Inqilab Logo

বৃহস্পতিবার, ১৮ এপ্রিল ২০২৪, ০৫ বৈশাখ ১৪৩১, ০৮ শাওয়াল ১৪৪৫ হিজরী

দূষণে বিষিয়ে উঠেছে কর্ণফুলী

৩০ প্রজাতির অর্থকরী মাছ বিলুপ্তির পথে

প্রকাশের সময় : ২২ জানুয়ারি, ২০১৬, ১২:০০ এএম

আইয়ুব আলী : চট্টগ্রামের প্রাণ কর্ণফুলী নদী এখন শিল্প-কারখানার বিষাক্ত বর্জ্যে মারাত্মক দূষণের শিকার। নদীরপাড় ও আশপাশে গড়ে ওঠা অসংখ্য অবৈধ বসতি এবং শিল্প-কারখানার বর্জ্য নদীতে পড়ায় কর্ণফুলীর পানি মারাত্মক দূষিত হয়ে পড়ছে। শিল্পবর্জ্যে পানি দূষণের কারণে এ নদীর পরিবেশও বিপণœ হওয়ার পথে। কর্ণফুলী নদীর পানি পান অযোগ্য হয়ে পড়েছে, নদীর তীরে বসবাসরত অধিবাসীরা বাধ্য হয়ে দূষিত পানি পান করে বিভিন্ন রোগে আক্রান্ত হচ্ছেন। দূষণের কারণে বিভিন্ন প্রজাতির মাছও কমে যাচ্ছে। বর্তমানে নদীর প্রায় ৩০ প্রজাতির অর্থকরী মাছ বিলুপ্তির পথে। একসময় কর্ণফুলী নদীতে ডলফিন লাফালাফি করত এখন সেই ডলফিনের দেখা মেলে না। দূষণের পাশাপাশি একই সাথে জলবায়ু পরিবর্তনের শিকারও এ নদী। এছাড়া কর্ণফুলীর শাখা নদী খালে স্লুইচ গেইট নির্মাণে নাব্যতা হ্রাস পেয়েছে।
চট্টগ্রাম সার্কিট হাউসে নৌ-পরিবহন মন্ত্রীর উপস্থিতিতে দেশের গুরুত্বপূর্ণ নদ-নদীর নব্যতা এবং নদীর স্বাভাবিক গতিপ্রবাহ অব্যাহত রাখা সংক্রান্ত সম্প্রতি অনুষ্ঠিত টাস্কফোর্সের ৩০তম সভায় অবৈধ দখল ও দূষণ থেকে রক্ষার ব্যবস্থা না নিলে চট্টগ্রামের কর্ণফুলী নদীও অদূর ভবিষ্যতে ঢাকার বুড়িগঙ্গার ভাগ্য বরণ করতে পারে এমনটি আশংকা ব্যক্ত করা হয়েছে।
১৯৫৩ সালে তৎকালীন পাকিস্তান ইন্ডাস্ট্রিজ ডেভেলাপমেন্ট কর্পোরেশন (পিআইডিসি) উন্নতমানের কাগজ উৎপাদনের জন্য নদীর তীরে কর্ণফুলী পেপার মিল প্রতিষ্ঠা করে। নিষ্কাশন ও পরিশোধনের কোন সুব্যবস্থা না থাকায় প্রতিষ্ঠার পর থেকে এ মিলের বর্জ্য পদার্থ নদীতে ফেলা শুরু হয়। এর ফলে কর্ণফুলী নদীর পানি দূষিত হতে থাকে। বিশেষজ্ঞদের মতে, মাত্রাতিরিক্ত দূষণের ফলে কর্ণফুলী থেকে দ্রুত মাছ বিলুপ্ত হয়ে যাচ্ছে। প্রাকৃতিক মৎস্য প্রজননক্ষেত্র হালদা নদীর মাছের উৎসস্থল ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। মাছের প্রজনন কমে যাচ্ছে বঙ্গোপসাগরের মোহনায়। ফলে সাগরে মাছের মজুদের পরিমাণও দিনদিন হ্রাস পাচ্ছে।
১৯৬০ সালে কাপ্তাই বাঁধ নির্মাণের কাজ শেষ হলে কর্ণফুলী নদীর মাছের ভা-ার ধীরে ধীরে হ্রাস পেতে থাকে। ওই সময়ে নদীর দু’পাড়ে জনবসতি তেমন একটা গড়ে না ওঠায় কর্ণফুলীর পানি দূষণ নিয়ে কেউ ভাবেনি। কিন্তু সময়ের বিবর্তনে কর্ণফুলী নদীর পাড় ও আশপাশে গড়ে ওঠে অসংখ্য বসতি এবং শিল্প কারখানা। এসব শিল্পের বর্জ্য নদীতে পড়া শুরু হলে দূষণের বিরুদ্ধে সজাগ হয়ে ওঠে পরিবেশবাদিসহ সচেতন মানুষ। বিগত এক যুগ আগেও কর্ণফুলী নদীতে প্রচুর মাছ পাওয়া যেত। নদীতে জাল ফেললে মাছে ভরে যেত। কিন্তু এখন সেইদিন আর নেই। দূষণ ও কারেন্ট জাল ব্যবহারের কারণে নদীতে বর্তমানে মাছ নেই বললে চলে।
জেলে সম্প্রদায় তাদের বাপ-দাদার বংশপরম্পরায় কর্ণফুলী নদীতে মাছ মেরে জীবিকা নির্বাহ করত। কাপ্তাই বাঁধের আগে নদীতে নানা মাছে ভরপুর ছিল। এমনকি নদীর শাখা খাল-বিলও মাছে ভর্তি ছিল। সেখান থেকে সারা বছরই মাছ পাওয়া যেত। কিন্তু নদীতে কারেন্ট জাল ও দূষণের কারণে মাছ ক্রমান্বয়ে হ্রাস পেতে থাকে। এতে সারাদিন জাল ফেললেও তেমন মাছ মেলে না। হতাশায় জেলেরা কুলে ফিরে। মাছ না পাওয়ায় তারা পরিবার-পরিজন নিয়ে আর্থিক অনটনে রয়েছেন। অনেক জেলে ইতোমধ্যে পেশা ছেড়ে অন্য পেশায় চলে গেছে।
মৎস্য বিশেষজ্ঞের মতে, এক সময় কর্ণফুলী নদীতে প্রায় ১৪০ প্রজাতির মাছ পাওয়া যেত। এর মধ্যে মিঠা পানির ৬০, মিশ্র পানির ৫৯ এবং সামুদ্রিক ১৫ প্রজাতির। কিন্তু দূষণের কারণে ইতোমধ্যে মিঠা পানির মাছ বিলুপ্ত প্রায়। অবশিষ্ট মাছের মধ্যে ১০ থেকে ২০ প্রজাতি ছাড়া অন্য প্রজাতির মাছ এখন পাওয়া যায় না। মূলত: শিল্প-কারখানার বর্জ্যে মারাত্মক দূষণের কারণে মুখ থুবড়ে পড়েছে কর্ণফুলী নদী। নাব্যতা হ্রাস এবং নদীর শাখা খাল ও কাপ্তাই লেকের স্লুইচ গেইটের পানি প্রবাহে বাধা পেয়ে নদীর স্বাভাবিক প্রবাহ কমে গেছে। এক সময়ের বিশাল মৎস্য ভা-ারে এখন সহজে মাছ মিলে না। এতে যেন দুঃখ নেমে এসেছে জেলে সম্প্রদায়ের মধ্যে।
কর্ণফুলী নদীর চান্দগাঁও মোহরা, রাউজানের কচুখাইন, চৌধুরীহাট, উহলং, লাম্বুরহা, কাটাখালী, রাঙ্গুনিয়ার বেতাগী বড়–য়াপাড়া, সরফভাটা, চন্দ্রঘোনা, বোয়ালখালীর খেলারঘাট, ফকিরাখালী, নোয়ারাস্তা, গুইদ্দ্যাখালী, কধুরখীল, কৈবর্তপাড়াসহ বিভিন্ন এলাকায় প্রায় ৩০টি জেলে পাড়া রয়েছে। এসব জেলে পাড়ায় প্রায় ১০ হাজার জেলে রয়েছে। তাদের প্রধান পেশা নদী থেকে মৎস্য আহরণ। কিন্তু নদীতে মাছ কমে যাওয়ার কারণে তাদের পেশা হুমকির মধ্যে পড়েছে। ইতোমধ্যে অর্ধেকেরও বেশি জেলে তাদের পেশা বদল করে অন্য পেশায় ঝুঁকে পড়েছেন। মৎস্য গবেষকদের মতে, বর্তমানে নদীর প্রায় ৩০ প্রজাতির অর্থকরী মাছ বিলুপ্তির পথে। মূলত মাত্রাতিরিক্ত দূষণের কারণেই মাছ দ্রুত বিলুপ্ত হয়ে যাচ্ছে বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা। দূষণের কারণে নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে নগর পরিবেশের ওপর, অন্যদিকে জীবিকা সংকটে পড়ছে এ অঞ্চলের হাজার হাজার জেলে।



 

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

ঘটনাপ্রবাহ: দূষণে বিষিয়ে উঠেছে কর্ণফুলী
আরও পড়ুন
এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ
গত​ ৭ দিনের সর্বাধিক পঠিত সংবাদ