Inqilab Logo

বুধবার, ১৭ এপ্রিল ২০২৪, ০৪ বৈশাখ ১৪৩১, ০৭ শাওয়াল ১৪৪৫ হিজরী

সম্ভাবনা ও সঙ্কটে খাদিশিল্প

কুমিল্লা থেকে সাদিক মামুন | প্রকাশের সময় : ১৫ সেপ্টেম্বর, ২০১৭, ১২:০০ এএম

শতবর্ষের পথ পরিক্রমায় কুমিল্লার খাদি বাঙালি সংস্কৃতির এক অবিচ্ছেদ্য অংশ। বর্তমানে বাহারি রঙ ও নকশার খাদির পোশাক হাল ফ্যাশনে যোগ করেছে নতুন মাত্রা। কিন্তু সমস্যাও রয়েছে এ শিল্পে। কেননা ব্যাপক চাহিদা সত্তে¡ও এ পণ্যটির সঠিক মূল্য না পাওয়া, কাঁচামাল সংকট ও ব্র্যান্ডিংয়ের অভাবে কাজে লাগানো যাচ্ছে না কুমিল্লার খাদির অপার সম্ভাবনাকে। খাদি পেশার সাথে সংশ্লিষ্টরা বলছেন এখানকার খাদি পন্যের আন্তর্জাতিক বাজার তৈরি করা গেলে রপ্তানি বাণিজ্যের মধ্যদিয়ে খাদিপণ্যের ব্যবসা আরও জমজমাট হয়ে ওঠবে এবং কারিগরসহ এ পেশার সাথে জড়িতরা দেখবেন আলোর মুখ।
কুমিল্লার খাদি কেবল কাপড়ই নয়, এ শিল্পের সাথে জড়িয়ে রয়েছে এই উপমহাদেশের আন্দোলন সংগ্রামের ইতিহাস। ১৯২১ সালে মহাত্মা গান্ধীর আহবানে সমগ্র ভারতবর্ষে অসহযোগ আন্দোলনের সময় তাঁরই আদর্শে অনুপ্রাণিত হয়ে কুমিল্লায় খদ্দরশিল্প প্রতিষ্ঠা লাভ করে। নিখিল ভারত তন্তুরায় সমিতির একটি শাখাও গঠন করা হয় কুমিল্লার অভয়াশ্রমে। অল্প সময়ের মধ্যে শিল্পগত উৎকর্ষে সুনাম আর খ্যাতির শীর্ষে পৌঁছে যায় কুমিল্লার খাদি। খাদিশিল্পের প্রসারতার ২৬ বছরের মাথায় হঠাৎ থমকে দাঁড়ায় এ পণ্যটির চাহিদা। ১৯৪৭ সালে ভারত বিভক্তির সময়ে ওই সমিতি কুমিল্লা শাখা থেকে তাঁদের পৃষ্ঠপোষকতা প্রত্যাহার করলে খাদিশিল্পে বিপর্যয় নেমে আসে। তবে খাদিশিল্পের এ বিপর্যয় বেশি দিন স্থায়ী থাকেনি। ১৯৫২ সালে ভাষা আন্দোলনের পর সমবায় আন্দোলনের প্রাণপুরুষ ড. আখতার হামিদ খানের সার্বিক চেষ্টায় এবং তৎকালীন গভর্ণর ফিরোজ খান নুনের সহযোগিতায় কুমিল্লার অভয়াশ্রমে দি খাদি এন্ড কটেজ ইন্ডাষ্ট্রিজ এসোসিয়েশন প্রতিষ্ঠিত হয়। পাশাপাশি খাদিশিল্প প্রসারে একটি প্রশিক্ষণ ও বিক্রয়কেন্দ্র স্থাপন করা হয়। আর তখন থেকেই পাক-ভারত উপমহাদেশে কুমিল্লার খাদি পণ্য উন্নতমানের সামগ্রী হিসেবে সুনামের জায়গাটি দখল করে নেয়। তখন খাদি হয়ে ওঠে দেশপ্রেমের প্রতীক।
খাদি কোন সুতা বা কাপড়ের নাম নয়। পায়ে চালিত প্যাডেলের নিচে খাঁদ বা গর্ত করা হতো। আর সেখান থেকেই যে কাপড় উৎপন্ন হয় বলেই খাদি বলা হয়ে থাকে। সময়ের পরিক্রমায় ফ্যাশন ডিজাইনারদের ছোঁয়ায় মোটা ও মিহি সুতায় তৈরি হচ্ছে খাদির পাঞ্জাবি, ফতুয়া, সেলোয়ার কামিজ, ওড়না, স্কার্ট, বিছানার চাদর, গায়ের চাদর এবং ব্যাগ, টুপি, গলাবন্ধনীসহ ব্যবহার্য অন্যান্য পোশাক। আবার খাদি কাপড়ের রং, নকশা ও বুনন বৈচিত্র্য এ পণ্যের চাহিদাও বাড়িয়ে দিয়েছে। এক সময় বিদেশে রপ্তানি হতো কুমিল্লার খাদি। তবে তা ধরে রাখা যায়নি। এ অবস্থার জন্য সংশ্লিষ্টরা দায়ী করছেন সুতার সংকট, ব্র্যান্ডিং ও বিপণন অবকাঠামোর অভাবকে। তারা বলছেন খাদির সুতা তৈরি করতে হবে। খাদি দিয়ে আরো উন্নত কী ধরণের প্রেডাক্ট তৈরি করা যায় এসব ব্যাপারে পরিকল্পনা করে এগুতে হবে, নয়তো সমস্যা থেকে উত্তরণ ঘটানো সম্ভব নয়। কুমিল্লার সদর, চান্দিনা, দেবিদ্বার ও মুরাদনগরে হাজার হাজার তাঁতী এশিল্পের প্রসারে একসময় কাজ করলেও বর্তমানে হাজার খানেক তাঁতী কোনরকমে তাদের পেশা টিকিয়ে রেখেছে। চান্দিনার বারেরা, নুরীতলা, কলাগাঁয়ের কিছু কিছু পরিবার তুলা থেকে সুতা বানানোর কাজ করছে। এপেশার লোকজন ওইসব পরিবার থেকে সুতা কিনে খাদি তৈরি করতো। বর্তমানে ওইসব এলাকাতেও খুব একটা সুতা তৈরি হয়না। বর্তমানে নারায়ণগঞ্জ থেকে সুতা এনে খাদি কাপড় তৈরির কাজটা চলছে। একসময় দেবিদ্বারের বরকামতায় ৫০টির বেশি তাঁত ছিল। বর্তমানে ১৫-২০টি তাঁত চালু রয়েছে।
কুমিল্লার খাদিশিল্পকে মাথা উঁচু করে দাঁড়াতে যারা নিরলস পরিশ্রম করেছেন তাদের মধ্যে খাদি ঘরের তরণী মোহন রাহা, খাদি কুটির শিল্পের শংকর সাহা, খাদি ভবনের দীনেশ দাশ, বিশুদ্ধ খদ্দরের মনমোহন দত্ত, রাম নারায়ণ স্টোরের কৃষ্ণ সাহাসহ অনেকেই আজ বেঁচে নেই। আবার খাদি শিল্পায়ন, বঙ্গশ্রী খাদির মালিকেরা চলে গেছেন ভারতে। অন্যদিকে প্রবীণদের মধ্যে যারা বেঁচে রয়েছেন তাদের মধ্যে খাদি বিতানের আবদুস সাত্তার, হারুন ব্রাদার্সের হারুনুর রশিদ, খাদি কুটিরের তপন চক্রবর্তী, খাদি ঘরের প্রদীপ রাহাসহ আরো অনেকেই কুমিল্লার খাদিশিল্প টিকিয়ে রাখার লক্ষ্যে কাজ করে যাচ্ছেন। আবার যারা বেঁচে নেই তাদের সন্তানরাও খাদি ব্যবসার সঙ্গে জড়িয়ে রয়েছেন। এ ব্যবসার সাথে সংশ্লিষ্টরা বলছেন, বর্তমানে কাঁচামাল ও কারিগর সংকট, পরিশ্রমের ন্যায্যমূল্য না পাওয়া এবং ব্র্যান্ডিংয়ের অভাবে খাদি পোশাক তৈরি পরিমান কমছে। খাদিশিল্পের প্রসারে মাঠপর্যায়ে প্রান্তি খাদিশিল্পীদের সঠিকভাবে খোঁজখবর নিয়ে সমস্যাগুলো চিহ্নিত করে তাদেরকে সংগঠিত করতে হবে। সরকারিভাবে এশিল্পের পৃষ্ঠপোষকতা থাকতে হবে। তবেই কুমিল্লার মাটির সাথে মিশে ঐতিহ্যের খাদির সম্ভাবনার দুয়ার আবার খুলে যাবে।



 

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

ঘটনাপ্রবাহ: কুমিল্লা


আরও
আরও পড়ুন
এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ
গত​ ৭ দিনের সর্বাধিক পঠিত সংবাদ