Inqilab Logo

শুক্রবার, ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ০৬ বৈশাখ ১৪৩১, ০৯ শাওয়াল ১৪৪৫ হিজরী

মাত্র দুই ঘণ্টার অভিযানে আটক ২৯৩টি

চট্টগ্রামে ভয়ঙ্কর মোটরবাইক!

রফিকুল ইসলাম সেলিম | প্রকাশের সময় : ২৮ সেপ্টেম্বর, ২০১৭, ১২:০০ এএম

উল্টো দিক থেকে হঠাৎ বেপরোয়া গতির মোটর সাইকেল এসে প্রচন্ড থাক্কা দেয় চট্টগ্রাম নগরীর জামালখান সড়কে দ্রæতগতির একটি রিকশাকে। রিকশা আরোহী চট্টগ্রামের এক সিনিয়র সাংবাদিক ছিটকে রাস্তায় পড়ে গুরুতর আহত হন।
মোটর সাইকেল আরোহী দুই যুবক ঝড়ের গতিতে উল্টো পথেই এলাকা ত্যাগ করেন। ঘটনার যারা প্রত্যক্ষদর্শী তারা বলছেন, অনেকটা টর্নেডোর বেগেই ওই দুই তরুণ সড়কের উল্টো পথে মোটর সাইকেল চালিয়েছিল। ওই সিনিয়র সাংবাদিকের মতো এমন ভীতিকর অভিজ্ঞতা চট্টগ্রামের অনেকের আছেই। বেপরোয়া গতির ভয়ঙ্কর মোটর সাইকেল এখন এক ভয়ানক আতঙ্কের নাম। সড়কজুড়ে শত শত মোটর সাইকেল। বেশিরভাগের নেই কোন লাইসেন্স বা বৈধ কাগজপত্র। এসব মোটর সাইকেলে যারা অলিগলি রাজপথ দাপিয়ে বেড়ায় তাদেরও নেই কোন প্রশিক্ষণ। ট্রাফিক আইন বা সড়কের নিরাপত্তা সম্পর্কেও তাদের কোন ধারণা নেই। ফলে দুই চাকার এই যন্ত্রযানটি এখন সড়কে নতুন আতঙ্কের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে।
ট্রাফিক পুলিশের কর্মকর্তারা বলছেন, সড়ক, মহাসড়ক ও অলিগলিতে যত দুর্ঘটনা ঘটছে তার বেশিরভাগের সাথে কোন না কোনভাবে জড়িত মোটর সাইকেল। অন্যের জীবন কেড়ে নেওয়ার পাশাপাশি বেপরোয়া গতির কারণে আরোহীর জীবনও কেড়ে নিচ্ছে এই দুই চাকার মোটরযানটি। দ্রæতগতির মোটর সাইকেল খুন ছিনতাইসহ নানা অপরাধে অপরাধীর বাহন হিসাবেও ব্যবহৃত হচ্ছে। চোরাইপথে আসা মোটর সাইকেল নিয়ে খুনোখুনির ঘটনাও ঘটছে। আবার মোটর সাইকেল চুরি এবং চোরাই মোটর সাইকেল ব্যবসাকে ঘিরেও মহানগর এবং জেলায় গড়ে উঠেছে বেশকয়েকটি অপরাধী সিন্ডিকেট। এসব কারণে মোটরবাইক এখন আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর মাথা ব্যাথার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে।
চট্টগ্রাম মহানগর ও জেলায় মোটর সাইকেলের প্রকৃত সংখ্যা কত তা বিআরটিএ বা ট্রাফিক পুলিশের কারো জানা নেই। তবে বৈধ মোটর সাইকেলের চেয়ে অবৈধ মোটর সাইকেলের সংখ্যা অন্তত দশগুণ বলে তাদের ধারণা। চট্টগ্রামের পুলিশ সুপারের নির্দেশনায় মঙ্গলবার মাত্র দুই ঘটনার অভিযানে ২৯৩টি রেজিস্ট্রেশন বিহীন মোটর সাইকেল ধরা পড়ে। অভিযানে থাকা একজন অতিরিক্ত পুলিশ সুপার বলেন, ৫৪টি চেকপোস্টে যে কয়কটি মোটর সাইকেল আটকানো হয়েছে তার প্রায় সবকটিই ছিল অবৈধ। জেলার ষোলটি থানা এলাকায় কয়েক লাখ মোটর সাইকেল আছে।
মহানগরীতে এই সংখ্যা আরও বেশি। বৈধ-অবৈধ পথে আসা মোটর সাইকেলে ভরে গেছে মহনগর এবং জেলা। কুমিল্লা ফেনী সীমান্ত পথে প্রতিনিয়ত আসছে ভারতীয় মোটর সাইকেল। কোন প্রকার রেজিস্ট্রেশন ছাড়াই এসব বাইক রাস্তায় চলছে। চট্টগ্রাম মেট্রোপলিটন পুলিশের ট্রাফিক বিভাগের একজন কর্মকর্তা জানান, রাস্তায় মোটর সাইকেলের রীতিমত ঢল দেখা যায়। বেশিরভাগ মোটর সাইকেলের বৈধ কাগজপত্র নেই। চালকদের প্রায় নব্বই ভাগের নেই লাইসেন্স, নিরাপত্তা হেলমেট। বেপরোয়া গতির এসব বাইক সড়ক থেকে ফুটপাত এমনকি সড়কদ্বীপেও চলাচল করছে। যানজটে পড়লে এরা উল্টো পথে চলতে শুরু করে। এসব বাইকের চালকদের বেশিরভাগই কিশোর কিংবা উঠতি তরুণ। মোটর সাইকেলে অনিরাপদভাবে শিশুদের নিয়েও ভ্রমণ করেন অনেকে। মহাসড়কগুলোতেও নারী-শিশুসহ পরিবারের সব সদস্য নিয়ে মোটর সাইকেল চালাতে দেখা যায় অনেককে। মোটর সাইকেলের সামনে পেছনে সাংবাদিক, আইনজীবী, পুলিশ লেখা স্টিকার দিয়ে চলছে মোটর সাইকেল।
বেপরোয়া গতির মোটর বাইকের কারণে রাস্তায় প্রায় দুর্ঘটনা ঘটছে। এতে অনেকের জীবন যাচ্ছে, অনেকে পঙ্গু হচ্ছে জীবনের তরে। স¤প্রতি নগরীর মুরাদপুর ফ্লাইওভারে এক দুঘটনায় প্রাণ হারায় দুই তরুণ। দেশ ট্রাভেলস’র একটি এসি বাসের ধাক্কায় দুই মোটরবাইক আরোহীর একজন ছিটকে ফ্লাইওভারের নিচে পড়ে মারা যায়। অপরজন ফ্লাইওভারে বাসের চাকায় পিষ্ট হয়। দুই তরণের এ মর্মান্তিক মৃত্যুর ঘটনার প্রত্যদক্ষর্শীরা বলেছেন, নতুন চালু হওয়া ওই ফাঁকা ফ্লাইওভারে মোটরবাইক নিয়ে উঠা ওই দুই তরুণ এসি বাসটিকে বামপাশ থেকে বার বার ওভারটেক করছিল। এক পর্যায়ে বাসের ধাক্কায় এই দুর্ঘটনা ঘটে।
ওই দুর্ঘটনার কয়েকদিন আগে নগরীর একে খান গেইট এলাকায় মোটর সাইকেল আরোহী তিন বন্ধুর ট্রেনে কাটা পড়ে মর্মান্তিক মৃত্যু হয়। মামলাটির তদন্তকারী কর্মকর্তা বলেন, তিন যুবকের মৃত্যু মর্মান্তিক হলেও বাস্তবতা ছিল যে যুবক মোটর সাইকেল চালিয়ে দুই বন্ধুকে নিয়ে যাচ্ছিল তার চোখে ছিল ঘুম। এই কারণে রেললাইনে ট্রেন চলে আসার দৃশ্য না দেখেই সে লাইনে বাইক তুলে দেয়। তিন বন্ধু রাতভর একটি গায়ের হলুদের অনুষ্ঠানে নির্ঘুম ছিলেন। ভোরেই ফিরছিলো বাসায়।
মোটরবাইক এখন ছিনতাইকারীদের প্রধান বাহন। স¤প্রতি নগরীতে সংগঠিত বেশকয়েকটি ছিনতাই এবং খুনসহ ছিনতাইয়ের ঘটনায় অপরাধীদের বাহন হিসাবে মোটরবাইক ব্যবহার করার কথা স্বীকার করেছে অপরাধীরা। কয়েকজন বিদেশীও এসব ছিনতাইকারীর কবলে পড়েন। ঈদের আগে নগরীর জামাল খান এলাকায় রিকশা আরোহী এক তরুণীর ব্যাগ ছিনতাইকালে রিকশা থেকে ছিটকে রাস্তায় পড়ে আহত হয় সে। পরে হাসপাতালে তার মৃত্যু হয়। মোটরবাইকসহ ওই ছিনতাইকারীকে গ্রেফতার করে পুলিশ। নগরীর কদমতলী ফ্লাইওভারেও এক যুবককে ছুরিকাঘাতে হত্যা করে মোবাইল ছিনতাই করে মোটর সাইকেল আরোহী সন্ত্রাসীরা। পুলিশের হাতে ধরা পড়ার পর অপরাধীরা স্বীকার করে খুন, ছিনতাইসহ কোন অপরাধ করে দ্রæত পালিয়ে যাওয়ার বাহন হিসাবে মোটরবাইকের কোন বিকল্প নেই।
একসময় সড়কে যানজট কম হতো-তখন অটোরিকশা নিয়েও পালানো যেত। এখন রাস্তায় যানজট বেশি, তাছাড়া মোটরবাইক নিয়ে সড়কের উল্টো পথ, ফুটপাত এমনকি অলিগলি দিয়েও পালানো যায়। রেজিস্ট্রেশন না থাকায় এসব মোটরবাইক ধরা পড়ারও আশঙ্কা থাকে না। চট্টগ্রামে বহুল আলোচিত পুলিশ সুপার বাবুল আক্তারের স্ত্রী মাহমুদা খানম মিতু হত্যার ঘটনায়ও ব্যবহার হয় একাধিক রেজিস্ট্রেশন বিহীন মোটর সাইকেল। তাদের একটি পুলিশ আটকও করে। নগরীর রেয়াজুদ্দিন বাজারের একটি রেস্টুরেন্টে দুপুরে খাবার গ্রহণকালে কুপিয়ে হত্যা করা হয় নগর ছাত্রলীগ নেতা ইয়াছিন আরাফাতকে। মামলা তদন্তে পুলিশ জানতে পারে খুনের নেপথ্যে ছিল ভারত থেকে চোরাইপথে আসা আড়াই লাখ টাকার একটি মোটরবাইক নিয়ে বিরোধ।
গণহারে মোটরবাইক চুরির ঘটনাও ঘটছে মহানগর ও জেলায়। চোরাই মোটর সাইকেল দিয়ে মহানগরী ও জেলায় বেশ কয়েকটি শো-রুম চালু হয়েছে। এমন কয়েকটি শো-রুম থেকে অসংখ্য চোরাই মোটরবাইক উদ্ধার করে পুলিশ। স¤প্রতি অনলাইনে চোরাই বাইকের ব্যবসায় জড়িত একটি চক্রের কয়েকজনকে আটক করে পুলিশ। তারা স্বীকার করে মোটর সাইকেল চুরির পর তার ছবি ফেসবুকে দিয়ে বিক্রির অফার দেওয়া হয়। বিকাশে টাকা পরিশোধের পর ক্রেতার ঠিকানায় পৌঁছে দেওয়া হয় মোটরবাইক। মোটরবাইক চুরি ও চোরাই বাইকের ব্যবসা জমজমাট হওয়ায় কলেজ বিশ্ববিদ্যালয়ের অনেক শিক্ষার্থীকেও এ পেশায় জড়িয়ে পড়তে দেখা যায়। চোরচক্রের সদস্য হিসাবে তাদের অনেকে ধরা পড়েও পুলিশের হাতে।
এদিকে অবৈধ মোটর সাইকেলের বিরুদ্ধে অভিযান শুরু করেছে জেলা পুলিশ। গতকাল বিকেলেও জেলার বিভিন্ন এলাকায় আকস্মিক অভিযান চালিয়ে মোটর সাইকেল আটক করা হয়। মঙ্গলবার প্রথম দিনের অভিযানে ২৯৩টি রেজিস্ট্রেশন বিহীন মোটর সাইকেল আটক করেছে পুলিশ। মোট ৫৪টি চেকপোস্ট বসিয়ে এসব মোটর সাইকেল আটক করা হয়। এসব ঘটনায় ২১৪টি মামলা হয়েছে। অতিরিক্ত পুলিশ সুপার রেজাউল মাসুদ জানান অভিযান অব্যাহত থাকবে।



 

Show all comments
  • মাসুদ ২৮ সেপ্টেম্বর, ২০১৭, ১২:৫০ পিএম says : 0
    পুলিশ কঠোর হলে দুর্ঘটনা অনেক কমে আসবে।
    Total Reply(0) Reply
  • শাহে আলম ২৮ সেপ্টেম্বর, ২০১৭, ২:২১ পিএম says : 0
    প্রতিদিনই এই অভিযান পরিচালনা করা উচিত
    Total Reply(0) Reply

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

ঘটনাপ্রবাহ: চট্টগ্রাম

৩০ জানুয়ারি, ২০২৩

আরও
আরও পড়ুন
এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ
গত​ ৭ দিনের সর্বাধিক পঠিত সংবাদ