Inqilab Logo

শনিবার, ২০ এপ্রিল ২০২৪, ০৭ বৈশাখ ১৪৩১, ১০ শাওয়াল ১৪৪৫ হিজরী

মিয়ানমারের নীতি-অবস্থানের প্রতি ভারতের নজিরবিহীন সমর্থন

মুনশী আবদুল মাননান | প্রকাশের সময় : ১০ সেপ্টেম্বর, ২০১৭, ১২:০০ এএম

মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যে সুপরিকল্পিত গণহত্যা চলছে। এ গণহত্যার শিকার সংখ্যালঘু রোহিঙ্গা মুসলিম জনগোষ্ঠী। সেনাবাহিনী, বিজিপি, পুলিশ ও উগ্রবাদী বৌদ্ধরা সংঘবদ্ধভাবে এই গণহত্যা চালাচ্ছে। তারা যেমন রোহিঙ্গাদের নির্বিচারে হত্যা করছে, তেমনি তাদের বাড়িঘর পুড়িয়ে দিচ্ছে, নারীদের ধর্ষণ করছে, ঢালাও গ্রেফতার ও নির্যাতন করছে এবং বাংলাদেশের দিকে তাড়িয়ে দিচ্ছে। এ বছর ফেব্রুয়ারী মাসে জাতিসংঘের মানবাধিকার সংক্রান্ত বিশেষ রেপোটিয়ার ইয়াংগ লি রোহিঙ্গাদের ওপর নিপীড়ন-নির্যাতনের বর্ণনা দিতে গিয়ে বলেছিলেন, মিয়ানমারের নিরাপত্তা বাহিনী যে সব অপরাধ করেছে তা মানবতাবিরোধী অপরাধ ছাড়া আর কিছুই নয়। গত কয়েকদিনে রোহিঙ্গাদের ওপর যা কিছুই হয়েছে বা হচ্ছে তাকে বলা যায়, মানবতাবিরোধী অপরাধের চূড়ান্ত। সাতদিনেরও কম সময়ে সেখানে তিন হাজার রোহিঙ্গাকে নৃশংসভাবে হত্যা করা হয়েছে। তাদের উল্লেখযোগ্য সংখ্যক নারী ও শিশু। ধর্ষণের ঘটনা কত ঘটেছে তার ইয়ত্তা নেই। এই সময়ে অন্তত ১০ হাজারের বেশী গ্রাম পুড়িয়ে দেয়া হয়েছে। অন্তত তিন লাখ রোহিঙ্গা নারী-পুরুষ-শিশু বাংলাদেশে প্রবেশ করেছে। আরো হাজার হাজার প্রবেশের অপেক্ষায় আছে। এই গণহত্যা, গণনির্যাতন ও গণবিতাড়নের ঘটনা শুরুতে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় অতটা আমলে না নিলেও বিভিন্ন মাধ্যমে বর্বরতা-নিষ্ঠুরতার যে বিবরণ ও চিত্র বেরিয়ে এসেছে, তাতে সহৃদয় ও বিবেকবান মানুষ বিস্মিত ও হতবাক। ইতোমধ্যে বিভিন্ন দেশ ও আন্তর্জাতিক সংস্থা গণহত্যা, গণনির্যাতন ও গণবিতাড়ন বন্ধের জন্য মিয়ানমারের প্রতি আহ্বান জানিয়েছে। মুসলিম দেশগুলোতে এর প্রতিক্রিয়া সঙ্গতকারণেই বেশি হওয়ার কথা।
ইন্দোনেশিয়ার পররাষ্ট্রমন্ত্রী মিয়ানমার সফর শেষে বাংলাদেশও সফর করে গেছেন। তিনি মিয়ানমারের নেত্রী অংসান সুচির সঙ্গে সাক্ষাৎ করে গণহত্যা, গণনির্যাতন ও গণবিতাড়নের নিন্দা জানিয়েছেন। একই সঙ্গে রাখাইনে শান্তি ও নিরাপত্তা ফিরিয়ে আনা, সর্বোচ্চ সংযত আচরণ করা ও সহিংসতা বন্ধ, জাতি-ধর্ম নির্বিশেষে সকলের জীবন সুরক্ষা এবং কফি আনানের সুপারিশ বাস্তবায়নের প্রস্তাব দিয়েছেন। বাংলাদেশ সফরের সময় তিনি প্রধানমন্ত্রী ও পররাষ্ট্রমন্ত্রীর সঙ্গে বিষয়টি নিয়ে কথা বলেছেন। তুরস্কের প্রেসিডেন্ট এরদোগান শুরু থেকেই এ ব্যাপারে সক্রিয় হয়েছেন। তিনি অংসান সুচি ও বাংলাদেশের প্রেসিডেন্টের সঙ্গে টেলিফোনে কথা বলেছেন। তার উদ্বেগ জানিয়েছেন। তুরস্কের ফার্স্ট লেডি এবং পররাষ্ট্রমন্ত্রী বাংলাদেশে সফরে এসে রোহিঙ্গদের আশ্রয় শিবির পরিদর্শন করে গেছেন। রোহিঙ্গাদের জন্য সব রকমের সহায়তা দেয়ার আশ্বাস দিয়ে গেছেন। ইরান, পাকিস্তান, কাতার, মালয়েশিয়া প্রভৃতি দেশ উদ্বেগ জানানোর পাশাপাশি হত্যা-সহিংসতা বন্ধ করার জন্য মিয়ানমারের প্রতি আহ্বান জানিয়েছে। সবচেয়ে কঠোর প্রতিক্রিয়া দেখিয়েছে মালদ্বীপ। সে মিয়ানমারের সঙ্গে বাণিজ্য সম্পর্ক ছিন্ন করেছে। ওদিকে ওআইসি, জাতিসংঘ, ইউরোপীয় ইউনিয়ন প্রভৃতি সংস্থাও সক্রিয় হয়ে উঠেছে। জাতিসংঘ মহাসচিব নিরাপত্তা পরিষদকে চিঠি দিয়ে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেয়ার আহ্বান জানিয়েছেন। ওআইসি জাতিসংঘকে পদক্ষেপ নেয়ার তাকিদ দিয়েছে। ইউরোপীয় ইউনিয়ন রোহিঙ্গা নির্যাতনের তথ্য সংগ্রহে শিগগিরই একটি ফ্যাক্ট ফাইন্ডিং মিশন পাঠানোর কথা জানিয়েছে। দু:খের বিষয়, বিশ্বের প্রভাবশালী দেশগুলো যেমন, যুক্তরাষ্ট্র, ব্রিটেন, ফ্রান্স, জার্মান, অস্ট্রেলিয়া, রাশিয়া, চীন প্রভৃতি দেশের জোরালো প্রতিক্রিয়া এখনো পাওয়া যায়নি। উদ্বেগ জানানোর মধ্যেই তাদের প্রতিক্রিয়া সীমিত রয়েছে। যদি রোহিঙ্গারা মুসলমান না হয়ে খ্রীস্টান বা অন্য কোনো ধর্মীয় জনগোষ্ঠী হতো তাহলে হয়তো এতদিন তুলকালাম হয়ে যেতো। রাষ্ট্রীয় সংস্থা হিসাবে সার্ক কিংবা আসিয়ান নিরব। তবে এখন পর্যন্ত ভারত ছাড়া আর কোনো দেশ প্রকাশ্য মিয়ানমারের অবস্থান সমর্থন করেনি। বিস্ময়করভাবে ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি মিয়ানমারে গিয়ে এই সমর্থন জানিয়েছেন। মিয়ানমারের রোহিঙ্গা নির্মূল অভিযান কোনো বিবেচনাতেই সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে লড়াইয়ের অংশ নয়। মিয়ানমার কয়েকটি নিরাপত্তা চৌকিতে হামলার ঘটনাকে সন্ত্রাসী হামলা বলে অভিহিত করে অভিযানের যৌক্তিকতা প্রমাণের চেষ্টা করছে। অথচ নিরাপত্তা চৌকিতে হামলা হওয়ার বেশ কয়েকদিন আগেই রাখাইনের মুসলিম অধুষিত গ্রামগুলোতে সেনাবাহিনী মোতায়েন করা হয়। তখনই রোহিঙ্গাদের মধ্যে এ আশঙ্কা দেখা দেয় যে, আরেকটি সেনা অভিযান, হত্যা, নির্যাতন, ধরপাকড় বুঝি আসন্ন। কার্যত সে আশঙ্কাই সত্য হয়েছে। নিরাপত্তা চৌকিতে হামলার ঘটনা এক্ষেত্রে একটা যুৎসই অজুহাত হিসাবে কাজে এসেছে। হতে পারে, এটা ইনসাইড গেম অথবা কাঁকতালীয় ব্যাপার। উল্লেখ করা যেতে পারে, মিয়ানমারের নিরাপত্তা চৌকিতে হামলার পর ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে একটি বিবৃতি দেয়া হয়। সেখানে সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে মিয়ানমারের পাশে থাকার অঙ্গীকার করা হয়। মোদি মিয়ানমারে গিয়ে সে অঙ্গীকারই যে পুনর্ব্যক্ত করেছেন সেটা বুঝা যায় রোহিঙ্গা গণহত্যা, নজিরবিহীন নির্যাতন ও বিতাড়ন প্রসঙ্গে তার একটি কথাও না বলা থেকে। তিনি এতটুকু উদ্বেগ প্রকাশ করেননি। অংসান সুচির বক্তব্যও এর একটি নির্ভরযোগ্য প্রমাণ। সুচি-মোদি বৈঠকের পর সুচি জানান, সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে ভারতীয় মনোভাবের জন্য তিনি কৃতজ্ঞ। তিনি এ আশাও ব্যক্ত করেন যে, দু’ দেশ একযোগে সন্ত্রাসের মোকাবেলা করতে পারবে। তার এ কথা থেকে সহজেই অনুমিত হয়, তথাকথিত সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে একযোগে লড়াই করার ক্ষেত্রে দু’ দেশের মধ্যে ঐক্যমত্য প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। মিয়ানমারে রোহিঙ্গা হত্যা- নির্যাতনের ইতিহাস দীর্ঘ। স্বাধীনতা লাভের পরে পরেই এ হত্যা-নির্যাতনের নব অধ্যায় সুচিত হয়। এরপর ১৯৮২ সালে সামরিক শাসক নে উইন।
রোহিঙ্গাদের নাগরিকত্ব খারিজ করে দিলে এ হত্যা-নির্যাতন ব্যাপক মাত্রায় বেড়ে যায়। সেই থেকে লাগাতার রোহিঙ্গাদের হত্যা করা হচ্ছে, যথেচ্ছ নির্যাতন করা হচ্ছে এবং ব্যাপক সংখ্যায় বিতাড়ন করা হচ্ছে। একটি অসম্পূর্ণ পরিসংখ্যানে দেখা যায়, এ পর্যন্ত ১০ লাখেরও বেশী রোহিঙ্গাকে বিতাড়ন করা হয়েছে বা অত্যাচার-নির্যাতনে তারা দেশছাড়া হতে বাধ্য হয়েছে। দেশত্যাগী রোহিঙ্গাদের ৫ লাখ বাংলাদেশে, সাড়ে ৩ লাখ পাকিস্তানে, ২ লাখ সউদী আরবে, ১৪ হাজার ভারতে, ৫ হাজার থাইল্যান্ডে রয়েছে। এই পরিসংখ্যানে মালয়েশিয়া, ইন্দোনেশিয়া, চীন প্রভৃতি দেশে আশ্রিত রোহিঙ্গাদের হিসাব নেই। জাতিসংঘের বর্ণনায়, বিশ্বের সবচেয়ে নিপীড়িত সংখ্যালঘু জনগোষ্ঠী হলো রোহিঙ্গা। রাখাইনের ভূমিপুত্র হওয়ার পরও তাদের নাগরিকত্ব নেই। কোনো সংবিধানিক অধিকার নেই কর্মসংস্থানের সুযোগ নেই। মিয়ানমারের শতাধিক জাতিগোষ্ঠীর মধ্যে সবচেয়ে দরিদ্র ও পশ্চাদপদ জাতিগোষ্ঠী হলো রোহিঙ্গা। তারা বঞ্চিত, নিগৃহীত ও নিপীড়িত হওয়া সত্তে¡ মাটি কামড়ে পড়ে আছে। তাদের ধারণা ছিল, সামরিক শাসনের অবসান হলে, গণতন্ত্র ফিরে এলে সুদিন ফিরে আসবে। সামরিক শাসন দৃশ্যত নেই এবং গণতন্ত্র ফিরে এসেছে বলে দাবি করা হচ্ছে। কিন্তু তাদের সুদিন আসেননি। বরং গণতান্ত্রিক ফ্যাসিস্টদের আক্রমন, নির্যাতন ও নিপীড়ন অতীতের সকল রেকর্ড অতিক্রম করে গেছে। এত বঞ্চনা, এত দমন-দলন, এত সন্ত্রাস-জুলুম সত্তে¡ও রোহিঙ্গারা সন্ত্রাসের পথ অবলম্বন করেনি। এতদিনে তাদের পেছনে হটারও ও আর জায়গা নেই। এমন পরিস্থিতিতে তাদের সন্ত্রাসের সঙ্গে সংযুক্ত হওয়া কোনোভাবেই সম্ভব নয়। তাদের সামর্থের প্রশ্ন যেমন এখানে জড়িত, তেমনি সহযোগিতা পাওয়ার অনুকূল অবস্থাও মজুদ থাকা আবশ্যক। এর কোনোটাই রোহিঙ্গাদের নেই। বাস্তবতার এই প্রেক্ষাপটে রোহিঙ্গাদের কেউ বা কতিপয় ব্যক্তি যদি ক্ষুব্ধ-বিক্ষুব্ধ ও হতাশাক্রান্ত হয়ে কোথাও হামলা করে বসে তাকে বিচ্ছিন্ন ঘটনা বলেই বিবেচনা করতে হবে। সেটা তাদের অন্যায় বটে। কিন্তুু সে জন্য গোটা জাতিগোষ্ঠীকে সন্ত্রাসী বলে অভিহিত করা যায় না এবং ঢালাওভাবে তাদের হত্যা-নির্যাতনের শিকারে পরিনত করা যায় না।
লক্ষ্য করার বিষয়, গত বছর অক্টোবরে সীমান্ত চৌকিতে প্রথম বারের মতো হামলার ঘটনা ঘটে। সেই হামলাকে উসিলা করে রোহিঙ্গাদের নির্বিচারে হত্যা করা হয়, গ্রেফতার ও নির্যাতন করা হয়, নারীদের শ্লীলতাহানি করা হয়। ওই ধরনের দ্বিতীয় হামলার ঘটনাটি ঘটেছে সম্প্রতি। প্রতিক্রিয়া ও ফলাফল অভিন্ন। এই দুটি ঘটনার ক্ষেত্রেই মিয়ানমার গোটা রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীকেই সন্ত্রাসী হিসাবে চিহ্নিত করার চেষ্টা করছে যা উদ্দেশ্যমূলক। এটা করে সে তার মূল এজেন্ডা বাস্তবায়ন করতে চাইছে। অন্যদিকে সম্প্রতিক বছরগুলোতে মিয়ানমার রোহিঙ্গাদের বাঙালী বলে পরিচিহ্নিত করার প্রচারণা চালাছে এবং বলছে, তারা নাকি বাংলাদেশ থেকে অনুপ্রবেশকারী। এর মাধ্যমে সে রোহিঙ্গাদের সম্পূর্ণভাবে বাংলাদেশে ঠেলে দিতে চাইছে।
রোহিঙ্গা নির্মূলন ও উৎসাদনের লক্ষ্যে মিয়ানমার যা করছে, তার প্রতি ভারত সমর্থন জানিয়ে বিরল নজির সৃষ্টি করেছে। শুধু রোহিঙ্গাদের ব্যাপারে গৃহীত ব্যবস্থার প্রতি সমর্থনই জানায়নি একই সঙ্গে ভারতে আশ্রিত রোহিঙ্গাদের মিয়ানমারে ফেরৎ পাঠানোরও ঘোষণা দিয়েছে। রোহিঙ্গা গণহত্যা ও নির্যাতনের ব্যাপারে নূন্যতম উদ্বেগ প্রকাশেও ভারত নারাজ। ইন্দোনেশিয়ায় অনুষ্ঠিত এক আন্তর্জাতিক সম্মেলনের ঘোষণাপত্রে ভারত সই করেনি। ওই ঘোষণা পত্রে রাখাইনে চলমান সহিংসতা বিষয়ে গভীর উদ্বেগের কথা ছিল। ভারত এই অংশের ব্যাপারে আপত্তি জানায়। এ থেকে আর কোনো প্রশ্নের অবকাশ থাকে না যে, ভারত মিয়ানমারের অবস্থানকেই সমর্থন করছে। ভারতের বিশ্লেষকরাই দাবি করেছেন, উগ্র জাতীয়তাবাদী বৌদ্ধরা ও সে দেশের ক্ষমতাসীনরা মুসলিম প্রশ্নে যে নীতি অনুসরণ করছে ভারতের হিন্দুত্ববাদী মহল ও ক্ষমতাসীন বিজেপিও সেই নীতিই অনুসরণ করছে। নীতি-অবস্থানগত এই অভিন্নতাই মোদির সফরে প্রতিফলিত হয়েছে। অতএব, একথা বলাই বাহুল্য, চরম মুসলিম বিদ্বেষই দুদেশ ও দু’সরকারকে একই সমতলে এনে দাঁড় করিয়ে দিয়েছে। মিয়ানমার যেমন রোহিঙ্গামাত্রকেই সন্ত্রাসী ও অনুপ্রবেশকারী হিসাবে মনে করছে, ভারতের হিন্দুত্ববাদী সংগঠনগুলো এবং ক্ষমতাসীন বিজেপিও মনে করে, ভারতীয় মুসলমানরা নির্বিশেষে সন্ত্রাসী বা সন্ত্রাসের সঙ্গে সম্পর্কিত ও বহিরাগত। বিজেপি ক্ষমতাসীন হওয়ার পর থেকে মুসলমানদের ওপর নিপীড়ন-নির্যাতন বহুগুণে বেড়ে গেছে। গোরক্ষার নামে পর্যন্ত মুসলমানদের হত্যা করা হচ্ছে। ভারতীয় মুসলমানরা কেমন আছে, সাবেক ভাইস প্রেসিডেন্ট মুহম্মদ হামিদ আনসারীর বিদায়ী ভাষণ থেকে তা কিঞ্চিৎ উপলব্ধি করা যায়। তিনি সাবেক প্রেসিডেন্ট রাধাকৃষ্ণনের একটি উক্তি উদ্ধৃত করে বলেন, একটি গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রের পরিচয় এ বিষয় দিয়ে হয় যে, সে তার সংখ্যালঘুদের কেমন নিরাপত্তা দিতে পারে। এর একদিন আগে এক সাক্ষাৎকারে তিনি বলেন, মুসলমানদের মধ্যে অস্থিরতা ও নিরাপত্তাহীনতার অনুভূতি বিদ্যামান। তিনি গণপিটুনিতে মুসলমান হত্যা এবং ঘরওয়াপস কর্মসূচীর মত বিষয়গুলোকে ভারতের মর্যাদার পরিপন্থী বলে মনে করেন। তার বক্তব্যের জন্য মুহাম্মদ হামিদ আনসারীকে সংঘ পরিবার ও বিজেপি নেতাদের তীব্র সমালোচনার সম্মুখীন হতে হয়েছে।
ভারতীয়রা এই বলে দাবি করে যে, ভারত বিশ্বের বৃহত্তম গণতন্ত্র। অথচ সেই গণতন্ত্র ফ্যাসিবাদে রূপ নিতে বসেছে। মিয়ানমারকেও অনেকে গণতন্ত্রী দেশ বলে আখ্যায়িত করে। বাস্তবে তার ফ্যাসিবাদী চরিত্র নগ্নভাবে প্রকাশিত। ফ্যাসিবাদ ফ্যাসিবাদকেই সমর্থন করে। ভারত-মিয়ানমার সখ্য থেকে সেটাই আর একবার প্রমাণিত হলো। দুর্ভাগ্যজনক হলো, ভারতের প্রতিষ্ঠাতা পিতারা ভারতকে একটি গণতান্ত্রিক ও মানবিক রাষ্ট্রই বানাতে চেয়েছিলেন। তাদের সেই প্রত্যাশা-প্রচেষ্টা ব্যর্থতায় পর্যবসিত হওয়ার প্রান্তে এসে উপনীত হয়েছে।
ভারতের স্বরাষ্ট্রপ্রতিমন্ত্রী কিরণ রিজজু ভারতে আশ্রিত রোহিঙ্গাদের মিয়ানমারে ফেরৎ পাঠানোর ঘোষণা দেয়ার পর ভারতের সাবেক সংসদ সদস্য মনি শংকর আয়ার এক নিবন্ধে দু:খ করে বলেছেন, গত ৭০ বছরে ভারত সব ধর্মের শরণার্থীদের জন্য দরজা খুলে দিয়েছে। তিব্বতের বৌদ্ধদের জন্য যেমন দরজা খুলে দিয়েছে তেমনি আফগানিস্তানের মুসলমান, শ্রীলঙ্কার হিন্দু-খ্রীস্টান এবং ১৯৭১ সালে তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের হিন্দু, মুসলমান, বৌদ্ধ, খ্রীস্টানদের জন্য দরজা খুলে দিয়েছে। ২০১৪ সালের আগে শরণার্থীদের আশ্রয় দেয়ার ক্ষেত্রে ধর্ম ভারতের কাছে বিবেচ্য ছিল না। কিন্তু এখন সেদিন নেই। তিনি উল্লেখ করেছেন, ২০১৫ সালে ভারতের স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় পার্সপোর্ট ও বিদেশী আইনের অধীনে এক নোটিশ জারি করে যে, পার্শ্ববর্তী দেশে নিপীড়নের শিকার হিন্দু, খ্রীস্টান, জৈন, পারসিক ও বৌদ্ধদের ভারতে প্রবেশের ক্ষেত্রে স্বাভাবিক প্রক্রিয়া থেকে অব্যাহতি দেয়া হয়েছে। কিন্তু বিশেষ করে মুসলমানদের এই অধিকার দেয়া হবে না। মনিশংকর আয়ার অত:পর বলেছেন, এটা ভারতীয় সংবিধানের ১৯ ও ১৪ ধারার লংঘন। বলার অপেক্ষা রাখেনা, এতে ভারতে অনুসৃত ‘মুসলিম নীতির’ পরিচয় কতকটা উন্মোচিত হয়েছে।
মিয়ানমার ও ভারতের ‘মুসলিম নীতি’র ঐক্যের প্রসঙ্গ ছাড়াও মিয়ানমারের রোহিঙ্গা নিধন-নির্যাতনের প্রতি ভারতের সমর্থন জ্ঞাপনের আরও দু’টি কারণ বিশ্লেষকরা উল্লেখ করেছেন। তাদের মতে, মিয়ানমারে চীনের প্রভাব হ্রাস করে ভারতের প্রভাব বাড়ানোর জন্য মোদি মিয়ানমারে নীতি-অবস্থানের প্রতি আগ বাড়িয়ে সমর্থন দিয়েছেন। দ্বিতীয়ত, মিয়ানমারে তার অর্থনৈতিক ও বাণিজ্যক স্বার্থ রয়েছে, যা সে অর্জন করতে চায়। ভারতে চীনের বিপরীতে মিয়ানমারের সঙ্গে সম্পর্ক ঘনিষ্ঠ করতে তৎপর বহুদিন ধরে। ইতোমধ্যে ভারত রাখাইনের সিওয়েতে একটি বন্দর ও একটি নৌপথ নির্মাণ শুরু করেছে। একটি সড়ক নির্মাণের কাজও সে শিগগিরই শুরু করবে, যা মিজোরামের জিরিনপুই ও সিওয়েকে সংযুক্ত করবে। মোদি হয়তো মনে করেছেন, এই মুহূর্তে মিয়ানমারকে সমর্থন করলে ভারতের আর্থ-বাণিজ্যিক স্বার্থ হাসিল সহজতর হবে। তার কাছে, গণহত্যা, মানবিক বিপর্যয় কোনো গুরুত্ব পায়নি।
রোহিঙ্গা হত্যা-নির্যাতন প্রশ্নে চীনের নিরবতা নিয়েও প্রশ্ন উঠেছে। চীনও সম্ভবত মিয়ানমারে তার প্রভাব অক্ষুন্ন রাখা এবং আর্থ-বাণিজ্যক সুবিধা আদায়ের বিষয়টি প্রাধান্যে নিয়েছে। চীন মিয়ানমারের দীর্ঘদিনের একমাত্র মিত্র। সেখানে তার নানা স্বার্থ ও লক্ষ্য রয়েছে। রয়েছে বিভিন্ন প্রকল্প। এখন রাখাইনের চ্যাউকফু এলাকায় চীনের অংশীদারিত্বে একটি গভীর সমুদ্র বন্দর নির্মিত হচ্ছে। দক্ষিণ চীনের কুনমিং থেকে চ্যাউকফু পর্যন্ত গ্যাস সরবরাহের জন্য একটি পাইপ লাইনও নির্মিত হচ্ছে। রেললাইনও হবে। পরিকল্পনা রয়েছে একটি অর্থনৈতিক এলাকা গঠনের। এ সবের মাধ্যমে ভারত মহাসাগরে চীন তার প্রভাববলয় শক্তিশালী করতে চাইছে। তাই বোধকরি মিয়ানমারের বিরুদ্ধে চীন টু শব্দ করছেনা। এর আগে জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদে রোহিঙ্গা প্রশ্নে একটি বিবৃতি দেয়ার উদ্যোগে চীন ও রাশিয়া যুগপৎভাবে বিরোধিতা করে। ‘স্বার্থের নিগড়ে বাধ্য অখিল সংসার’, বুঝি একেই বলে! চীনের আভ্যন্তরীণ ‘মুসলিম নীতি’ও মূলত দমনমূলক, যা কারো অজানা নেই।
নিকট প্রতিবেশী হিসাবে চীন ও ভারত সক্রিয় হলে রোহিঙ্গা হত্যা- নির্যাতন বন্ধ ও তাদের ন্যায়সঙ্গত অধিকার প্রতিষ্ঠা তরান্বিত হতে পারতো। রোহিঙ্গা ইস্যুতে সবচেয়ে বেশি বেকায়দায় পড়েছে বাংলাদেশ। তার পক্ষে বছরের পর বছর ধরে রোহিঙ্গা শরণার্থীদের চাপ বহন করা সম্ভব নয়। বাংলাদেশ এর স্থায়ী সমাধান চায়। এক্ষেত্রে বন্ধুরাষ্ট্র হিসাবে ভারত বাংলাদেশের সহায়তায় আসতে পারতো। কিন্তু ভারত এখন যা করছে, বাংলাদেশের জন্য তা অত্যন্ত উদ্বেগজনক। ভারত মিয়ানমারের নীতি অবস্থান সমর্থন করায় বাংলাদেশ আগামীতে আরো সমস্যায় পড়বে। অন্যদিকে চীনের সঙ্গেও বাংলাদেশের সুম্পর্ক বিদ্যামান। সেও বাংলাদেশের সমস্যা আমলে নিতে নারাজ, ঘটনাদৃষ্টে সেটা স্পষ্ট। বাংলাদেশ এ ব্যাপারে দেশ দুটির সঙ্গে কূটনৈতিক-রাজনৈতিক পর্যায়ে কতটা যোগাযোগ ও আলোচনা করেছে, আমাদের জানা নেই। মিয়ানমার যখন রোহিঙ্গাদের বাংলাদেশে ঠেলে দেয়, আকাশসীমা লংঘন করে এবং বৃহৎ প্রতিবেশীরা মিয়ানমারের নীতি-অবস্থান প্রকাশ্যে বা অপ্রকাশ্যে সমর্থন করে তখন বাংলাদেশের কূটনৈতিক-রাজনৈতিক ব্যর্থতাটা বড় দাগে চোখে ধরা পড়ে।

 



 

Show all comments
  • Shahadat Hossain ১০ সেপ্টেম্বর, ২০১৭, ১১:৫৭ এএম says : 6
    সবাই কে এগিয়ে আসতে হবে
    Total Reply(0) Reply

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

আরও পড়ুন
গত​ ৭ দিনের সর্বাধিক পঠিত সংবাদ