Inqilab Logo

বৃহস্পতিবার, ১৮ এপ্রিল ২০২৪, ০৫ বৈশাখ ১৪৩১, ০৮ শাওয়াল ১৪৪৫ হিজরী

মিয়ানমারের নির্যাতিত রোহিঙ্গাদের অপরাধটা কোথায়?

মোহাম্মদ আবদুল গফুর | প্রকাশের সময় : ৫ অক্টোবর, ২০১৭, ১২:০০ এএম

বেশ বিলম্বে হলেও মিয়ানমার বাংলাদেশে আশ্রয় নেয়া রোহিঙ্গাদের স্বদেশে ফিরিয়ে নিতে রাজী হয়েছে। বাংলাদেশ সফররত মিয়ানমারের মন্ত্রী খিউ টেস্ট সোয়ে বলেছেন, ৫ লাখ রোহিঙ্গা ফেরৎ যাবে মিয়ানমারে। কী ভাবে কখন তাদের ফেরৎ নেয়া হবে সে বিষয়ে প্রয়োজনীয় কর্মপন্থা স্থির করতে মিয়ানমার বাংলাদেশের সঙ্গে যৌথ ওয়ার্কিং গ্রæপ গঠন করবে। মিয়ানমারের এ সিদ্ধান্তের ফলে গত ২৫ আগস্ট থেকে নতুন করে শুরু হওয়া রোহিঙ্গা সমস্যা একটা সুরাহার ব্যবস্থা হতে চলেছে বলে পর্যবেক্ষক মহলের অনেকের ধারণা।
মিয়ানমার কর্তৃপক্ষের এ সিদ্ধান্ত কোন আকষ্মিক ঘটনা ছিল না। দীর্ঘ দিন ধরে মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যে বসবাসরত রোহিঙ্গা মুসলমানদের উপর মিয়ানমারের সেনাবাহিনী, উগ্র মগ ও মুসলমান বিদ্বেষী বৌদ্ধ ধর্মনেতাদের বর্বর নির্যাতনের বিরুদ্ধে বিশ্বব্যাপী যে ক্ষোভ ও নিন্দার ঝড় ওঠে, তার প্রেক্ষিতেই মিয়ানমার কর্তৃপক্ষ এ বিলম্বিত সিদ্ধান্ত গ্রহণ করতে বাধ্য হয়। বলা চলে রোহিঙ্গাদের বিরুদ্ধে গত ২৫ আগস্ট থেকে নতুন ভাবে শুরু করা মিয়ানমার সেনাবাহিনী ও অন্যদের বর্বর নির্যাতনের ফলে প্রতিবেশী রাষ্ট্র বাংলাদেশের জন্য যে শরণার্থী সমস্যা সৃষ্টি হয় তার ফলে বাংলাদেশে এ ব্যাপারে বিশ্বের সকল দেশের দৃষ্টি আকর্ষণ করে এ ব্যাপারে মানবিক কারণে তাদের সমস্যা নিরসনে সক্রিয় ভূমিকা পালনে এগিয়ে আসতে আহŸান জানায়। তার ফলে জাতিসংঘের কফি আনান কমিশন মিয়ানমারের উপদ্রæত এলাকায় গিয়ে সরেজমিনে যে করুণ অভিজ্ঞতা অর্জন করে তার ভিত্তিতে এ সমস্যা নিরসনে কিছু সুপারিশমালা প্রকাশ করে। এর ফলে রোহিঙ্গা সমাধানে কফি আনান কমিশনের সুপারিশমালা বাস্তবায়নে বিশ্ব জনমত দ্রæত গড়ে উঠতে থাকে।
এতে মিয়ানমার কর্র্তৃপক্ষ তাদের রোহিঙ্গা নির্যাতনের তথ্যাদি বিশ্ববাসীর কাছে ফাঁস হয়ে যাবার ভয়ে অত:পর ঐ এলাকায় বহিরাগতদের প্রবেশাধিকারে নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে। ফলে মিয়ানমার সেনাবাহিনী ও রোহিঙ্গা বিরোধী মগ ও উগ্র বৌদ্ধনেতারা রোহিঙ্গা অধ্যুষিত গ্রামের পর গ্রাম আগুন দিয়ে তাদের চোখের সামনে তাদের ঘর বাড়ি পুড়িয়ে দেয়া, এবং যুবক রোহিঙ্গাদের গণহত্যা, নারীদের গণধর্ষণ ও রোহিঙ্গা নারী পুরুষ শিশুদের উপর বর্বর নির্যাতনের যে অমানুষিক অভিযান শুরু করে, তা থেকে প্রাণে বাঁচতে রোহিঙ্গারা যে যেদিকে পারে পালিয়ে যেতে শুরু করে।
এভাবে প্রাণ নিয়ে পালিয়ে আসা রোহিঙ্গারা নিকটতম রাষ্ট্র বাংলাদেশের টেকনাফ, কক্সবাজার প্রভৃতি এলাকায় আশ্রয় নেয়া শুরু করে। এর ফলে বাংলাদেশে এক অভাবনীয় শরণার্থী সমস্যা সৃষ্টি হয়। সকলেই জানেন, বাংলাদেশ অমনিতেই সারা বিশ্বের মধ্যে একটি জনবহুল দেশ। তার পক্ষে এই বাড়তি রোহিঙ্গা শরণার্থী জনসংখ্যার চাপ সামাল দেয়া একেভারেই অসম্ভব। তবু শুধু মাত্র মানবিকতা বিবেচনায় বাংলাদেশ এদের আশ্রয় দেয় এবং রোহিঙ্গাদের বাংলাদেশে নিরাপদে আশ্রয় দানের লক্ষ্যে শরণার্থী ক্যাম্প খোলার ব্যবস্থা করা হয়।
এদিকে রোহিঙ্গাদের নিজ জন্মভূমি মিয়ানমারের রাখাইন থেকে বিতাড়নের এ বর্বর অভিযানের কথা বিশ্বে জানাজানি হয়ে যাবার ফলে সমগ্র বিশ্বে মিয়ানমারের বিরুদ্ধে দ্রæত জনমত গড়ে উঠতে থাকার সময়েই নিউইয়র্কে জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদের অধিবেশন শুরু হয়। স্বাভাবিক পরিস্থিতিতে সে অধিবেশনে মিয়ানমারের স্টেট কাউসিলর (এককালের গণতন্ত্রী নেত্রী) অং সান সুচির যোগদানের কথা। কিন্তুু মিয়ানমারের সেনাবাহিনীর নতুন করে ২৫ আগস্ট শুরু করা রোহিঙ্গা নিধন সম্পর্কে বিশ্বনেতাদের প্রশ্নের কোন সদুত্তর দিতে না পারার ভয়ে সুচি জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদের সে অধিবেশনে যোগদান থেকে বিরত থাকেন।
জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদের অধিবেশনে যোগদান থেকে বিরত থাকলেও মিয়ানমারের চলতি পরিস্থিতি সম্পর্কে মিয়ানমারের রাষ্ট্রীয় প্রচার মাধ্যমে অং সান সুচি যে ভাষণ দেন তাতে প্রমাণিত হয়, অতীতে মিয়ানমারে সেনা শাসনের বিরুদ্ধে বলিষ্ঠ ভূমিকা পালন করেন যে অং সান সুচি, সে অং সান সুচির রাজনৈতিক মৃত্যু ঘটেছে। কারণ অং সান সুচির ভাষণে দেখা গেল মিয়ানমারে সেনাবাহিনীর বর্বর অভিযানের প্রতি সমর্থন জানালেন তিনি। এককালের গণতন্ত্রের প্রশ্নে লড়াকু ভূমিকার জন্য নোবেল পুরস্কার বিজয়ী অং সান সুচির এ ভাষণের প্রতিক্রিয়াও হয়েছে তাৎক্ষণিক। তাঁর ছবি অপসারিত হয়েছে অক্সফোর্ড থেকে। এছাড়া বিশ্বের বিভিন্ন দেশ থেকে রোহিঙ্গাদের উপর বর্বর নির্যাতনের বিরুদ্ধে মিয়ানমারের সেনাবাহিনীর দায়ী জেনারেলদের বিচার ও শাস্তির দাবী উঠেছে।
এখন মনে হচ্ছে, মিয়ানমারের কর্র্তৃপক্ষ যে অবশেষে বিতাড়িত রোহিঙ্গাদের ফেরৎ নিতে আগ্রহ প্রকাশ করেছে এবং সে জন্য রোহিঙ্গা শরণার্থীদের ফিরিয়ে নেয়ার লক্ষ্যে বাংলাদেশের সঙ্গে জয়েন্ট ওয়ার্কিং গ্রæপ গঠনেও রাজী হয়েছে, সে সবের মূলে রয়েছে রোহিঙ্গা নির্যাতন প্রশ্নে গড়ে ওঠা বিক্ষুদ্ধ বিশ্বজনমত। রোহিঙ্গা নির্যাতন প্রশ্নে মিয়ানমারের সেনাবাহিনী ও অন্যান্য উগ্র বৌদ্ধদের বিরুদ্ধে বিশ্বজনমত গড়ে উঠতে এত দিন যে বিলম্ব হয়েছে, তার মূলে ছিল কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ রাষ্ট্রের মিয়ানমারের অবস্থানের প্রতি সমর্থন। এসব রাষ্ট্রের মধ্যে ভারত, চীন ও রাশিয়ার ভূমিকা ছিল চোখে পড়ার মত। ২৫ আগস্ট মিয়ানমারে নতুন করে রোহিঙ্গা নিধন অভিযান শুরু হবার পর পর ভারতের প্রধান মন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী রহস্যজনকভাবে মিয়ানমারে তিনদিন ব্যাপী শুভেচ্ছা সফরে গিয়ে মিয়ানমারের রোহিঙ্গা বিরোধী অভিযানের প্রতি ভারতের সমর্থন জ্ঞাপন করেন। শুধু তাই নয়, যেসব রোহিঙ্গা প্রাণ বাঁচাতে মিয়ানমারের অন্যতম প্রতিবেশী রাষ্ট্র ভারতে আশ্রয় নিয়েছিল তাদের ভারত থেকে বিতাড়িত করা হবে বলেও ঘোষণা দিয়েছিলেন। অবশ্য নরেন্দ্র মোদীর সে ঘোষণার প্রকাশ্যে বিরোধিতা করেন ভারতের অনেক নেতাও। তাদের অন্যতম ছিলেন ভারতের পশ্চিম বঙ্গ রাজ্যের মুখ্য মন্ত্রী মমতা ব্যানার্জী।
মিয়ানমারের এ রোহিঙ্গা বিতাড়ন অভিযানের প্রতি সমর্থন জ্ঞাপন করেছিল চীনও রাশিয়াও। চীন পরবর্তীকালে তার এ সিদ্ধান্ত পুনর্বিবেচনার আশ্বাস দেয় ইতোমধ্যে বাংলাদেশের একটি প্রতিনিধি’দলের চীন সফরের পর। ভারত অবশ্য পরবর্তীকালে মিয়ানমারের শরণার্থীদের জন্য ত্রাণ পাঠিয়ে ঘোষণা দেয় যে, মানবিকতা বিবেচনায় তাদের এ পদক্ষেপ। এভাবেই একই সাথে দুই নৌকায় পা দিয়ে তার রোহিঙ্গা নীতিতে দোদুল্যমানতার পরিচয় দেয় ভারত। অন্যদিকে ইউরোপীয় ইউনিয়ন রোহিঙ্গাদের প্রতি সহানুভূতি প্রকাশ করায় এবং নির্যাতিত রোহিঙ্গাদের প্রতি বিশ্বজনমত প্রবল হয়ে উঠায় রাশিয়ার মিয়ানমার-সমর্থনেও ভাটার টান শুরু হয়েছে।
এরই মধ্যে খোদ মিয়ানমার কর্তৃপক্ষের বিলম্বিত বোধোদয় শুরু হয়েছে বাংলাদেশে প্রাণ নিয়ে পালিয়ে আসা রোহিঙ্গাদের ফিরিয়ে নিতে তাদের আগ্রহ প্রকাশের মাধ্যমে। রোহিঙ্গা সমস্যার জন্য যারা এতদিন গভীর উদ্বেগে ছিলেন, তারা নিশ্চয়ই এতে কিছুটা হলেও স্বস্তি বোধ করছেন এ লক্ষ্যে মিয়ানমার প্রতিনিধিদের বাংলাদেশে আগমনের ঘটনায়। বাংলাদেশের মত জনবহুল রাষ্ট্রের ঘাড় থেকে রোহিঙ্গা শরণার্থীদের বাড়তি বোঝা অচিরেই সরে যাচ্ছে মনে করে বাংলাদেশের অনেকেই গভীর স্বস্তির নি:শ্বাস ফেলছেন এই ভেবে যে, রোহিঙ্গা সমস্যার শেষ পর্যন্ত একটা সুরাহা হচ্ছে।
আমরা কিন্তু আমাদের জনগণের এ আশাবাদী অংশের সঙ্গে একমত হতে পারছি না বলে দু:খিত। রোহিঙ্গা সমস্যা হঠাৎ করে গত ২৫ আগস্ট শুরু হয়নি। রোহিঙ্গা সমস্যা বাংলাদেশে আগেও ছিল। এমন কি পাকিস্তান আমলেও ছিল। পাকিস্তান আমলেও তদানীন্তন বার্মা থেকে রোহিঙ্গাদের উপর নির্যাতনের স্টীম রোলার নেমে আসায় তারা তদানীন্তন পূর্ব পাকিস্তান এসে আশ্রয় গ্রহণ করে। দুই দেশের প্রতিনিধিদলের মধ্যে সফল আলোচনার পর বার্মা সরকার রোহিঙ্গা শরণার্থীদের ফিরিয়ে নিতে রাজী হয়। ফলে তখনকার মত রোহিঙ্গা সমস্যার একটা সুরাহা হয়। কিন্তু রোহিঙ্গা সমস্যার স্থায়ী সমাধান যে তখন হয়নি, তার বহু দৃষ্টান্ত পরবর্তীকালে দেখা গেছে। সর্বশেষ দৃষ্টান্ত দেখার সৌভাগ্য (অথবা দুর্ভাগ্য) আমাদের হয়েছে গত ২৫ আগস্ট।
রোহিঙ্গা সমস্যার ইতিহাস খুঁজতে গেলে আমাদের যেতে হবে রাজনৈতিক অতীতে যখন আজকের পাকিস্তান, ভারত, বাংলাদেশ, মিয়ানমার সবগুলি দেশই ছিল সা¤্রাজ্যবাদী বৃটেনের শাসনাধীনে। এসব দেশে তখন চলছিল স্বাধীনতা সংগ্রাম। সা¤্রাজ্যবাদী বৃটেনের বিরুদ্ধে চলছিল সে সা¤্রাজ্যবাদ বিরোধী স্বাধীনতা সংগ্রাম। আজকের মিয়ানমার সেদিনের বার্মার স্বাধীনতা সংগ্রামের নেতৃত্বে যেমন ছিল বার্মার বৌদ্ধরা, তেমনি ছিল বার্মার মুসলমানরা। তাদের সেদিনের শ্লোগান ছিল বার্মা ফর বার্মিজ। অর্থাৎ বার্মা বার্মাবাসীদের জন্য। বৃটিশ সা¤্রাজ্যবাদী শাসকরা দুই সম্প্রদায়ের মধ্যে বিভেদ সৃষ্টির লক্ষ্যে তাদের মধ্যে যে শ্লোগান চালুর অপচেষ্টা চালায় তা ছিল: বার্মা ফর বার্মিজ বুদ্ধিষ্টস। অর্থাৎ বার্মা হবে শুধু বার্মার বৌদ্ধ ধর্মঅবলম্বীদের জন্য। সেই যে সা¤্রাজ্যবাদের শেখানো শ্লোগান তার ধারাবাহিকতায়ই আজ চলছে সেদিনের বার্মা তথা আজকের মিয়ানমার থেকে রোহিঙ্গা বিতাড়ন অভিযান। রোহিঙ্গাদের অপরাধ তারা ধর্মবিশ্বাসে মুসলমান। আর বার্মার অধিকাংশ মানুষ বৌদ্ধ ধর্মে বিশ্বাসী। অথচ ইতিহাস সাক্ষ্য দেয় বার্মার আরাকান (রাখাইন) এলাকায় আরব বনিকদের মাধ্যমে মুসলমানদের বসতি স্থাপন শুরু হয় বার্মার বর্মীদের আগমনের শত শত বছর আগে থেকে। বাংলাদেশের সমুদ্র-সন্নিহিত কক্সবাজার, চট্টগ্রাম, নোয়াখালী প্রভৃতি অঞ্চলে আসা আরব বনিকদের বসতি স্থাপনের সময়ে। সুতরাং যে কোন বিচারে রোহিঙ্গারা সেদিনের বার্মা তথা আজকের মিয়ানমারের বৈধ নাগরিক। তাদের জন্মভূমি থেকে তাদের বিতাড়নের যে কোন অপচেষ্টা মানবাধিকারের চরম লংঘন হিসাবে বিবেচিত হতে বাধ্য।
ক্রমবর্ধমান বিশ্বজনমতের চাপে রোহিঙ্গাদের ফেরৎ নিতে মিয়ানমার কর্তৃপক্ষ রাজী হয়েছে বলে রোহিঙ্গা সমস্যার সমাধান হয়ে গেছে বলে যারা ভেবে থাকেন তারা ভুল করবেন। মিয়ানমারের নেতৃবৃন্দের মধ্যে দুটি বিষয়ে প্রকৃত ধারণা সৃষ্টি না হওয়া পর্যন্ত এ সমস্যায় স্থায়ী সমাধান হতে পারে না। এর একটি হলো বৌদ্ধ জাতির ইতিহাস, আর একটি বৌদ্ধ ধর্মের আদর্শ। বৌদ্ধ জাতির জন্ম মিয়ানমারে তো নয়ই, আজকের বিশ্বের কোন বৌদ্ধ প্রধান দেশেও হয়নি। বৌদ্ধ ধর্মের প্রবর্তক মহামতি গৌতম বুদ্ধ জন্মেছিলেন ভারতে এবং ভারতেই তিনি বৌদ্ধ ধর্মের প্রচার শুরু করেন। বিখ্যাত বৌদ্ধ গবেষক বিশ্বেশ্বর চৌধুরী তাঁর ‘টেকনাফ থেকে খাইবার’ গ্রন্থে বলেছেন, ভারতীয় উপমহাদেশে প্রতœতাত্তি¡ক খননকার্য চালাতে গেলে মাটি খুঁড়লেই যে যত্রতত্র বুদ্ধমূর্তি পাওয়া যায়, তাতে প্রমাণিত হয় একদা এই উপমহাদেশের অধিকাংশ জনগণ বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বী ছিলেন। পরবর্তীকালে এক কট্টর বৌদ্ধ-বিদ্বেষী হিন্দু শাসকের আমলে ভারতবর্ষে বৌদ্ধ গণহত্যা অভিযান শুরু হয়। ঐ অভিযানকে সফল করার লক্ষ্যে ধর্মীয় নেতাদের নামে ঘোষণা দেয়া হয়, যে ব্যক্তি কোন বৌদ্ধকে দেখা মাত্র তাকে হত্যা করবে, সে অনন্তকাল স্বর্গ সুখ লাভে ধন্য হবে। আর যে ব্যক্তি কোন বৌদ্ধকে দেখা সত্তে¡ও তাকে হত্যা করবেনা, সে অনন্তকাল নরক শাস্তি ভোগ করবে। এই ঘোষণার ফলে অসংখ্য বৌদ্ধকে হত্যা করা হয়। বাকীরা প্রাণ নিয়ে উত্তরে চীন, তিব্বত, পূর্বে মিয়ানমার, থাইল্যান্ড, জাপান, দক্ষিণে শ্রীলঙ্কা প্রভৃতি অঞ্চলে পালিয়ে রক্ষা পান। ফলে ঐসব অঞ্চল বৌদ্ধ প্রধান হয়ে উঠলেও বৌদ্ধধর্মের নিজ জন্মভূমি ভারতে বৌদ্ধ খুঁজে পাওয়া যায়না। বৌদ্ধদের এ ইতিহাস জানলে মিয়ানমারের বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বী সেনা ও বৌদ্ধ ধর্মনেতারা উদোর পিন্ডি বুধোর ঘাড়ে চাপিয়ে রোহিঙ্গা নিধনে উন্মক্ত হয়ে উঠতেন না।
আরেকটি কারণেও বৌদ্ধরা নীতিগতভাবে ইসলাম তথা মুসলিম বিরোধী হতে পারেন না। উভয় ধর্মই জাতিভেদ বিরোধী এবং মানুষে মানুষে শান্তি ও সাম্যের নীতিতে বিশ্বাসী। এ কারণে অতীতে উপরে উল্লেখিত কট্টর হিন্দু শাসনামলে যে বৌদ্ধ নিধন শুরু হয়, তাতে যেসব নিপীড়িত বৌদ্ধ কোনভাবে প্রাণে বেঁচে যান, তারা পরবর্তীকালে এদেশের সঙ্গে সাম্য-ভ্রাতৃত্বের ধর্ম ইসলামের পরিচয় ঘটলে তাদের অনেকেই ইসলাম গ্রহণ করেন। আজ এদেশে আমরা যারা মুসলমান আছি। তাদের অনেকেরই পূর্বপুরুষ বৌদ্ধ ছিলেন।
আমাদের আজকের এ আলোচনার ইতি টানার আগে আরেকটি বিষয়ে সংক্ষেপে উল্লেখ করতে চাই। আমাদের দেশে এক ধরনের প্রগতিশীল বুদ্ধিজীবি আছেন, যাদের নির্যাতিত মানবতার মুক্তির দাবীতে সব সময় উচ্চকণ্ঠ হতে দেখা যায়। এই যে মিয়ানমার হতে লক্ষ লক্ষ বিতাড়িত রোহিঙ্গা বাংলাদেশে খাদ্য, বাসস্থান, চিকিৎসার অভাবে অসহায় মানবেতর জীবন যাপন করতে বাধ্য হচ্ছেন, তারা কি এই সব প্রগতিশীল বুদ্ধিজীবিদের সামান্যতম সহানুভূতি লাভের যোগ্য নয়? এদের কি বড় অপরাধ এই যে এরা নির্যাতিত হলেও মুসলমান?



 

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

ঘটনাপ্রবাহ: মিয়ানমার


আরও
আরও পড়ুন
গত​ ৭ দিনের সর্বাধিক পঠিত সংবাদ