Inqilab Logo

শনিবার, ২০ এপ্রিল ২০২৪, ০৭ বৈশাখ ১৪৩১, ১০ শাওয়াল ১৪৪৫ হিজরী

চাপের মুখে বিচারালয়

স্টালিন সরকার | প্রকাশের সময় : ২০ আগস্ট, ২০১৭, ১২:০০ এএম

নাগরিকের অধিকার রক্ষা-ন্যায় বিচারের ভরসাস্থল সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠান উচ্চ আদালতের ষোড়শ সংশোধনী বাতিল রায়ের পর্যবেক্ষণ ইস্যুতে সরগরম হয়ে উঠেছে দেশের রাজনীতি। রায়ের পক্ষ্যে বিপক্ষ্যে চলছে আলোচনা-পর্যালোচনা, তর্ক-বিতর্ক। একজন প্রভাবশালী মন্ত্রী প্রধান বিচারপতির সঙ্গে দেখা করে ‘সুবিধা করতে ব্যর্থ হয়ে’ বঙ্গভবনে গিয়ে প্রেসিডেন্টের কাছে নালিশ করেছেন। অতপর প্রেসিডেন্টের সঙ্গে প্রধানমন্ত্রীর বৈঠক। রায়ের পর্যবেক্ষণে সরকারের মন্ত্রী-এমপিরা সংক্ষুব্ধ হয়ে নিত্যদিন কথার ক্ষেপনাস্ত্র হামলায় প্রধান বিচারপতিকে নাস্তানাবুদ করছেন। আইনমন্ত্রী জানিয়েছেন রায়ের রিভিউয়ের প্রস্তুতি চলছে। অন্যদিকে একজন সাবেক প্রধান বিচারপতি বর্তমানে আইন কমিশনের চেয়ারম্যান এবিএম খায়রুল হক ব্যাক্তিগত আক্রোশে প্রধান বিচারপতির দিকে নিত্য তীর ছুঁড়ছেন। আইনের কোনো নিয়ন-নীতি, সভ্যতা-ভব্যতার তোয়াক্কা না করে প্রধান বিচারপতির ওপর ব্যাক্তিগত আক্রোশ মেটাচ্ছেন; যা আদালত অবমাননার নামান্তর। গতকালও খাদ্যমন্ত্রী অ্যাডভোকেট কামরুল ইসলাম বলেছেন, বর্তমান প্রধান বিচারপতি সুরেন্দ্র কুমার সিনহা ১৯৯৯ সালে আওয়ামী লীগের শাসনামলেই ‘রাজনৈতিক বিবেচনায়’ বিচারপতি হন। তাকে নিয়ে আওয়ামী লীগ এখন দুশ্চিন্তায়। তবে প্রেসিডেন্টের সঙ্গে বৈঠক করে বের হয়ে ওবায়দুল কাদের দলীয় কর্মীদের রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের কাব্যনাট্ট ‘বিষর্জন’ থেকে উদ্ধৃত করে বলেছেন, ‘শঙ্কিত হওয়ার কোনো কারণ নেই। আকাশের মেঘ ক্ষণিকের, সূর্য চিরদিনের। ক্ষণিকের মেঘ কাটিয়া যাবে, চির দিবসের সূর্য উঠিবে আবার’। বোঝা যায় সংবিধানের ষোড়শ সংশোধনী বাতিল ৭৯৯ পৃষ্টার পুণাঙ্গ রায় পহেলা আগষ্ট প্রকাশের পর কার্যত চাপের মুখে পড়ে গেছে বিচারালয়।
রায়ের পর্যবেক্ষণে উচ্ছাস প্রকাশ করে বিএনপি থেকে অভিযোগ করা হচ্ছে ‘সরকার প্রধান বিচারপতিকে চাপের মুখে ফেলে রায় পাল্টে নেয়ার চেষ্টা করছে। এ কাজে তারা রাষ্ট্রের এক নম্বর নাগরিক মহামান্য প্রেসিডেন্টকে ব্যবহার করার চেষ্টা করছে’। সংবিধানের ষোড়শ সংশোধনী বাতিলের রায় নিয়ে সর্বত্রই চলছে তর্ক বিতর্ক। প্রিন্ট ও ইলেক্টোনিক্স মিডিয়ার পাশাপাশি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে চলছে রায়ের পর্যবেক্ষণ নিয়ে চুলচেরা বিশ্øেষণ, মতামত প্রদান, লাইক, শেয়ার। রায় নিয়ে রাজনীতি না করার জন্য প্রধান বিচারপতির অনুরোধ ও মন্ত্রী এমপিদের সংক্ষুব্ধ কথাবার্তা নিয়ে মতামত দেয়া বাদ যাচ্ছে না সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে। প্রধান বিচারপতির সঙ্গে দেখা করে সুবিধা করতে না পারায় রায় পুনর্বিবেচনার আবেদন আদালতে দাখিল করার প্রস্তুুতি নিচ্ছে রাষ্ট্রপক্ষ। আইনমন্ত্রী আনিসুল হক জানিয়েছেন, রায়ের সার্টিফাইড কপি হাতে পাওয়ার ত্রিশ দিনের মধ্যে রিভিউ আবেদন করা হবে। রিভিউ আবেদনের প্রক্রিয়া নিয়ে সরকারি দল সমর্থিত আইনজীবী ও সংবিধান বিশেষজ্ঞরা পরামর্শ করছেন। রিভিউ এর বিষয়ে তাদের মধ্যে দুই রকম মত আসছে। কেউ পুরো রায়টি বাতিল চেয়ে আবেদন করার পক্ষ্যে। আবার কেউ যে সব পয়েন্টে আপত্তিজনক ও অপ্রাসঙ্গিক সেগুলো একপাঞ্জের অনুরোধ জানিয়ে আবেদনের পক্ষ্যে। এ প্রসঙ্গে আইনমন্ত্রী আনিসুল হক বলেন, রায় পড়া হচ্ছে, পরীক্ষা-নিরীক্ষা চলছে। পরীক্ষা-নিরীক্ষা শেষ হলে রিভিউ আবেদন করা হবে। রায়ে অপ্রাসঙ্গিক কথাগুলো রিভিউতে আসবে। সরকার সেই জন্য তৈরি হচ্ছে।
ষোড়শ সংশোধনী রায় কার্যত দেশের রাজনীতির গতি প্রকৃতি পাল্টে দিয়েছে। রায়ের পর্যবেক্ষণে ‘আমিত্বের’ বদলে ‘আমরা’ ও ‘ব্যাক্তি বন্দনা’ রাজনীতির বদলে ‘যার যেটুকু প্রাপ্য সেটা দেয়া’র সংস্কৃতি চর্চার সুপাশি কার্যত বিপাবে ফেলেছে ব্যাক্তি বন্দনা চর্চায় অভ্যস্ত দলগুলোকে। কথায় কথায় সংবিধান সংশোধন নিয়ে প্রশ্ন তোলা এবং সংসদের গ্রহণযোগ্যতা নিয়ে প্রশ্ন তোলা ভাল চোখে দেখছে না ক্ষমতাসীন দল। তবে চ্যানেল আই-এর টকশো তৃতীয় মাত্রায় গতকালও রাষ্ট্রবিজ্ঞানী অধ্যাপক আতাউর রহমান বলেছেন, আমেরিকায় দুইশ-আড়াইশ বছরে সংবিধান যতবার সংশোধন হয়নি; বাংলাদেশে ৪৪ বছরে তার চেয়ে বেশিবার হয়েছে। যতবারই সংবিধান সংশোধন হয়েছে ততবারই ক্ষমতাসীনদের সুবিধার জন্য। শুধুমাত্র একজন ব্যাক্তির জন্য দেশে দুই বার সংবিধান সংশোধন হয়েছে। আদালত রায়ে যে পর্যবেক্ষণ দিয়েছেন তা বাস্তব; একশ বছর পরে হলোও কেউ না কেউ এটা দিতই। ব্যারিষ্টার নাজমুল হুদা বলেন, সংবিধান সংশোধন সংসদে সংখ্যাগরিষ্টতার জোরে করা উচিত নয়। সে জন্য নাগরিকের মতামত নেয়া আবশ্যক। অথচ আমাদের দেশে তা নেয়া হয় না। সিনিয়র সাংবাদিক নুরুল কবির বলেন, ষোড়শ সংশোধনী বাতিল রায়ে যে পর্যবেক্ষণ দেয়া হয়েছে; তার কোনোটিই প্রধান বিচারপতি নিজস্ব মতামত নয়। অ্যাটর্নি জেনারেলের বক্তব্য এবং আর্গুমেন্টের প্রেক্ষাপটে জবাব দিতে গিয়ে তিনি পর্যবেক্ষণ দিয়েছেন মাত্র। একই অনুষ্ঠানে এ মন্তব্যের বিরোধিতা করে বিচারপতি শামসুদ্দিন চৌধুরী মানিক বলেন, বিচার বিভাগ নিয়ে প্রধান বিচারপতি ইচ্ছা করেই দেশে এই পরিস্থিতি সৃষ্টি করেছেন। তিনি বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্ব অস্বীকার করে ইতিহাস বিকৃতি করেছেন। তিনি পাকিস্তান সুপ্রিম কোর্টের রায় থেকে অনুপ্রাণিত হয়েই এইসব করছেন। এটা যে পাকিস্তান নয়; শেখ হাসিনাও যে নওয়াজ শরিফ নন; সেটা এস কে সিনহার মাথায় আসেনি।
বিচারপতিগণ ষোড়শ সংশোধনী বাতিল রায়ের পর্যবেক্ষণে জনগণের ভোটাধিকার, নাগরিকের সাংবিধানিক অধিকার, শাসনব্যবস্থা, গণতন্ত্র, রাজনীতি, নির্বাচন কমিশন, সেনাশাসন, জাতীয় সংসদের সার্বভৌমত্ব, সংসদ ও বিচার বিভাগের সম্পর্ক, বিচার বিভাগের স্বাধীনতা, বিশ্ববিদ্যায়ে নিয়োগ, সংবিধানের ৭০ অনুচ্ছেদ, আইনের শাসন, রাজনৈতিক দলগুলোর আমিত্বের আচরণ, প্রশাসনে দলীয়করণ, নিয়োগ প্রক্রিয়ায় দুর্নীতি, সমাজের নৈতিক অবক্ষয়সহ নানা অসংগতির চিত্র তুলে ধরা হয়। বিএনপি রায়কে ‘ঐতিহাসিক’ অবিহিত করে প্রধান বিচারপতিকে ‘বাহবা’ দিলেও ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ প্রথমে ছিল ‘নীরব’। আইনজীবী ও সংবিধান বিশেষজ্ঞরা ‘রায় নিয়ে নেতিবাচক মন্তব্য করা উচিত নয়’ এমন বক্তব্য দেন। এখন আওয়ামী লীগ রায়ের পর্যবেক্ষন নিয়ে প্রশ্ন তুলছে।
পহেলা আগষ্ট পুণাঙ্গ রায় প্রকাশের পর ৬ আগষ্ট প্রধান বিচারপতির এস কে সিনহার সঙ্গে দেখা করেন আওয়ামী লীগের প্রেসিডিয়াম সদস্য সাবেক আইনমন্ত্রী আবদুল মতিন খসরু, সাবেক আইনমন্ত্রী ব্যারিষ্টার শফিক আহমেদ ও দলের উপদেষ্টা মন্ডলীর সদস্য অ্যাডভোকেট ইউসূফ হোসেন হুমায়ুন। তারা রায়ের পর্যবেক্ষণে সরকারের বিব্রতকর অবস্থা চিত্র তুলে ধরেন। অতপর সিলেটের এক অনুষ্ঠানে রায়ের কঠোর সমালোচনা করে অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত বলেন, আদালত যতবার ষোড়শ সংশোধনী বাতিল করবে, আমরা ততবার সংসদে বিল পাস করব। আমরা বিচারপতিদের চাকরি দেই। তারা সংসদের উপর পোদ্দারি করবে? দুদিন পর মন্ত্রিসভায় রায়ের পর্যবেক্ষণের কিছু শব্দ নিয়ে আপত্তি তুলে রায় থেকে সেগুলো এক্সপাঞ্জ করার আবেদন করা হবে সিদ্ধান্তের পর মুখ খুলতে শুরু করে আওয়ামী লীগ নেতারা। আইনমন্ত্রী আনিসুল হক সংবাদ সম্মেলনে সরকারের অবস্থান তুলে ধরেন। তিনি বলেন, ষোড়শ সংশোধনী বাতিল রায়ে আদালতের পর্যবেক্ষণ অনাকাঙ্খিত, অনভিপ্রেত ও অপ্রাসঙ্গিক। কিছু কিছু শব্দ এক্সপাঞ্জ করার আবেদন করা হবে। অতপর আওয়ামী লীগের সিনিয়র নেতা ও মন্ত্রীরা একের পর এক প্রধান বিচারপতিকে আক্রমন করে বক্তৃতা দিতে থাকেন।
রায়ের পর্যবেক্ষণ নিয়ে সারাদেশে তোলপাড় এবং চলছে কথামালার যুদ্ধ। এরই মধ্যে ৯ আগষ্ট সাবেক প্রধান বিচারপতি বর্তমানে জাতীয় আইন কমিশনের চেয়ারম্যান এবিএম খায়রুল হক সংবাদ সম্মেলন করে বলেন, সংবিধানের ষোড়শ সংশোধনী বাতিলে আপিল বিভাগের রায় অপরিপক্ব, পূর্বপরিকল্পিত ও অগণতান্ত্রিক। তিনি প্রশ্ন রাখেন প্রধান বিচারপতি কি প্রধান শিক্ষক? আর অন্য বিচারপতিরা ছাত্র নাকি যে, সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিলের মাধ্যমে তাকে (প্রধান বিচারপতি) অন্য বিচারপতিদের পরিচালনা করতে হবে? সংবিধানে গণপ্রজাতন্ত্রের কথা বলা হয়েছে। রায় দেশকে বিচারিক প্রজাতন্ত্রের দিকে নিয়ে যাচ্ছে। এর মাধ্যমে মার্শাল ল› আমলে চলে যাওয়ার চেষ্টা চলছে। তত্ত¡াবধায়ক সরকার প্রসঙ্গে দেয়া রায় এবং নিজের রায় নিজেই না মানায় বিতর্কিত সাবেক এই প্রধান বিচারপতির বিরুদ্ধে আদালত অবমাননতার অভিযোগ এনে সুপ্রিম কোট আইনজীবী সমিতির সভাপতি এ্যাডভোকেট জয়নুল আবেদীন আপিল বিভাগে আবেদনের মাধমে রুল দাবি করেন। এ সময় প্রধান বিচারপতি এস কে সিনহা বলেন, আমরা কারো ফাঁদে পা দেব না। রায় নিয়ে গঠনমূলক আলোচনায় দোষ নেই; কিন্তু কেউ রাজনীতি করবেন না মত দেন তিনি। এরই মধ্যে বিএনপি সমর্থিত জাতীয়তাবাদী আইনজীবী ফোরাম এবং আওয়ামী লীগ সমর্থিত বঙ্গবন্ধু আইনজীবী পরিষদ পাল্টা-পাল্টি কর্মসূচি ঘোষণা করে। বিএনপিপন্থীরা এবিএম খায়রুল হককে আইন কমিশন থেকে অপসারণসহ বেশ কিছু দাবি জানায়। আওয়ামী লীগ সমর্থিতরা প্রধান বিচারপতির কঠোর সমালোচনা করে অভিযোগ করে একজন পত্রিকার সম্পাদকের লেখা রায় পেনড্রাইভে করে নিয়ে আপিল বিভাগে দেয়া হয়। আওয়ামী লীগের নেতা ও মন্ত্রীরা অব্যাহত ভাবে প্রধান বিচারপতির বিরুদ্ধে কথাবার্তা এবং তাকে অপসারণের দাবি করছেন; অন্যদিকে বিএনপি আইন কমিশনের চেয়ারম্যানের অপসারণের দাবি করছেন। এরই মধ্যে ১৩ আগষ্ট আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক সড়ক যোগাযোগ ও সেতু মন্ত্রী ওবায়দুল কাদের প্রধান বিচারপতির কাকরাইলের বাসায় গিয়ে বৈঠক করেন তাঁর সঙ্গে। তিনি জানান, রায় নিয়ে দলের নেতাদের প্রতিক্রিয়া প্রধান বিচারপতিকে জানানো হয়েছে। পরের দিন তিনি বঙ্গভবনে গিয়ে প্রেসিডেন্টের সঙ্গে দেখা করে জানান, প্রধান বিচারপতির সঙ্গে যে সব কথাবার্তা হয়েছে সেগুলো প্রেসিডেন্টকে অবহিত করা হল। কারণ প্রেসিডেন্ট সর্বময় ক্ষমতার অধিকারী; তিনি প্রধান বিচারপতিকে নিয়োগ দেন। এ ঘটনার পর বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর উদ্বেগ প্রকাশ করে বলেন, আওয়ামী লীগ উচ্চ আদালতের রায় পরিবর্তনের জন্য প্রধান বিচারপতির ওপর চাপ দিচ্ছে। এ অবস্থায় বিভিন্ন বুদ্ধিজীবী ও বিশিষ্টজনের বরাত দিয়ে মিডিয়ায় প্রচার হয় প্রধান বিচারপতিকে চাপ দিয়ে রায় পরিবর্তনের চেস্টা করছে সরকার। ১৫ আগষ্ট এক অনুষ্ঠানের জবাব দিতে গিয়ে প্রধান বিচারপতি বলেন, আমি যা বলবো আদালতেরই বলবো। এই মধ্যে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বঙ্গভবনে যান প্রেসিডেন্টের সঙ্গে দেখা করতে। তার সঙ্গে ছিলেন আইনমন্ত্রী আনিসুল হক, সড়ক যোগাযোগ ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের, অ্যাটর্নী জেনালের মাহবুবে আলম। বৈঠক থেকে বের হয়ে ওবায়দুল কাদের জানান, বন্যাসহ অন্যান্য বিষয়ের পাশাপাশি আদালতের রায় প্রসঙ্গে প্রেসিডেন্টের সঙ্গে আলোচনা করেছেন প্রধানমন্ত্রী। এ তথ্য প্রচার হওয়ার পর বিএনপি থেকে অভিযোগ তোলা হয় সরকার প্রধান বিচারপতিকে চাপ দিয়ে রায় পরিবর্তনের পাশাপাশি তাকে পদচ্যুত করার চেষ্টা করছে।
এখানে প্রাসঙ্গিক যে, বিচারপতি খায়রুল হকের একটি রায়ের পর্যবেক্ষনকে ইস্যু করে আওয়ামী লীগ সরকার ২০১১ সালে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা বাতিল করে সংবিধানের পঞ্চদশ সংশোধনী বিল পাস করে। ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারী বিতর্কিত নির্বাচনের পর ক্ষমতায় এসে ৯ মাসের মাথায় ১৭ সেপ্টেম্বর ষোড়শ সংশোধন বিল পাস করে। সংবিধানের ষোড়শ সংশোধন বিল-২০১৪ নামের এই বিল পাসের মাধ্যমে বিচারকদের অপসারণের ক্ষমতা সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিলের হাত থেকে জাতীয় সংসদের হাতে ফিরিয়ে আনা হয়। অথচ বাহাত্তরে সংবিধান প্রণয়নের পর থেকে পঁচাত্তরের জানুয়ারি পর্যন্ত ‘অসদারচণ ও অসামর্থের’ অভিযোগ প্রমাণিত বিচারপতিদের অপসারণের বিধান সংসদের হাতে ছিল। ১৯৭৫ সালে বাকশাল গঠনের সময় সংবিধানের চতুর্থ সংশোধনীর মাধ্যমে বিচারপতিদের অপসারণর ক্ষমতা প্রেসিডেন্টের হাতে ন্যস্ত হয়। পরবর্তীতে জিয়াউর রহমানের শাসনামলে সে ক্ষমতা সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিলের হাতে অর্পন করা হয়।
গতকালও জাতীয় আইন কমিশনের চেয়ারম্যান এবিএম খায়রুল হক বলেছেন, ষোড়শ সংশোধনী বাতিল রায়ে প্রধান বিচারপতি এস কে সিনহা বিরাগের বশবর্তী হয়ে সংবিধানের ষোড়শ সংশোধনী বাতিলের রায় দেন। এই রায়ে তার শপথ ভঙ্গ হয়েছি কি না তা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। শপথ ভঙ্গ হলে কি করণীয় তা করা উচিত। বিরাগের বশবর্তী হয়ে রায় দিলে বিচারপতিদের শপথ ভঙ্গ হয়। প্রধান বিচারপতি বলেছেন তারা (এমপি) ঠিকমত নির্বাচিত হয়ে আসেনি। তাহলে ওনারা (বিচারপতি) কি নির্বাচিত হয়ে এসেছেন? পার্লামেন্ট একটি স্বাধীন সংস্থা। তিনি পলিটিক্সকে বিশ্লেষণ করেছেন। তিনি সবচেয়ে বেশি আপত্তিকর যে কথাটি বলেছেন তা হলো পার্লামেন্ট অকার্যকর। এটি একজন বিচারকের ভাষা হতে পারে না; এটি সুপ্রীম কোর্টের ভাষা হতে পারে না। শপথ নেয়ার সময় বিচারপতি বলেছেন আমি অনুরাগ বা বিরাগের বশবর্তী হয়ে কিছুই করবো না। তিনি তার রায়ে যে কথাগুলো বলেছেন তা যদি অনুরাগ বা বিরাগের কারণেই বলে থাকেন তাহলে সেই রায়ের কি অবস্থা হবে? সরকারি চাকরিতে কর্মরত আইন কমিশনের চেয়ারম্যান খায়রুল হকের বক্তব্য প্রধান বিচারপতিকে ওপর ব্যাক্তিগত আক্রোশ হিসেবে অবিহিত করছেন দেশের সংবিধান বিশেষজ্ঞরা। সাবেক প্রধান বিচারপতি এবং সরকারি চাকরিতে থেকে তিনি এ ধরনের নৈতিকতা বিরোধী মন্তব্য করতে পারেন না এমন বক্তব্য দিয়ে তার বিএম সুলতান মাহমুদ নামের এই আইনজীবী। সংবিধান ও স্থানীয় সরকার বিশেষজ্ঞ সুজনের সাধারণ সম্পাদক ড. বদিউল আলম মজুমদার লিখেছেন আইন কমিশনের চেয়ারম্যান খায়রুল হকের উচিত আয়নার নিজের চেহারা দেখা। তিনি নিজের দেয়া রায় না মেনে লাভজনক পদে বসেছেন। তিনি একটি রায় দিয়ে দেশকে চরম বিশৃংখলা পরিস্থিতির দিকে নিয়ে গেছেন। প্রায় অর্ধশত সংবিধান বিশেষজ্ঞ খায়রুল হকের বিরুদ্ধে অনৈতিকতার অভিযোগ তুলেছেন। প্রধান বিচারপতি এসকে সিনহাকে উদ্দেশ্য করে গতকাল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ড. আসিফ নজরুল বলেছেন, মাননীয় প্রধান বিচারপতি আইন সচিবের বক্তব্য দেখেন নি আপনি? মন্ত্রীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে পারেননি বুঝলাম। কিন্তু একজন সরকারী কর্মচারীর বিরুদ্ধে আদালত অবমাননার দায়ে ব্যবস্থা নিতেও কি আপনি অপরাগ এখন? ফেসবুকে আরেকটি স্ট্যাটাসে তিনি বলেন, এখন জানা গেল খায়রুল হক-ই ছিলেন বিতর্কিত ষষ্ঠদশ সংশোধনীর নেপথ্যে। বিচারকদের বিরুদ্ধে অভিযোগ সংসদদের দিয়ে তদন্তের জঘন্য আইনটির খসড়াও তারই করা। প্রধান বিচারপতির বিরুদ্ধে চরম অবমাননামূলক বক্তব্য তিনিই প্রথম শুরু করেছেন। তিনি এখন চান নিম্ন আদালত থাকুক পুরোপুরি সরকারের নিয়ন্ত্রনে। ত্রয়োদশ সংশোধনী বাতিল করে তিনি বাংলাদেশে গনতন্ত্রের বারোটা বাজিয়েছেন। এখন তার তৎপরতা বিচার বিভাগকে সরকারের পদানত করার দিকে। যারা ভাবেন খায়রুল হক আদর্শিক চিন্তা থেকে এসব করেছেন তারা ভুল করছেন। মনে করে দেখুন অন্যদের ডিঙ্গিয়ে তিনি প্রধান বিচারপতি হয়েছিলেন। লক্ষ লক্ষ রিলিফের টাকা পেয়েছিলেন। নজীরবিহীন মর্যাদা আর সুবিধা নিয়ে পরে আইন কমিশনের প্রধান হয়েছেন।
খাদ্যমন্ত্রী অ্যাডভোকেট কামরুল ইসলাম গতকাল বলেছেন, বর্তমান প্রধান বিচারপতি সুরেন্দ্র কুমার সিনহা ১৯৯৯ সালে আওয়ামী লীগের শাসনামলেই রাজনৈতিক বিবেচনায় বিচারপতি হয়েছিলেন। তাকে নিয়ে আওয়ামী লীগ একন দুশ্চিন্তায়। এর আগে তিনি প্রধান বিচারপতির পদত্যাগের দাবি জানান। আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মাহবুব উল আলম হানিফ বলেন, মাননীয় বিচারপতি কোন গোষ্ঠীর সাথে হাত মিলিয়ে আপনি এই ষড়যন্ত্র লিপ্ত হয়েছেন তা আমরা জানতে চাই। রায় থেকে এই পর্যবেক্ষণ আপনাকে বাদ দিতে হবে। আমাদের জাতির পিতা একাধিক নয়, আমাদের জাতির পিতা একজন। ফলে সংবিধানের ষোড়শ সংশোধনী অবৈধ ঘোষণা করে দেয়া রায়ে ‘ফাদারস অব দ্য নেশন’ বলতে আপনি কী বুঝিয়েছেন তাও জানতে চাই। আওয়ামী লীগ থেকে বহিস্কৃত ইসলাম বিদ্বেষী বিতর্কিত ব্যাক্তি আব্দুল লতিফ সিদ্দিকী বলেন, ষোড়শ সংশোধনী নিয়ে উচ্চ আদালতের কর্মকান্ড ষড়যন্ত্র কি না তা ইতিহাসের গবেষণার বিষয় হলেও এই রায় ষড়যন্ত্রকারীদের একটি বড় অস্ত্র হয়ে দাঁড়িয়েছে। রায় কে লিখে দিয়েছে জানি কিন্তু বলব না। এর আগে এর আগেও শিল্পমন্ত্রী আমির হোসেন আমু, বাণিজ্য মন্ত্রী তোফায়েল আহমদ, স্থানীয় সরকার পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় মন্ত্রী ইঞ্জিনিয়ার খন্দকার মোশাররফ হোসেন, মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রী মোজাম্মেল হক, স্বাস্থ্যমন্ত্রী মোঃ নাসিমসহ কয়েকজন মন্ত্রী ও সিনিয়র নেতারা ষোড়শ সংশোধনী বাতিল রায় নিয়ে প্রধান বিচারপতির প্রতি ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেন। সরকারের গুরুত্বপূর্ণ মন্ত্রী এবং দায়িত্বশীল নেতাদের কথাবার্তা এবং দৌঁড়ঝাপে বোঝা যায় দেশের সর্বচ্চো বিচারালয় বেশ চাপের মুখেই সময় অতিক্রম করছে।



 

Show all comments
  • বাদাল ২০ আগস্ট, ২০১৭, ১২:২৪ পিএম says : 0
    এই সরকারের কথায় ও কাজে কোন মিল নেই। মুখে বলে বিচার বিভাগ স্বাধীন আর বাস্তবে বিচার বিভাগের উপর খড়গ ধরে আছে। এই দিমুখী আচরণের কারনে মানুষ আর এই সরকারকে বিশ্বাস করেনা
    Total Reply(0) Reply
  • নিজাম ২০ আগস্ট, ২০১৭, ১২:৫১ পিএম says : 0
    এই ধরনের চাপ দেশের ও দেশের গণতন্ত্রের জন্য ভালো নয় বলে মনে করি।
    Total Reply(0) Reply
  • আসাদ ২০ আগস্ট, ২০১৭, ১২:৫৩ পিএম says : 0
    ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ড. আসিফ নজরুল স্যার একদম ঠিক কথা বলেছেন।
    Total Reply(0) Reply
  • ফারদিন ইসলাম ২০ আগস্ট, ২০১৭, ১২:৫৬ পিএম says : 0
    এই বর্তমান পরিস্থিতির প্রেক্ষাপটে এই তথ্য সমৃদ্ধ লেখাটির জন্য স্টালিন সরকার ও দৈনিক ইনকিলাবকে অসংখ্য ধন্যবাদ জানাই।
    Total Reply(0) Reply
  • Md Shahid ২০ আগস্ট, ২০১৭, ১:০২ পিএম says : 0
    মাননীয় প্রধান বিচারপতির সমীপে, স্যার আপনাকে অনেক ধন্যাবাদ। আপনি ই শুধু পারেন যারা লাগামহীন কথা বলে তাদের লাগাম দিতে এবং গণতন্ত রক্ষা করতে।
    Total Reply(0) Reply
  • নাজমুল হুদা ২০ আগস্ট, ২০১৭, ১:০৩ পিএম says : 0
    অন্তত বিচার বিভাগটা স্বাধীন থাকা উচিত.......নইলে দেশের স্বাধীনতার সাথে প্রতারণা করা হয়।
    Total Reply(0) Reply
  • হীরা ২০ আগস্ট, ২০১৭, ১:০৬ পিএম says : 0
    স্যার, আপনি কিছু একটা করেন,এদেশের সাধারন মানুষের জন্য,এখন আপনার দিকে তাকিয়ে আছে সারা বাংলাদেশ
    Total Reply(0) Reply
  • Tauhidur Rahman ২০ আগস্ট, ২০১৭, ১:০৭ পিএম says : 0
    আমি প্রধান বিচার প্রতিকে ধন্যবাদ জানাই আপনি আপনার বিবেকের কাছে অটোল থাকবেন। আপনার মোত লোক দরকার
    Total Reply(0) Reply
  • Asadul Islam ২০ আগস্ট, ২০১৭, ১:০৮ পিএম says : 0
    আমি বিচার পতিকে ধন্যবাদ জানাই আইনের গতিতে আইন চালিয়ে যান জোনগন আছে আপনার সাথে, সতের জয় চিরদিন থাকবে। ১৭ কোটি জনগোন আপনার সাথে আছে আপনি আইন চালুয়া যান।
    Total Reply(0) Reply
  • Ahmed Masum ২০ আগস্ট, ২০১৭, ১:১০ পিএম says : 0
    আমি আমার অন্তঃস্থল থেকে মাননীয় প্রধান বিচারপতি এস কে সিনহাকে অভিনন্দন জানাই,
    Total Reply(0) Reply

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

ঘটনাপ্রবাহ: ষোড়শ সংশোধনী

৫ নভেম্বর, ২০১৭
১৪ সেপ্টেম্বর, ২০১৭

আরও
আরও পড়ুন
এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ
গত​ ৭ দিনের সর্বাধিক পঠিত সংবাদ