক দেশেই খাদ্য সংকট ও খাদ্যপণ্যের মূল্য অস্বাভাবিক বেড়ে যায়। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো থেকে প্রকাশিত তথ্য অনুসারে, ২০০৭ সালে ২০ লাখ টনের বেশী চাল আমদানী করতে হয়েছিল। বেসরকারি হিসেব, চোরাচালান এবং অন্যান্য খাদ্য সামগ্রি মিলিয়ে আমদানীকৃত খাদ্যশস্যের পরিমান নিশ্চয়ই আরো বেশী হতে পারে। মূলত: প্রতিবছরই বাংলাদেশে খাদ্য আমদানী অব্যাহত থাকলেও চলতি বছর তা’ ২০০৭ সালের রেকর্ড অতিক্রম করার আশঙ্কা দেখা যাচ্ছে। ইতিমধ্যে বছরের প্রথম ৬ মাসেই ৭ লাখ টন চাল আমদানী হয়েছে বলে জানা যায়। হাওরে ফসলহানি, সরকারী খাদ্যগুদামের মজুদ তলানিতে নেমে যাওয়া এবং অস্বাভাবিক মূল্যবৃদ্ধির পেক্ষাপটে এখন সরকারী বেসরকারী উদ্যোগে নানা দেশ থেকে চাল আমদানীর হিড়িক চলছে। ইতিমধ্যে চাল আমদানীর শুল্কহার ২৮ শতাংশ থেকে কমিয়ে ১০ শতাংশ করা হয়েছে। এরপরও বাজারে চালের মূল্য কমেনি। বাজারে সঙ্কট দেখিয়ে মূল্যবৃদ্ধি অব্যহত থাকলেও আরো শুল্ক কমিয়ে সুযোগ নেয়ার জন্য আমদানীকৃত চাল বোঝাই হাজার হাজার ট্রাক সীমান্তে আটকে রাখা হয়েছে। এটাও এক ধরনের মজুদদারি। অর্থাৎ সরকার শত শত কোটি টাকা আমদানী শুল্ক রেয়াত দিলেও এর সুফল দেশের দরিদ্র মানুষ পাচ্ছেনা। সঙ্কটকে পুঁজি করে কমশুল্কে আমদানীকৃত চাল বেশীদামে বিক্রি করে ভোক্তাদের কাছ থেকে শত শত কোটি টাকার অতিরিক্ত মুনাফা হাতিয়ে নিচ্ছে আমদানীকারক ও বিক্রেতারা। চোরাচালান, বিপনণ ও বাজার নিয়ন্ত্রণে সরকারের ব্যর্থতার সুযোগ নিয়ে থাকে আমদানীকারক ও মজুদদাররা। বেশীরভাগ সময়ে কারসাজির মাধ্যমে কৃত্রিম সংকট সৃষ্টি করেই ভোগ্য পণ্যের মূল্য বৃদ্ধি করা হয়। সরকারী খাদ্যগুদামে আপদকালীন পর্যাপ্ত মজুদ নিশ্চিত রাখা সরকারের দায়িত্ব। এ দায়িত্ব পালনে সংশ্লিষ্টরা নিশ্চিতভাবেই ব্যর্থ হয়েছে। দেশে বাম্পার ফলন হওয়ার পরও আমাদের সরকার চাল আমদানী উন্মুক্ত করে দিয়ে কৃষককে ন্যয্যমূল্য থেকে বঞ্চিত করেন। আবার মাত্র ৫-১০ লাখ টন আভ্যন্তরীণ খাদ্য সশ্য সংগ্রহের লক্ষ্যমাত্রা অর্জনেও সরকার ব্যর্থ হয়। এমনকি আপদকালীন খাদ্য মজুদের অবস্থাও হতাশাজনক।
বছরের শুরুতে হাওরে আকষ্মিক বন্যার বিপর্যয়ের জন্য দায়ী অতিবৃষ্টি এবং ভারত থেকে আসা পাহাড়ি ঢল। আর ভাটির দেশ বাংলাদেশের জন্য এটি কোন অস্বাভাবিক বাস্তবতা নয়। এর জন্য আমাদের কৃষকদের সর্বদাই আশঙ্কার মধ্যে থাকতে হয়। আমাদের দেশের বাস্তবতায় বেড়িবাঁধ ও বন্যানিয়ন্ত্রণ বাঁধগুলোকে সম্ভাব্য বন্যা মোকাবেলার সর্বদা উপযোগি করে রাখতেই হয়। আমাদের পানি উন্নয়ন বোর্ড এবারো এ দায়িত্ব পালনে চরমভাবে ব্যর্থ হওয়ার কারণে হাওরের লাখ লাখ পরিবারকে চরম মাশুল গুনতে হচ্ছে। মূলত: পুরো জাতিকেই হাওরের ফসলহানির খেসারত দিতে হচ্ছে। এখনো হাওরসহ দেশের উত্তর-পশ্চিম ও মধ্যাঞ্চলের প্রায় ২০ টি জেলার কয়েক কোটি মানুষ বন্যাদুর্গত অবস্থায় রয়েছে। এরই মধ্যে আরো বড় ধরনের বন্যার পূর্বাভাস পাওয়া যাচ্ছে। কেউ কেউ শত বছরের সবচেয়ে বড় বন্যার আশঙ্কা করছে। আমাদের প্রতিবেশী এবং ধান উৎপাদনকারি অন্যান্য বেশ কয়েকটি দেশও বন্যা ও খরার আশঙ্কার মধ্যে রয়েছে। চাহিদা বাড়লেও গত বছর গম উৎপাদন ২০১৫ সালের চেয়ে কোটি টন কম হয়েছে। এবারের বন্যায় ভারত বাংলাদেশসহ দক্ষিন এশিয়ার দেশগুলোতে খাদ্য উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা অর্জিত না হলে এবং বেশী দাম দিয়েও বিশ্ববাজার থেকে খাদ্য সংগ্রহ করা অসম্ভব হলে দেশে দেশে দুর্ভিক্ষ দেখা দিতে পারে। অত্যন্ত উর্বর মাটিসমৃদ্ধ গাঙ্গেয় সমভ’মি বাংলাদেশে খাদ্যের অভাব হওয়ার কোন কারণ নেই। এই অকাল বন্যা, প্রলম্বিত বন্যার মূল কারণ উজানে বাঁধ নির্মানের কারণে আমাদের নদীগুলো পলিমাটিতে ভরাট হয়ে যাওয়া। আমাদের সরকার অভিন্ন নদীর পানির ন্যায্য হিস্যা আদায় করতে পারছেনা। বন্যা নিয়ন্ত্রণ ও বেড়িবাধগুলোর উন্নয়ন ও সংস্কার করে ফসলের নিরাপত্তা দিতে ব্যর্থ হচ্ছে। কৃষকের উৎপাদিত ফসলের ন্যায্যমূল্য নিশ্চিত করতে পারছেনা। অন্যদিকে উজানে ভারত শুকনো মওসুমে অভিন্ন নদীর পানি থেকে বাংলাদেশকে বঞ্চিত করলেও বর্ষার সময় ফারাক্কা, গজলডোবার সব গেট খুলে দিয়ে ডুবিয়ে মারার আয়োজন অব্যাহত রেখেছে। ভারতকে তার চাহিদার সবকিছু দিয়েও বাংলাদেশ অভিন্ন নদীর পানির ন্যায্য হিস্যা এবং নদী ব্যবস্থাপনায় সহযোগিতা থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। এ বাস্তবতা এখন বাংলাদেশে কোটি কোটি মানুষের খাদ্য নিরাপত্তা ও অস্তিত্বের সংকট হয়ে দাড়িয়েছে। এটি আমাদের বিরুদ্ধে একটি নিরব আগ্রাসন, যা আমাদেরকে যুদ্ধের চেয়েও বড় সঙ্কটের দিকে ঠেলে দিচ্ছে।
[email protected]



 

Show all comments
  • মো: রিফাত খান ২৮ সেপ্টেম্বর, ২০১৯, ১০:০০ পিএম says : 0
    সকল ক্ষুধার মুলে খাদ্য সংকট নয় দায়ী কুটনৈতিক সংকট সম্পের প্রতিবেদন
    Total Reply(0) Reply
  • মো: রিফাত খান ২৮ সেপ্টেম্বর, ২০১৯, ১০:০৫ পিএম says : 0
    সকল ক্ষুধার মুলে খাদ্য সংকট নয় দায়ী কুটনৈতিক সংকট এবিষয়ের কয়েকটি প্রতিবেদন
    Total Reply(0) Reply

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

আরও পড়ুন
গত​ ৭ দিনের সর্বাধিক পঠিত সংবাদ