Inqilab Logo

শুক্রবার, ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ০৬ বৈশাখ ১৪৩১, ০৯ শাওয়াল ১৪৪৫ হিজরী

গণতন্ত্রের মানসপুত্র হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী

আফতাব চৌধুরী | প্রকাশের সময় : ৮ সেপ্টেম্বর, ২০১৭, ১২:০০ এএম

জাতীয় কবি বলতে যেমন কাজী নজরুল ইসলামকে বোঝায়, শেরে বাংলা বলতে যেমন এ কে ফজলুল হককে বোঝায়, বঙ্গবন্ধু বলতে যেমন শেখ মুজিবুর রহমানকে বোঝায় ঠিক তেমনি গণতন্ত্রের মানসপুত্র বলতে সোহরাওয়ার্দীকেই বোঝায়। হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী ছিলেন গণতান্ত্রিক আন্দোলনের একজন মহান পুরোধা। জীবনের অন্তিম মূহুর্ত পর্যন্ত তিনি বিশ্বাস করতেন রাজনৈতিক অধিকার প্রতিষ্ঠায় গণতন্ত্রের বিকল্প নেই।
যেসকল মনীষীর মহৎ রাজনৈতিক প্রচেষ্টার মাধ্যমে এ অঞ্চলে গণতন্ত্রের শুভ সূচনা হয়েছে তাদের মধ্যে অন্যতম হলেন হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী। মানুষের গণতান্ত্রিক অধিকার প্রতিষ্ঠায় তিনি আজীবন সংগ্রাম করে তাঁর অবদানের স্বীকৃতি স্বরূপ ‘গণতন্ত্রের মানসপুত্র’ হিসেবে ব্যাপক পরিচিতি, সুনাম ও সুখ্যাতি লাভ করেন। সকল লোভ, স্বার্থ ও ক্ষমতার মোহের উর্ধে উঠে গণতান্ত্রিক চেতনাকে সমুন্নত রাখাই ছিল তাঁর সারা জীবনের সাধনা। তৎকালীন অখন্ড উপমহাদেশের মুসলিম পরিবারসমূহের মধ্যে শিক্ষা-দীক্ষায় শীর্ষস্থানীয় কলকাতা শহরের ঐতিহ্যবাহী ‘সোহারাওয়ার্দী’ পরিবারে ১৮৯২ খ্রীষ্টাব্দের ৮ই সেপ্টেম্বর তারিখে জন্মগ্রহণ করেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী। তাঁর পিতার নাম জাহিদ সোহারাওয়ার্দী এবং মাতার নাম খুজিস্তা আখতার বানু। পরিবারের দ্বিতীয় সন্তান ছিলেন তিনি। গৃহ শিক্ষকের কাছে প্রাথমিক শিক্ষা শেষ করার পর তিনি কলকাতা মাদরাসা স্কুলে ভর্তি হন। এ স্কুল থেকে কৃতিত্বের সাথে প্রথম বিভাগে ম্যাট্রিক পাশ করেন। এরপর তিনি কলকাতার প্রাচীনতম শিক্ষা প্রতিষ্ঠান সেন্ট জেভিয়ার্স কলেজে ভর্তি হন। শৈশব থেকেই ছাত্র হিসাবে তিনি ছিলেন অত্যন্ত মেধাবী এবং প্রতি ক্লাসেই উত্তীর্ণ হতেন কৃতিত্বের সাথে।
একজন সফল আইনবিদ ও রাজনীতিবিদ হিসেবে জীবনে বিভিন্ন বিষয়ে পূর্বপুরুষের ঐতিহ্যপূর্ণ উত্তরাধিকার লাভের সাথে সাথে হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী রাজনৈতিক প্রতিভারও অধিকারী হয়েছিলেন উত্তরাধিকার সুত্রে। সে সময় হাতে গোনা কয়েকটি ব্যতিক্রম ছাড়া শিক্ষা ক্ষেত্রে পিছিয়ে থাকা মুসলমান জাতির সরকারী উচ্চপদে কোন ঠাঁই ছিল না। তারা ছিল সত্যিকার অর্থে নেতৃত্বহীন, সংগঠনহীন। উচ্চ ও অভিজাত পরিবারে রূপোর চামচ মুখে নিয়ে জন্মগ্রহণ করলেও সাধারণ মানুষের দুর্দশা শহীদ সোহরাওয়ার্দীর হৃদয়কে বিচলিত করে তুলত। অসহায় প্রজার উপর জমিদারের নিপীড়ন, পরাধীন জাতির উপর শ্বেতাংগ শাসকের সীমাহীন অবিচার তাঁকে পীড়া দিত। দেশ ও জাতির প্রতি এ মমত্ববোধই পরবর্তীতে তাঁকে রাজনীতিতে টেনে এনেছিল। সেন্ট জেভিয়ার্স কলেজ থেকে তিনি প্রথম শ্রেণীতে অনার্সসহ বিএসসি পাশ করেন। এরপর উচ্চ শিক্ষার উদ্দেশ্যে ইংল্যান্ড গমন করেন এবং বিশ্ব বিখ্যাত অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হন। এই বিশ্ববিদ্যালয় থেকে শহীদ সোহরাওয়ার্দী কৃতিত্বের সাথে ইংরেজিতে এমএ এবং জুরিসপ্রুডেন্সে অনার্স ও দুর্লভ বিসিএল ডিগ্রি লাভ করেন। সমগ্র উপমহাদেশে ক’জন মাত্র বিসিএল ডিগ্রিদারীদের মধ্যে সোহরাওয়ার্দী ছিলেন অন্যতম। বিসিএল হলো আইন শাস্ত্রের সর্ব্বোচ্চ ডিগ্রি। ১৯১৮ সালে তিনি গ্রেজ ইন হতে ব্যারিস্টারী পাশ করেন।
এরপর তিনি দেশে ফিরে এস কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে আরবী ভাষায় এম.এ ডিগ্রী লাভ করেন। ১৯১৮ সালে ২৬ বৎসর বয়সে তিনি আইন ব্যবসা শুরু করেন। বৃটিশ সাম্রাজ্যবাদ অধীন ভারতের নির্যাতিত মানুষের ভাগ্য পরিবর্তনের লক্ষ্যে, আইন ব্যবসার সাথে সাথে রাজনীতিতে ঝুঁকে পড়েন সোহরাওয়ার্দী। রাজনৈতিক জীবনের প্রথমার্ধে তিনি ১৯২১ সালে ২৯ বৎসর বয়সে বঙ্গীয় ব্যবস্থাপক সভার সদস্য নির্বাচিত হন। এ সংগঠনের প্রভাবশালী সদস্য হিসাবে তাঁর রাজনৈতিক দক্ষতা সকলের দৃষ্টি আকর্ষণ করে। এরপর তিনি একে একে কলকাতা খেলাফত কমিটির সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্ব লাভ করেন এবং কলকাতা সিটি কর্পোরেশনের ডেপুটি মেয়র নির্বাচিত হন। ১৯৩৭ সালে অখন্ড বাংলার নির্বাচিত প্রধানমন্ত্রী শেরে বাংলা এ.কে. ফজলুল হকের মন্ত্রী পরিষদের বাণিজ্য ও শ্রমমন্ত্রীর দায়িত্ব লাভ করেন। ১৯৪৩ সালে খাজা নাজিমুদ্দিনের নেতৃত্বে গঠিত মন্ত্রী পরিষদের খাদ্য ও সরবরাহ মন্ত্রীর দায়িত্বও পালন করেন। ১৯৪৬ সালে অনুষ্ঠিত সাধারণ নির্বাচনে জয়লাভের পর হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী অখন্ড বাংলার প্রধানমন্ত্রী হন। ১৯৪৭ সালের ৭ আগস্ট পর্যন্ত তিনি বাংলার প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব পালন করেন। ১৯৪৭ সালের ১৪ আগস্টে কোন সংঘর্ষ ছাড়াই ব্রটিশ সাম্রাজ্যবাদের কাছ থেকে পাকিস্তান নামক রাষ্ট্র স্বাধীন হয়। তার মধ্যে একটা পশ্চিম পাকিস্তান অপর অংশ পূর্ব পাকিস্তান নামে খ্যাত হয়।
অখন্ড উপমহাদেশে সাম্রাজ্যবাদী ব্রটিশ শাসনামলে বাংলার প্রধানমন্ত্রী হিসাবে শহীদ সোহরাওয়ার্দী স্বদেশের স্বার্থ সংশ্লিষ্ট বিষয়ে কেন্দ্রীয় বৃটিশ সরকারের সাথে আপোসহীন ও সাহসী ভুমিকা পালন করেন। বয়সে নবীন হলেও অসাধারণ বাগ্নীতা এবং সরকারী নীতির বিরুদ্ধে অনলবর্ষী ও ক্ষুরধার বক্তব্য দ্বারা অল্পদিনের মধ্যেই তিনি পরিষদের ভিতর ও বাহিরে সবার দৃষ্টি আকর্ষণ করতে সক্ষম হন। রাজনৈতিক জীবন শুরুর অল্প কিছুদিনের মধ্যেই তিনি একজন আপসহীন, অসাধারণ ব্যক্তিত্বসম্পন্ন নেতা হিসাবে স্বীকৃতি লাভ করেন। এ সময় তিনি দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন দাশকে অকাট্য যুক্তিদ্বারা বোঝাতে সক্ষম হন যে রাজনৈতিক, সামাজিক, আর্থিক ও অন্যান্য ক্ষেত্রে মুসলমানদের সহযোগিতা পেতে হলে সর্বক্ষেত্রে জনসংখ্যার অনুপাতে তাদের প্রতিনিধিত্ব থাকা অপরিহার্য। এরই পরিপ্রেক্ষিতে দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন দাশ স্বাক্ষরিত ঐতিহাসিক বেঙ্গল ন্যাশন্যাল প্যাক্টের ভিত্তিতে শতকরা ৫৬টি চাকুরী অবিভক্ত বাংলার মুসলমানদের প্রদানের ব্যবস্থা করা হয়। এটা শুধু শহীদ সোহরাওয়ার্দীর অসাধারণ ব্যক্তিত্ব, দূরদর্শিতা ও রাজনৈতিক প্রজ্ঞার ফলেই সম্ভব হয়েছিল।
উচ্চ শিক্ষিত ও দূরদর্শী রাজনীতিবিদ সোহরাওয়ার্দী বৃটিশ সাম্রাজ্যবাদকে তোয়াজ না করে তার হিংসামূলক কাজের তীব্র প্রতিবাদ করতেন। বৃটিশ সাম্রাজ্যবাদীদের ইন্ধনের ফলে ১৯৪৭-১৯৪৮ সালে ভারত উপমহাদেশে এক ভয়াবহ হিন্দু মুসলিম দাঙ্গা সৃষ্টি করা হয়েছিল। উক্ত সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা নিরসনকল্পে সোহরাওয়ার্দী ও মহাত্মা গান্ধী একই সাথে উক্ত ঐতিহাসিক শান্তি মিশনে ভারত উপমহাদেশের বিভিন্ন দুর্গম অঞ্চল পায়ে হেঁটে সফর করেন। এই মহান দুই নেতার শান্তি মিশনের ফলে তখন ভয়াবহ সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা বন্ধ হয়।
১৯৪০ সালের কথা। ঘটেছিল এক ছোট্ট মজার ঘটনা, তখন অখন্ড বাংলার প্রধানমন্ত্রী শেরে বাংলা এ কে ফজলুল হকের সাথে গোপালগঞ্জের মিশন হাই স্কুল পরিদর্শনে গেলেন বাণিজ্য ও শ্রমমন্ত্রী হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী, মাওলানা আব্দুল হামিদ খান ভাসানী। স্কুল পরিদর্শন শেষ করে মন্ত্রীদ্বয় ফিরছিলেন ডাক বাংলোর দিকে, এমন সময় সাহসী ছিপছিপে লম্বা এক ছেলের নেতৃত্ব বেশ ক’য়েকজন ছাত্র মন্ত্রীদ্বয়ের পথ অবরোধ করে রাখে। স্কুলের প্রধান শিক্ষক ছেলেগুলোকে রাস্তা থেকে সরিয়ে দিতে আপ্রাণ চেষ্টা করলেন। তখন ভয়ে সবাই রাস্তা থেকে সরে গেলেও সেই ছেলেটি কিন্তু নাছোড়বান্দা। ছেলেটি একা সাহসিকতার সাথে দুই দু’জন মন্ত্রীকে রাস্তায় অবরুধ করে রেখে নির্ভয়ে স্কুলের দুরবস্থার কথা জানালো। ছেলেটির অসম্ভব সাহস ও প্রতিবাদী রূপ দেখে মন্ত্রীদ্বয় মুগ্ধ হলেন এবং সাথে সাথে ছেলেটির সকল ন্যায্য দাবী মেনে নিয়ে স্কুল উন্নয়নের জন্য টাকা বরাদ্দ করলেন। এই ঘটনার পর সোহরাওয়ার্দী ছেলেটির প্রতি দারুণভাবে আকৃষ্ট হয়ে পড়েন। সাহসী ও প্রতিবাদী সেই ছেলেটিকে রাজনীতির অঙ্গনে প্রতিষ্ঠা করার স্বপ্ন দেখলেন তিনি। সাথে সাথে সোহরাওয়ার্দী ছেলেটি সম্পর্কে খোঁজ খবর নিয়ে জানতে পারলেন, গোপালগঞ্জ মিশন হাই স্কুলের নবম শ্রেণীর ছাত্রটির নাম শেখ মুজিবুর রহমান। টুঙ্গিপাড়া গ্রামের শেখ লুৎফর রহমানের পুত্র। সোহরাওয়ার্দী ডাক বাংলোয় ফিরে লোক মারফত ডেকে পাঠালেন সেই ছেলেটিকে। অতঃপর ডাক বাংলোয় এসে বাংলার প্রধানমন্ত্রী এবং বাণিজ্য ও শ্রমমন্ত্রীর সাথে ঘনিষ্টভাবে পরিচিত হলো কিশোর শেখ মুজিব। মুজিবকে বুকে জড়িয়ে ধরলেন সোহরাওয়ার্দী। এরপর থেকে রাজনীতিবিদ সোহরাওয়ার্দী ও কিশোর মুজিবের মধ্যে গড়ে উঠলো ঘনিষ্ট সম্পর্ক। সোহরাওয়ার্দী নিজের মত করে প্রগতিশীল ও গণতান্ত্রিক রাজনৈতিক চিন্তাধারায় গড়ে তুললেন শেখ মুজিবকে। শেখ মুজিবও অত্যন্ত দক্ষতার সাথে অর্জন করলেন রাজনৈতিক শিক্ষাগুরুর মহান আদর্শ। পরবর্তী পর্যায়ে শহীদ সোহরাওয়ার্দী যোগ্য রাজনৈতিক উত্তরসূরী বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের বলিষ্ট নেতৃত্বে মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে বাংলাদেশ স্বাধীন ও সার্বভৌম রাষ্ট্রে পরিণত হয়। পূর্ব পাকিস্তানের ক্ষমতাসীন মুসলিম লীগ সরকারকে উৎখাত করার লক্ষ্যে কয়েকটি বিরোধী দলকে ঐক্যবদ্ধ করার ১৯৫৩ সালে ‘যুক্তফ্রন্ট’ নামে একটি প্রভাবশালী বিরোধী রাজনৈতিক ফোরাম গঠিত হয়। সোহরাওয়ার্দী ছিলেন তার অন্যতম শীর্ষনেতা। যুক্তফ্রন্ট এর অন্তর্ভুক্ত বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে অন্যতম ছিল, আওয়ামী লীগ, কৃষক শ্রমীক পার্টি, নেজামে ইসলাম পার্টি ও গণতন্ত্রী পার্টি। ১৯৫৪ সালে অনুষ্ঠিত পূর্ব পাকিস্তানের সাধারণ নির্বাচনে ঐতিহ্যবাহী নৌকা প্রতীক নিয়ে যুক্তফ্রন্ট নির্বাচনে জয়লাভ করে। ১৯৫৪ সালের ঐতিহাসিক এই সাধারণ নির্বাচনে পূর্ব পাকিস্তানের ক্ষমতাসীন মুসলিম লীগ চরমভাবে পরাজয় বরণ করে। সুদক্ষ রাজনীতিবিদ সোহরাওয়ার্দীর সফল রাজনৈতিক জীবনের ঐতিহাসিক বিজয় হিসাবে অভিহিত করা হয় উক্ত নির্বাচনকে। ১৯৫৬ সালের ১২ সেপ্টেম্বর তারিখে গণতান্ত্রিক আন্দোলনের প্রাণপুরুষ শহীদ সোহরাওয়ার্দী পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী নির্বাচিত হন। পাকিস্তানের রাজনীতিতে সামরিক শাসনের পূর্বাভাস, চরম ষড়যন্ত্র এবং বিভিন্ন রাজনৈতিক মতবিরোধের কারণে ১৯৫৭ সালের ১৬ অক্টোবর তারিখে সোহরাওয়ার্দী পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রীর পদ থেকে পদত্যাগ করেন। ক্ষমতার লোভহীন ও আপোসহীন একজন সত্যিকার অর্থে রাজনীতিবিদ এর পরিচয় দিয়েছেন তিনি এই পদত্যাগের মাধ্যমে। ইচ্ছা করলে তিনি এই ক্ষমতা ধরে রাখতে পারতেন। রক্তপাত হতো, কিন্তু তিনি করেননি। ১৯৫৮ সালে পাকিস্তানে সামরিক শাসন জারি করা হয়। এসময় সামরিক শাসক কর্তক গ্রেফতার হয়ে কয়েক মাস কারাবরণের পর মুক্তি লাভ করেন সোহরাওয়ার্দী। মুক্তি লাভের পর সোহরাওয়ার্দী সামরিক শাসনের বিরুদ্ধে তথা গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার সঙ্গে বৃহত্তর আন্দোলনে ঝাঁপিয়ে পড়েন। তাঁর নেতৃত্বে সমগ্র পাকিস্তানে গণতান্ত্রিক আন্দোলন সুসংহত হয়। যে সময় পাকিস্তানে গণতন্ত্রের আন্দোলন তুঙ্গে, দুর্ভাগ্যবশত তখন শারীরিকভাবে অসুস্থ হয়ে পড়েন। তিনি অতঃপর চিকিৎসার জন্য বৈরুত গমন করেন। ১৯৬৩ সালের ৫ ডিসেম্বর এ মহান নেতা কোটি কোটি মানুষকে কাঁদিয়ে স্বদেশ-স্বজন হতে বহুদূরে বৈরুতে একটি হোটেলের নির্জন কক্ষে মৃত্যুর হিমশীতল কোলে ঢলে পড়েন। গণতন্ত্রের মানসপুত্র হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীর মৃত্যুতে, লন্ডন থেকে প্রকাশিত বিশ্ববিখ্যাত টাইমস পত্রিকায় তাঁর বৈচিত্রময় জীবনী প্রকাশিত হয় এবং এতে বলা হয়, তিনি একজন স্বাধীনচেতা বিরাট ব্যক্তিত্বসম্পন্ন পুরুষ ও অসম সাহসী ব্যক্তি ছিলেন। স্বাধীনতা পূর্ব আমলে এবং পাকিস্তানের রাজনীতিতে তিনি বর্ণাঢ্য ভূমিকা পালন করেন। শহীদ সোহরাওয়ার্দী ছিলেন গণতন্ত্রের অতন্দ্র প্রহরী। সরকার প্রধান বা বিরোধী দলের নেতা- সর্ব অবস্থায় গণতন্ত্রই ছিল তাঁর জীবনের মূলমন্ত্র। গণতন্ত্র হত্যাকারী স্বৈরাচারের উত্থানকে তিনি মেনে নিতে পারেননি কখনও। তাই তাঁর উপর নেমে আসে তৎকালীন সামরিক চক্রের নির্যাতন। গণতন্ত্রের আজীবন সাধক হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী গৃহবন্দী দশা থেকে মুক্ত হয়ে ভগ্নস্বাস্থ্য নিয়ে পাকিস্তান থেকে সেই যে বাইরে গেলেন আর জীবদ্দশায় ফিরে আসেননি। তিনি জানতেন যে শুধুমাত্র গণতান্ত্রিক শাসন ব্যবস্থায় অধীনেই জনগণের অধিকার সংরক্ষিত হতে পারে। মৃত্যুর আগে তিনি আক্ষেপ করে বলেছিলেন, ‘আমি যখন কারও কাজে লাগছি না, যদি শুধু নিজের জন্যই বাঁচতে হয়, তা হলে সে বাঁচার কি মূল্য আছে।’ শহীদ সোহরাওয়ার্দীর জীবন ছিল জনগণের জন্য, গণতন্ত্রের জন্য, দেশ ও জাতির জন্য। বহুমুখী প্রতিভার অধিকারী হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী ছিলেন একজন মহান দেশপ্রেমিক ও রাষ্ট্রনেতা। আত্মস্বার্থ কোনদিন তাকে পথভ্রষ্ট করতে পারেনি। ক্ষমতার জন্য অন্যায়ের কাছে তিনি কোনদিন মাথা নত করেননি। পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী হয়েও তিনি জনগণের মানুষ একথা একদিনের জন্যও বিস্মৃত হননি। কথা ও কাজে তিনি ছিলেন নিখাদ গণতন্ত্রী। তিনি আন্তরিকভাবে বিশ্বাস করতেন জবাবদিহিমূলক সরকার প্রতিষ্ঠার মাধ্যমেই জনগণের মৌলিক অধিকার এবং রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক স্বাধীনতা নিশ্চিত হতে পারে। তিনি মনে প্রাণে বিশ্বাস করতেন নিরপেক্ষভাবে নির্বাচিত জন প্রতিনিধিদের দ্বারা গঠিত সরকারের মাধ্যমেই গণতন্ত্রের বিকাশ সম্ভব। আর তাইতো দেশ ও জাতির জন্য, নির্যাতিত-নিপীড়িত মানুষের অধিকার আদায়ের জন্য আরাম-আয়েশ ত্যাগ করে গণতন্ত্রের জন্যই জীবনের সুখ স্বাচ্ছন্দ্য বিসর্জন দিয়ে টেকনাফ থেকে শুরু করে গিরিসংকুল সোয়াতের পথে প্রান্তরে মিছিল করেছেন, আন্দোলন করেছেন। গণতন্ত্র ব্যর্থ হয়েছে এ কথা মানতে তিনি কোনও সময়ই রাজী ছিলেন না। তাইতো তিনি ‘গণতন্ত্রের মানসপুত্র’ হয়ে কোটি কোটি গণতন্ত্রী মানুষের মনে ঠাঁই করে নিয়েছেন।
লেখক : সাংবাদিক ও কলামিস্ট



 

Show all comments
  • মো:আফছার উদ্দীন মৃধা ৯ ফেব্রুয়ারি, ২০১৯, ৭:১১ পিএম says : 0
    সোহরাওয়ার্দীর জীবনীর আরো নানা দিক তোলে দরলে ভালো হত।
    Total Reply(0) Reply
  • md saiful islam ৫ মার্চ, ২০১৯, ১২:১৩ পিএম says : 0
    গঠনতন্ত্রের মানসপুত্র অভিহিত করা হয় কত সালে
    Total Reply(0) Reply

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

আরও পড়ুন
গত​ ৭ দিনের সর্বাধিক পঠিত সংবাদ