Inqilab Logo

বৃহস্পতিবার, ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১, ১৫ শাওয়াল ১৪৪৫ হিজরী

ওআইসিকে ঐক্যবদ্ধ ভূমিকা নিতে হবে

| প্রকাশের সময় : ২২ সেপ্টেম্বর, ২০১৭, ১২:০০ এএম

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা রোহিঙ্গা সমস্যা সমাধানের জন্য ওআইসি নেতাদের প্রতি আহŸান জানিয়েছেন। জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদের ৭২তম অধিবেশনের ফাঁকে নিউইয়র্কে গত মঙ্গলবার রোহিঙ্গা সংক্রান্ত ওআইসির কন্টাক্ট গ্রæপের বৈঠকে তিনি বলেছেন, ‘বেশি দেরি হওয়ার আগেই রোহিঙ্গা সমস্যা সমাধানে আমি ওআইসির দেশগুলোর মধ্যে ঐক্য চাই। এক্ষেত্রে ওআইসির যে কোনো উদ্যোগে বাংলাদেশ যোগ দিতে তৈরি আছে।’ রোহিঙ্গা সমস্যার মূল উৎস মিয়ানমারে উল্লেখ করে তিনি আরো বলেছেন, অবিলম্বে রোহিঙ্গাদের বিরুদ্ধে সব ধরনের নৃশংসতা বন্ধ হোক। ‘আমরা চাই জাতিগত নিধনের অবসান হোক। আমাদের মুসলিম ভাইবোনদের দুর্দশার অবসান হোক।’ ওই বৈঠকে শেখ হাসিনা ছয়টি সুনির্দিষ্ট প্রস্তাব দিয়েছেন। প্রস্তাবগুলো হলো : ১. রোহিঙ্গা মুসলমানদের ওপর সব ধরনের নিপীড়ন এই মুর্হূতে বন্ধ করতে হবে। ২. নিরপরাধ বেসামরিক জনগোষ্ঠী, বিশেষ করে নারী, শিশু ও বৃদ্ধদের জন্য মিয়ানমারের অভ্যন্তরে নিরাপদ এলাকা (সেফ জোন) প্রতিষ্ঠা করা যেতে পারে, যেখানে তাদের সুরক্ষা দেয়া হবে। ৩. বল প্রয়োগের ফলে বাস্তুচ্যুৎ সব রোহিঙ্গা যেন নিরাপদে এবং মর্যাদার সঙ্গে মিয়ানমারে তাদের বাড়িতে ফিরতে পারে, সেই ব্যবস্থা করতে হবে। ৪. রোহিঙ্গা সংকট নিরসনে কোফি আনান কমিশনের পূর্ণাঙ্গ সুপারিশ অবিলম্বে নি:শর্তভাবে বাস্তবায়ন করতে হবে। ৫. রোহিঙ্গাদের ‘বাঙালী’ হিসাবে চিহ্নিত করার যে রাষ্ট্রীয় প্রপাগাÐা মিয়ানমার চালাচ্ছে, তা অবিলম্বে বন্ধ করতে হবে। ৬. রোহিঙ্গারা মিয়ানমারে না ফেরা পর্যন্ত তাদের জরুরি মানবিক সহায়তা দেয়ার ক্ষেত্রে বাংলাদেশকে সহযোগিতা করতে হবে ভ্রাতৃপ্রতিম মুসলিম দেশগুলোকে। জানা গেছে, ওই বৈঠকে আলোচনার প্রতিবেদন সর্বসম্মত ঘোষণা হিসাবে গৃহীত হয়েছে। সেই ঘোষণায় রোহিঙ্গা মুসলমানদের দুর্দশার প্রেক্ষিতে মিয়ানমারের সঙ্গে সদস্য দেশগুলোকে অর্থনৈতিক সম্পর্ক শিথিল করা এবং অগ্রাধিকারমূলক বাণিজ্য সুবিধা স্থগিত করার বিষয় বিবেচনা করতে বলা হয়েছে। এছাড়া রোহিঙ্গাদের নিয়ে জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদকে জরুরি ভিত্তিতে ব্যবস্থা নেয়ার আহŸান জানানো হয়েছে। ওআইসির সদস্যরা জাতিসংঘের অধিবেশনে রোহিঙ্গাদের নিয়ে একটি প্রস্তাব দেয়ার বিষয়ে একমত হয়েছে।
কোনো সন্দেহ নেই, মিয়ানমারের রাখাইনে গত একমাস যাবৎ যা চলেছে, তা এক কথায় নির্বিচার গণহত্যা। জাতিসংঘের মতে বিশ্বের সবচেয়ে নিপীড়িত জনগোষ্ঠী রোহিঙ্গাদের সম্পূর্ণ নিশ্চিহ্ন করে দেয়ার জন্য এই গণহত্যা চালানো হচ্ছে। তাদের বাড়িঘর জ্বালিয়ে দেয়া হচ্ছে, নারীদের গণবর্ষণ করা হচ্ছে, শিশুদের নৃশংসভাবে হত্যা করা হচ্ছে এবং বাংলাদেশে তাড়িয়ে দেয়া হচ্ছে। বিশ্বের সম্প্রতিক ইতিহাসে এরূপ গণহত্যা, গণনির্যাতন ও গণবিতাড়নের নজির নেই। রোহিঙ্গাদের এক্ষেত্রে ‘একমাত্র অপরাধ’ তারা মুসলমান। উগ্র বৌদ্ধ জাতীয়তাবাদী ধ্যান-ধারণার বশবর্তী হয়ে মিয়ানমার সরকার ও সেনাবাহিনী তাদের সম্পূর্ণ নির্মূলণের জন্য এই অভিযান চালাচ্ছে। যদি রোহিঙ্গারা মুসলমান না হয়ে অন্য কোনো ধর্মীয় জনগোষ্ঠীর লোক হতো তাহলে তাদের ওপর এই জুলুম-নির্যাতন চালানো সম্ভব হতো না। আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় সেখানে বাধা হয়ে দাঁড়াতো, পাল্টা ব্যবস্থা গ্রহণ করতো যেটা পূর্বতিমুরে আমরা দেখাছি, দেখেছি আরো কোনো কোনো এলাকায়। যেহেতু মুসলমান হওয়ার কারণে রোহিঙ্গারা গণহত্যা, গণনির্যাতন ও গণবিতাড়নের ভয়াবহ শিকার, সুতারাং মুসলিম দেশগুলোর অপরিহার্য দায়িত্ব, এই মুসলিম নিধন ও মানবতাবিরোধী অপরাধ বন্ধে সর্বাগ্রে এগিয়ে আসা। অত্যন্ত দুর্ভাগ্যজনক বাস্তবতা এই যে, মাত্র গুটি কয়েক মুসলিম দেশ ছাড়া এ-ব্যাপারে অন্যরা কেউই এগিয়ে আসেনি। মুসলিম রাষ্ট্রগুলোর একমাত্র জোট ওআইসির ভূমিকা মোটেই ইতিবাচক নয়। অর্ধ শতাধিক রাষ্ট্রের এই জোট যদি শুরু থেকেই প্রতিবাদ মুখর হতো, প্রতিকারে শক্ত অবস্থান ও পদক্ষেপ নিতো, আমরা নিশ্চিত, মিয়ানমার এই হত্যাযজ্ঞ, এই নির্যাতন ও উৎসাদন চালাতে এতটা সাহস পেতো না। অনেক বিলম্বে রোহিঙ্গা সংক্রান্ত কন্টাক্ট গ্রæপের বৈঠকে হয়েছে এবং ওই বৈঠকের ঘোষণা কতটা কার্যকর হবে বা করা যাবে, আমরা জানিনা। এই ইস্যুতে ওআইসির একটি জরুরি সম্মেলন হতে পারতো। সম্মেলনে মিয়ানমারের বিরুদ্ধে কী ধরনের কূটনৈতিক, অর্থনৈতিক ও অন্যবিধ ব্যবস্থা নেয়া যায় তা নিয়ে আলোচনা ও সিদ্ধান্ত হতে পারতো। এর তাৎক্ষণিক ও দীর্ঘমেয়াদী সুফল পাওয়া যেতো।
ইতোমধ্যে রাখাইন প্রায় রোহিঙ্গা শূন্য হয়ে গেছে। এখন জাতিসংঘসহ আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় অনেকটাই সোচ্চার হয়ে উঠেছে। মুসলিম দেশগুলোও নিরবতা ভাঙতে শুরু করেছে। কিন্তু এই সোচ্চার ও সরব হওয়াটা এখনো নিন্দা, প্রতিবাদ ও আহŸানের মধ্যেই সীমিত হয়ে আছে। সবচেয়ে বড় কথা, বাংলাদেশে পালিয়ে আসা রোহিঙ্গাদের ত্রাণ ও বাংলাদেশে আশ্রয় সুনিশ্চিত করার জন্য যতটা তৎপরতা লক্ষ্য করা যাচ্ছে, রাখাইনে হত্যা-নির্যাতন বন্ধ এবং সেখানে রোহিঙ্গাদের ফেরত পাঠানো ও নিরাপত্তা সুনিশ্চিত করার বিষয়ে ততটা তৎপরতা দেখা যাচ্ছে না। জাতিসংঘ, ওআইসি ও আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের প্রশ্নবিদ্ধ ভূমিকার কারণেই মিয়ানমারের সেনাবাহিনীর প্রধান দম্ভ প্রকাশ করে রোহিঙ্গাদের বিরুদ্ধে জাতীয় ঐক্য গড়ে তোলার আহŸান জানাতে পেরেছেন। মিয়ানমারের সর্বোচ্চ নেত্রী অংসান সুচি জাতির উদ্দেশ্য দেয়া ভাষণে গণহত্যা, গণনির্যাতন ও গণবিতাড়ন কার্যত সমর্থন করেছেন। এমন ভাব দেখিয়েছেন যেন রাখাইনে কিছুই হয়নি। তিনি বস্তুত উটপাখির আচরণ করেছেন। বিশ্বজুড়ে তার ভাষণের ব্যাপারে তীব্র নিন্দা ও প্রতিবাদের ঝড় উঠেছে। মিয়ানমার যে বেপরোয়া ও স্পর্ধিত অবস্থান নিয়েছে তাতে রোহিঙ্গাদের নিরাপত্তা, নাগরিক অধিকারসহ সকল প্রকার রাষ্ট্রগত ও মানবিক অধিকার প্রতিষ্ঠা ও স্বদেশে প্রত্যাবর্তন অসম্ভবপর হয়ে দাঁড়িয়েছে। এমতাবস্থায়, জাতিসংঘ, ওআইসি ও আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের কঠোর পদক্ষেপ গ্রহণের বিকল্প নেই। এক্ষেত্রে সবচেয়ে কার্যকর ভূমিকা রাখতে পারে জাতিসংঘ। নিরাপত্তা পরিষদ তার বিবৃতিতে গণহত্যা ও সহিংসতা বন্ধ করার আহŸান জানিয়েছে। এখানেই নিরাপত্তা পরিষদকে থেমে গেলে চলবে না। তাকেই নিতে হবে দ্ব্যর্থহীন কার্যকর পদক্ষেপ। ওআইসি বা মুসলিম দেশগুলোকে এ ব্যাপারে চাপ সৃষ্টি করতে হবে। একই সঙ্গে তার দিক থেকে আর কী করণীয় আছে তাও নিধারণ ও বাস্তবায়ন করতে হবে।



 

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

ঘটনাপ্রবাহ: ওআইসি


আরও
আরও পড়ুন